Author Picture

ধর্ম নিয়ে খুনোখুনি

খন্দকার রেজাউল করিম

আমার ছোট বেলার বন্ধু সমীরণ ঘোষ। ও ছিল হিন্দু, কারণ ওর মা-বাবা হিন্দু। আমি ছিলাম মুসলমান, কারণ আমার মা-বাবা মুসলমান। হিন্দু না মুসলিম- কোন মায়ের কোলে জন্মাবে তাতে শিশুর তো কোনো হাত নেই। সমীরণ এবং আমি কেউই ধর্ম বেছে নিই নি।৷ শিশু বয়েসে ধর্মের কিই বা বুঝি? জন্মের আকস্মিকতাই আমাদের ধর্ম নির্ধারণ করে দিয়েছিলো। বুড়ো বয়েসে আমি এখনো মুসলমান, সমীরণ এখনো হিন্দু। বিচার বিশ্লেষণ করে ধর্ম পরিবর্তন করে কয়জন? শিশু বয়েসের ধর্মটাই বহাল থেকে যায়। সময় কোথায় সব ধর্ম জানার? কয়জন মুসলমান বাইবেল পড়েছেন, কয়জন খ্রীষ্টান পড়েছেন মহাভারত? নিজের ধর্ম পুস্তকটিই তো পড়া হয় নি! স্রষ্টা এক, সবাই বলে। তাঁকে কি নামে ডাকা হবে, তা নিয়ে চলছে মারামারি। স্রষ্ঠা কি চান, তা নিয়ে খুনোখুনি। আমি আর সমীরণ কি এক অপরের ধর্মবিশ্বাসকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতে পারি না?

আমার ধর্ম-জ্ঞান অতি সামান্য, যে কয়েকটি ধর্মগ্রন্থ পড়ার সুযোগ হয়েছে তার মধ্যে কোরানশরিফটাই পড়েছি সবচেয়ে বেশী। কোরানের একটি আয়াত দিয়েই শুরু করি, “Unto you is your religion, unto me is my religion (Quran 109:6)”। সুরাটির নাম আল-কাফেরুন। নাস্তিক বা অমুসলমানদের (কাফের) উদ্দেশ্যে লেখা এই ছোট্ট সুরাটির সারাংশ : “তুমি তোমার ধর্ম পালন কর, আমাকে আমার ধর্ম পালন করতে দাও। তুমি যা বিশ্বাস কর, আমি তা করি না। আমি যা বিশ্বাস করি তুমি তা কর না।” অনেকটা “Live and let live” জাতীয় কথা, তবে “pluralism” নয়। নাস্তিক বা অমুসলমানদের ধর্মেকর্মে একজন মুসলমানের বিশ্বাস নেই, কিন্তু তাকে তার ধর্ম পালন করতে দিতে হবে। এখানে মারামারি, খুনোখুনির কথা একেবারেই নেই। কিন্তু একজন নাস্তিক যদি নবীর নামে কুৎসা প্রচার করে, ইসলাম ধর্মকে গালমন্দ করে? তাকে আঘাত করা যাবে কি?
হজরত মুহাম্মদ (সা:) এবং তাঁর অনুসারীদে মক্কা থেকে উৎখাত করা হয়েছিলো। কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মুসলমানরা বিজয়ীর বেশে মক্কায় ফিরে আসে। নবীর বিপক্ষ-দলের প্রধানের নাম আবু সুফিয়ান। সে আর তার স্ত্রী হিন্দ নবীর নামে হরেক রকমের কুৎসা প্রচার করতো। নবীর চাচা হামজা ছিলেন মস্ত বীর, সম্মুখ যুদ্ধে তাঁকে হারানো প্রায় অসম্ভব ছিলো। হিন্দ একজন ক্রীতদাসকে নিয়োগ করেছিলো শুধু হামজাকে মারার জন্য। হামজা মরলেই ক্রীতদাসটি পাবে মুক্তি। হামজা যখন আরেক জনের সাথে যুদ্ধে ব্যস্ত, তখন দূর থেকে বল্লম ছুড়ে এই ক্রীতদাসটি হামজার বক্ষ ছিন্ন করে দেয়। হিংসায় উন্মত্ত হিন্দ, হামজার রক্তাক্ত কলজে হাতে নিয়ে উল্লাসে নাচতে থাকে, মুখে দিয়ে চিবিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করে। মৃত মুসলমান যোদ্ধাদের নাক, কান কেটে, তা দিয়ে মালা বানিয়ে হিন্দ গলায় দোলাতো – এমন পৈশাচিক মহিলা। মক্কা বিজয়ের পর নবী কি করলেন? সবার জন্য ক্ষমা ঘোষণা করলেন, আবু সুফিয়ান এবং হিন্দের গায়ে আঁচড়টুকুও পড়লো না। হিন্দের মত কুৎসা রটনাকারী যদি মুক্তি পায়, তবে নাস্তিক ব্লগারদের কেনো মরতে হবে? নবীর আদর্শকে অনুসরণ করাই কি একজন মুসলমানের কাজ নয়?

যখন একদল লোক তার ধর্মকে, জাতীয়তাকে, বর্নকে, বা ভাষাকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে দাবী করে তখনি বাধে খুনোখুনি। মাঝামাঝি কোনো পথ কি খোলা নেই? প্রতিদিন নামাজের সাথে মুসলমানরা যে সুরাটি পড়ে, তার একটি কথা হলো, “আমাকে সোজা পথ দেখাও।” আর কোনো পথ, হোক না বাঁকা, খোলা আছে কি ? “I am the way, and the truth, and the life. No one comes to the Father except through me.” (John 14:6)। বাইবেলের এই উক্তিকে ভিত্তি করে গোঁড়া খ্রীষ্টানরা আর সবাইকে স্বর্গ থেকে বহিষ্কার করে বসে আছেন। “In my Father’s house are many mansions, if it were not so, I would have told you. I go prepare a place for you.” (John 14:2)। বাইবেলের এই কথাটি কি “pluralism” এর একটু আভাস দেয়?
হিন্দু ধর্মে “pluralism” কোনো ব্যাপারই নয়। চার্বাকের মত নাস্তিকদের ঋষির সন্মান দেওয়া হয়েছে। ভিন্নমতকে স্বাগত জানাতে হিন্দু ধর্ম যেমন উদার, নিজেদের জাত, আচার, হাঁড়ি, আর ছোঁয়াছুয়ি নিয়ে এ ধর্ম আবার তেমনি সংকীর্ণ। যে কোনো ধর্ম সময়ের সাথে অনেক ভাগে ভাগ হয়ে যায়। হিন্দু ধর্ম থেকে এসেছে বৌদ্ধ, জৈন, শিখ; খ্রীষ্টান ধর্মে আছে ক্যাথলিক, প্রটেস্টান্ট, আরো কত কি; ইসলাম ধর্ম থেকে এসেছে প্রধানত সুন্নী এবং শিয়া। এই বিভাগের কারণ কখনো ক্ষমতার দন্দ্ব, কখনো বা আদর্শের বিরোধ। এই বিভাগ নিয়ে হয়েছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, মুসলমানদের রক্তক্ষরণ এখনো চলছে।

কোরানের একটি আয়াত, “Had God so willed, He could surely have made you all one single community; however, He lets go astray him that wills, and guides aright him that wills; and you will surely be called to account for all that you ever did!” (Quran 16:93)। আল্লাহ যদি চাইতেন তাহলে তিনি দুনিয়ার সবাইকে সৎ পথে নিয়ে আসতে পারতেন। তিনি ইচ্ছে করেই তা করেন নি। কেন করেন নি? যে অসৎপথে যেতে চায় তাকে তিনি বাধা দেন না, আর যে সৎ পথে যেতে চায় তাকে তিনি পথ দেখান। “যেমনি নাচান তেমনি নাচি, পুতুলের কি দোষ”, বলে একটা মারফতি গান আছে। এই আয়াতে বেপথে পা বাড়ানোর দোষটা মানুষের ঘাড়েই চাপানো হয়েছে। তবে একদিন এ নিয়ে আপনাকে জেরা করা হবে, তখন ভালো জবাবদিহি করে হয়তোবা উদ্ধার পেতে পারেন!

কোরানে এরকম আরো গোটা তিনেক আয়াত আছে যেখানে “pluralistic” সমাজ বা ধর্ম গঠনের পেছনে স্রষ্টার একটা মৌন সম্মতি কাজ করছে বলে মনে হয়, যেন তিনি চেয়েছেন পৃথিবীতে বৈচিত্র সৃষ্টি করতে। বিভিন্ন জাতের লোকেরা পরস্পরকে জানুক, এবং তাদের মাঝে ভালো কাজের একটা প্রতিযোগিতা চলুক। যেমন ধরুন মসজিদ থেকে ঘোষণা দেওয়া হলো যে পাড়ার অমুক হিন্দু ভাই না খেয়ে আছেন, তাঁর কাছে খাবার পৌঁছে দিন। অথবা মন্দির থেকে প্রচার করা হলো যে এক মুসলমান ভাই অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন, তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। কোরানে বলা আছে, “And certainly we raised in every nation an Apostle.” (Quran 16:36)। এমন কোনো জাতি নেই, যেখানে নবী পাঠানো হয় নি। ভারত, চীন, ইউরোপ, আমেরিকার বিশাল ভুখন্ডের নবীরা কে ছিলেন? তাঁদের বাণীই বা কি ছিল?

কোরানশরিফে লেখার ধরন অনন্য। আল্লাহ যেন চাচ্ছেন আমি তাঁর সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ি। তর্কের বিষয়বস্তু হলো একেশ্বরবাদ, পৃথিবীর বৈচিত্র, ইতিহাস, দর্শন, মনোবিজ্ঞান, পাপ-পুণ্য-ক্ষমা, দণ্ড-পুরস্কার। যুদ্ধের কথাও লেখা আছে, আর সেখানেই বাধে গন্ডগোল। কোরানের সুরাগুলি (অধ্যায়) বিষয় অনুসারে সাজানো নয়। যেমন নামাজের কথা বলা হয়েছে অনেকবার, অনেক স্থানে। এদের একসাথে জড়ো না করলে নামাজের পুরো বিষয়টা বোঝা সম্ভব নয়। তেমনি যুদ্ধ এবং শান্তির আয়াতগুলি সব একসঙ্গে না দেখলে ভয়াবহ ভুল হওয়ার সম্ভবনা আছে। অনেক আয়াত নবীর কাছে এসেছে যুদ্ধের সময়ে যখন শত্রুর সাথে চলছিলো জীবন-মরণ সঙ্ঘর্ষ। মুসলমান-জঙ্গী, এবং মুসলমান-বিদ্বেষী দু’দলের কাছেই এই আয়াতগুলি প্রিয়। জঙ্গীরা এগুলি ব্যবহার করে মানুষ-খুনের কাজে, আর মুসলমান-বিদ্বেষীরা ইসলাম-ভীতি প্রচারে। মাত্র গোটা পাঁচেক আয়াত আছে এরকম (কোরানের আয়াতের সংখ্যা সব মিলিয়ে ৬২৩৬)। এদের মধ্যে যেটি সবচেয়ে বেশী ব্যবহার করা হয় সেটা হলো, “Slay them who ascribe divinity to aught beside God wherever you find them, and take them captive, and besiege them, …” (Quran 9:5)। এর পরের আয়াতটাই কিন্তু, “And if any of those who ascribe divinity to aught beside God seeks thy protection, grant him protection, so that he might hear the word of God; and then escort him to a place where he can feel secure.” (Quran 9:6)।
একই সাথে একজন অমুসলমানকে বন্দী বা খুন করা, আবার তাকে আশ্রয় দিয়ে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেওয়া কি করে সম্ভব? কোরানে যে অমুসলমান হত্যার কথা বলা হয়েছে, তারা যে কোনো অমুসলমান নন, তারা যুদ্ধের ময়দানে বিপক্ষ দলের যোদ্ধা। নবীর চাচা আবু তালেব অমুসলমান ছিলেন, তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন নি। ছোটবেলা থেকে নবী তাঁর আশ্রয়েই বড় হয়েছেন, মক্কায় যতদিন ছিলেন, তাঁর আশ্রয়েই তিনি ইসলাম ধর্ম প্রচার করেন। কোরানের বিধান যদি হয় অমুসলমানকে খুন করা, বা কোনপ্রকার অসন্মান করা, তবে নবী কেন আবু তালেবকে এত ভালবাসতেন, শ্রদ্ধা করতেন? নবী আবু তালেবকে অনুরোধ করেছেন ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে, কিন্তু কোনো জোরাজোরি করেন নি। কারণ কোরানে স্পষ্ট নির্দেশ দেয়া আছে, “There shall be no compulsion in matters of faith” (Quran 2:256); ধর্মে জবরদস্তি নাই। যারা জোর খাটাতে চায় তাদেরকে সাবধান করা হয়েছে, “If it had been thy Lord’s will, they would all have believed – all who are on earth! Will you then compel mankind, against their will, to believe!” (Quran 10:99)।
গান্ধী একবার খ্রীষ্টান ধর্ম সম্পর্কে বলেছিলেন, “I don’t reject Christ. I love Christ. It’s just that so many of you Christians are so unlike Christ.” আর সব ধর্মের ধার্মিকদের একই দশা! একজন শিবসেনাকে বলা যায়, “ভাই, তোমার আচরণ তো শিব বা রামের মত নয়। বিশ্বকে বাঁচাতে শিব হলাহল পান করেন, বিষের যন্ত্রণা গলায় লুকিয়ে অধরে হাসি বিলান। রামচন্দ্রের পায়ের ছোঁয়ায় অভাগিনী অহল্যা পায় মুক্তি। আর তুমি তাদের নামে লাঠি মারছো অসহায় সংখ্যালঘুদের মাথায়।” কপর্দকশূণ্য ভবঘুরে দার্শনিক যীশুকে না ভালোবেসে উপায় নেই। তিনি শোনালেন অদ্ভুত কিছু কথা, “love your enemies and pray for those who persecute you.” যীশুর নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়, তবে তার খানিকটা কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন, কপালগুনে এমন দু’একজনের পরিচয় এ জীবনে আমি পেয়েছি, কিন্তু তারা কেউই খ্রীষ্টান নন। আমার ধারণা এরা যীশুর সত্যিকারের শিষ্য- বাইরের পরিচয় যাই হোক না কেনো।

আমি নিজে মুসলমান। কেউ যখন মুসলমান বলে দাবী করেন তখন আমি ভাবি নবীর কথা। ছোট বেলায় স্কুলের বইয়ের গল্পটি মনে পড়ে। এক অমুসলমান মহিলা নবীর চলার পথে কাঁটা ফেলে রাখতো। ছাদের উপর থেকে লুকিয়ে নবীর মাথায় ঢেলে দিত নোংরা আবর্জনা। সে যখন অসুখে পড়লো, নবী নিজ হাতে সেবা করে তাকে সারিয়ে তুললেন। যে এরকম করতে পারে সেই তো নবীর অনুসারী, সত্যিকারের মুসলমান- বাইরের পরিচয় যাই হোক না কেনো।

আরো পড়তে পারেন

আওরঙ্গজেব ও শম্ভাজির মিথ বনাম ইতিহাস: প্রসঙ্গ ছাবা চলচ্চিত্র

বর্তমানে বিজেপির সংঘ পরিবার প্রায় তিন’শ বছর আগের ভারতের এমন এক সম্রাটের কবর মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদ থেকে সরিয়ে দেয়ার আন্দোলন করছেন- যিনি ইতিহাসে ভারতকে সর্বকালের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রের মানচিত্র ও সংহতি উপহার দিয়েছিলেন, যার আয়তন ছিল চল্লিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার- যা ছিল বর্তমান ভারতের চেয়ে আট লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বড়, তাঁর অধীকৃত রাষ্ট্রটিই ভারত এখনো তারা….

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা: বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যা জানা গিয়েছে, যা জানা সম্ভব

এক মহান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের অপরিসীম আত্মত্যাগ। নানা সূত্র থেকে আমরা শুনে এসেছি ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা। অনেকেই আবার ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমন প্রশ্ন ওঠার মূলে রয়েছে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে ৭১-পরবর্তী শাসকদের উদাসীনতা। তারা এত বছরেও শহীদের সংখ্যা….

জর্জ অরওয়েলের নৌকাডুবি

১৯৪৪ সালের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে হিটলার যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে যুদ্ধে জয় পেতে। তার মরণকামড়ের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে নানা দেশের নানা শহর ও জনপদ। জার্মান বাহিনীর ভি-ওয়ান নামক উড়ন্ত যুদ্ধজাহাজগুলো মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ করেছে লন্ডন শহরে। বিমানবাহিনীর এমন দুর্দৈব তাণ্ডবে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষজন সব আশ্রয় নিচ্ছে মাটির তলার বাঙ্কারে ও পাতাল রেলের সুড়ঙ্গে। এমনই একদিন….

error: Content is protected !!