
১৯৪৪ সালের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে হিটলার যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে যুদ্ধে জয় পেতে। তার মরণকামড়ের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে নানা দেশের নানা শহর ও জনপদ। জার্মান বাহিনীর ভি-ওয়ান নামক উড়ন্ত যুদ্ধজাহাজগুলো মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ করেছে লন্ডন শহরে। বিমানবাহিনীর এমন দুর্দৈব তাণ্ডবে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষজন সব আশ্রয় নিচ্ছে মাটির তলার বাঙ্কারে ও পাতাল রেলের সুড়ঙ্গে। এমনই একদিন দুর্ভাগ্যবশত যুদ্ধবিমানের কয়েকটি সেল এসে আঘাত হানল লন্ডনের ১০ নম্বর মোর্টিমার ক্রিসেন্ট রোডে অবস্থিত জর্জ অরওয়েলের এই গৃহে। ঈশ্বরের পরম মহিমা ও ভাগ্য তাদের অসম্ভব সুপ্রসন্ন ছিল বলা চলে। জর্জ অরওয়েলের সহধর্মিণী ইলেন ও পালিত পুত্র রিচার্ড এ সময় ঘরের বাইরে ছিলেন। গোলার আঘাতে পাহাড়ে ভূমিধসের মতো সম্পূর্ণ বাড়িটি পরিণত হলো ধ্বংসস্তূপে। অরওয়েল সে সময় সাহিত্যসম্পাদক হিসেবে কাজ করতেন ব্রিটিশ নিউজ পেপার ট্রিবিউন-এ। মধ্যাহ্নভোজের বিরতিতে দ্রুত বাড়ি ফিরে গৃহের এহেন অবস্থা দেখে তো তার চোখ চড়কগাছ। একি অবস্থা! ইতোমধ্যে তার স্ত্রী ও পুত্র এসে দাঁড়িয়েছেন তার পাশে। গৃহে অবস্থান করলে কী হতে পারত সেটার সম্ভাব্য ভয়াবহতার কথা ভেবে সকলেরই লোমকূপ দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অরওয়েল থরথর করে কাঁপছেন অন্য একটি কারণে। তার এত দিনের অধ্যাবসায় ও শ্রমের ফসল দ্য অ্যানিমেল ফার্ম উপন্যাসটি নিশ্চয়ই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে সেলের আঘাতে। এসব ভাবতে ভাবতে তার বুকটা হু-হু করে উঠল। জর্জ অরওয়েলের দত্তক পুত্র রিচার্ড হোরাটিও ২০১২ সালে হ্যাম অ্যান্ড হাই (Ham & High) নামক একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘সেদিন বিষাদগ্রস্ত বাবাকে দেখেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বড়ো বড়ো সব পাথরের ছাই ও ইট সরিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজছেন তার মহামূল্যবান বইয়ের পাণ্ডুলিপি। তিনি সেসব ধ্বংসস্তূপের চূর্ণগুলো দুই চাকাবিশিষ্ট হাতলওয়ালা ছোট্ট একটা ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে যেতেন অফিসে। সেখানে বসে একটা একটা ইট-পাথরের টুকরো সরিয়ে খুঁজতেন অ্যানিমেল ফার্ম-এর ম্যানুস্ক্রিপ্ট। এভাবে সমস্ত ধ্বংসস্তূপ খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে পাওয়া গেল পরবর্তীকালে জগৎ মাতানো সেই বইয়ের পাণ্ডুলিপিখানা।’
যে-কোনো উপন্যাস লেখার সময়ই কেন যেন আকস্মিক ও কাকতালীয়ভাবে জর্জ অরওয়েল পতিত হন দৈব দুর্বিপাকে। এবার তার বিখ্যাত উপন্যাস নাইনটিন এইটি ফোর লেখার সময়কার কথা। জর্জ অরওয়েলের স্ত্রী ইলিন মৃত্যুবরণ করেন ১৯৪৫ সালে। প্রিয়তমা স্ত্রীর প্রাণবিয়োগে মুষড়ে পড়েন তিনি। অন্যদিকে শরীরের ভাবগতিও বেশি ভালো নয়। ১৯৩৮ সালে শরীরে ধরা পড়েছে ক্ষয় রোগ যক্ষ্মা। জীবনের এই প্রান্তে এসে এসব তিক্ত অনুভূতিকে তুচ্ছ করে তিনি পুনরায় হাতে তুলে নিলেন কলম। লন্ডন শহর ছেড়ে পাড়ি জমালেন স্কটিশ এক দ্বীপের কুটিরে। এমনিভাবে তিনি একদিন পুত্র ও ভাগনে-ভাগনিদের নিয়ে বেরিয়েছেন প্রমোদবিহারে।
স্কটল্যান্ডের পশ্চিম উপকূলের করিভ্রেকেন সাগরে নৌবিহারে আমোদফুর্তিতে সময় বেশ ভালোই কাটাচ্ছিলেন। জর্জ অরওয়েলের কিন্তু আদৌ জানা ছিল না পৃথিবীর কুখ্যাত সব ঘূর্ণিস্রোতের অবস্থান সেই করিভ্রেকেন সমুদ্রে। বস্তুত বড়ো বড়ো ঘূর্ণিস্রোতের দিক থেকে করিভ্রেকেনের অবস্থান পৃথিবীতে তৃতীয়। তো হয়েছে কি হঠাৎ তাদের নৌকাটি সেই ঘূর্ণিস্রোতের মধ্যে পড়ে উলটে গেল। স্রোতের অতল গভীরে তলিয়ে যেতে যেতেও অলৌকিকভাবে চার জনই তারা শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন। ঐদিন যদি অরওয়েল জলে ডুবে মারা যেতেন তাহলে বোধ হয় তার বিখ্যাত উপন্যাস নাইনটিন এইটি ফোর আর কোনো দিন আলোর মুখ দেখত না। পৃথিবীর মানুষ বঞ্চিত হতো এমন একটি মাস্টারপিস উপন্যাস থেকে। এ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৯ সালে জর্জ অরওয়েলের মৃত্যুর মাত্র সাত মাস আগে।
‘সেদিন বিষাদগ্রস্ত বাবাকে দেখেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বড়ো বড়ো সব পাথরের ছাই ও ইট সরিয়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজছেন তার মহামূল্যবান বইয়ের পাণ্ডুলিপি। তিনি সেসব ধ্বংসস্তূপের চূর্ণগুলো দুই চাকাবিশিষ্ট হাতলওয়ালা ছোট্ট একটা ঠেলাগাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে যেতেন অফিসে। সেখানে বসে একটা একটা ইট-পাথরের টুকরো সরিয়ে খুঁজতেন অ্যানিমেল ফার্ম-এর ম্যানুস্ক্রিপ্ট। এভাবে সমস্ত ধ্বংসস্তূপ খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে পাওয়া গেল পরবর্তীকালে জগৎ মাতানো সেই বইয়ের পাণ্ডুলিপিখানা’
জর্জ অরওয়েলের পোশাকি নাম এরিক আর্থার ব্লেয়ার। তিনি ১৯০৩ সালের ২৫ জুন ব্রিটিশ ভারতের বিহারের মতিহারে জন্মগ্রহণ করেন। অরওয়েলের বাবা রিচার্ড ওয়ামেসলি ব্লেয়ার ইন্ডিয়ার সিভিল সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতেন ভারতে। শুধু জর্জ অরওয়েলকেই নয়, ভারত জন্ম দিয়েছিল আরও বেশ কয়েকজন প্রাতঃস্মরণীয় লেখক। তাদের মধ্যে উইলিয়াম ম্যাকপিচ থ্যাকারে (১৮১১-১৮৬৩), রুডইয়ার্ড কিপলিং (১৮৬৫-১৯৩৬, যিনি ১৯০৭ সালে নোবেল পেয়েছিলেন), জিম করবেট (১৮৭৫-১৯৫৫) ও রাস্কিন বন্ড (১৯৩৪-বর্তমান) প্রমুখ। তবে এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় মোট চার জন বিদেশি লেখক ভারতবর্ষে না জন্মেও ভারতবর্ষ নিয়ে লিখে নোবেল পেয়েছেন। ১৯১৭ সালে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী দিনেমার সাহিত্যিক কার্ল গেলেরুপের উপন্যাসের অনুবাদ The Pilgrim Kamanita লন্ডন থেকে প্রকাশিত হয় ১৯১১ সালে। একটি বৌদ্ধ উপাখ্যান এই উপন্যাসের ভিত্তি। জার্মান লেখক টমাস মান নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ১৯২৯ সালে। বেতালপঞ্চবিংশতির একটি কাহিনি অবলম্বন করে তিনি লিখেছেন The Transposed Heads; আরেক জার্মান লেখক হেরমান হেসে নোবেল পেয়েছেন ১৯৪৬ সালে। হেসের সমগ্র রচনার মধ্যেই হিন্দু ও বৌদ্ধ দর্শনের মূল সত্যগুলো ওতপ্রোতভাবে মিশে আছে। বিশেষ করে তাঁর লিখিত সিদ্ধার্থ ভারতীয় পটভূমিকায় রচিত একটি অনবদ্য উপন্যাস। কিপলিং নোবেল পেয়েছিলেন ১৯০৭ সালে অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার ছয় বছর পূর্বে। কিপলিং-এর রচনাতেও ভারতের ছবি আছে বটে তবে সে ছবি বড়োই নিষ্প্রভ। ইংরেজ কবি টি এস এলিয়ট নোবেলে ভূষিত হন ১৯৪৮ সালে। ‘দ্য ওয়েস্টল্যান্ড’ কবিতায় এলিয়ট ভারতীয় সাহিত্য ও দর্শনের মিশ্রণ ঘটিয়েছেন। এর কারণ সম্ভবত এলিয়ট যখন হার্ভার্ডে লেখাপড়া করেছিলেন তখন হার্ভার্ডের শিক্ষক অ্যার্ভিং ব্যাবিট এবং পল এলমোরের সান্নিধ্যে এসেছিলেন এলিয়ট। তাদের সান্নিধ্যই এলিয়টকে প্রাচ্যবিদ্যা বিশেষত বৌদ্ধ ও হিন্দু মতবাদের প্রতি তাকে আকৃষ্ট করে তোলে। দ্য ওয়েস্টল্যান্ড অ্যান্ড ফোর কোয়ার্টেটস (পোড়োজমি ও চৌতাল) তার জাজ্বল্যমান প্রমাণ। জর্জ অরওয়েল নিজেই বলেছেন তিনি টি এস এলিয়টের লেখা দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। পাঠকবৃন্দের উদ্দেশে বলছি, টি এস এলিয়টের দ্য ওয়েস্টল্যান্ড-এর চমৎকার একটা বাংলা অনুবাদ বাজারে পাওয়া যায়। অনুবাদ করেছেন জগন্নাথ চক্রবর্তী। বইটির নাম, পোড়োজমি ও চৌতাল। প্রকাশ করেছে ভারতীয় প্রকাশনা সংস্থা সাহিত্য অকাদেমি। আমার দৃষ্টিতে এটি একটি উৎকৃষ্ট অনুবাদ।
তো যা বলছিলাম, জন্মের পর সুশিক্ষার উদ্দেশ্যে এক বছর বয়সের শিশু এরিককে ফেরত পাঠানো হয় ইংল্যান্ডে। কিন্তু তার বাবা ভারতবর্ষেই থেকে যান। কিন্তু ছোটোবেলা থেকেই এরিক অর্থাৎ জর্জ অরওয়েল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে সবার চেয়ে বেশ খানিকটা ভিন্নতর ছিলেন। চার বছর বয়সে অন্য ছেলেরা যখন পাড়ার রকে বসে আড্ডাবাজিতে মশগুল থাকে কিংবা মারবেল খেলায় ব্যস্ত ঠিক তখন জর্জ অরওয়েল লিখে ফেললেন তার জীবনের প্রথম কবিতা। যেন লেখালেখির জন্যই তার জন্ম। শিশুবয়সে তার এই আচরণ দেখে এ মুহূর্তে আমার তিন জন লেখকের কথা মনে পড়ছে। অবিস্মরণীয় মনোচিকিৎসক সিগমন্ড ফ্রয়েডও নাকি ছোটোবেলায় বই ছাড়া কিছু বুঝতেন না। ফ্রয়েডরা ছিলেন সাত-আট ভাইবোন। ফ্রয়েডের অন্য ভাইবোনরা সব যখন খেলাধুলায় ব্যস্ত ঠিক তখন ঘরের মধ্যে একাগ্রচিত্তে বইপড়ায় নিমগ্ন থাকতেন ফ্রয়েড।
আরেক প্রণম্য ইংরেজ অর্থনীতিবিদ জন স্টুয়াটমিলও নাকি তিন বছর বয়সে গ্রিক ভাষাটি রপ্ত করে ফেলেছিলেন। ভারতবর্ষেও এমন প্রতিভা বিরল নয়। এ মুহূর্তে আমার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের নাম মনে পড়ছে। বিদ্যাসাগরের মাইনস্টোন দেখে ইংরেজি সংখ্যা শেখার কথা তো বোধ করি কমবেশি সকলেই জানেন। তবে ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত তিন বছর বয়সে কবিতা লিখেছিলেন, ‘রেতে মশা, দিনে মাছি/ এই নিয়ে কলকাতায় আছি।’ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের চেয়ে বয়সে ২৬ বছরের বড়ো ছিলেন। বিশেষ করে ঈশ্বরচন্দ্র তার সম্পাদিত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় বঙ্কিমের লেখা ছাপিয়ে বঙ্কিমকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছিলেন। যদিও বঙ্কিমচন্দ্র ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তকে গুরুপদে বরণ করে নিয়েছিলেন। আমার ধারণা ঈশ্বরচন্দ্রকে বঙ্কিম কিছুটা ঈর্ষাও করতেন বোধ হয়, কারণ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের জীবনী লেখার সময় বঙ্কিম নাকি বলেছিলেন, ‘মাত্র তিন বছর বয়সে এই কবিতা। তাই নাকি? অনেকে কথাটা অবিশ্বাস করিতে পারেন। আমরা বিশ্বাস করিব ডশ না জানি না, তবে স্টুয়ার্ট মিলের তিন বছর বয়সে গ্রিক শেখার কথাটা যখন সাহিত্যজগতে চলিয়া গিয়াছে, তখন এ কথাটাও না হয় চলুক।’
এগারো বছর বয়সে অরওয়েলের প্রথম প্রকাশিত কবিতা প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি লেখালিখির প্রতি অধিকতর উৎসাহী হয়ে ওঠেন। জর্জ অরওয়েল তার ব্যক্তিগত ডায়ারিতে লিখেছেন, ‘একাকী অসহায় শিশুর মতো আমিও গল্প বানাতাম। ধীরে ধীরে তা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। কাল্পনিক বন্ধুদের সঙ্গে অনেক্ষণ ধরে কথা বলতাম। আমি মনে করি আমার সাহিত্যের শুরুতে মিশে আছে সবার থেকে আলাদা হয়ে একা বাস করা এক শিশুর মিশ্র অনুভূতি।’
অবাক করা ব্যাপার হলো, প্রথম প্রকাশের প্রায় ৭০ বছর পর অরওয়েলের নাইন্টিন এইটি ফোর যেন আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এ উপলক্ষ্যে পেঙ্গুইন প্রকাশনী এ বইয়ের নতুন ৭৫ হাজার কপি পুনর্মুদ্রণের সিদ্ধান্ত নেয়
১৯১৭ সালে ইটনে পড়াশোনা করার সময় সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে জর্জ অরওয়েলের। এ সময় বিভিন্ন কলেজ ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখতে থাকেন তিনি। ১৯২২ সাল থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত ভারতীয় পুলিশ বিভাগের হয়ে বার্মায় কাজ করেন অরওয়েল। চাকরির এই অভিজ্ঞতা তাকে প্রথম উপন্যাস লিখতে অনুপ্রেরণা যোগায়। ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত হয় তার বার্মিজ ডেজ। পরবর্তীতে ক’টা বছর দারিদ্র্যের কষ্ট পোহাতে হয় অরওয়েলকে। ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার আগে দুটো বছর প্যারিসে কাটান তিনি। এ সময় জীবিকার জন্য বিভিন্ন কাজ করতে হয় তাকে। কখনও গৃহশিক্ষক ছিলেন, কখনও স্কুলে পড়াতেন, কখনও বা বইয়ের দোকানে বই বিক্রি করতেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে লেখালিখিও চালিয়ে গেছেন। বিভিন্ন সাময়িকীতে তখন তার বেশ কিছু লেখাও ছাপা হয়। ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত হয় জর্জ অরওয়েলের ডাউন অ্যান্ড আউট ইন প্যারিস অ্যান্ড লন্ডন।
১৯৩৬ সালে ভিক্টর গোলাঙ্কজের কাজ নিয়ে তিনি পরিদর্শন করতে যান ল্যাঙ্কাশায়ার এবং ইয়র্কশায়ারের বেকারত্বপূর্ণ এলাকাগুলো। এই অভিজ্ঞতা থেকে পরবর্তীতে লেখেন দ্য রোড টু উইগান পায়্যার। ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত এই বইটিতে জর্জের নিজ চোখে দেখা দারিদ্র্যের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে নিখুঁত বর্ণনার মাধ্যমে। ১৯৩৬ সালের শেষদিকে প্রজাতন্ত্রের সমর্থনে তার সতীর্থ লেখক অর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো তিনিও যুদ্ধ করতে স্পেন চলে যান। যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হন তিনি। গৃহযুদ্ধের এই অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন হোমেজ টু ক্যাটালোনিয়া বইটি।
তার লেখা রূপকধর্মী উপন্যাসিকা অ্যানিমেল ফার্ম প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭ আগস্ট ১৯৪৫ সালে। অরওয়েলের মতে, বইটি ১৯১৭-এর রুশ বিপ্লবের নেতৃত্ব দানের ঘটনা এবং পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নে স্তালিন যুগের চালচিত্র প্রতিফলিত হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের স্টালিন শাসনামলের নানা চিত্র পাওয়া যায় এতে। অরওয়েল ছিলেন একজন ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি সদস্য এবং স্টালিন-সমালোচক। যদিও বইটি ছাপাতে প্রথমে কোনো প্রকাশক খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেক চেষ্টা তদবির করে তবেই বইটি আলোর মুখ দেখে। কিন্তু প্রকাশিত হওয়ার দুই বছরে বইটি বিক্রি হয় পাঁচ লক্ষ কপি।
অরওয়েলের জগৎ মাতানো উপন্যাস নাইনটিন এইটি ফোর প্রকাশিত হয় ১৯৮৪ সালে। উপন্যাসটি পৃথিবীর কথা কল্পনা করেছে, যেখানে বাকস্বাধীনতার কোনো স্থান নেই এবং মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ড সরকার পর্যবেক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। টাইম ম্যাগাজিন এই উপন্যাসকে ইংরেজি ভাষায় লেখা ১০০টি শ্রেষ্ঠ উপন্যাসের (১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বর্তমান) তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এছাড়া মডার্ন লাইব্রেরির বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস তালিকায় এর অবস্থান ৩১তম।
এই উপন্যাসের একটি বিখ্যাত সংলাপ ছিল, ‘Big brother is watching you’। অর্থাৎ বড়ো ভাই তোমাকে নজরে রাখছে। উপন্যাসে দেখানো হয়েছে, প্রতিটি বাড়ির ভেতরের দেওয়ালে একটি যান্ত্রিক পর্দা রয়েছে যার মাধ্যমে সরকার বাড়ির অধিবাসীদের উপরে নজর রাখতে পারে। এই সংলাপটির মাধ্যমে Big Brother কথাটি ইংরেজি গণমাধ্যমে সরকারি নজরদারির প্রতীক হিসাবে প্রচলিত হয়ে যায়।
২৫ জানুয়ারি ২০১৭ সালে দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বইয়ের বাজারে অন্যান্য বেস্ট সেলারের সঙ্গে সবাইকে অবাক করে দিয়ে পাঠকদের চাহিদার প্রথম পছন্দে উঠে আসে জর্জ অরওয়েলের নাইন্টিন এইটি ফোর-এর নাম। অনলাইন বিক্রয় বিপণী অ্যামাজনে সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায়ও উঠে আসে এ উপন্যাসটি।
অবাক করা ব্যাপার হলো, প্রথম প্রকাশের প্রায় ৭০ বছর পর অরওয়েলের নাইন্টিন এইটি ফোর যেন আবার জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এ উপলক্ষ্যে পেঙ্গুইন প্রকাশনী এ বইয়ের নতুন ৭৫ হাজার কপি পুনর্মুদ্রণের সিদ্ধান্ত নেয়।