
সাদা মানুষ, কালো মানুষ
আমেরিকায় সাদা মানুষ এবং কালো মানুষ কখন সবচেয়ে বেশি আলাদা হয়ে পড়ে? রবিবার সকাল নয়টা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত। আমেরিকার প্রাপ্তন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সাদা-কালো সম্প্রীতির আলোচনা করতে গিয়ে এই মর্মান্তিক সত্যটা ফাঁস করে দিয়েছিলেন, ‘most segregated hour of American life occurs on Sunday morning!’ কি হয় তখন? প্রার্থনা।
প্রতিটি গির্জায় ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজে, সুবেশধারী নারী-পুরুষ ছেলেমেয়ের হাত ধরে গির্জায় ঢুকতে থাকে। গির্জার পিয়ানোতে তখন ধর্ম-সংগীতের সুর বাজছে: ‘প্রভু আমি এসেছি। হে বিশ্বপিতা, হে আমার প্রিয়, আমি এসেছি তোমারি দ্বারে।’
আমেরিকার বারো পার্সেন্ট মানুষ কালো, এদের পূর্বপুরুষেরা আফ্রিকা থেকে এসেছে, তাই এদেরকে আফ্রিকান-আমেরিকান বলে ডাকা হয়। সাদা মানুষ শতকরা সাতাত্তর ভাগ। রাস্তা ঘাটে, কর্মক্ষেত্রে, খেলার মাঠে, যুদ্ধক্ষেত্রে, সাদা-কালো পাশাপাশি আছে, কিন্তু গির্জায় প্রায় সবাই শুধুই সাদা অথবা কালো। এমনকি সাদাদের যীশুর গায়ের রং সাদা, চোখের রং নীল, চুলের রং সোনালী। কালোদের যীশুর সবকিছুই কালো! গির্জার ভিতরে সারি সারি বেঞ্চ পাতা থাকে। উপসনাকারীরা স্বামী-স্ত্রী পরিবার প্রিয়জন নিয়ে যে যার পছন্দমতো জায়গায় বসেন। কয়েক’শ বছর ধরে একসাথে বাস করার পরেও সাদা-মানুষ কালো-মানুষ একে ওপরের প্রিয়জন হয়ে উঠতে পারে নি।
আমেরিকার কালোদের অনেকেই মুসলমান, এবং ধর্ম নিয়ে ওদের উৎসাহ আর সব মুসলমানদের চেয়ে একটু বেশি। মসজিদে প্রিয়জনদের পাশে বসতে পারেন, কিন্তু নামাজের কাতারে শরিক হবার ডাক এলে কে কোথায় ছিটকে পড়ে তার কোনো ঠিক নেই। হয়তো দেখলেন যাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন তারা একেবারেই অপরিচিত, কেউ সাদা, কেউ কালো, কেউ ফকির, কেউ বা ধনী। নিরাকার আল্লাহর সামনে সেজদারত মানুষগুলো কিছুক্ষনের জন্যে অবিভিন্ন হয়ে যায়!
রাস্তা ঘাটে, কর্মক্ষেত্রে, খেলার মাঠে, যুদ্ধক্ষেত্রে, সাদা-কালো পাশাপাশি আছে, কিন্তু গির্জায় প্রায় সবাই শুধুই সাদা অথবা কালো। এমনকি সাদাদের যীশুর গায়ের রং সাদা, চোখের রং নীল, চুলের রং সোনালী। কালোদের যীশুর সবকিছুই কালো!
অনেক যুগের অবহেলা সয়ে কালোরা ভালোবাসার কাঙাল, মুসলমানি কায়দায় কোলাকুলি করতে গেলে ওরা আর ছাড়তে চায় না। গির্জায় পাদ্রী সাহেব স্টেজে দাঁড়িয়ে আবেগ-তাড়িত কণ্ঠে ধর্মের কথা বলেন, বাইবেলের অংশ ব্যাখ্যা করে বোঝান। শ্রোতারা প্রিয়জনের হাত ধরে হিতোপদেশ শোনে। এক দল গাইয়ে স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। মাঝে মাঝে ধর্ম-সংগীত গায়।
অনেক বছর পরে কেভিন গির্জায় এসেছে। গ্রাম্য এলাকার গির্জায় তার এই প্রথম প্রবেশ। সবাই অচেনা, তবে কয়েকজন স্কুলের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকের দেখা মিললো। সামনের একটি বেঞ্চে সুজান এবং তার ছেলে জেসি বসে আছে, পাশে ক্যারোল এবং তার মা ম্যাগি। পাদ্রী সাহেব এবং সুজানের স্বামীর কোনো পাত্তা নেই। গির্জায় স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি বসার রেয়াজ, ম্যাগির স্বামী পাদ্রী, তিনি হয়তো স্টেজের যবনিকার ওপারে আজকের হিতোপদেশের মহড়া দিচ্ছেন, কিন্তু সুজানের স্বামীর খবর নেই কেন? আরাধনা-অনুষ্ঠান শুরু হতে এখনো কিছুটা বাঁকি, সবাই গল্প করছে, কুশল বিনিময় করছে। পিছনের বেঞ্চগুলো প্রায় ফাঁকা। কিছুক্ষন এদিক ওদিক তাকিয়ে কেভিন একেবারে পিছনের এক বেঞ্চে এসে বসলো। সামনে যেয়ে সুজান এবং ক্যারোলের পাশে বসতে ইচ্ছে করছিলো, কিন্তু সাহস হলো না। এতো সব উৎসুক ধর্মানুরাগী মানুষের মাঝে নিজেকে বড় বেমামান মনে হচ্ছিলো। ও যে আসবে তা পাদ্রী সাহেবকে আগাম জানিয়েছিল, গির্জার মাসিক চাঁদার এক’শ ডলারের চেকটা পকেট থেকে উনার কাছে হস্তান্তর করতে হবে।
কেভিন হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। সুজানের স্বামী কোথায় থাকে? নিজের স্ত্রীর সাথে দেখা করতে, নিজের ছেলেকে লাঞ্চ করতে নিয়ে যেতে এপয়েন্টমেন্টের দরকার হবে কেন?
ক্যারোল বারে বারে পিছনে ফিরে তাকাচ্ছিলো, যেন কাউকে খুঁজছে। কেভিনের দেখা মিলতেই ও একছুটে পিছনে চলে আসলো। ‘তোমাকেই খুঁজছিলাম, বাবা বলেছিলেন তুমি আজ আসবে, মা বলেছে তোমাকে পাকড়াও করে নিয়ে যেতে। চলো, আমাদের সাথে বসবে।’ হাত ধরে টানতে টানতে কেভিনকে ম্যাগির সামনে হাজির করলো। ‘তোমার তো এখানে পরিচিত কেউ নেই, আমাদের সাথেই বস না বাবা, ‘ম্যাগি বললো। সুজান কোনো কথা না বলে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে শুধু একবার কেভিনের দিকে ফিরে তাকালো। ও কি কেভিনকে দেখে বিরক্ত হচ্ছে? সুজানের স্বামীকে কেন কখনো সুজানের সাথে দেখা যায় না তা নিয়ে কেভিনের মনে দারুন কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে।
উপাসনার কাজ শুরু হয়ে গেলো। পাদ্রী সাহেব বাইবেল হাতে স্টেজে হাজির হয়ে কথা বলা শুরু করলেন, ‘‘আজকের বিষয় বাইবেলের ‘সার্মন অন দ্য মাউন্ট’ অধ্যায়। তবে তার আগে এক নতুন অতিথির সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। ওর নাম কেভিন, ওই যে সামনের বেঞ্চে ম্যাগি এবং ক্যারোলের পাশে বসে আছে। সম্প্রতি এখানকার হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছে, UCLA এর মতো নামি ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করা কোনো শিক্ষক এর আগে আমরা কখনো পাইনি।’’ গির্জার ভিতরে একটা মৃদু আলাপন শুরু হলো। সবাই কেভিনকে প্রীতিসম্ভাষণ জানাচ্ছে, করতালি দিচ্ছে, ক্যারোল পাশ থেকে কেভিনের পিঠে চিমটি কাটলো। অনিচ্ছা সত্বেও কেভিনকে উঠে দাঁড়িয়ে হাতজোড় করে অভিবাদন গ্রহণ করতে হলো।
আরাধনা অনুষ্ঠান শেষ হবার পরে বাড়ি ফেরার পালা। কেভিনের হাতটি জাপ্টে ধরে ক্যারোল বললো, ‘তোমাকে কোথাও যেতে দিচ্ছি না, আজ আমাদের সাথে লাঞ্চ করবে। তোমার সাথে UCLA নিয়ে অনেক কথা আছে’। ক্যারোলের মা-বাবা হাসি মুখে চেয়ে আছেন, যেন এই নতুন অতিথিকে নীরবে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।
‘সুজান, তুমিও আমাদের সাথে চলো না কেন, সবাই মিলে আড্ডা দেয়া যাবে!’ ম্যাগি বললো।
‘না, আজকে তো তার কোনো উপায় নেই,’ সুজান উত্তর দিলো, ‘আজ জেসির বাবা দুই ঘন্টার জন্যে জেসিকে লাঞ্চ করতে নিয়ে যাবে। আগে থেকেই এপয়েন্টমেন্ট করা আছে।’
কেভিন হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। সুজানের স্বামী কোথায় থাকে? নিজের স্ত্রীর সাথে দেখা করতে, নিজের ছেলেকে লাঞ্চ করতে নিয়ে যেতে এপয়েন্টমেন্টের দরকার হবে কেন?