Author Picture

জাতি ও শ্রেণি প্রশ্নে চিন্তা ও দুশ্চিন্তা: উপমহাদেশে, বাংলাদেশে (পর্ব-৬)

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

এখান থেকে আমরা জাতি ও শ্রেণী প্রশ্নে সমাজতন্ত্রীদের ভূমিকাটাকে আরও একটু কাছে গিয়ে দেখতে চেষ্টা করবো। তাঁদের ভূমিকাই প্রধান হতে পারতো, এবং তেমনটা ঘটলে উপমহাদেশের ইতিহাস ভিন্ন ভাবে লেখা হতো। সেটা ঘটে নি। কারণ অনেক। যেমন ভেতরের তেমনি বাইরের। বাইরে থেকে তাদের ওপর সরকার ও সরকারবিরোধী উভয় পক্ষের ছিল সমান ক্রোধ, কারণ তারা ব্যক্তিমালিকানায় নয় বিশ্বাস করে সামাজিক মালিকানায়। ব্রিটিশের রাষ্ট্র তাদেরকে অঙ্কুরে বিনাশ করতে চেয়েছে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই ছিল কমিউনিস্টবিরোধী। আবুল হাশিম মোটেই কমিউনিস্ট ছিলেন না, ছিলেন ইসলামপন্থী; তাঁকেও ছদ্মবেশী কমিউনিস্ট বলা হতো। পার্টিকে নিষিদ্ধ করার আগেও ‘কমিউনিস্ট বলে সন্দেহ হলেই গ্রেপ্তার করো’ এই নিয়ম চালু ছিল। কোনো গোলযোগ দেখা দিলেই বলা হতো কমিউনিস্টরা দায়ী। একুশে ফেব্রুয়ারীর ঘটনা কমিউনিস্টরা ঘটিয়েছে বলে প্রচার করে নূরুল আমিন আশা করেছিল যে পূর্ববঙ্গবাসী আন্দোলনকে প্রত্যাখ্যান করবে। করাচীর শাসকেরা সে সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানকেও কমিউনিস্ট বলে সন্দেহ করতো।৩৮

এর পাশাপাশি ভেতরের দুর্বলতা ছিল আরও ক্ষতিকর। এই দুর্বলতার মূল উৎস পার্টির পেটি বুর্জোয়া চরিত্র। পেটি বুর্জোয়ারাই পার্টি গঠন ও পরিচালনা করেছেন। শুরুতেই পার্টির ওপর ওই শ্রেণীর চরিত্রটা সংক্রমিত হয়েছিল, পরেও তা রয়ে গেছে। পেটি বুর্জোয়ারাই যে পার্টি তৈরীর দায়িত্ব নেবে সেটাই ছিল স্বাভাবিক। তারাই ছিল অগ্রসর, কিন্তু তাদের শ্রেণীচরিত্রে দু’টি বিশেষ দুর্বলতা ছিল, একটি পরাধীনতাজনিত, অপরটি নিজেদের অর্থনৈতিক পশ্চৎপদতা-উৎসারিত। পরাধীনতা মেরুদ-কে দুর্বল করে দেয়, পরের ওপর নির্ভরতা বাড়ায়। পেটি বুর্জোয়াদের মেরুদ- এমনিতেই শক্ত নয়, পরাধীনতা মেরুদ-কে আরও নরম করে দিয়েছে।

পরাধীন বাংলার পেটি বুর্জোয়ারাই কমিউনিস্ট পার্টি গঠনে উদ্যোগ নিয়েছেন। ওদিকে আবার সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্তবাদী শোষণের কারণে বাংলা তখন অত্যন্ত পশ্চাৎপদ। প্রধান উদ্যোক্তা মুজফ্ফর আহমদের জন্য কলকাতায় কোনো থাকার জায়গা ছিল না, উপার্জন করতে হতো ছোটখাটো কাজ করে, এমনও দিন গেছে যখন তাঁকে রাত কাটাতে হয়েছে ছাত্রের বসবার ঘরে। তাঁর সহযোদ্ধা ছিলেন আবদুল হালীম। তাঁরও থাকার জায়গা ছিল না। আবদুল হালীম অল্প বয়সে যোগ দিয়েছিলেন অসহযোগ-খেলাফত আন্দোলনে, জেলও খেটেছেন, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ পান নি। সে-সময়ে মার্কসবাদী সাহিত্য পাওয়াই যেত না, দু’একটা এলে কেনবার জন্য যৎসামান্য টাকা সংগ্রহ করাটাও কঠিন ছিল। অপুষ্টিতে মুজফ্ফর আহমদ যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর ভেতরে থেকেও তাঁরা যে মার্কসবাদী হতে পেরেছিলেন সেখানেই তাঁদের অসামান্যতা। মার্কসবাদীরা বুর্জোয়াদেরকে হারিয়ে দেয় দু’টি বিশেষ ক্ষেত্রে- একটি জ্ঞান অপরটি নৈতিকতা। ভারতীয় মার্কসবাদীরা জ্ঞানের দিক থেকে বুর্জোয়াদের ছাড়িয়ে যাবার ব্যাপারে সুবিধা করতে পারেন নি।

পার্টিকে নিষিদ্ধ করার আগেও ‘কমিউনিস্ট বলে সন্দেহ হলেই গ্রেপ্তার করো’ এই নিয়ম চালু ছিল। কোনো গোলযোগ দেখা দিলেই বলা হতো কমিউনিস্টরা দায়ী। একুশে ফেব্রুয়ারীর ঘটনা কমিউনিস্টরা ঘটিয়েছে বলে প্রচার করে নূরুল আমিন আশা করেছিল যে পূর্ববঙ্গবাসী আন্দোলনকে প্রত্যাখ্যান করবে। করাচীর শাসকেরা সে সময়ে শেখ মুজিবুর রহমানকেও কমিউনিস্ট বলে সন্দেহ করতো।

তবে তাঁদের নৈতিকতা অবশ্যই বুর্জোয়াদের তুলনায় অনেক অনেক উন্নত ছিল, কিন্তু সেখানে আবার পেটি বুর্জোয়া সঙ্কীর্ণতাও ছিল। মুজফ্ফর আহমদের আত্মজৈবনিক বইটিতে দেখা যায় যে তিনি উদ্দীপনা সৃষ্টি এবং বৈজ্ঞানিক শ্রেণী ও সমাজ বিশ্লেষণে তেমন আগ্রহী নন, খুব বেশী আগ্রহী তিনি, বলা যায় খুঁতখুঁতেই, সাল তারিখে খুটিনাটি, শব্দের বানান ও ব্যক্তির পরিচয় দানের ব্যাপারে। ঘটনা পর্যন্ত আসেন; তার চেয়ে বিস্তৃত এলাকায় যান না। এই সঙ্কীর্ণতা, এভাবে ছোট জায়গায় আটকে থাকা, আন্তর্জাতিক হয়েও না-হওয়া, এটা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির একটি ব্যাধি ছিল। শুরুতে ভারতের বাইরে দুই কর্মকেন্দ্র মস্কো ও বার্লিনে অবস্থানকারী মার্কসবাদী নেতাদের এক হতে না-পারা সম্পর্কে বলতে গিয়ে মুজফ্ফর আহমদ লিখছেন, “দশজন ফকীর একখানা চাদর পেতে তার ওপরে ঘুমুতে পারেন, কিন্তু দু’জন বাদশাহের জায়গা এক দেশে কি করে হতে পারে?”৩৯ হয় না। তবে দশজন ফকির কিন্তু আবার বাদশাহদের মতোই একে অপরের নিকৃষ্টতম শত্রু হয়ে দাঁড়ায়, যদি কেউ দানখয়রাত করতে আসে। ফকির তখন পেটি বুর্জোয়া হয়ে পড়ে। মুজফ্ফর আহমদের স্মৃতিচারণ পেটি বুর্জোয়া নেতৃত্বের যে ব্যক্তিগত কলহের খবর পাই সেগুলো সংগঠনের বিপ্লবী চরিত্র গ্রহণের পক্ষে অবশ্যই প্রতিবন্ধক ছিল।

আর ছিল পরনির্ভরতা। পার্টির প্রতিষ্ঠা ১৯২০ সালে, দেশে নয় দেশের বাইরে, সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থন ও অর্থানুকূল্যে। তখন থেকেই এর যে বিদেশনির্ভরতা শুরু পরে তা থেকে আর মুক্তি ঘটে নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণের পরে এই নির্ভরতা চরম ও সর্বাধিক ক্ষতিকর রূপ ধারণ করে। সমাজতন্ত্রের পিতৃভূমি রক্ষা করার জন্য অবস্থান নিতে গিয়ে শত্রুর শত্রু অতএব মিত্র এই নীতির কবলে পড়ে কমিউনিস্ট পার্টি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতি নমনীয় নীতি গ্রহণ করে। দেশে যখন ব্রিটিশবিরোধিতা ক্রমশ চরম আকার ধারণ করছে তখনই ঘটল এই ঘটনা, ফলে ‘জনযুদ্ধে’র আওয়াজ দিতে দিতে কমিউনিস্ট পার্টি অনেকটাই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো। সেটা কাটিয়ে ওঠা সহজ হয় নি। পরবর্তীতে চীন-রাশিয়া বিরোধের সময় পার্টি দ্বিখ- হয়ে যায়। ১৯৬০-এর দশকে সশস্ত্র কৃষক অভ্যুত্থানের লাইন ধরে যে নকশালবাড়ী আন্দোলনের তৎপরতা দেখা গেল সেটাও পরনির্ভরশীলতার গ-ির ভেতরেই রয়ে গেল। বাইরে যেতে পারলো না।

তাসখন্দে কমিউনিস্ট পার্টির যখন গোড়া পত্তন হচ্ছে তখন দেশের ভেতরেও কমিউনিস্ট মতাবলম্বীরা তৈরী হচ্ছিলেন। পারস্পরিক যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত খারাপ, গোয়েন্দারা কমিউনিজমের গন্ধ শুঁকে বেড়াচ্ছিল, তার ভেতরেও পেজেন্টস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টি নামে স্থানীয় ভাবে, কিন্তু আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমৃদ্ধ হয়ে একটি সংগঠন তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন। পরে এর নাম বদল করে রাখা হয় ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পেজেন্টস পার্টি। এই পরিবর্তনের তাৎপর্যটা কিন্তু উপেক্ষণীয় নয়। ভারতবর্ষের পরিপ্রেক্ষিতে মেহনতী মানুষ বলতে প্রধানত কৃষককেই বোঝাত, তারাই ছিল শতকরা ৮০ জন; তাই তাদের কাছেই যাবার কথা উঠেছিল। কিন্তু ধ্রুপদী মার্কসবাদে কৃষকের কথা যেহেতু তেমন ভাবে বলা হয় নি, শ্রমিকদের নেতৃত্বে এবং তাদের দ্বারাই বিপ্লব সংঘটিত হবে বলে মত প্রকাশ করা হয়েছে, তাই ভারতীয় মার্কসবাদীরাও দলের নাম বদলে পেজেন্টসকে সরিয়ে দিয়ে ওয়ার্কার্সকেই প্রধান করে তুলেছেন। লেনিন কিন্তু মার্কসবাদকে তাঁর দেশের বাস্তবতায় স্থাপন করে কৃষককে পাশে টেনে নিয়েছিলেন, এবং সেজন্যই তাঁর দেশে বিপ্লব সম্ভব হয়েছিল। আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে মাও সে-তুঙ মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে নিজের দেশের বাস্তবতায় নিয়ে গিয়ে কৃষককেই সামনে নিয়ে এলেন। ভারতের বিপ্লবীরা তেমনটা করতে পারেন নি, শাস্ত্রের এবং সোভিয়েত-দৃষ্টান্তের ওপর অধিক নির্ভরশীলতার কারণেই।

শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখছেন যে, জেল পরিদর্শনে এসে এক ডাক্তার তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি কেন জেল খাটছেন?’ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন ‘ক্ষমতা দখল করার জন্য।’ শুনে ডাক্তার ভদ্রলোক তাঁর মুখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে তারপর বলেছেন, ‘ক্ষমতা দখল করে কি করবেন?’ শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘যদি পারি দেশের জনগণের জন্য কিছু করব। ক্ষমতায় না গিয়ে কি তা করা যায়?’

পার্টির প্রথম সংগঠক এম এন রায়ও পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীরই লোক। সেই শ্রেণীর সীমা অনেকটা পার হয়ে তিনি অসাধারণ দুঃসাহস, কষ্ট সহিষ্ণুতা ও সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন; জ্ঞানে বুদ্ধিতে তিনি বুর্জোয়াদের তুলনাতেও অধিক বুর্জোয়া ছিলেন। কিন্তু পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর লোকদের আত্মসচেতনতা, অহমিকা ও অস্থিরতা যে পরিহার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তা নয়। ফলে তিনি তাঁর নিজের-গড়া পার্টি থেকে ১৯২৯ সালেই বহিষ্কৃত হন, বহিষ্কৃত না হলে হয়তো নিজেই ছেড়ে দিতেন। পরে তিনি জাতীয়তাবাদী ধারাতে যোগ দেন, এবং আরও পরে বিপ্লবী মানবতাবাদ নামে নতুন এক মতাদর্শ প্রবর্তনে সচেষ্ট হন। অনেক বড় মাত্রায় যেন আমাদের অলি আহাদেরই পূর্বসূরী।

এম এন রায়ের বিরুদ্ধে অর্থলোলুপতারও অভিযোগ আছে।৪০ আর ছিল অনড় পিতৃতান্ত্রিকতা। মুজফ্ফর আহমদ স্মরণ করেছেন যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি যে-সাতজনকে নিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁদের ভেতর রায়ের প্রথম স্ত্রী এভেলিন ট্রেন্ট ছিলেন একজন। “জার্মানী ও প্যারিস হতে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির যে-সব সাহিত্য প্রকাশিত হয়েছে সে-সব এভেলিনের অবদানে ভরা।” কিন্তু ১৯২৫ সালেই এভেলিন রায়কে ছেড়ে চলে যান। রায় তাঁর স্মৃতিকথায় কোথাও উল্লেখ করেন নি যে এভেলিন নামে কোনো নারী কোনদিন তাঁর জীবনে এসেছিলেন।৪১
পার্টিগঠনে মাতৃহৃদয়ের সংবেদনশীলতা যে কাজ করেনি তা নয়। মাতৃহৃদয় অবশ্যই ছিল। মোহাম্মদ তোয়াহা জানাচ্ছেন যে ১৯৪৩ সালের মন্বন্তরের সময় ঢাকার একটি লঙ্গরখানায় কাজ করতে গিয়ে তিনি একটি মেয়েকে দেখেন সাদা শাড়ি পরে শানকি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে তাঁর সামনে নিজের মায়ের মুখটি ভেসে ওঠে। তিনি লিখেছেন,

অতিকষ্টে আমি কোনো মতে নিজেকে সামলিয়ে নিলাম। হলে ফিরে সারারাত্রি আমার ঘুম হয় নি। পেটের দায়ে মায়েরা ফের ঘরছাড়া হলো? এর প্রতিকারের পথ কী? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়ে আমিও ঘরছাড়া হলাম, সেই পথের সন্ধানে। সেই পথের সন্ধান পেলাম- সমাজতন্ত্রের পথ সেই পথ।৪১ক

তবে নেতৃত্বের চরিত্রে যে পিতৃতান্ত্রিকতা ছিল তাতে সন্দেহ নেই। না-থেকে উপায়ও ছিল না। প্রথম কারণ পেটি বুর্জোয়াদের স্বভাবের ভেতর পিতৃতান্ত্রিকতা থাকে। দ্বিতীয় কারণ পার্টিকে কাজ করতে হয়েছে গোপনে, বিরূপ পরিবেশে, শৃঙ্খলার সঙ্গে। মাতৃহৃদয়ের চর্চার সুযোগ ছিল সীমিত। ফলে পার্টির কর্মীরা জনগণের কাছে গেছেন, সঙ্গে থেকেছেন, নিজেদের পারিবারিক জীবন ছেড়ে চলে এসেছেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারেন নি। আত্মত্যাগ সত্ত্বেও তাঁদের ধরনটা ছিল শিক্ষকের; পিতার মতো, মা-বোনের মতো নয়, সহযোদ্ধারও নয়।

ওদিকে আবার ছিল বুর্জোয়াদেরকে পেছনে না রেখে তাদের পেছনে পেছনে থাকার প্রবণতা। কমিউনিস্টরা সংগ্রাম করবে, আত্মত্যাগ করবে, কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে না, এমনটাই ছিল মনোভাব। রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবে কংগ্রেস ও লীগ এটাই ধরে নেওয়া হয়েছিল। সে জন্য কমিউনিস্টরা কংগ্রেস ও লীগের ঐক্য চেয়েছে, গান্ধী ও জিন্নাহর সমঝোতা কামনা করেছে, কিন্তু নিজেরা যে রাষ্ট্রক্ষমতা করতলগত করবে এমন ঘোষণা জোরগলায় দেয় নি। এ বিষয়ে জাতীয়তাবাদীদের অবস্থানটা কিন্তু ছিল পরিষ্কার, তারা রাজনীতি করেছে ক্ষমতায় যাবার জন্য। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখছেন যে, জেল পরিদর্শনে এসে এক ডাক্তার তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি কেন জেল খাটছেন?’ তিনি উত্তর দিয়েছিলেন ‘ক্ষমতা দখল করার জন্য।’ শুনে ডাক্তার ভদ্রলোক তাঁর মুখের দিকে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে তারপর বলেছেন, ‘ক্ষমতা দখল করে কি করবেন?’ শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, ‘যদি পারি দেশের জনগণের জন্য কিছু করব। ক্ষমতায় না গিয়ে কি তা করা যায়?’৪২ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার কথাটা কমিউনিস্টদেরও বলা দরকার ছিল, যদিও তাদেরকে বলতে হতো, ‘রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে আমরা সেটাই করতে চেষ্টা করবো অক্টোবর বিপ্লবের পরে লেনিন যা করেছিলেন, অর্থাৎ পুরাতন রাষ্ট্র আমরা রাখবো না, তাকে ভেঙে ফেলে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটাবো, এবং ক্ষমতা পৌঁছে দেব জনগণের কাছে।’ সেটা তাঁরা বলেন নি। সাধারণ মানুষ ভেবেছে এঁরা লোক ভালো, খুবই সৎ ও ত্যাগী কিন্তু রাষ্ট্র চালানো সোজা কাজ নয়, এরা পারবে না, রাষ্ট্র চালাবে ওই জাতীয়তাবাদীরাই। ব্রিটিশ আমলে একটা আওয়াজ শোনা যেত, ‘ভাত-কাপড়াকে লিয়ে কমিউনিস্ট, আজাদীকে লিয়ে কংগ্রেস।’ মর্মার্থটা এই যে রাষ্ট্রক্ষমতা থাকবে দেশের বড় বড় সাহেবদের কাছে, আর কমিউনিস্টরা লড়াই করবে মানুষের ভাত-কাপড়ের জন্য; কমিউনিস্টরা যে দেশ স্বাধীন করবে এমন আস্থা কমিউনিস্টরা সে-সময়ে সৃষ্টি করতে পারে নি।

পার্টির প্রথম সংগঠক এম এন রায়ও পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীরই লোক। সেই শ্রেণীর সীমা অনেকটা পার হয়ে তিনি অসাধারণ দুঃসাহস, কষ্ট সহিষ্ণুতা ও সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন; জ্ঞানে বুদ্ধিতে তিনি বুর্জোয়াদের তুলনাতেও অধিক বুর্জোয়া ছিলেন। কিন্তু পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর লোকদের আত্মসচেতনতা, অহমিকা ও অস্থিরতা যে পরিহার করতে সক্ষম হয়েছিলেন, তা নয়। ফলে তিনি তাঁর নিজের-গড়া পার্টি থেকে ১৯২৯ সালেই বহিষ্কৃত হন, বহিষ্কৃত না হলে হয়তো নিজেই ছেড়ে দিতেন।

তেভাগা আন্দোলন হয়েছে, আন্দোলন হয়েছে তেলেঙ্গানাতে, কিন্তু সেগুলো স্থানীয় লড়াই, এবং তার ভেতর দিয়ে যে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা যাবে এমন সম্ভাবনা ছিল না। ব্রিটিশ শাসকেরা চলে গেল স্থানীয় জাতীয়তাবাদীদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিয়ে। কিছুই করতে না-পারার ব্যর্থতার বোধ থেকে কমিউনিস্ট পার্টি এবার আওয়াজ তুলল সশস্ত্র শ্রেণী সংগ্রামের, বলল ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়।’ তাঁদের ইস্তেহারে স্বীকার করা হলো যে ব্রিটিশ শাসনের কালে পার্টি পেটি বুর্জোয়া শ্রেণীর ওপর ভরসা করে ভুল করেছিল, তাঁদের পক্ষে আরও বেশী করে যাওয়া উচিত ছিল শ্রমিক, ক্ষেতমজুর ও গরীব কৃষকের কাছে। তা না করে পার্টি ‘বুর্জোয়া শ্রেণীর লেজুড়’ হয়ে পড়েছিল, মার্কসবাদ-লেনিনবাদের চর্চার অভাবের দরুন পার্টি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের দিকে নেমে গিয়েছিল।৪৩

কিন্তু সেই সময়ে সশস্ত্র বিপ্লবের এই লাইন কার্যকর করার তো উপায় ছিল না। প্রথমত, ব্রিটিশের বিদায় এবং ক্ষমতা হস্তান্তরকে স্বাধীনতা বলে হৈ হৈ প্রচারের প্রভাব জনসাধারণের ওপর গিয়ে পড়েছিল। তারা শ্রেণী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বার অবস্থায় ছিল না। পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীরা উৎফুল্ল ছিল উন্নতির রাস্তা খুলে গেছে মনে করে। দ্বিতীয়ত, দেশভাগ হওয়াতে পার্টি নিজেও বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। পূর্ববঙ্গের দিকেই তাকানো যাক। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য সংখ্যা বার হাজার থেকে নেমে এসে দাঁড়িয়েছিল দুই শ’তে। নেতারা ছিলেন হয় জেলে নয়তো আত্মগোপনে। সদস্যরা অনেকেই বাধ্য হয়েছেন দেশত্যাগে। সর্বোপরি, বিরোধী-দমনে, বিশেষ করে কমিউনিস্ট নির্মূলে, নতুন শাসকশ্রেণী ছিল ব্রিটিশ শাসকদের চাইতেও নৃশংস।

গরম লাইন ব্যর্থ হলো, প্রতিক্রিয়ায় ফল দাঁড়ালো নরমের চেয়েও নরম লাইনে প্রত্যাবর্তন। পূর্ববঙ্গে ১৯৫৪-র নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি আবারও চলে গেল বুর্জোয়া নির্ভরশীলতার দিকে। তাঁরা চাপ দিয়েছিল হক-ভাসানী সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট গঠনের। যুক্তফ্রন্ট গঠিত হলো, কিন্তু একেবারে প্রথম ফলটাই দাঁড়ালো রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে মৌলবাদী নেজামে ইসলামের আত্মপ্রকাশ এবং তাদের আবদারে যুক্তফ্রন্ট থেকে কমিউনিস্ট পার্টিকে বাদ দেওয়া। নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি অবধারিতই ছিল, মাঝখান থেকে ক্ষতিটা হলো কমিউনিস্টদের।

এরপরে কমিউনিস্ট পার্টি মস্কো-পিকিং-এ ভাগ হয়ে গেছে। মস্কোপন্থীরা ঝুঁকেছে আওয়ামী লীগের দিকে, আর পিকিংপন্থীরা বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত হয়ে গেছে। শ্রেণী প্রশ্নের মীমাংসার জন্যই যে জাতিপ্রশ্ন মীমাংসা করাটা অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়েছিল তাদের একাংশ সেটা অনুধাবনে অসমর্থ হওয়ার দরুন কার্যকর রাজনৈতিক ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলো। একাত্তরের যুদ্ধে মস্কোপন্থীরা মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিলে মিশে যুদ্ধ করতে চেয়েছে, কিন্তু তাদেরকে সঙ্গে নেওয়া হয় নি। মধ্যস্থতার জন্য অনুরোধ জানাতে মণি সিংহের নেতৃত্বে পাঁচজন নেতা দিল্লীতে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করেছিলেন।৪৪ কিন্তু তাতেও সুফল পাওয়া যায় নি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পিকিংপন্থীরা আর দৃশ্যমান থাকে নি। তাদের নেতাদের কেউ কেউ কারাগারে চলে যান, কর্মীদের মধ্য থেকে অনেকেই রক্ষীবাহিনীর হাতে নিহত হন। মস্কোপন্থীরা তৎপর হয়ে পড়েন সরকারের সাথে মিলে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট গঠনে। ওদিকে হাজার হাজার তরুণ, যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছে এবং হানাদারদের নৃশংসতা দেখেছে, তারা অস্থির হয়ে উঠেছিল সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবার সংগ্রামে যুক্ত হবার জন্য। কমিউনিস্ট পার্টিকে সামনে পেলে তারা তাতেই যোগ দিত। মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিই তখন দৃশ্যমান; কিন্তু তারা তরুণদেরকে ডেকে নেওয়ার পরিবর্তে নিজেরাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল আওয়ামী লীগের ভেতরে জাতীয় বুর্জোয়াদের খোঁজ পাওয়া যাবে এই দুরন্ত আশা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐক্য জোট গঠনে। এই ফাঁকে মুজিব বাহিনীর একাংশ ক্ষমতার অংশ পাওয়া-থেকে-বঞ্চিত হচ্ছে দেখতে পেয়ে নিজেদের শক্তিপ্রদর্শন করে বঙ্গবন্ধুর কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠার আকাক্সক্ষায় ময়দানে চলে এলো, এবং উপযুক্ত শ্লোগানের প্রয়োজনে কমিউনিস্টদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আওয়াজটি গলায় তুলে নিলো। একাত্তরের পরে চাঞ্চল্যকর ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলোর মধ্যে এটিও একটি। তরুণরা তখন স্রোতের মতো যোগ দিয়েছে মুজিববাদীদের ছদ্মবিপ্লবী অংশের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলে। রক্ষীবাহিনীর সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়ে দলের বহু তরুণ প্রাণ হারালো। বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল যে একটা জাতীয় রূপ দিতে চাইছিল এই ঘটনাটা আপতিক নয়। কারণ তারা জাতীয়তাবাদীই ছিল; এবং তাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী কার্যক্রম প্রমাণ করে যে সমাজতন্ত্রের জাতীয়করণের উছিলায় প্রকারান্তে তারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বিরোধিতাই করতে চাইছিল।

ওদিকে আবার নব্বই দশকের শুরুতেই সোভিয়েত ইউনিয়নের আনুষ্ঠানিক বিলুপ্তি ঘটায় মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের একাংশ প্রকাশ্যেই, ঘোষণা দিয়েই, বিলোপবাদী হয়ে পড়লো। তার আগে ১৯৭৫-এ তো গোটা পার্টি চলে গিয়েছিল বাকশালে, গোছগাছ করে। তারপরে একই ধারায় তারা জিয়াউর রহমানের খালকাটা কর্মসূচীতে এবং এরশাদের দ্বারা আয়োজিত নির্বাচনেও যোগ দিয়েছে। সাধারণ ভাবেই সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে জনমনে বিরাজমান সংশয় ও আগ্রহের অভাব পুষ্টি পেল।

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা তরুণদের জন্য উন্নতির নতুন সম্ভাবনাও তৈরী করে দিয়েছিল। এর ফলে অনেক মেধাবানই বিদেশে চলে গেল, আর ফিরে এলো না। দেশে থাকলে এরা হয়তো বামপন্থী আন্দোলনকে বেগবান করতো। ছাত্রজীবনে বামপন্থী আন্দোলনে যারা যুক্ত ছিল হতাশাগ্রস্ত ও ক্লান্ত অবস্থায় তাদের অনেকেই জাতীয়তাবাদীদের দলে গিয়ে শামিল হলো; কেউ গেল বিএনপি’তে কেউ আওয়ামী লীগে। মস্কো-পিকিং বিভাজনের সূত্রপাত ঘটেছিল প্রথমে ছাত্র ইউনিয়নে; দ্বিখ-িকরণে যে দু’জন নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এমনকি তাঁরাও, উভয়েই মিলেছেন গিয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে- অধিক অনলবর্ষী গেলেন আগে, কম অনলবর্ষী কিছুটা পরে। পেটি বুর্জোয়া আকাক্সক্ষা একবার ঘাড়ে চড়লে আর কী নামে।

সবকিছু মিলিয়ে শ্রেণীব্যবস্থায় পরিবর্তন আনবার কথা যে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সেটি শক্তিশালী হতে পারে নি। অর্থনৈতিক উন্নতিটা ঘটছে মেহনতীদের শ্রমে ও ঘামে এবং পুঁজিবাদী কায়দায়, তাই শ্রেণী বৈষম্যও বেড়েছে এবং বাড়ছে।

 

তথ্যসূত্র: 
৩৮. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত, পৃ ২৬৮
৩৯. মুজফ্ফর আহমদ, পৃ ২১৭
৪০. ঐ, পৃ ৪৭১
৪১. ঐ, পৃ ৪৭৩
৪১ক. মোহাম্মদ তোয়াহা, পৃ ৩৬
৪২. শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, প্রাগুক্ত, পৃ ১৮৪
৪৩. মোস্তাফিজুর রহমান, পৃ ২৬০-৬১
৪৪. মণি সিংহ, জীবন-সংগ্রাম, দ্বিতীয় খ-, ঢাকা, ১৯৯২, পৃ ১২৭

আরো পড়তে পারেন

আওরঙ্গজেব ও শম্ভাজির মিথ বনাম ইতিহাস: প্রসঙ্গ ছাবা চলচ্চিত্র

বর্তমানে বিজেপির সংঘ পরিবার প্রায় তিন’শ বছর আগের ভারতের এমন এক সম্রাটের কবর মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদ থেকে সরিয়ে দেয়ার আন্দোলন করছেন- যিনি ইতিহাসে ভারতকে সর্বকালের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রের মানচিত্র ও সংহতি উপহার দিয়েছিলেন, যার আয়তন ছিল চল্লিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার- যা ছিল বর্তমান ভারতের চেয়ে আট লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বড়, তাঁর অধীকৃত রাষ্ট্রটিই ভারত এখনো তারা….

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা: বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যা জানা গিয়েছে, যা জানা সম্ভব

এক মহান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের অপরিসীম আত্মত্যাগ। নানা সূত্র থেকে আমরা শুনে এসেছি ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা। অনেকেই আবার ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমন প্রশ্ন ওঠার মূলে রয়েছে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে ৭১-পরবর্তী শাসকদের উদাসীনতা। তারা এত বছরেও শহীদের সংখ্যা….

জর্জ অরওয়েলের নৌকাডুবি

১৯৪৪ সালের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে হিটলার যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে যুদ্ধে জয় পেতে। তার মরণকামড়ের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে নানা দেশের নানা শহর ও জনপদ। জার্মান বাহিনীর ভি-ওয়ান নামক উড়ন্ত যুদ্ধজাহাজগুলো মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ করেছে লন্ডন শহরে। বিমানবাহিনীর এমন দুর্দৈব তাণ্ডবে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষজন সব আশ্রয় নিচ্ছে মাটির তলার বাঙ্কারে ও পাতাল রেলের সুড়ঙ্গে। এমনই একদিন….

error: Content is protected !!