Author Picture

দ্যা মাস্ক অব আফ্রিকাঃ আফ্রিকান বিশ্বাসের খন্ডাংশ

মাসউদুল হক

প্রথম পর্বঃ কাসুভি’র সৌধ (৮)

যারা আফ্রিকান চিরায়ত ধর্মে বিশ্বাসী তারা এখন পিছিয়ে পড়েছে। পুরনো প্রথার প্রতি অন্ধ বিশ্বাস আর স্থানিক পবিত্রতার ধারনা ছাড়া সেই বিশ্বাস ধরে রাখার মত আর কোন উপাদান তাদের নেই। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ এবং পঞ্চম শতকে খ্রিষ্টান ধর্মের সাথে পৌত্তলিকতার যে দ্বন্দ্ব তার সাথেই কেবল এই পরিস্থিতি তুলনীয়। তবে চিরায়ত ধর্মের পশ্চাদপদতার কারণ পৌত্তলিকতা নয়। শ্রষ্টা বিষয়ক প্রাচীন ধারণা আর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মন্দিরগুলো মানুষের কল্যাণে কাজ করেছে বহুদিন। কিন্তু ইসলাম এবং খ্রিষ্টান ধর্মের মধ্যে যে দর্শন বিদ্যমান তা আফ্রিকার চিরায়ত ধর্মে নেই। কোন দর্শন ছাড়াই আফ্রিকান চিরায়ত ধর্ম নানারকম আচার-প্রথা আর যাদুর উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে।

এখন অফ্রিকার যারা পুরনো ধর্ম বিশ্বাস লালন করে তারা নতুন তত্ত্ব তৈরি করতে চাইছে বা পুন:আবিষ্কারে সচেষ্ট হয়েছে। তারা বোগান্ডার মানুষদের জন্য ‘স্বর্গ থেকে বিচ্যূত’ হবার মত একটা গল্প তৈরি করতে চাইছে। তারা বিশ্বাস করে, শ্রষ্টা যিনি সব কিছুর নিয়ন্ত্রক এবং চিরস্থায়ী একটি অস্তিত্ব তিনি কেবল একজন রাজকীয় ব্যক্তির ভেতরেই বাস করতে পারেন। আর সেই বিশেষ রাজকীয় ব্যক্তিটি হলো কাবাকা। তাদের ধর্ম মতে কাবাকা আধ্যাত্মিক জগতের যোগসূত্র; আর যোগাযোগের মাধ্যম হলো পূর্বপুরুষ। আর এভাবেই সৃষ্টিতত্ত্ব স্পর্শ করে পৃথিবী এবং বাগান্ডাকে।
সেরেনা হোটেলের বামবারা লাউঞ্জে বসে এক সময় উগান্ডার সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী মাদাম সেহেনা
যখন ‘স্বর্গচ্যুত’ হবার ধারণা থেকে পৃথক করে নতুন একটি ধারণা উপস্থাপন করলেন তখন ধর্মতত্ব আরও কঠিন হয়ে দাঁড়াল।
মেকেরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সুসান একদিন বিকেলে এই মধ্যবয়সী নারীকে আমাদের সাথে পরিচিত করাতে নিয়ে আসেন। তিনি শুধু প্রাক্তন মন্ত্রীই ছিলেন না, তিনি বিভিন্ন গনমাধ্যমে সংস্কৃতি এবং ধর্ম নিয়ে আলোচনাও করে থাকেন। বিশেষত তরুণ বাগান্ডাবাসী যারা সাংস্কৃতিক ভাবে বিপর্যস্থ তাদের তিনি দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। হোটেল সেরেনা নানারকম আফ্রিকান খোদাই করা কাজ আর কাবাকোদের নানারকম চিহ্ন দিয়ে সাজানো। এমনি এক খোদাই করা কাঠের ছাদের নীচে বসে আমরা আলোচনায় মগ্ন হয়েছিলাম।

তাদের কাবাকার ডান হাতে একটি বিশেষ চিহ্ন আছে এবং তিনি দুটি নাড়ী নিয়ে জন্ম গ্রহন করেছেন। বাগান্ডার বায়ান্নটি উপজাতীর মধ্যে শুধু মাত্র বানর গোত্রের লোকেরা কাবাকা পদে অধিষ্ঠিত হতে পারে। কাবাকা পদে অধিষ্ঠিত হবার পর তিনি উপর থেকে প্রেরিত বাণী জানতে পারেন। এবং আত্মাদের সাথে কথা বলতে পারেন। কাবাকার জন্য একটি আলাদা কক্ষ নির্মাণ করা হয়েছে যেখানে তিনি নির্জনে অবস্থান করে থাকেন। তবে সেখানে কোন নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ। এখানেই দেবদূতরা আসেন এবং তাকে দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। কিন্তু এর মধ্যে সরকার আবার বাগান্ডার নয় হাজার বর্গকিলোমিটার পবিত্র ভূমি দাবী করে বাগান্ডাবাসীকে নতুন সমস্যার দিকে ঠেলে দিয়েছে। অনেক মানুষই মনে করেন কাবাকার অধিষ্ঠান যথাযথ ভাবে না হওয়ায় এই ঘটনা ঘটছে। কিছু আনুষ্ঠানিকতা বাকি থাকায় জনগনকে ভোগান্তির শিকার হতে হচ্ছে।

পুরনো ধর্মের পুনরুত্থানের স্বপ্ন দেখা মাদাম সেহেনা জানায়, ‘আমরা এখানেই থামতে রাজী না। আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কাবাকাদের রক্ষাকারি অনেক দেবদূত আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। আমাদের রাজকীয় রক্তের একজন যুবরাজ আছেন। তিনি দৈববাণী পান এবং আমাদের অবগত করেন। তার সাথে ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করাও সম্ভব। তিনি তার মন্দিরে অবস্থান করে থাকেন। আপনি একটি খাতা কিনে তাতে আপনার প্রথম পূর্বপুরুষের নাম, নিজের নাম এবং সমস্যা লিখে দিতে পারেন।’
তাদের মতে প্রথম পূর্বপুরুষ যিনি দেবতাদের পরিচিত, তিনি জন্ম নেন না, তাকে তৈরি করা হয়। এবং তিনি হারিয়ে যান কিন্তু মৃত্যুবরণ করেন না।
সেহেনা বলতে থাকেন , ‘ঐ খাতা মন্দিরে নিয়ে গেলে সমাধান দেয়া হয়। তবে ঐ সমাধানটি বিনামূল্যে পাওয়া সম্ভব না। সেই মন্দির প্রাঙ্গনে রাজকীয় ড্রাম বাজানো হয়। সিংহ গোত্রীয় কেউ তা বাজায়। এবং সিংহ হলো বুগান্ডাদের প্রতীক। ঐ মন্দির প্রাঙ্গনে পতিত দেবদূতও বাস করে কিন্তু তাকে দেখা যায় না। আপনি যদি নিজের খুব প্রিয় যেমন মা বা সন্তান এমন কাউকে উৎসর্গ করেন তবে সেই দেবদূতরা আপনাকে এমন সম্পদ দান করবে যা আপনার কল্পনার বাইরে। সেক্ষেত্রে অবশ্য একটা মাধ্যম ধরতে হয়। এবং হ্রদের পারে যেতে হয়। আপনি নারী হলে একজন সুপুরুষ আত্মা এসে আপনাকে হ্রদের ভেতরে নিয়ে যাবে। এবং পুরুষ হলে কোন রূপবতী নারীর আত্মা আপনার কাছে আসবে এবং সম্পদ দান করবে। কিন্তু একবার ঐ আত্মাকে ডাকলে তাদের নিয়ম মানতে হয়। যেমন একবার আত্মা আপনার সাথে বসবাস শুরু করলে আপনি আর বিয়ে করতে পারবেন না। আপনি এই ভাবে সম্পদের দেখা পেয়েছে এমন অনেক মানুষ পাবেন যারা এখানে দামী গাড়ি চালাচ্ছে এবং প্রাসাদের মত অট্টালিকায় বাস করে থাকে। যদি আপনি নিয়মের ব্যতয় ঘটান তবে সম্পদ হারাবেন এবং শাস্তিও প্রাপ্য হবেন।’

ভি এস নাইপল ও ‘দ্যা মাস্ক অব আফ্রিকা’

কিছুদিনের জন্য আমি লুক নামের এক ভদ্রলোককে আমাদের গাইড হিসেবে নিয়েছিলাম। যদিও আমাকে দেখানোর মত বিশেষ কিছু তার ছিল না। সে বাস করত কাম্পালা শহর থেকে বহুদূরে যেখানে রাস্তা তখনও কাঁচা। যেদিন বৃষ্টি হতো সেদিন তার পক্ষে আসা সম্ভব হতো না। সে টেলিফোনে জানিয়ে দিয়ে তার পরিকল্পনা বাতিল করে দিত। পরবর্তী সময় তার সাথে দেনা-পাওনা মেটাবার সময় সে বাতিল করা দিনগুলোর জন্যও অর্থ দাবী করে। কারণ সেই দিনগুলো নাকি সে আমার জন্য আলাদা করে রেখেছিল।
লুক এক সময় উগান্ডায় স্থাপিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটিতে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিল। তার বেতন ছিল প্রায় এক লক্ষ সত্তর হাজার শিলিং। যা পাউন্ডে হিসেব করলে পাঁচশ আর ডলারে হিসেব করলে ১২০০ ডলারের মত। এবং আমার হিসেবে তার প্রয়োজনের পক্ষে যথেষ্টই ছিল। কিন্তু তার মতে তিনি এবং আরও শিক্ষক-ছাত্ররা কম বেতনের কারণে ধর্মঘটে গেছে। ঐ অর্থের অংক থেকে আমি অনুমান করি লুকের চাহিদা অনেক। এবং এক সকালে দেরিতে উপস্থিত হয়ে সে যখন বললো আমাদের একজন যাদুকরের কাছে নিয়ে যাবে তখন আমি উদ্বিগ্ন না হয়ে পারিনি। আমি চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম এই ভেবে যে, ঐ যাদুকরদের না জানি কত টাকা দিতে হয়? আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দেই আমাদের বাসাদাজেনজিতে অবস্থিত পাথর-মন্দির দেখতে যাওয়ার কথা। যদিও আগের দিন এই বিষয়ে আমাদের সবিস্তারে আলোচনা হয়েছে কিন্তু সে আমাকে বার বার বলতে থাকে যে পাথর-মন্দির নয় আমি তাকে যাদুকরের সাথে দেখা করানোর কথা বলেছি। সে কারণে সে যাদুকরের সাথে পরিচয় আছে এমন একজন বন্ধুকেও নিয়ে এসেছে। সেই বন্ধুটি যাত্রাপথে একটি পুলিশ বক্সে আমাদের জন্য অপেক্ষারত। সে এমন ভাবে বলছিল যে আমার নিজের মধ্যেই এক সময় দ্বিধা তৈরি হয় এবং আমরা লুকের বন্ধুকে তুলে নিতে রওয়ানা দেই।
সেই পুলিশ পোস্টটি শহরের এমন একটি বেকায়দা জায়গায় অবস্থিত যে সেখানে যেতে আমাদের ভগ্ন রাস্তা, শিশুদের জটলা, পরিখার মত গর্ত আর নিয়মিত ঝাঁকুনির ফাঁকে ফাঁকে পড়ে থাকা ময়লা অতিক্রম করতে হয়েছিল। পরে অবশ্য আমরা আরেকটি সংকীর্ণ রাস্তা ধরে, আচমকা সবুজের সমাহার দেখা দেয়া একটা রাস্তায় উঠে আমরা সেই রাস্তা ধরে যাদুকরের বাড়ি পৌঁছে যাই।
যাদুকরের বাড়ি ছিল একটি আদর্শ কুঁড়েঘর। তবে তা আধুনিক এবং মাত্রই রং করা। বাড়ির চারপাশে ছিল কংক্রিটের ব্লক দিয়ে তৈরি করা পাঁচিল। লুক এবং তার বন্ধু খুব নি:শব্দে সেই বাড়ির উঠানে গিয়ে দাঁড়ায় এবং যাদুকরের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। যাদুকর ঘরে পরিধান করা পোষাক পড়েই বের হয়ে আসেন। তাকে বেশ বিক্ষিপ্ত মনে হয়েছিল; সম্ভবত তিনি এই সময়ে বিরক্ত হতে চাননি। আমি যেন শুনতে না পাই এমন নিচুস্বরে তাদের তিনজনের মধ্যে কথোপকথন শুরু হয় এবং যাদুকরকে বেশ একরোখা মনে হচ্ছিল।

আমার গাড়ির চালক জানালেন যে, আজ বৃহস্পতিবার। এই দিন তিনি লতাপাতা এবং ভেষজ সংগ্রহে সময় ব্যয় করে থাকেন ফলে তিনি অতিথিদের গ্রহন করেন না। লতা-পাতা সংগ্রহ যাদুকরদের ব্যবসার অন্যতম উপাদান। উগান্ডার লোকেরা ঐসব ঔষধি উপাদানকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে থাকে। যেমন পুরুষেরা তার ওয়ালেটে ঐসব ঔষধি লতা-পাতা সংরক্ষণ করে থাকে। কারণ তারা বিশ্বাস করে ঐ লতাপাতা তাদের অর্থ রক্ষার পাশাপাশি আরও অর্থ সমাগমের নিশ্চয়তা দেয়।
ফলত: আমাকে যেমন অনুরোধ করে সাথে আনতে হয়েছিল তেমনি তারা এবার ঐ যাদুকরকে অনুরোধ করতে শুরু করে। তারা আমাকে বলেছিল, ‘এই যাদুকর কোন সাধারন যাদুকর নয়। সে খুবই আধুনিক। তাকে দেখা আমার জন্য দারুণ এক অভিজ্ঞতা হবে’ বলে তারা আমাকে অবগত করেছিল। জলস্রোতের মত তাদের মধ্যে কথা চালাচালি হচ্ছিল। আমার ধারণা ভাল একটা ফিস দেয়া হবে এমন আশ্বাস দিয়ে তারা যাদুকরকে রাজি করাতে চাচ্ছিল। বাড়ির পাশেই গ্যারেজের মত একটা কক্ষে একজন মহিলা বাঁকা হয়ে মুছার কাজে ব্যস্ত ছিলো। সে মেঝের একই জায়গা বারবার মুছে যাচ্ছিল। আর এই উসিলায় যাদুকর এবং লুকদের মধ্যে কি কথা হচ্ছে তা জেনে নিচ্ছিলো। তার অর্ধ ভাঁজ করা শরীরের পেছনেই পড়ে ছিল হামাগুড়ি দিতে থাকা একটি উলঙ্গ শিশু।
দীর্ঘ আলাপের পর লুক এবং তার বন্ধু গাড়ির কাছে ফিরে এসে আমাকে জানায় যে তাদের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। তিনি আমাদের দেখা দিবেন। কিন্তু তার পূর্বে যাদুকরকে পবিত্র হতে হবে। পবিত্রকরন পর্ব সমাপ্ত হলে তিনি তার বাড়ি সংলগ্ন আরেকটি উঠোনের মন্দিরে উপস্থিত হবেন। সেই মন্দিরটি ছিল তার বাড়ি সংলগ্ন কিন্তু পৃথক বেড়া দেয়া একটি স্থান। এই অবসরে জুতা খুলে আমরা সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করতে পারি। আমরা যাদুকরের বাড়ির উঠান ত্যাগ করে, মূল রাস্তা ধরে বের হবার পরপরই মন্দির প্রাঙ্গনে প্রবেশ করি। মন্দির প্রাঙ্গনে প্রবেশের জন্য আরেকটি পৃথক দরজা আছে। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ইসমাইল ততক্ষণে যথেষ্ট আগ্রহী হয়ে উঠেছে। সে ইতোমধ্যে তার জুতা খুলে নিয়েছে এবং আমাদের জানাল যে, যদি যাদুকর নিজেকে যথযথভাবে পবিত্র না করে তবে আত্মা নাখোশ হতে পারে। আর আমি অনুভব করছিলাম যত সময় যাবে যাদুকরের পারিশ্রমিক বাড়তে থাকবে। মন্দির প্রাঙ্গনে পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন কুঁড়েঘর আছে। সবগুলো কুঁড়েঘরই আধুনিক। কংক্রিটের দেয়াল দেয়া। তবে আকারে এতই ক্ষুদ্র যে একজন লোকের বেশি কেউ সেখানে বাস করতে পারবে না। এবং ঘরগুলো একটির সাতে অন্যটি এক গজ প্রশস্ত এবং উঁচু রাস্তা দিয়ে সংযুক্ত। সম্ভবত আধুনিকতা আনতে ঐ পথ তৈরি করা হয়েছে কারণ কোন দর্শনার্থীর শুকনোর দিনেতো বটেই, এমনকি বর্ষায়ও ঐ পথ ব্যবহারের কোন কারণ নেই।
প্রবেশপথের সাথেই একটি ঘরকে দেখে অফিস কক্ষ মনে হয়েছে। কারণ সেখানে একটা আলমারি, কিছু বইপত্র এবং একটা টেলিফোন রাখা আছে। দেয়ালে ঝুলানো ছিল একটা সবুজ ফ্রেমে বাঁধাই করা লাইসেন্স। অন্যন্য দেশে একাউন্টেন্ট এবং ফার্মসিস্টদের যেমন কাজ করার জন্য সার্টিফিকেট দেয়া হয় এখানে তা দেয়া হয় যাদুকরদের।
ঐ ঘরের বেসিনের উপর একটা আয়না রাখা ছিল। এবং তার নীচে অল্প ব্যবহার করা কাগজে মোড়ানো একটা সাবান। সেখানকার দেয়ালে সাদা-কালো রং দিয়ে একটা সংকেত আঁকা ছিল। যা টয়লেট কোন দিকে তা প্রদর্শন করছিল। তবে সেই টয়লেটটি মন্দির প্রাঙ্গনে ছিল না। তা ছিল যাদুকরের বাড়ির সীমানায়। দুই সীমানার মধ্যবর্তী একটি ছোট গেইট দিয়ে সেখানে যাওয়া যায়। তিনি সম্ভবত পবিত্রস্থানে টয়লেট রাখতে চাননি।

তার পূর্বে যাদুকরকে পবিত্র হতে হবে। পবিত্রকরন পর্ব সমাপ্ত হলে তিনি তার বাড়ি সংলগ্ন আরেকটি উঠোনের মন্দিরে উপস্থিত হবেন। সেই মন্দিরটি ছিল তার বাড়ি সংলগ্ন কিন্তু পৃথক বেড়া দেয়া একটি স্থান। এই অবসরে জুতা খুলে আমরা সেখানে গিয়ে অপেক্ষা করতে পারি। আমরা যাদুকরের বাড়ির উঠান ত্যাগ করে, মূল রাস্তা ধরে বের হবার পরপরই মন্দির প্রাঙ্গনে প্রবেশ করি। মন্দির প্রাঙ্গনে প্রবেশের জন্য আরেকটি পৃথক দরজা আছে। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ইসমাইল ততক্ষণে যথেষ্ট আগ্রহী হয়ে উঠেছে। সে ইতোমধ্যে তার জুতা খুলে নিয়েছে এবং আমাদের জানাল যে, যদি যাদুকর নিজেকে যথযথভাবে পবিত্র না করে তবে আত্মা নাখোশ হতে পারে

আমরা যখন এইসব দেখছিলাম তখন যাদুকরের একজন সহকারি এসে হাটগুলোর দরজা খোলা শুরু করে। তার খোলা কুঁড়েঘরের একটিতে কাঠ দিয়ে আগুন প্রজ্জ্বলন করা ছিল। সম্ভবত ঐ আগুন দিয়ে আমাদের স্বাগতম জানানো হয়েছে অথবা ঐ আগুন দিয়ে মন্দির প্রাঙ্গন পবিত্র করা হয়েছে।
আমি বুঝলাম, খরচ যতই হোক আমার আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ এই আয়োজন আমার সম্মানে করা হয়েছে। এখন আমি ফিরে যেতে চাইলে আমার ড্রাইভার ইসমাইল যিনি ধর্ম মতে মুসলমান সেও আমার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যাবে।
এরপর যাদুকর নিজেই হাজির হলেন। আমি দেখলাম, ইতোমধ্যে তিনি তার পোষাক পাল্টে ফেলেছেন। জগিং প্যান্টের বদলে তিনি এখন লম্বা একটি পায়জামা পরিধান করেছে এবং গায়ে চড়িয়েছেন একটা গেঞ্জি। পবিত্রকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার কারণে তার চেহারার বিরক্তভাবটা দূর হয়েছে এবং তাকে অনেক ফুরফুরে লাগছে। আত্মার সাথে সম্পর্ক স্থাপনে সে এখন প্রস্তুত।
তিনি এসে উঠোনের দূরবর্তী একটা কুঁড়েঘরে আসন গ্রহন করলেন। ঘরের খোলা দরজাটির কারণে মনে হচ্ছিল তিনি একটা ছবির ফ্রেমে নিজেকে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। পরিবেশটি এমন দাঁড়াল যে আমরা সেবাগ্রহিতা আর তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সেবা প্রদানে রত হয়েছেন।

লুুকের বন্ধুর সুবাদে জানতে পারি প্রত্যেকটি কুঁড়েঘরের ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্য আছে। একটিতে যাদুকর তার সেবগ্রহিতাকে গ্রহন করে তার চাহিদা জানতে চায়। অন্য আরেকটি ঘরকে ঔষধাগার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যেখানে ছোট ছোট বাক্সে নানরকম লতা-পাতা বা ভেষজ দ্রব্যাদি রাখা হয়। আত্মার নির্দেশনা মতে সেই সব ভেষজ দ্রব্যাদি সেবাগ্রহিতাকে দেয়া হয়। যাদুকরকে আত্মার সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হয়। এই সর্বদা প্রস্তুত থাকাটাই তার সাথে সাধারন মানুষের ভিন্নতা।
আমরা তার আসনে নেয়া কুঁড়েঘরে উঁকি দিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখলাম সে রহস্যময় ভংগিতে কাবাকার ছবির নীচে বসে আছে। বাইরে থেকে যে কুঁড়েঘরকে কংক্রিটের তৈরি আধুনিক ঘর বলে মনে হয়েছিল, ভেতরে তা পুরোই চিরায়ত আফ্রিকান ঘরানার একটি কক্ষ। ঘরের আগা-গোড়া পুরোটাই আফ্রিকান বাকলের তৈরি কাপড় দিয়ে ঢাকা। সেই সব বাকলের কাপড় এমন ভাবে সেলাই করা যে গৃহ নির্মানে ব্যবহার করা আধুনিক সরঞ্জামাদি আড়াল করে রাখা হয়েছে। এইসব বাকলের কাপড়ের সাথে একধরনের আধ্যাত্মিক এবং যাদু বিশ্বাসের সম্পর্ক রয়েছে। কাসুবিতে কাবাকাদের সৌধেও একই ধরনের বাকলের তৈরি কাপড় ছাদ থেকে মাটি পর্যন্ত ঝুলানো থাকে। এই কাপড়ের পর্দা হলো পূর্বপুরুষরা মৃত্যুর পর যে বনে বসবাস করে সেই বনের প্রতীক।
সেই যাদুকর জানতো তিনি তার বাড়ি এবং তৎসংলগ্ন এলাকায় নানারকম কংক্রিটের অবকাঠামো তৈরি করে আফ্রিকান চিরায়ত প্রথার বিরূদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। আফ্রিকান প্রথা মানলে ঘরের সব কিছু আফ্রিকার নিজ ভূমি থেকে সংগ্রহ করার কথা। কিন্তু তিনি সেই দর্শন থেকে সরে এসেছে। অবশ্য এই কাজের পেছনে তারও যুক্তি আছে। কাসুবির সৌধ নির্মানের পর অনেক সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। তাকে এখন খ্রিষ্টানদের চার্চ আর মুসলমানদের মসজিদের সাথে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হচ্ছে। সুতরাং যারা এখানে আসেন তাদেরকে একটা ভাল অনুভূতি প্রদান করাও তার দায়িত্বের মধ্যে পরে।
যাদুকর একসময় কুঁড়েঘর থেকে বের হয়ে অল্প কিছুদূরের উন্মুক্ত অগ্নিকুন্ডের পাশে গিয়ে বসেন। সেখানে তখনও ধূসর কাঠের ছাই এবং যথেষ্ট পরিমান আধ-পোড়া কাঠ বিদ্যমান আছে। সে জানায়, সে মাঝে মাঝেই ঐ আগুনের পাশে গিয়ে বসেন। কারণ তার উপর ভর করা আত্মারা তাকে এই কাজ করতে নির্দেশ দেয় এবং ঐ আগুনের পাশে বসলেও তিনি কোন উত্তাপ অনুভব করেন না। নানারকম প্রণোদনামূলক শব্দ বা নির্দেশ তিনি শুনতে পান মাটির উপর-নীচ দু’জায়গা থেকেই।
আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ইসমাইল হঠাৎ করে তার ইসলামী বিশ্বাসে ফিরে গিয়ে, অত্যন্ত নীচু গলায় বললো, ‘আমি তাকে সত্যি সত্যি তা করতে দেখলে খুশি হতাম।’

লুক এবং তার বন্ধু আমাদের কথা শুনতে পায়নি। তারা তখন যাদুকরের বিভিন্ন কুঁড়েঘরের ব্যবহার সংক্রান্ত বর্ণনার সাথে একাত্ম হয়ে উঠেছে। তার বক্তব্য শেষ হলে যাদুকর তার সহকারিকে ডাকে এবং সহকারি অত্যন্ত প্রশিক্ষিত মানুষের মত মোটা এবং বর্গাকৃতির একটি রঙ্গিন ছবির এলবাম নিয়ে হাজির হয়। ঐ ছবিগুলো ছিল ঐসব বিখ্যাত ব্যক্তিদের যারা ইতোপূর্বে ঐ মন্দিরে দর্শনার্থী হয়ে এসেছিল। লুক, তার বন্ধু এবং ইসমাইল সেই স্থানীয় প্রখ্যাত ব্যক্তিবর্গ যারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মিনতি নিয়ে ঐ মন্দিরে এসেছিলেন তাদের ছবি মনোযোগ দিয়ে দেখতে শুরু করে।
পরিশেষে এলো পারিশ্রমিকের বিষয়। এই সময় লুক তার স্বভাবজাত ভয়জাগানিয়া কন্ঠে জানায়, কত টাকা দিব তা আমার উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। যেহেতু আমি যাদুকরের কাছে কোন মিনতি করিনি সেহেতু আমি তাকে বিশ হাজার শিলিং প্রদান করি। এবং কোন বাক্যব্যয় না করে যাদুকর যখন সেই শিলিং নেয় তখন আমি টাকার কথা ভেবে যে সারাদিন দুশ্চিান্তায় মগ্ন ছিলাম তার জন্য আফসোস করতে শুরু করি।

কিন্তু সমস্যা হাজির হলো তখন, যখন আমি লুক’কে পারিশ্রমিক দিতে যাই। টেলিফোনে কথোপকথনের সময় তার পারিশ্রমিক এক’শ ডলার নির্ধারন করা হয়েছিল। এবং সে তাতে সম্মতিও প্রদান করে। কিন্তু আমাকে বিস্মিত করে সেদিন সন্ধ্যায় ফোন করে সে জানতে চায়, আমি কি তাকে একশ ডলার না একশ পাউন্ড দেয়ার কথা বলেছিলাম। আমার ভেতরেও একটা অনুভূতি কাজ করছিল যে একশ ডলার তার মজুরি হিসেবে কম হয়ে যায়। তাই আমি তাকে একশ পাউন্ড দিতে সম্মত হই। কিন্তু পরদিন সকালে পারিশ্রমিক নিতে এসে সে জানায় আমার দেয়া অর্থ তার যা প্রাপ্য হওয়া উচিৎ তার চেয়ে অনেক কম । সুতরাং আমি যেন তাকে দুইশ পাউন্ড দেই। এটা ছিল তার মজুরি বাড়ানোর কৌশল। এভাবে সে তার চাহিদা দ্বিগুণ করে ফেলে। আমার তখন মনে পড়েছিল অভিযাত্রী স্পেক’র ক্রোধের কথা। যখন তিনি একশ পঞ্চাশ বছর আগে নীল নদের উৎস আবিষ্কার করতে যাচ্ছিলেন তখন এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে প্রবেশ করতেই গোত্র প্রধানরা তার কাছ থেকে প্রবেশ-কর বা হংগো দাবী করে যাচ্ছিলেন। তাদের মতে, সীমানায় প্রবেশ করতে হলেই কর দিতে হবে। কর পেলে সেই অঞ্চলের গোত্র প্রধানরা ড্রাম বাজাতো। যার মানে হলো, কেউ যেন দর্শনার্থীর কোনরূপ ক্ষতি না-করে।
প্রবেশ কর বা হংগো’র মত লুকও আমাকে প্রথমে ডলার এবং পাউন্ডের জালে আটকে ফেলে। তারপর সেই অর্থ দ্বিগুন করতে চেষ্টা করে। বিষয়টি মীমাংসা করতে আমি তাকে শেষ পর্যন্ত একশ পঞ্চাশ পাউন্ড দিয়েছিলাম। যা অবশ্যই তার প্রাপ্য অর্থের চেয়ে অনেক বেশি।

[অনুবাদকের কথাঃ ভি এস নাইপলের এই পুস্তকটি কোন এক বিমানবন্দরের বুক স্টোর থেকে সংগ্রহ করা। অনেক দিন ধরে খুব ধীরে ধীরে আমি পাঠ করে যাচ্ছি। পাঠ করার সময় মনে হলো এই পাঠ-অভিজ্ঞতা শেয়ার করা মন্দ হবে না। একটা দায়িত্ববোধের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখলে বই পড়ার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সহজ হয়। সেই ভাবনা থেকে অনুবাদ শুরু করি। এই বইয়ে রয়েছে ‘আফ্রিকান বিশ্বাস’কে কেন্দ্র করে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন ভ্রমন-বিষয়ক প্রবন্ধ। প্রতিটি প্রবন্ধ আবার অনেকগুলো অধ্যায়ে বিভক্ত। পাঠকের এবং নিজের সুবিধার্থে লাইন বাই লাইন অনুবাদ না করে, মূল তথ্য অবিকৃত রেখে বইটির বিষয়বস্তুর একটি ভাবানুবাদের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনশত পঁচিশ পৃষ্ঠার ‘দ্যা মাস্ক অব আফ্রিকা’র ঠিক কত পর্ব পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারব জানি না। মতামত জানাতে পারেন : onemasud@gmail.com]

আরো পড়তে পারেন

আওরঙ্গজেব ও শম্ভাজির মিথ বনাম ইতিহাস: প্রসঙ্গ ছাবা চলচ্চিত্র

বর্তমানে বিজেপির সংঘ পরিবার প্রায় তিন’শ বছর আগের ভারতের এমন এক সম্রাটের কবর মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদ থেকে সরিয়ে দেয়ার আন্দোলন করছেন- যিনি ইতিহাসে ভারতকে সর্বকালের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রের মানচিত্র ও সংহতি উপহার দিয়েছিলেন, যার আয়তন ছিল চল্লিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার- যা ছিল বর্তমান ভারতের চেয়ে আট লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বড়, তাঁর অধীকৃত রাষ্ট্রটিই ভারত এখনো তারা….

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা: বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যা জানা গিয়েছে, যা জানা সম্ভব

এক মহান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের অপরিসীম আত্মত্যাগ। নানা সূত্র থেকে আমরা শুনে এসেছি ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা। অনেকেই আবার ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমন প্রশ্ন ওঠার মূলে রয়েছে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে ৭১-পরবর্তী শাসকদের উদাসীনতা। তারা এত বছরেও শহীদের সংখ্যা….

জর্জ অরওয়েলের নৌকাডুবি

১৯৪৪ সালের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে হিটলার যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে যুদ্ধে জয় পেতে। তার মরণকামড়ের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে নানা দেশের নানা শহর ও জনপদ। জার্মান বাহিনীর ভি-ওয়ান নামক উড়ন্ত যুদ্ধজাহাজগুলো মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ করেছে লন্ডন শহরে। বিমানবাহিনীর এমন দুর্দৈব তাণ্ডবে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষজন সব আশ্রয় নিচ্ছে মাটির তলার বাঙ্কারে ও পাতাল রেলের সুড়ঙ্গে। এমনই একদিন….

error: Content is protected !!