
কাজী নজরুল ইসলাম লেখালেখিতে আত্মপ্রকাশ করেন ১৯১৯ সালে। তার মানে নজরুলের আগের আধুনিক বাংলাসাহিত্যের বয়স একশ বছরের কিছু বেশি। বিশ শতকের আগের আধুনিক বাংলাসাহিত্যকে প্রবণতার দিক এক কথায় যদি ধরতে চাই তাহলে বলতে হবে, এ সাহিত্য প্রধানত ইউরোপীয় চিন্তাচেতনা ও সাহিত্যের প্রেরণাজাত। সমগ্র উনিশ শতক আসলে বাঙালির ‘আধুনিক’ হওয়ার প্রচেষ্টার কাল। ইংরেজের বইপত্র, শিক্ষা ও সঙ্গ-সহবতের ভেতর দিয়ে এ কাজটি ক্রমে হয়েছে। গড়ে উঠেছে একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এ শ্রেণিটি যদিও খুব ছোট ছিল, তবু তারাই তাদের বিচিত্র সৃজনকর্ম ও সামাজিক কাজকর্মের ভেতর দিয়ে পরবর্তী শিক্ষিত বাঙালির চিন্তা ও রুচিকে শাসন করেছে।
এই শ্রেণিটির তৎপরতা ও প্রভাবের পরিধি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিনয় ঘোষ কলকাতার আশপাশের ১৫-২০ বর্গমাইলকে নির্দেশ করেছেন। সুশোভন সরকার, বিনয় ঘোষসহ অনেক ঐতিহাসিক এ নবজাগরণের শ্রেণিচরিত্র শনাক্ত করতে গিয়ে উচ্চবর্ণের হিন্দু আর জমিদার শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কথাও বলেছেন। এটা একটা অভূতপূর্ব ব্যাপার ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু এর আওতাটাও যে ছোট ছিল তাতেও কোনো সন্দেহ নেই।
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণিটি সমগ্র উনিশ শতকব্যাপী তাদের শিল্প-সাহিত্য চর্চার ভেতর দিয়ে বাঙালির জন্য ইউরোপীয় ছাঁচের একটা চলনসই রুচি ও আদর্শ নির্মাণের চেষ্টা করেছে। এ শ্রেণিটি কখনো তার নিজের চারপাশ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেনি। ঔপনিবেশিক বাস্তবতার মধ্যে সেটা সম্ভবও নয়। কারণ, তার আদর্শ তো স্বয়ং ইংরেজ আর তাদের বইপত্রে প্রতিফলিত জীবন ও রুচি। ফলে অন্তত বিশ শতকে প্রবেশের মুখ পর্যন্ত তাদের রচিত বাংলাসাহিত্য প্রবলভাবে আদর্শ-সন্ধানী এবং আরোপণ প্রমুখ। এ সময়ের সাহিত্য পড়লেই তা বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এর বাইরে নন। ইউরোপীয় রুচি-আদর্শের সঙ্গে বৈষ্ণব চৈতন্য ও ভারতীয় সংস্কৃতির পরিমার্জিত মিশেলে যে রবীন্দ্রনাথকে আমরা পাই, তা তুলনারহিত। কিন্তু মনে রাখতে হবে এ রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত পরিচ্ছন্ন আদর্শায়নের এক দুর্লভ সংঘট্ট।
কিন্তু বিশ শতকের শুরু থেকে বাংলার রাজনৈতিক পারিস্থিতি ক্রমে ঘোলাটে হতে থাকে। বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫), বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯১১), মুসলিম লীগ (১৯০৬) গঠন, স্বদেশি আন্দোলন (১৯০৫-১৯১১) প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৯) ইত্যাদির ঢেউ লাগে বাংলায়। বড় পৃথিবী তার উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আর অবক্ষয়সহ কলকাতার কাছাকাছি এসে উত্তপ্ত নিশ্বাস ফেলে। এদিকে আবার ১৯১৯ ও ১৯২০-এ শুরু হয় ইংরেজবিরোধী খেলাফত আন্দোলন (১৯১৯-১৯২৪) ও অসহযোগ আন্দোলন (১৯২০-১৯২২)। রাজনীতির পানি চুইয়ে গড়িয়ে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে গ্রাম-গ্রামান্তরের সাধারণ মানুষের মধ্যেও। রাজনীতির সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততাও আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়ে যায়। ফলে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের তো বটেই, এমনকি সাধারণ মানুষের চিন্তায় ও রুচিতে একটা ব্যাপক রদবদল ঘটে যায়।
চিন্তা আর রুচির এ পরিবর্তনের চিহ্নগুলো সমকালের সাহিত্যকে একটা ভিন্ন মেজাজ দেয়। ফলে, দেখা গেল আগের ভাষায় আর চলছে না। কবিতার ছন্দ থেকে শুরু করে পুরো কৃৎকৌশলের ধারণার মধ্যে নতুনত্ব হানা দিল। নতুন জীবনবোধের জন্য এ যেন এক নতুন নন্দনের আবির্ভাব।
সময়ের এ বদলকে যিনি প্রথম সর্বাত্মকভাবে কবিতায় মূর্ত করতে পেরেছিলেন তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। প্রায় সমকালে ও কিছু পরে এই নতুন রুচির পসরা নিয়ে বাংলাসাহিত্যে পঞ্চপাণ্ডবসহ কালি-কলম ও কল্লোলগোষ্ঠীর আরও অনেকে আবির্ভূত হন। এতে করে ওই বিশের দশকেই নতুন নন্দনের সঙ্গে পুরোনো নন্দনের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এই নতুন প্রজন্মের সাহিত্যিকদের সম্পর্কে বলে উঠলেন, তাদের ‘কলমের আব্রু ঘুচে গেছে’। নতুন প্রজন্মের হতাশা-নৈরাশ্যের কোনো কারণও তিনি খুঁজে পাননি। রবীন্দ্রনাথ এদের কারও কারও কবিতার ভাষাকে বলেছেন ‘জবরদস্তিমূলক’। নজরুল ছিলেন ওই ‘বেআব্রু’ ‘হট্টগোল’ প্রবণ প্রজন্মের প্রথম সাহিত্যিক।
সময়ের এ বদলকে যিনি প্রথম সর্বাত্মকভাবে কবিতায় মূর্ত করতে পেরেছিলেন তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। প্রায় সমকালে ও কিছু পরে এই নতুন রুচির পসরা নিয়ে বাংলাসাহিত্যে পঞ্চপাণ্ডবসহ কালি-কলম ও কল্লোলগোষ্ঠীর আরও অনেকে আবির্ভূত হন। এতে করে ওই বিশের দশকেই নতুন নন্দনের সঙ্গে পুরোনো নন্দনের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে
নজরুল এসেই কবিতায় বিকট আওয়াজ তুললেন। ধ্বংসামি আনলেন। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শরীরের যেখানে-সেখানে কষে মারতে থাকলেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা (১৯২২) এসবেরই একটা কাব্যিক প্রকাশ। আবার নর-নারীর সম্পর্ক ও রোমান্টিক অনুভব অনুভূতি নিয়ে যেসব কবিতা লিখলেন তাও ঠিক আগের সঙ্গে যেন মিলমিশ খেল না। নারীর প্রতি প্রেমাকাঙ্ক্ষা, ব্যাকুলতা, কাতরতা প্রকাশের ব্যাপারেও যেন আগের সেই ‘রাখঢাক’ অনেকটাই থাকল না। নারী তার শরীরসহ সাপিনীর মতো ভারী নিশ্বাস ছাড়তে লাগল কবিতার পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠায়।
নজরুলের লেখাপত্র আগের একশ-সোয়াশ বছর ধরে গড়ে ওঠা আধুনিক কবিতার ধারণার বেশ বাইরে চলে গেল। আসলে নজরুলের কবিতা গেল বলার চেয়ে বলা ভালো-সময়টা বিগত সময়ের ধরনের বাইরে চলে গেল; বদল ঘটল। নজরুল তার কবিতায় সেই বদলের সারসত্যটাকে জুতমতো জমিয়ে তুলতে পারলেন। ফলে পুরোনের সঙ্গে একটা কাব্যতাত্ত্বিক বিরোধ যেন অনিবার্য হয়ে উঠল। এ বিরোধের বিষয়টি বিংশ শতাব্দীর বিশের দশকের প্রায় সব কবি-সাহিত্যিকের আত্মজীবনীমূলক রচনায় পাওয়া যাবে। সজনীকান্ত দাশের আত্মস্মৃতি ও অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের কল্লোলযুগ-এর কথা প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়।
পুরোনো কবিতার রুচির সঙ্গে নতুন কবিতার বিরোধের বিষয়টি বোঝার জন্য একটি ঘটনারও উল্লেখ করা যায়। ঘটনাটি রবীন্দ্রনাথের বসন্ত (১৩২৯) গ্রন্থটি উৎসর্গের সঙ্গে যুক্ত। নজরুলকে বই উৎসর্গের ব্যাপারটা জানাজানি হতেই রবীন্দ্রনাথের চারপাশের কবি-সাহিত্যিক-অনুরাগীদের মধ্যে একটা যেন রিঁ-রিঁ পড়ে গেল। রবীন্দ্রনাথ সেটা জানতে পেরে একদিন সবার উপস্থিতিতে বললেন, “নজরুলকে আমি বসন্ত গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গ পত্রে তাকে ‘কবি’ বলে অভিহিত করেছি। জানি তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এটা অনুমোদন করতে পারনি। আমার বিশ্বাস তোমরা নজরুলের কবিতা না পড়েই এ মনোভাব পোষণ করেছ।” রবীন্দ্রনাথের এ কথা শুনে উপস্থিত একজন সাহিত্যিক- যিনি ওই উনিশ শতকী নন্দনতত্ত্বের ভোক্তা-মন্তব্য করলেন, ‘মার মার কাট কাট ও অসির ঝনঝনার মধ্যে রূপ ও রসের প্রলেপটুকু হারিয়ে গেছে।’ উদ্ধৃতির শেষাংশ লক্ষ করলে দেখা যাচ্ছে, রবীন্দ্রনাথের চার পাশের মানুষেরা আসলে পুরোনো নন্দনের বশবর্তী ও ভোক্তা হওয়ার কারণেই নজরুলকে কবি হিসাবে মানতে পারছেন না। আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে তাকে বই উৎসর্গ করলেন, এটা থেকে ভাবার কোনো কারণ নেই যে, তিনি নজরুলের নন্দনের শর্তহীন অনুমোদন করেছেন। মনে রাখতে হবে, এর সঙ্গে ব্যক্তিগত আবেগ যুক্ত, কাব্যতাত্ত্বিক অবস্থান নয়। উৎসর্গটি ছিল নতুন নন্দনের প্রতিনিধিত্বকারী একজন কারাবন্দি কবির প্রতি আরেকজন মহৎপ্রাণ কবির সহমর্মিতার প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথ খুব ভালো করেই জানতেন যে, তিনি নজরুলের থেকে ভিন্ন নন্দনের মানুষ।
রবীন্দ্রনাথের আশপাশের উনিশ শতকী রুচির কাব্যরসিকরা যে রূপ ও রসের প্রলেপ হারিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছেন তা নজরুলের কাব্য-কবিতা বিষয়ে কোনো নতুন কথা নয়। এ শ্রেণির কবিতা-ভোক্তা ও সাহিত্যিকরা বরাবরই নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ ও সমগোত্রীয় নতুন নন্দনের কবিতার বিরুদ্ধে বলেছেন এবং ক্রমাগত লিখেছেন। কারণ, যা কিছু গণমুখী সাহিত্য তাকেই ‘বাবু কালচারের’ ওইসব লোকেরা অনেক আগেই ইউরোপীয় ‘উন্নত রুচি’, ‘সূক্ষ্ম সৌন্দর্যের’ দোহাই পেড়ে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে দিয়েছেন। ফলে নজরুলের রাজনৈতিকতাস্পৃষ্ট গণমুখী (গণমুখী বলছি এজন্য যে, নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা প্রথম সংস্করণে ছাপা হয়েছিল দুই হাজার কপি। এবং ক্রমাগত প্রতি সংস্করণের দুই হাজার কপি প্রতি এক বছরের মধ্যে নিঃশেষিত হয়েছে। এটি ওই কালে শুধু বিরল নয় অবিশ্বাস্যও ছিল বটে। আর কবিতায় গণ-মানুষের চেতনার প্রতিনিধিত্ব করার ব্যাপারটা তো আছেই।) কবিতা উনিশ শতকী বাবু-নন্দনের কাছে ‘তারস্বর’, ‘অসংবদ্ধ’, ‘এলোমেলো’, ‘অস্থির’, ‘উন্মাদনা’ বলেই সাব্যস্ত হয়েছে। মোহিতলাল মজুমদার ‘সাহিত্যের আদর্শ’ প্রবন্ধে খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, ‘আমাদের দেশে খুব বর্তমানকালে এমন একটি প্রবৃত্তি দেখা দিতেছে, যাহাতে সাহিত্যের এই নীতি বা আদর্শ একেবারে উড়িয়া যাইতেছে; অতিশয় অমেধ্য এবং মানবাত্মার পক্ষে গ্লানিকর এ শ্রেণির ভাব ও ভাবুকতা বিদ্রোহের ‘রক্তনিশান’ উড়াইয়া ভয়ানক আস্ফালন করিতেছে।’ ফলে সজনীকান্ত যখন শনিবারের চিঠিতে নজরুলের কবিতা নিয়ে ব্যাঙ্গের পর ব্যাঙ্গ কবিতা রচনা করতে থাকেন বা রবীন্দ্রনাথ যখন ‘কলমের আব্রু ঘোচা’র কথা বলেন, তখন তা আসলে ব্যক্তিগত কোনো বিষয় থাকে না। এ আসলে নন্দনতাত্ত্বিক ধারণার ফেরা। অন্য কথায় সময়ের ফেরা মাত্র।
কালের পরিবর্তনই আসলে সাহিত্যের নন্দনে কল্লোল তোলে। কালের বড় কবিরা ওই কল্লোলকে অনুবাদ করেন তাদের সাহিত্যে। তাই এ কাজটি করতে পেরেছিলেন। এজন্যই বলি, নজরুল তার কালের নতুন নন্দনের নকিব
নজরুল নতুন নন্দনের নকিব ছিলেন এ কথা আগেই বলেছি। তিনি মূলত রাজনৈতিক কবি। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে নজরুল তার কালের যেসব কবি-সাহিত্যিকের সঙ্গে চলাফেরা করতেন তার প্রায় সবাই ছিলেন অরাজনৈতিক। বিশেষত কল্লোল ও কালি-কলম গোষ্ঠীর লেখকরা অধিকাংশই ছিলেন অরাজনৈতিক। এ বিপরীতের সন্নিবেশ কীভাবে ঘটেছিল তা অনুসন্ধান করা দরকার। এ অনুসন্ধানের মধ্য থেকে বের হয়ে আসতে পারে নতুন নন্দনের ব্যাপারটা।
নজরুল এবং কল্লোল, কালি-কলম ও প্রগতির নন্দন এক ছিল না। কিন্তু নতুন কথা নতুনভাবে বলার দিক থেকে নজরুলের সঙ্গে এসব পত্রিকার ও সমকালের কবি-সাহিত্যিকদের একটা বড় মিল ছিল। এবং তারা নজরুলকে অপ্রথাগতদের শিরোমণি মনে করে যথেষ্ট পাত্তা দিতেন। এ কারণে নজরুল কল্লোল-এর অন্যতম লেখক ছিলেন। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রকাশের পর কল্লোলের লেখকদের দু-একটি মন্তব্য দেখলে বোঝা যেতে পারে তারা কেন নজরুলকে দলে টানতেন। ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি ছাপা হওয়ার পরের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র বলেছেন, ‘সেদিন ঘরে বাইরে, মাঠে-ঘাটে রাজপথে সভায় এ কবিতা নীরবে নয়, উচ্চকণ্ঠে শতশত পাঠক পড়েছে। সে উত্তেজনা দেখে মনে হয়েছে যে, কবিতার জ্বলন্ত দীপ্তি এমন তীব্র যে, ছাপার অক্ষরই যেন কাগজে আগুন ধরিয়ে দেবে। …গাইবার গান নয়, চিৎকার করে পড়বার এমন কবিতা এ দেশের তরুণরা যেন এই প্রথম হাতে পেয়েছিল। তাদের উদ্দাম হৃদয়ের অস্থিরতারই এ যেন আশ্চর্য প্রতিধ্বনি।’ আর অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত বলেছেন, ‘এ কে নতুন কবি? নির্জীব দেশে এ কার বীর্যবাণী? শুধু বাংলাসাহিত্যে নয়, সমগ্র দেশ প্রবল নাড়া খেয়ে জেগে উঠল। এমনটি কোনোদিন শুনিনি, ভাবতেও পারিনি। যেন সমস্ত অনুপাতের বাইরে, যেন সমস্ত অঙ্কপাতেরও অতিরিক্ত …গদগদ বিহ্বলের দেশে এ কে এল উচ্চণ্ড বজ নাদ হয়ে। আলস্যে আচ্ছন্ন দেশ আরামের বিছানা ছেড়ে হঠাৎ উদ্দণ্ড মেরুদণ্ডে উঠে দাঁড়াল।’ নিজেদের কবিতার সঙ্গে বিষয় ও প্রকরণে বিস্তর ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও এই ভিন্ন স্বর, সুর, নন্দনের সাধনাই তাদের নজরুলের সঙ্গে সেদিন একসঙ্গে গেঁথে রেখেছিল।
কল্লোল ও কালি-কলমগোষ্ঠীর সঙ্গে নজরুলের এ সাযুজ্যের কারণেই সজনীকান্ত দাস রবীন্দ্রনাথের কাছে সমকালীন সাহিত্য নিয়ে যত অভিযোগ-নালিশ করেছেন, তার মধ্যে ওইসব পত্রিকার সঙ্গে সঙ্গে সব সময় নজরুলের কবিতার প্রসঙ্গও থাকত। সজনীকান্তদের উপর্যুপরি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতেই রবীন্দ্রনাথ ‘সাহিত্যধর্ম’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘মত্ততার আত্মবিস্মৃতিতে এক রকম উল্লাস হয়; কণ্ঠের অক্লান্ত উত্তেজনায় খুব একটা জোরও আছে, মাধুর্যহীন সেই রূঢ়তাকেই যদি শক্তির লক্ষণ বলে মানতে হয় তবে এ পালোয়ানির মাতামাতিকে বাহাদুরি দিতে হবে সে কথা স্বীকার করি।’ রবীন্দ্রনাথের এই খোঁচার মাথায় যে নজরুল আছেন তাতে সন্দেহ নেই। বলা বাহুল্য রবীন্দ্রনাথ, মোহিতলাল, সজনীকান্ত ও অপরাপর কবিদের নন্দনতাত্ত্বিক অবস্থানের ওপর ভিত্তি করেই ওই একই নন্দনতত্ত্বের ভোক্তা-সমর্থক-চর্চাকারী কাজী আবদুল ওদুদ নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, ‘বিভিন্ন ভাবের একত্র সমাবেশের সংগতি সুষমা অথবা যৌক্তিকতা বিষয়ে কবি বেশ, উদাসীন হয়েছেন।’
কবিতা কেমন হবে এই নিয়ে বিতর্ক, বাদানুবাদ সাহিত্যের ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। এ বাদানুবাদ যত ঘনঘন দেখা দেয় সাহিত্যের জন্য ততই তা সপ্রাণতার লক্ষণ বলেই বিবেচিত হয়। কিন্তু লক্ষণীয় হচ্ছে, নন্দনতাত্ত্বিক বাদানুবাদ কোনো সাহিত্যিকের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় ঘটে না। এর সঙ্গে কালের একটা গভীর সম্পর্ক থাকে। কালের পরিবর্তনই আসলে সাহিত্যের নন্দনে কল্লোল তোলে। কালের বড় কবিরা ওই কল্লোলকে অনুবাদ করেন তাদের সাহিত্যে। তাই এ কাজটি করতে পেরেছিলেন। এজন্যই বলি, নজরুল তার কালের নতুন নন্দনের নকিব।