Monday, November 17, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    নিজেকে বাদ দিয়ে অন্য কেউ হয়ে ওঠার সুযোগ খুব বেশি পাওয়া যায় না: হারুকি মুরাকামি

    তখনো শহরের ষড়যন্ত্রে পা দেয়নি গ্রাম, মানুষের মনের দখল মানবতার কাছেই ছিল। সেই বিংশ শতাব্দীর প্রতিনিধি হারুকি মুরাকামি আধুনিক জাপানি সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় লেখক। তার রচনাগুলো শুধু জাপান নয়, বরং সারা বিশ্বের পাঠকদের মন জয় করেছে। তার লেখার অনন্য শৈলী, গভীর চরিত্র বিশ্লেষণ এবং বাস্তবতার সঙ্গে অলৌকিকতার মিশ্রণে গড়ে ওঠা গল্পগুলো তাকে বিশ্ব সাহিত্যে এক বিশেষ স্থান করে দিয়েছে। মুরাকামি ১৯৪৯ সালের ১২ জানুয়ারি জাপানের কিয়োটো শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং কোবে শহরে তার শৈশব কাটান।

    তার বাবা-মা উভয়েই জাপানি সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন, যা মুরাকামির সাহিত্য জীবনে প্রভাব ফেলেছে। তবে তিনি প্রথাগত জাপানি সাহিত্যের বদলে পাশ্চাত্য সাহিত্য, বিশেষ করে ফ্রাঞ্জ কাফকা, ফ্রেডেরিক ডাস্টয়েভস্কি এবং রেমন্ড কার্ভারের লেখায় বেশি আকৃষ্ট হন। তার প্রায় সব বই দীর্ঘকাল যাবৎ আন্তর্জাতিকভাবে বেস্টসেলার হয়ে আসছে। তার অনেক বই বাংলাসহ সারা বিশ্বে মোট ৫০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সাহিত্যে অবদানের জন্য বিভিন্ন সময় মুরাকামি বিভিন্ন পুরস্কার অর্জন করেছেন, যার মধ্যে বিশ্ব ফ্যান্টাসি পুরস্কার, ফ্র্যাঙ্ক ও’কনর আন্তর্জাতিক ছোট গল্প পুরস্কার, ফ্রাঞ্জ কাফকা প্রাইজ উল্লেখযোগ্য। মুরাকামি নোবেল পুরস্কার না পেলেও তার নাম নোবেল পুরস্কারের সম্ভাব্য প্রাপক হিসাবে প্রায়ই আলোচিত হয়। মুরাকামি শুধু একজন লেখক নন; তিনি একটি সাংস্কৃতিক প্রতীক। বিশ্বজুড়ে পাঠকদের অনুপ্রাণিত করে চলা মুরাকামি তার নতুন বই ‘দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসার্টেন ওয়ালস’ নিয়ে সম্প্রতি গার্ডিয়ানের সঙ্গে কথা বলেছেন; তার অংশবিশেষ অনুবাদ করেছেন মেজবাহ উদ্দিন


    দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসার্টেন ওয়ালস১৯৮০ সালে লেখা একটি উপন্যাসের ভিত্তিতে তৈরি। এখন এটিকে নতুন পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়াটা কেন জরুরি মনে হলো?

    : এটি এমন একটি কাজ যা আমি কখনোই বই আকারে পুনর্মুদ্রণ করতে দিইনি। সহজভাবে বললে, আমি গল্পটি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলাম না। আমি মনে করতাম যে, এ গল্পের থিমটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত, তখন আমার লেখার দক্ষতা যথেষ্ট ছিল না, যা আমি চেয়েছিলাম তা যথাযথভাবে প্রকাশ করার জন্য। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, আমি অপেক্ষা করব যতক্ষণ না আমার লেখার দক্ষতা যথেষ্ট উন্নত হয়, তারপর পুরো গল্পটি আবার নতুন করে লিখব।

    এর মধ্যে অনেক কাজ করার ছিল যা নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম এবং তাই এ প্রকল্পটি শুরু করতে পারিনি। এক সময় দেখলাম, ৪০ বছর কেটে গেছে (মনে হলো যেন চোখের পলকেই) এবং আমি সত্তর বছর বয়সে পৌঁছে গেছি। ভাবলাম, যদি সত্যিই এটি করতে চাই, তাহলে আর দেরি করা ঠিক হবে না, কারণ আমার হাতে হয়তো বেশি সময় নেই। একজন ঔপন্যাসিক হিসাবে আমার দায়িত্ব পালন করার জন্যও এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মনে হলো।

    আপনি বইটি লকডাউনের সময় লিখেছেন এবং লেখার সময় খুব কমই বাড়ির বাইরে বের হয়েছেন। পরিস্থিতি কি গল্পের ধরন বা বিষয়বস্তুর ওপর প্রভাব ফেলেছে?

    : অবশ্যই, যখন আমি এ উপন্যাসটি লিখছিলাম তখন আমার নির্দিষ্ট পরিমাণ শান্তি এবং নিরিবিলি পরিবেশ প্রয়োজন ছিল, আর নিজের চিন্তাভাবনার জন্য সময়ও প্রয়োজন ছিল। দেওয়ালঘেরা শহরের পরিস্থিতি বিশ্বব্যাপী লকডাউনের এক রূপক। কীভাবে চরম বিচ্ছিন্নতা এবং গভীর সহানুভূতির উষ্ণ অনুভূতি একসঙ্গে বিদ্যমান থাকতে পারে? এটি ছিল এ উপন্যাসের একটি প্রধান থিম। এদিক দিয়ে এটি মূল উপন্যাসের তুলনায় একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি।

    আমি মনে করি, একটি অসাধারণ উপন্যাস সব সময় কিছু আকর্ষণীয় প্রশ্ন উত্থাপন করবে-কিন্তু একটি সুনির্দিষ্ট ও সরল সমাধান দেবে না। আমি চাই, আমার বই শেষ করার পর পাঠকরা এমন কিছু নিয়ে ভাবুক। যেমন, এখানে কী কী সম্ভাব্য সমাপ্তি হতে পারত?

    কিছু জাপানি পাঠক বইটি নিয়ে বিভ্রান্ত হয়েছেন। অনেকে মনে করেন, আপনার উপন্যাসের অদ্ভুত অতিপ্রাকৃত উপাদানগুলোই সেরা আনন্দ দেয়। আপনি কি পাঠকদের কাছে কিছু প্রশ্নের উত্তর অমীমাংসিত রাখতে পছন্দ করেন?

    : আমি মনে করি, একটি অসাধারণ উপন্যাস সব সময় কিছু আকর্ষণীয় প্রশ্ন উত্থাপন করবে-কিন্তু একটি সুনির্দিষ্ট ও সরল সমাধান দেবে না। আমি চাই, আমার বই শেষ করার পর পাঠকরা এমন কিছু নিয়ে ভাবুক। যেমন, এখানে কী কী সম্ভাব্য সমাপ্তি হতে পারত? আমি প্রতিটি গল্পে কিছু সূত্র রেখে যাই যাতে পাঠকরা তা খুঁজে নিয়ে তাদের নিজস্ব, ভিন্ন ভিন্ন সমাপ্তিতে পৌঁছাতে পারেন। অনেক পাঠক আমাকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন: ‘আমি আপনার একই বই এতবার পড়েছি এবং প্রতিবারই উপভোগ করেছি।’ একজন লেখক হিসাবে এর থেকে আনন্দের কিছু হতে পারে না।

    দ্য সিটি অ্যান্ড ইটস আনসার্টেন ওয়ালস’-এর কথক, বা আপনার অন্য বইদ্য উইন্ডআপ বার্ড ক্রনিকল’-এর তোড়ু, বাকাফকা অন দ্য শোর’-এর কাফকার মতো চরিত্র লেখার সময় আপনি কতটা নিজের কথা লিখছেন?

    : আমার উপন্যাসে উত্তম পুরুষের চরিত্রগুলো বর্তমানের আমি নই, বরং এমন এক ‘আমি’ যেমনটা আমি হতে পারতাম। এ সম্ভাবনাগুলো অনুসরণ করা সত্যিই আকর্ষণীয়, কারণ নিজেকে বাদ দিয়ে অন্য কেউ হয়ে ওঠার সুযোগ খুব বেশি পাওয়া যায় না।

    আপনি অনেক ইংরেজি বই জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছেনযেমন স্যালিঞ্জার, ফিটজেরাল্ড, চ্যান্ডলার, কারভার এবং ক্যাপোট, এদের মধ্যে কোনো লেখক আপনাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছেন?

    : আমি প্রত্যেক লেখকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি। ফিটজেরাল্ড এবং ক্যাপোটের উজ্জ্বল ও দীপ্তিময় লেখার ধরন আমাকে খুব আকর্ষণ করে, যদিও এটি আমার নিজের ধারা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ব্যক্তিগতভাবে, আমি চ্যান্ডলারের শৈলীর প্রতি বেশ আগ্রহী।

    আপনি ৪০ বছরেরও বেশি সময় ধরে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছেন। সময় জাপানি সাহিত্যিক চিত্রে কী পরিবর্তন ঘটেছে এবং আপনি নিজেকে চিত্রের অংশ মনে করেন, নাকি এর বাইরে?

    : আমি মনে করি, এখনকার তরুণ লেখকরা ‘এটাই সাহিত্য’ এমন কৃত্রিম ধারণা থেকে নিজেদের মুক্ত করে ফেলেছে এবং অনেক বেশি স্বাধীন ও নমনীয় পদ্ধতিতে গল্প লিখছে। আমি সত্যিই এটার প্রশংসা করি। তবে আমার ক্ষেত্রে, আমি কেবল আমার নিজের পথে কাজ চালিয়ে যাই এবং বলতে পারি না এ পরিবর্তনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঠিক কেমন।

    আমি মনে করি, এখনকার তরুণ লেখকরা ‘এটাই সাহিত্য’ এমন কৃত্রিম ধারণা থেকে নিজেদের মুক্ত করে ফেলেছে এবং অনেক বেশি স্বাধীন ও নমনীয় পদ্ধতিতে গল্প লিখছে

    আপনার জাপানি এবং আন্তর্জাতিক পাঠকদের মধ্যে কী ধরনের পরিবর্তন দেখেছেন, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লেখালেখি করা সহজ হচ্ছে, না কঠিন?

    : মনে হয় জাপানে এবং বিদেশে আমার পাঠকের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে, যা আমাকে প্রায়ই বিস্মিত করে। লাওসে একজন থাই পাঠক আমাকে থামিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, ড্রেসডেনে একজন আলবেনিয়ান পাঠক এবং টোকিওতে একজন ইন্দোনেশীয় পাঠক। আমি প্রায়ই অনুভব করি যেন, আমি আর আসল আমি নই, বরং কোনো কাল্পনিক ব্যক্তি হয়ে উঠেছি…..

    তবে এসবের কিছুই উপন্যাস লেখা সহজ বা কঠিন করেনি। আমি কেবল কৃতজ্ঞ যে এত লোক আমার বই পড়েন, যা আমি কখনো কল্পনাও করিনি। সবাই আমার মতো সৌভাগ্যবান নয়।

    জাপানি সাহিত্য এখন ব্রিটেনে বিক্রি হওয়া অনুবাদ সাহিত্যের একচতুর্থাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। এটি কেন এত বিস্তৃত আবেদন তৈরি করেছে বলে আপনার মনে হয়?

    : আমি জানতাম না যে, জাপানি উপন্যাস ব্রিটেনে এত জনপ্রিয়। এর কারণ কী? আমার কোনো ধারণা নেই। হয়তো আপনি বলতে পারেন-আমি জানতে চাই। জাপানের অর্থনীতি এ মুহূর্তে খুব ভালো নয়, এবং আমি মনে করি সংস্কৃতির রপ্তানি কোনো না কোনোভাবে অবদান রাখতে পারে, যদিও সাহিত্যিক রপ্তানির অবদান তেমন বড় কিছু নয়, তাই না?

    ২০১৭ সালে আপনার বইয়ের নারীদের বিষয়ে মিয়েকো কাওয়াকামির সমালোচনা কি আপনার নারীবিষয়ক চরিত্র লেখায় কোনো প্রভাব ফেলেছে?

    : আমার বইগুলো এত বেশি সমালোচিত হয়েছে যে, আমি মনে করতে পারি না কোন প্রসঙ্গে সমালোচনা করা হয়েছিল। আর আমি এ নিয়ে তেমন মনোযোগ দেই না। মিয়েকো একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং অত্যন্ত বুদ্ধিমতী নারী, তাই তিনি যা-ই সমালোচনা করে থাকুন, নিঃসন্দেহে তা যথাযথ। তবে সত্যি বলতে, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না তিনি কী সমালোচনা করেছিলেন। তবে নারীদের এবং আমার কাজ নিয়ে বলতে গেলে, ঘটনাক্রমে আমার পাঠকদের মধ্যে পুরুষ ও নারী প্রায় সমানভাবে বিভক্ত, যা আমাকে খুব আনন্দিত করে।

    সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.