
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৭৬-১৯৩৮): “দিন-কতক তাহাদের ভারী কলহ বাধিয়া গেল, কে যে আলো, কে যে ছায়া কিছুতেই মীমাংসা হয় না। শেষে সুরমা বুঝাইয়া দিল, এটা তোমার সূক্ষ্মবুদ্ধিতে আসে না যে, তুমি না থাকিলে আমি কোথাও নাই।”
লেখক : আমার মোটা বুদ্ধিতে এটুকু বুঝি যে এই মহাবিশ্বের অস্তিত্বের জন্যে ছায়া, কায়া, এবং আলো সবাই একসাথে হাত মিলিয়েছে। তবে ছায়া এখানে আলোর নাস্তি নয়, বরং পদার্থের দোসর। এই দোসরকে দেখা যায় না, ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। “তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা, মন জানো না !”
রিচার্ড (Richard Gaitskel, ১৯৬৫): ছায়া কণিকা ধরার আশায় আমেরিকার দক্ষিণ ডাকোটা অঙ্গরাজ্যের একটি পুরানো স্বর্ণ-খনিতে আস্তানা গেড়েছি। মাটি থেকে দেড় কিলোমিটার নিচে এই গবেষণাগার গড়েছিলাম ২০০৯ সালে। এখন অনেক বিজ্ঞানী আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। এই গবেষণা কাজটি ভূগর্ভে বিশাল জিনন পরীক্ষা (large underground xenon experiment), সংক্ষেপে লাক্স (LUX) বলে পরিচিত। ছায়া কণিকা কি, কেউ জানে না। কিন্তু মহাবিশ্বের সিংহভাগ অংশ ছায়া কণিকা দিয়ে গঠিত। সংক্ষেপে ওদের উইম্প (WIMP) বলে ডাকা হয়। পুরো নাম “গুঁতো না দেয়া ভারী কণা” (weakly interacting massive particle) ! এই কণা কোনোরকম গুঁতোগুঁতি না করে পৃথিবীর এপার থেকে ওপারে চলে যেতে পারে।
লেখক : সাধারণ পদার্থ ইলেক্ট্রন, প্রোটন, এবং নিউট্রন কণিকা দিয়ে গঠিত। নিউট্রন এবং প্রোটন তিনটে কোয়ার্ক দিয়ে তৈরী, বিজ্ঞানীরা ওদের ব্যারিওন (baryon) বলে ডাকে। ধরে নিচ্ছি ছায়া পদার্থ হয়তো তেমনি ছায়া কণিকা দিয়ে তৈরী। অনেক গুজব শুনেছি, ছায়া কণিকার বাস নাকি শাখা-মহাবিশ্বে, বা সমান্তরাল কোনো মহাবিশ্বে। ওদের নাগাল পাওয়া সম্ভব নয় !
ডিরাক (Paul Dirac, ১৯০২-১৯৮৪): ১৯২৮ সালে কোয়ান্টাম তত্ত্বের সাথে আইনস্টাইনের বিশেষ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব জোড়া দিয়ে একটি সমীকরণ আবিষ্কার করি। এই সমীকরণে ইলেক্ট্রনের চক্কর কোথা থেকে এসে যেন জুড়ে বসে। সেই সাথে আরেকটি অদ্ভুত ব্যাপার খুঁজে পাওয়া যায় এই সমীকরণের সমাধান থেকে, ইলেক্ট্রনের পজিট্রন নামে একটি প্রতিকণা (anti-particle) আছে যার দেখা মিললে ওরা দুজনে আলো হয়ে হারিয়ে যাবে ! তখন সবাই প্রতি-পদার্থের (anti-matter) কথা গাঁজাখুরি মনে করেছিল। চার বছর পরে ক্লাউড চেম্বারে পজিট্রন আবিষ্কার করে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন কার্ল অ্যান্ডার্সন।
রিচার্ড : সেই ভরসায় ক্ষ্যাপার মতো মাটির নিচে এই পুরানো পরিত্যক্ত খনিতে জীবনের কয়েকটা বসন্ত কাটালাম। বছরের পর বছর গেল, এই সোনার খনিতে সোনার হরিনের নাগাল মিললো না। মাটির নিচে এই গবেষণাগারে আছে ৭০,০০০ গ্যালোনের এক পানির জলাশয়। তার ভিতরে আছে মাইনাস ১৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে রাখা ৩৭০ কেজি তরল জিনন গ্যাস ভর্তি একটি বিশাল পাত্র। ওই পাত্রের ভিতর দিয়ে এপার থেকে ওপারে যেতে হলে সাধারণ পদার্থের যে কোনো ভারী কণা জিনন নিউক্লিয়াসদের সাথে কয়েকবার ধাক্কা খেতে বাধ্য। কিন্তু ছায়া কণিকা বড় জোর একবার ধাক্কা খাবে। এই ধাক্কাধাক্কির অনুপাত থেকে বোঝা যাবে অজানা ছায়া কণিকার উপস্থিতি!
লেখক : দার্শনিকদের কাজ অন্ধকার ঘরে এক কালো বিড়ালের খোঁজ করা, যে সেখানে নেই। এখন পদার্থবিদরা ওই কাজে নেমে পড়েছেন। ছায়া কণিকা হয়তো উইম্প নয়, হয়তো উইম্প বলে কিছু নেই ! অনেকেই ভাবছেন যে ছায়া কণিকাদের ভর হয়তোবা সাধারণ কণিকাদের মতোই। পদাথবিদ্যার স্ট্যান্ডার্ড মডেলে যে কণিকাদের বিবরণ দেয়া আছে, তাদের সামনে একটি ছায়া যোগ করতে হবে, যেমন ছায়া ফোটন, ছায়া ইলেক্ট্রন, ছায়া হিগস বোসন, ছায়া নিউট্রিনো, ইত্যাদি। যদি তাই হয়ে থাকে তবে এই অপেক্ষাকৃত হালকা কণিকাদের ধরার জন্যে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে।
হেলেন (Helen Quinn, ১৯৪৩): ডিরাক প্রথমে প্রতিকণার কথা বলেন। মহাবিশ্বে কণা এবং প্রতিকণার সংখ্যা সমান হওয়ার কথা, কিন্তু মহাবিশ্বে এখন কণারা রাজত্ব করছে। আমি আমার গবেষণায় প্রতিসমতা (symmetry) নিয়ে অনেক মাথা ঘামিয়েছি। কণা এবং তার দোসর প্রতিকণার বৈদ্যুতিক চার্জ সমান এবং উল্টো, যেমন ইলেক্ট্রনের আছে নেগেটিভ চার্জ, ওর প্রতিকণা পজিট্রনের আছে সমান পরিমান পজিটিভ চার্জ। কণা এবং প্রতিকণার সংখ্যা-সমতা কে ভাঙলো ? আমি ১৯৭৭ সালে এসব নিয়ে একটা গবেষণা প্রবন্ধ লিখি যা এক নতুন কণার বার্তা এনে দেয়। এই নতুন কণার নাম দেয়া হয় এক্সিয়ন (axion) কণা। আজ পর্যন্ত এমন কণা খুঁজে পাওয়া যায় নি। এরকম কণা থাকলে পদার্থবিদ্যার কয়েকটি সমস্যার সহজ সমাধান মিলতো। আজকাল অনেকেই ভাবছেন যে এক্সিয়নরা হয়তোবা সেই না-ধরা ছায়া কণিকা। সূর্য থেকে অনেক এক্সিয়ন কণা বের হতে পারে, ওদেরকে ধরার জন্যে কাস্ট (CAST) নামে একটি বিশেষ টেলিস্কোপ (CERN Axion Solar Telescope) সেই ২০০৩ সাল থেকে সূর্যের দিকে চোখ রেখেছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো কণা খুঁজে পায় নি।
লেখক : যদি প্রকৃতিতে ছায়া কণিকা খুঁজে না পাওয়া যায় তবে বিজ্ঞানীদের শেষ ভরসা ওকে শক্তি থেকে সৃষ্টি করা। সুইজারল্যান্ডের লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে (Large Hadron Collider) এমন কাজটি করা যেতে পারে। ওখানে প্রায় আলোর বেগে ছুটে চলা দুটি প্রোটনের সংঘর্ষের শক্তি থেকে ছায়া কণিকা তৈরী হতে পারে। তবে কোটি কোটি সাধারণ কণার ভিড়ে ওকে চিনে নেয়া সহজ হবে না।