
জ্যোৎস্নার বৃষ্টিতে
জ্যোৎস্নার বৃষ্টিতে ভিজছে রাতের মহানগরী
বহুতল ভবনগুলোর গা বেয়ে বেয়ে ক্ষীণধারা ঝরনার মতো
গড়িয়ে পড়ছে জ্যোৎস্নার জল,
এ্যাপার্টমেন্টগুলোতে ঘুমকাতুরে মানুষদের চোখে চোখে
স্বপ্নের যে আলোছায়ার খেলা- তা ভেজে
কিনা যায় না দেখা।
তবু মানুষ ঘুমায়- স্বপ্ন দেখে
স্বপ্নের ভেতরে আরও এক স্বপ্নের মহানগরীতে চলে যায়-
সেখানে রাতের নকশাকাটা ফুটপাতগুলোতে শুয়ে থাকে না ছিন্নমূল মানুষ,
রাজপথগুলো স্বচ্ছ করতোয়ার মতো শান্ত স্থির,
হাইড্রোলিক হর্ন দূষিত করেনা শব্দের ঘর-বাড়ি,
নিশাচর পথিক আকণ্ঠ পান করে নেয় জ্যোৎস্নার সুপেয় জল,
ঘরে ঘরে মায়েরা ঘুমপাড়ানি গান গায়,
শিশুদের হাতে হাতে ঠাকুরমার ঝুলি,
কবিতা-পিপাসু তরুণীর হাতে জীবনানন্দ তুলে দিচ্ছেন বনলতা সেন,
বর্ষার প্রথম কদমফুল হাতে পৃথিবীর প্রথমা নারীর মতো
দাঁড়িয়ে থাকে একাকী গাছ ভোরের প্রতীক্ষায়-
জ্যোৎস্নার বৃষ্টিতে ভেজে তার ছিপছিপে মায়াবী শরীর।
ধোঁয়া ধোঁয়া ঘোলাটে সকাল
একটি ধবধবে সাদা সকালের জন্য
হাঁসগুলোর কী তীব্র প্রতীক্ষা-
জলক্রীড়ায় মেতে উঠবার জন্য উন্মুখ ওদের হৃদয়,
পুকুরের জলে তখনও নীরবতা-
ঘুমকাতুরে রাতের চোখ তখনও নিমীলিত,
রাতভর কারা যেন গান গেয়েছিল
সেই সুর রাতের নির্জনতাকে ভাঙতে পারেনি,
রাত শুয়ে থাকে মাঠের শয্যায়, ধুলোভরা পথে, শ্যাওলায়,
হাঁসগুলো শুধু কথা বলে পরস্পর,
স্বপ্ন ও বাস্তবতায় মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ওদের কণ্ঠস্বর ;
কোনো ক্ষণজন্মা মুহূর্ত কখন একটি ধোঁয়াহীন সকাল এনে দেবে
জানে না হাঁসগুলো-
হলুদ নখে মাটি খুঁটে খুঁটে কাটায় অস্থির সময়,
ডানা ঝাপটায় শঙ্খনীল আকুলতায়,
মমতার ঠোঁট রাখে সাদা পালকগুলোয়-
জনমানবহীনতা, গাছগাছালির নির্লিপ্ততা, পুকুরের জলের স্থিরতা
আরও বেশি প্রগাঢ় করে তোলে সকালের ঘোলাটে শরীর।
স্নান
স্নান শব্দটি উচ্চারিত হলে মনে পড়ে যায়
মধ্য দুপুরের পুকুরে জলক্রীড়ারত আদুর গায়ে একদল বালকের কথা,
জলের সাথে খুনসুটিরত এক ঝাঁক কিশোরী,
তরুণী বধূর ভেজা শাড়ি ও চুল থেকে ঝরে পড়া ফোঁটা ফোঁটা
জলে ভিজে যাওয়া ধুলোভরা মেঠোপথ;
স্নান শব্দটি এমনই- শৈশব কৈশোরের সহচর,
বাথরুম ওয়াশরুমের সাথে শব্দটি বড় বেমানান,
স্নান শব্দটির সাথে জড়িয়ে আছে সাঁতারের কতো নাম,
অবাধ সাঁতারে জলের এপার থেকে ওপারে যাওয়া,
ডুব সাঁতারে কিছুটা সময় নিজেকে হারিয়ে ফেলা,
প্রজাপতি প্রজাপতি খেলা,
আরও কতো খেলা, আরও কতো রং, জলের গভীরে লুকিয়ে
থাকা বর্ণাঢ্য অতীত-
তবু মনে পড়ে যায় বেলী বু’র সকরুণ মুখ
শাড়ির ভাঁজে ভাঁজে দারিদ্র্য, অভাব
ক্লান্ত শরীরে জড়িয়ে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামের কারুকাজ
স্নানের অপেক্ষায় অবিশ্রান্ত ঘরকন্নার কাজে ব্যস্ত সময় পার করা।
জরিনা আখতারের জন্ম ১৫ মে ১৯৫১ ঢাকায়। ষাটের দশকের মাঝামাঝি কামরুন্নেসা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে লেখালেখির সূচনা। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কালো ময়ূরের ডাক’ প্রকাশিত হয় ১৯৮৬ সালে। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ- ‘এই ছুরিই আরশি’, ‘এই আমি নিজস্ব আমি’, ‘জলের আরশিতে নির্নিমেষ চেয়ে থাকা একটি হিজল গাছ’। একমাত্র প্রবন্ধ গ্রন্থ-‘প্রসঙ্গ: সাহিত্য ও জীবন’।
১৯৭৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর শেষে ১৯৭৭ সালে লালমাটিয়া মহিলা মহাবিদ্যালয় শিক্ষকতা জীবন শুরু। ২০১১ সালে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে অবসর নেন।