Author Picture

জরিনা আখতারের সেগুন মেহেগুনি ও অন্যান্য কবিতা

জরিনা আখতার

না
.
সুদৃঢ় খিলান হয়ে ‘না’ শব্দটি দাঁড়িয়ে আছে
আমার সমস্ত গন্তব্যে-
তবে তার অর্থ এই নয় যে,
আমি কখনও যুদ্ধে যাবো না
কখনও ভালোবাসবো না
গান শুনবো না।

তবে হ্যাঁ
যদি বলো- এই যে বন উজাড় করতে করতে এগিয়ে চলেছে সভ্যতা
তাকে স্বীকৃতি দাও।
আমি বলবো- ‘না’।
যদি বলো- বাজারে তো অনেক কিছুই পাওয়া যায়
একটি ময়ূরপুচ্ছ কিনে সুদৃশ্য ময়ূর সেজে যাওনা কেন
আমি বলবো- না’।
যদি বলো- ঐ যে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বৈঠকে বসেছে মূর্খ মহাজনেরা
শুধু একবার নত মস্তকে ঈষৎ ঝুঁকে পড়ে নিজের যা কিছু আর্জি
সেখানে পেশ করো- কবুল হবে সব
আমি বলবো- ‘না’।

 

সেগুন মেহগনি
.
কুঠারের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে
নিমেষে পতিত হলো প্রাচীন মহীরূহ,
একদা যে ছিলো কালের নীরব সাক্ষী
আজ তাকে সরে যেতে হলো
যেন পথ চিনে নিতে পারে নবীন ছায়াতরু।

এভাবেই বিদায়ের আয়োজনে সঞ্চিত থাকে অতীত ইতিহাস
মাঝে মাঝে চেতনার কান পেতে শুনে নিতে হয়
জীবনের সুপ্রাচীন গান।

হে আমার পূর্বপুরুষ
শুনেছি তোমরা আমাদেরই মতো ছিলে-
তোমাদের একজন যখন ছোট্ট চারা রোপণ করে
সফল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতো
তখন একজন রাতের অন্ধকারে উপড়ে ফেলতো সেই চারাগাছ
আর একজন পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতো তোমাদের যাত্রায়
বিঘ্ন ঘটাবার জন্য
অন্য একজন রঙ-তুলির অনধিকার চর্চায় ভ’রে তুলতো
ঈর্ষা, শত্রুতা ও রুচিহীনতার বিশাল ক্যানভাস।
আমরাও তোমাদেরই মতো-
শুধু কুঠারের জায়গা দখল করেছে আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র
জ্বলছে আবাসভূমি
দূষিত হচ্ছে স্নিগ্ধ প্রতিবেশ
মানুষের ব্যর্থতার বেসাতি করে মুনাফা লুটছে নব্য পুঁজিপতি
বৃক্ষের নিধন-যজ্ঞে আত্মহুতি দিচ্ছে
পৃথিবীর সবুজ শ্যামলিমা।

তবু জাম জারুল মেহগনি কাঁঠালের বন আজও আছে
আছে কাঁটার আড়ালে ফুল, সুবাতাস;
জ্বলন্ত ভূমির উত্তপ্ত বাতাসকে পারাজিত করে
পাতার মর্মরে কখনও কখনও ধ্বনিত হচ্ছে
অহিংস পৃথিবীর কণ্ঠস্বর-
অসংখ্য মানুষের ভিড়ে আজও একজনকে দেখা যায়
সযত্নে পথের কাঁটাগুলো তুলে ফেলছে,
অন্য একজন ক্যানভাসের বিকৃত অধ্যায় মুছে দিয়ে
অঙ্কিত করছে মানুষের সপ্রশংস জীবন,
আর একজন পরম মমতায় রোপণ করছে
উপড়ে ফেলা সেগুন মেহগনি।

 

দীর্ঘ নীরবতার পর
.
দীর্ঘ নীরবতার পর
তিনি তৃতীয় বারের মতো উচ্চারণ করলেন-
না, হবে না;
এভাবে নয়
এভাবে নয়
এভাবে নয়
সঙ্গে সঙ্গেই সমোচ্চারিত কণ্ঠে ধ্বনিত হলো-
তবে কী ভাবে
তবে কী ভাবে
তবে কী ভাবে!
আন্দোলিত হলো লোকালয়
গুঞ্জরিত হলো বনাঞ্চল
তরঙ্গিত হলো স্রোতহীন নদী;
যেন উত্তাপে উজ্জীবিত হলো পৌষের শস্য ক্ষেত
যেন আবেগে প্রাণিত হলো সীম আর লাউলতা পুরনো মাচায়
যেন বহু আকাঙ্খিক্ষত উষ্ণতা শীতের উঠোনে নেমে এলো-
শিশুরা উল্লাস করলো
কিশোরীরা হেসে উঠলো
তরুণেরা স্বপ্নোথ্থিত হলো।
জাগতিক সব স্তব্ধতাকে আত্মসাৎ করে নিয়ে নিমীলিত চোখে
তিনি বললেন- দেখো,
আমাদের সেই পূর্বপুরুষ- যার কাঁধে স্বহস্তে তৈরী বল্লম
দীর্ঘ উন্নত আর সুন্দর;
দেখো, একদা কিংবদন্তীর সেই গায়ক
উদাত্ত কণ্ঠে যার শৃঙ্খল মুক্তির গান।

 

আমি আছি
.
হে জনপদবাসী
তোমাদের অস্তিত্ব রক্ষার নিরন্তর কর্মকাণ্ডে
আমাকে গ্রহণ করো;
এক মুঠো ভাতের জন্য
তোমাদের ক্ষুধার্ত আত্মার অনুভুতি দিয়ে
এ জীবন দেখবো বলে আমিও অংশ নিতে চাই
পূর্বপুরুষের দীক্ষা নিয়ে
তোমরা যে পথে যাত্রা করো,
ফসলের বীজ হাতে তোমরা যে প্রতীক্ষা করো,
মাঠে মাঠে চারা রোপণ করে তোমরা যে প্রত্যাশায় থাকো,
প্রকৃতির প্রতিকূলতায় তোমরা যে ব্যর্থ নিঃশ্বাস ফেলো,
তোমাদের সেই আনন্দ-বেদনার কাছাকাছি
আমি আছি।
কুমারীর যে স্বপ্ন নিয়ে ভরে ওঠে লাউমাচা,
কিশোরী বধূর যে বিরহ নিয়ে কুয়াশানিমগ্ন হয় পৌষের শস্যক্ষেত,
দূরন্ত কিশোর যে সখ্য গড়ে তোলে শরতের সাদা মেঘে
রঙিন ঘুড়ির সুতোয়;
সেই কিশোর কিশোরী কুমারীর উম্মিলিত উপাদান থেকে
যে আমি পেতে চাই জীবনের উপঢৌকন
সেই আমি আছি
তোমাদের কাছাকাছি।

 

এক বিকেলের গল্প
.
সমন্বিত দ্বীপপুঞ্জের মতো গাছটির খন্ড খন্ড ছায়া
যখন ম্লান ঘাসের ওপর পতিত হচ্ছিলো
আমরা পরস্পর কাছাকাছি হলাম
আমাদের শরীর তখন ছিলো ঘর্মক্ত
আর ক্লান্ত
আর হৃদয় দিলো উন্মুখ।

দেখা হলো যদি
পরস্পর পরিচিত হবার জন্য
যথাযথ শব্দের অনুসন্ধানী হলাম
তখনই বাতাস প্রবাহিত হলো গাছের শাখা আলোড়িত করে
আর পাখি ডেকে উঠলো
আর কোথাও যেন চলার ছন্দ ধ্বনিত হলো।

আমাদের মাঝে কোনো প্রতিশ্রুতি বিনিময় হলোনা
তবু আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম গভীর দৃষ্টিতে
গাছটির খন্ড খন্ড ছায়া একীভূত হতে হতে বিলীন হয়ে গেলো
আর আমরা কোনো আকাঙ্ক্ষার কথা ব্যক্ত না করে নীরব হলাম
আর তারপর পরস্পর বিচ্ছিন্ন হলাম।

 

দু’একটি বকুল
.
ব্যস্ততার মাঝে বকুল ঝরার নিভৃতি এ শহরে
একেবারেই কি নেই?
বকুল ঝরার পালা এ শতাব্দীতে বাস্তবিকই নিঃশেষ হয়ে যাবে?

মন বলছে কোথাও বকুল ঝরছে
চলো স্নিগ্ধতার সেই উপমা সঞ্চয় করি
তর্ক থাক, দ্বন্দ্ব ভুলে বকুলের সাথে ব্যয় করি কিছুটা সময়।
নাগরিক কোলাহল সযত্নে রক্ষা করছে তার পতনের নীরবতা
সুরভি আত্মসাৎ করছে নগরীর ক্ষতিকর প্রতিবেশ-
মন বলছে
হয়তো ঝরে আছে কোথাও প্রতীক্ষারত
হয়তো অজস্র নয়;
হয়তো অসংখ্য মানুষ নয়
দু’একজন আজও সন্ধান করে
দু’একটি বকূল।

আরো পড়তে পারেন

বেওয়ারিশ প্রেমের কবিতা

১. জীবনকে বিজ্ঞাপনের মতো সেঁটে দিয়ে দেখেছি, আমাকে গ্রহণ করেনা কেউ। আমাকে ভালোবাসে না ঘুমগন্ধওয়ালা সকাল— আমাকে ভালোবাসে না বাজারের জনবহুল রোদ, আমাকে ভালোবাসে না কেউ, ভিক্ষুক, শ্রমিক, চাষী আমাকে ভালোবাসে না, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে ভালোবাসে না, শোষক কিংবা শোষিত, শাসক ও প্রজা কেউই ভালোবাসে না, আমাকে ভালোবাসে না তরুণ-তরুণী-বৃদ্ধ বা যুবা, পার্থিব কোনো….

রঙের নামে যত ছলনা: হাবল-জেমস ওয়েবের ছবি ‘সত্যি’?

যখন আমি মহাকাশ নিয়ে প্রকাশ্য বক্তৃতা দিই এবং হাবল স্পেস টেলিস্কোপ বা জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST) এর সর্বশেষ চমকপ্রদ ছবিগুলো দেখাই, তখন আমাকে সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটি করা হয় তা হলো—”এগুলো কি আসলে বাস্তবে এরকমই দেখতে?” এর সাধারণ অর্থ: আপনি যদি নিজ চোখে এই বস্তুগুলো দেখতেন, তাহলে কি এরকমই দেখাতো? এর উত্তরটি প্রায় সবসময়ই….

আজাদুর রহমান-এর একগুচ্ছ কবিতা

সহজাত মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে যে কোন দিন যে কোন সন্ধ্যায় তুমি কল্পনাও করতে পারবে না এমন ঘোরতর বর্ষার দূপুরে মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে। পথের পাশে ওত পেতে থাকা শিকারির মত সন্তর্পনে উঠে আসা মানুষ পায়ে পা ঘষে তোমাকে অবহেলা করবে। কোথাও না কোথাও কোন এক বয়সে কোনও না কোনও ভাবে মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে।….

error: Content is protected !!