Author Picture

চৌধুরী রওশন ইসলাম-এর একগুচ্ছ কবিতা

চৌধুরী রওশন ইসলাম

বাঁচা

আমি যখন ডুবে যাচ্ছিলাম, তখন আমিই আমাকে
আমার জামার কলার ধরে টেনে তুলেছি ডাঙায়।

পেট ভরে গেছে ঘোলা পঁচা জলে;
তখনি বুঝেছি, কতটা সুখ স্থলে— অকারণ অবহেলায়
হাতের মুঠি থেকে প্রতিদিন নিঃশব্দে খসে যায়।

আমার হাতের মুঠোয় এখন ছোট-বড় সব সুখ ধরা থাকে;
তিলে তিলে জমানো বিন্দু বিন্দু সুখে আমার জীবন-গোলা পূর্ণ।
জলাধার-কিনারে দাঁড়িয়ে ভাবি— আমি যদি ডুবে যাই,
আমাকে বাঁচানোর আমি ছাড়া আর কেউ নাই।

 

এ শহর

এ শহরে কোনো মানুষ নেই।
চতুর্দিকে ভীড় ক’রে ছোটাছুটি করে
ক্ষোভের বারুদে-ঠাসা অসংখ্য জীবন্ত বোমা।

ধুলোয়, জ্যামে, থকথকে কাদায়, ঘামে,
শীতে, খরায়, বর্ষায়
এখানে ক্ষোভের চাষ হয় বারো মাস।

কর্তার প্রশ্নে, কামলার জবাবে,
উঁচুদের চিন্তায়, নিচুদের স্বভাবে
ঝরে পড়ে জ্বালাময় বিষাক্ত ক্ষোভ।

এখানে ওখানে জমে ওঠা
ক্ষোভহীন গল্পের আসরেও ক্ষোভ জমে।
এ শহর ক্ষোভের বারুদের গন্ধে ঠাসা।

অসংখ্য ক্ষুব্ধ জীবন্ত বোমা অসহ্য আক্রোশে
অধীর অপেক্ষায় চোখ রাখে ঘড়ির কাঁটায়;
ঠিক সময়ে ফেঁটে চৌচির হবে বলে।

এ শহরে কোনো মানুষ নেই।
চতুর্দিকে ভীড় ক’রে ছোটাছুটি করে
ক্ষোভের বারুদে-ঠাসা অসংখ্য জীবন্ত বোমা।

 

নিজের মুখোমুখি

আজকে আমি আমার কাছে ফিরতে চাই।
খুব গোপনে নিভৃত এক গভীর রাতে,
দেখা হবে একান্ত এই আমার সাথে।
আজকে আমি আমার কাছেই অনেক কিছু
জানতে এবং বুঝতে চাই।
আজকে আমি আমার কাছে ফিরতে চাই।

আজকে আমি আমার সাথেই কথা কব।
কথার মাঝে আমার সাথে ঝগড়া হবে;
তবু আমি আমার চুলের মুঠি ধরে তবে,
এই উড়ন-চণ্ডি জীবনখানার হিসেব-নিকেশ
কড়ায়-গণ্ডায় বুঝে লব।
আজকে আমি আমার সাথেই কথা কব।

আজকে আমি ধরবো আমার হাতে-পায়ে।
জেনে নেব, অশ্রুসিক্ত অনুনয়ে মুখোমুখি বসে
কতটা ফসল ফলিয়েছি কতটা জমি চষে।
জেনে নেব, আমার কতটা প্রায়শ্চিত্ত হলো
আজ কতটা ভুলের দায়ে।
আজকে আমি ধরবো আমার হাতে-পায়ে।

 

ঝুলে আছি

ধৈর্যের রশি ফাঁসির দড়ির মতো গলায় পরে
অন্ধকার রাতে অপেক্ষার মগডালে ঝুলে আছি।
জানি, ভোর হবেই; অন্ধকার ঠেলে নতুন সূর্য
পূর্ব দিগন্ত আলো করে উঁকি দেবেই।

তারপর
যদি অপেক্ষার সে মগডালখানি ভেঙে না পড়ে,
যদি ধৈর্যের রশি আরো আটসাট হয়ে না আসে,
যদি মাথা আর ধড়ে মিলেমিশে থাকে সারারাত,
তবেই দু’চোখ ভরে নেব সূর্যালোকে।

আর যদি
হৃদপিণ্ডে ও ফুসফুসে বিদ্রোহ করে সেই রাতে,
নতুন সূর্যোদয়েও দু’চোখ পাথর হয়ে রবে।
ধৈর্যের রশি ফাঁসির দড়ির মতো গলায় পরে
অন্ধকার রাতে অপেক্ষার মগডালে ঝুলে আছি।

 

সব নষ্ট হয়ে গেছে

যেদিকে তাকাই, বিস্ময়ে শিউরে উঠি।
কী অসম্ভব নিপুণ কৌশলে সব নষ্ট হয়ে গেছে !
যারা সভ্যতা পুড়িয়ে ভষ্ম করে,
তাদের পূঁজায় নৈবেদ্য সাজিয়ে
সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকে উৎসুক জনতা।
যারা সারাদিন ভণ্ডামির সাথে সঙ্গমরত,
শৈল্পিক দক্ষতায় তারা সব নীতিশাস্ত্রের অধ্যাপক।
যে যুবতীর ঠোঁটে-চোখে-বুকে সপ্তনরক গড়াগড়ি খায়,
পৃথিবীর সব মহাবীর তার পদতলে আত্মাহুতি দেয় অকাতরে।
নিরাপত্তার নিশ্ছিদ্র জালে পৃথিবীর রাজসভায়
প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ হয় সত্য আর সুন্দরের।

আয়নায় চোখ পড়তেই প্রতিবার চমকে উঠি—
অবিকল আমারি চেহারায় দাঁড়িয়ে থাকে
এক আপাদমস্তক নষ্ট মানুষ।

আরো পড়তে পারেন

বেওয়ারিশ প্রেমের কবিতা

১. জীবনকে বিজ্ঞাপনের মতো সেঁটে দিয়ে দেখেছি, আমাকে গ্রহণ করেনা কেউ। আমাকে ভালোবাসে না ঘুমগন্ধওয়ালা সকাল— আমাকে ভালোবাসে না বাজারের জনবহুল রোদ, আমাকে ভালোবাসে না কেউ, ভিক্ষুক, শ্রমিক, চাষী আমাকে ভালোবাসে না, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে ভালোবাসে না, শোষক কিংবা শোষিত, শাসক ও প্রজা কেউই ভালোবাসে না, আমাকে ভালোবাসে না তরুণ-তরুণী-বৃদ্ধ বা যুবা, পার্থিব কোনো….

আজাদুর রহমান-এর একগুচ্ছ কবিতা

সহজাত মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে যে কোন দিন যে কোন সন্ধ্যায় তুমি কল্পনাও করতে পারবে না এমন ঘোরতর বর্ষার দূপুরে মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে। পথের পাশে ওত পেতে থাকা শিকারির মত সন্তর্পনে উঠে আসা মানুষ পায়ে পা ঘষে তোমাকে অবহেলা করবে। কোথাও না কোথাও কোন এক বয়সে কোনও না কোনও ভাবে মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে।….

হোসনে আরা শাপলা’র একগুচ্ছ কবিতা

আলতু ব্যথা কোন এক শুভ্র সময় আমাদেরও ছিল পাশাপাশি-মুখোমুখি বসে থাকা শুধু হিসেব-নিকেশ, দাবি-দাওয়া, চাওয়া-পাওয়া এসবের বালাই ছিলো না কোন শুধু কানায় কানায় পূর্ণ ছিলো ভালোবাসা। চোখের তারায় ডুবে গিয়ে অন্বেষণ শুধু শত জনমের সুখ। ওইসব স্বপ্নমাখা দিন কোন দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল কোথায় তারই জন্য মনের মধ্যে কেমন আলতু ব্যথা।   তৃপ্তি ভরসার হাত….

error: Content is protected !!