
বছর বদলায়, কিন্তু দিন বদলায় না! বিশ্বব্যাপী নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের এমন হাহাকার আর দীর্ঘশ্বাস নিয়েই ফুরোল ২০২৩। যাকে নিয়ে লিখতে গেলে কলম ডোবাতে হয় হৃদয়হীনতার গভীরে। তাই তো কার্ল মার্ক্সের দর্শনে এথিক্স-এর স্থানাঙ্ক কী, এই বহুবিতর্কিত প্রশ্নের উত্তর খুজঁতে হবে নতুন বছরেও। তবে মানুষের ভুলে যাওয়া আর ভুলে থাকার ক্ষমতা অসাধারণ। মানুষকে বেঁচে থাকার জন্যই ভুলে থাকতে হয়। আর ক্রিয়াকে মনে করা হয় ভুলে থাকার অন্যতম মাধ্যম। এই ক্রিয়ার প্রধান পণ্যগুলোর একটি হলো ক্রিকেট। আজ আমরা জানব ক্রিকেটের অন্যতম ব্র্যান্ড ইকুইটি অষ্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার ডেভিড ওয়ার্নারের কথা।
৯০ দশকের মাঝামাঝি থেকে পরের এক দশক পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার মারকুটে ওপেনার ব্যাটসম্যান অ্যাডাম গিলক্রিস্ট এবং ম্যাথু হেইডেন ছিলেন বিপক্ষ দলের বোলারদের কাছে আতঙ্কের নাম। তবে এই দুই খ্যাতিমান প্লেয়ারের অবসরের পর অস্ট্রেলিয়ার ওপেনিং জায়গাটায় একজন মারকুটে ব্যাটসম্যানের অভাব অনুভুত হয়েছিল। যদিও সেসময় অস্ট্রেলিয়ার কাছে শেন ওয়াটসনের মত একজন আক্রমাত্মক ওপেনার ছিল, কিন্তু তাকে সঙ্গ দেওয়ার মত যোগ্য কেউ সে সময় না থাকায় অস্ট্রেলিয়াকে ভুগতে হয়েছিল। সেই শূণ্যতার মধ্যেই এক সময় অস্ট্রেলিয়া খুঁজে পেল ডেভিড ওয়ার্নারকে।
সেই ওয়ার্নার ব্যাট হাতে দেড় দশক ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রাজত্ব করে অবশেষে টেস্ট এবং এক দিনের ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন। দেশের মাটি হোক কি বিদেশের মাটি, সব জায়গাতেই তিনি খেলেছেন একাধিক ম্যাচ উইনিং ইনিংস। তিনি ক্রিজে এলেই চাপ বাড়তো বিপক্ষ দলের বোলারদের। তিনি শুধু ব্যাটার নন, ছিলেন এক আতঙ্ক। পাকিস্তানের বিপক্ষে জীবনের শেষ টেস্ট ম্যাচ খেলতে নামার আগেই নতুন বছরের প্রথম দিন এক দিনের ক্রিকেটকে বিদায় বলে দিলেন অস্ট্রেলিয়ার দু’বারের বিশ্বকাপ জয়ী এই ক্রিকেটার। তবে এটাও জানিয়েছেন, ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে যদি তাঁকে দরকার হয় তাহলে আগামী দিনে সিদ্ধান্ত ভেবে দেখতে পারেন।
ওয়ার্নার জানান, ভারতে বিশ্বকাপ জেতার আগে থেকেই এক দিনের ক্রিকেট ছাড়ার কথা ভাবছিলেন। তিনি বলেছেন, “পরিবারকে এ বার সময় দেওয়া দরকার। সেই কারণেই এক দিনের ক্রিকেট থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বিশ্বকাপের মাঝেই এই কথা এক বার বলেছিলাম। ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপ যেটা দুর্দান্ত কৃতিত্ব। তাই এক দিনের ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে বিভিন্ন দেশের টি২০ লিগে খেলার উপর মনোযোগ দিতে চাই। আমাদের এক দিনের ক্রিকেট দলেরও এ বার এগিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে।”
সেই ওয়ার্নার ব্যাট হাতে দেড় দশক ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রাজত্ব করে অবশেষে টেস্ট এবং এক দিনের ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেন। দেশের মাটি হোক কি বিদেশের মাটি, সব জায়গাতেই তিনি খেলেছেন একাধিক ম্যাচ উইনিং ইনিংস। তিনি ক্রিজে এলেই চাপ বাড়তো বিপক্ষ দলের বোলারদের। তিনি শুধু ব্যাটার নন, ছিলেন এক আতঙ্ক
ওয়ার্নারের শারীরিক উচ্চতা ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি; যেটা অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়দের গড় উচ্চতার চেয়ে অনেক কম। কিন্তু এই কম উচ্চতা তার ক্রিকেট প্রতিভা বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারেনি। ক্রিকেটে ওয়ার্নারের অবদানের কারণে ওয়ার্নারকে পকেট ডায়নামাইট বলা হয়। ওয়ার্নারের অসাধারণ প্রতিভাকে মূল্য দিতে গিয়ে অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের ১৩২ বছরের ইতিহাসে যেটা কখনো দেখা যায়নি সেটাই দেখা গেল। ওয়ার্নারই প্রথম খেলোয়াড় যে কোনো ধরণের প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট না খেলেই জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন।
ওয়ার্নারের বাবা হাবার্ড ওয়ার্নার ছিলেন এক কারখানার শ্রমিক। বাবার অর্থনৈতিক দৈন্যতার কারণে ওয়ার্নারের শৈশব খুব বেশি সুখের ছিল না। ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা থাকার কারণে ওয়ার্নারের পরিবার কষ্ট করে তাকে ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করিয়ে দেয়। সাপ্তাহিক বন্ধের দিনগুলোতে ওয়ার্নার পত্রিকা বিলির কাজ করত পরিবারকে সহযোগিতা করার জন্য। ছোট থেকেই ওয়ার্নার আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের ভক্ত ছিলেন, কিন্তু সেই আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করতে গিয়ে ওয়ার্নার বারবার বল বাতাসে ভাসিয়ে মারতে গিয়ে আউট হয়ে যেতেন। যেটা দেখে তার কোচ তাকে বাঁ হাতের পরিবর্তে ডান হাতে ব্যাটিং করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু ওয়ার্নারের মা তাকে বললেন, সে যেহেতু বাঁ হাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে সেহেতু সে যেন বাঁ হাতেই ব্যাটিং করে। মায়ের কথা অনুযায়ী বাঁ হাতে ব্যাটিং করেই আজ বিশ্ব জয় করেছেন ওয়ার্নার।
১৯৮৬ সালের ২৭ অক্টোবর অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের প্যাডিংটনে জন্মগ্রহণ করেন ওয়ার্নার। শৈশব থেকেই ক্রিকেটের প্রতি খুব আগ্রহী ছিলেন ওয়ার্নার। সিডনি কোস্টাল ক্রিকেটের হয় অনূর্ধ্ব ১৬ ক্রিকেটে সর্বাধিক রান করলে নির্বাচকদের দৃষ্টি পরে ওয়ার্নারের ওপর। এরপর অস্ট্রেলীয়া অনূর্ধ্ব ১৯-এর হয়ে শ্রীলংকা এবং ভারত সফরে ভালো করলে প্রথম-শ্রেণীর ম্যাচ না খেলার পরও অস্ট্রেলিয়া জাতীয় ক্রিকেট দলে ডাক পান তিনি। এবং ১১ জানুয়ারী ২০০৯ মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেট দলের বিরুদ্ধে টি-টোয়েন্টিতে তার আন্তর্জাতিক অভিষেক ঘটে। ওয়ার্নার তার প্রথম আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচে ৪৩ বলে দুর্দান্ত ৮৯ রান করে দিয়ে রাখেন নিজের আগমনী বার্তা।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধান কোচ অ্যান্ড্রু ম্যাকডোনাল্ড জানিয়েছেন, তিনি সম্ভববত আমাদের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার। তঁর না থাকাটা আমাদের কাছে একটা বড়সড় লোকসান হবে। একটা সময় বহু ব্যক্তিই তাঁকে নিয়ে নানান সমালোচনা করেছেন। কিন্তু দলের অন্দরে আমরা দেখতে পেয়েছি তাঁর মূল্য কতটা এবং তিনি কী করেছেন দলের জন্য। সেই কারণেই তাঁকে সবসময় দলে রাখার চেষ্টা করে গিয়েছি। এক দিনের এবং টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবসর ঘোষণা করেছেন ডেভিড ওয়ার্নার। দেশের হয়ে খেলবেন শুধু ২০ ওভারের ক্রিকেট। আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে চান অস্ট্রেলিয়ার হয়ে। এর মধ্যেই অবসরজীবন নিয়ে পরিকল্পনা করে ফেলেছেন ওয়ার্নার। ভবিষ্যতে কোচিংয়ে আসার ইচ্ছা রয়েছে বাঁহাতি ওপেনিং ব্যাটারের। একটি সাক্ষাৎকারে ওয়ার্নারের কাছে আগামী দিনের পরিকল্পনা জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেছেন, ‘‘আমার কিছু লক্ষ্য রয়েছে। হয়তো কোচিং করাব। তবে প্রথমে স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলব। যদি কিছু দিন পর অনুমতি পাই, তা হলেই কোচিং করাব।’’ তিনি আরও বলেছেন, ‘‘হয়তো এখনি নয়। পাঁচ বা ১০ বছর পর কোচিং করাতে শুরু করব। তখন হয়তো ক্রিকেটের সব কিছু আরও বদলে যাবে। সব কিছুই হয়ে যাবে জয় কেন্দ্রীক। ব্যাটারকে আহত করার কথা হয়তো তখন আর কেউ ভাববে না।’’
টি টুয়েন্টির যুগে টেষ্ট আর ওয়ান ডে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা আজ না-ও থাকতে পারে, কিন্তু এখনও উপমহদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। আর আইসিসি চেষ্টা করছে কীভাবে এই জনপ্রিয়তাকে নব-নব অ্যাড্রিনালিন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা যায়। আইসিসি যে থিওরেটিক্যাল ক্লাস করে থাকেন, ওয়ার্নরের মতো খেলোয়াড়রাই নিয়ে থাকেন তার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস, পপুলার ফরমেটে
বিশ্বকাপ ফাইনালই দেশের হয়ে ওয়ার্নারের খেলা শেষ এক দিনের ম্যাচ। ৩৭ বছরের এই ক্রিকেটার ১৬১টি এক দিনের ম্যাচে ৪৫.৩০ গড়ে ৬৯৩২ রান করেছেন। এর মধ্যে ২২টি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন তিনি। এই ফর্ম্যাটে তাঁর সর্বোচ্চ স্কোর হল ১৭৯ রান। এছাড়াও তিনি ৭৩৩টি চার ও ১৩০টি ছক্কা মেরেছেন। এক দিনের ফরম্যাটে অস্ট্রেলিয়ার ষষ্ঠ সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হিসেবে কেরিয়ার শেষ করছেন তিনি। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরি হাঁকানোর রেকর্ডটি সাবেক ক্রিকেটার রিকি পন্টিংয়ের। তিনি ২৯টি সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছিলেন। শতরানের তালিকায় রিকি পন্টিংয়ের পরেই রয়েছেন ওয়ার্নার। মাস্টার ব্লাস্টার সচিন তেন্ডুলকর ও রোহিত শর্মার মত ওয়ার্নারও বিশ্বকাপে করেছেন ৮টি শতরান।
আর ৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের বিপক্ষে শেষ হওয়া সিডনি টেস্ট দিয়ে এ সংস্করণকেও বিদায় বলেছেন অস্ট্রেলিয়ার উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান। বিদায়বেলায় কম অভিনন্দন পাচ্ছেন না ডেভিড ওয়ার্নার। সতীর্থ, প্রতিপক্ষ, ক্রিকেট কিংবদন্তিরা দারুণ এক ক্যারিয়ারের জন্য অভিনন্দন জানাচ্ছেন ওয়ার্নারকে। ওয়ার্নারের টেস্ট রেকর্ড প্রায় সবারই জানা। ১১২ ম্যাচে ২০৫ ইনিংসে ৪৪.৫৯ গড়ে ৮৭৮৬ রান। ২৬ শতক ও ৩৭টি অর্ধশতক। অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট ইতিহাসে রানের হিসাবে পঞ্চম ওয়ার্নার। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার ওপেনারদের মধ্যে আর কেউ টেস্টে ওয়ার্নারের মতো এত রান করতে পারেননি।
তবে ওয়ানডে এবং টেষ্টকে বিদায় বললেও আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলা চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন ওয়ার্নার। একই সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোতে নিজেকে সরব রাখতে চান এই অজি ক্রিকেটার। আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে চান অস্ট্রেলিয়ার হয়ে। ১৫ বছরের ক্যারিয়ারে দুটি বিশ্বকাপ জিতেছেন তিনি। সবশেষ ২০২৩ সালের বিশ্বকাপ জয়ে দারুণ অবদান রেখেছেন ওয়ার্নার। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহ করেছেন তিনি। ১১ ম্যাচে ওয়ার্নার করেছেন ৫৩৫ রান। এর মধ্যে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৬৩ রানের এক দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছেন তিনি। এছাড়া, ওডিআই ক্রিকেটে এক ক্যালেন্ডার বছরে সর্বোচ্চ ৭টি সেঞ্চুরি করা দ্বিতীয় খেলোয়াড় তিনি।
টি টুয়েন্টির যুগে টেষ্ট আর ওয়ান ডে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা আজ না-ও থাকতে পারে, কিন্তু এখনও উপমহদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। আর আইসিসি চেষ্টা করছে কীভাবে এই জনপ্রিয়তাকে নব-নব অ্যাড্রিনালিন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা যায়। আইসিসি যে থিওরেটিক্যাল ক্লাস করে থাকেন, ওয়ার্নরের মতো খেলোয়াড়রাই নিয়ে থাকেন তার প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস, পপুলার ফরমেটে।