কেউ কি জানত, এমন কি রুবি নিজেও, একেবারে আগস্টের ২৩ তারিখেই ঘটনা ঘটাবে? হ্যাঁ, সেদিনই ছিল প্রথম ওকে দেখার দিন। আগস্টের শেষদিকে বিকেল কিছুটা ছোট হয়ে আসে। ছোট হতে হতে মাস দুই পর বিকেল খুব সংক্ষিপ্ত হয়ে যায়। তারপর নভেম্বরের শেষদিকে বিকেল আর থাকেই না। শীত আসে। শীতকালে বিকেল কই? শুধু দুপুর, আর সন্ধ্যা।

তো ওই কিছুটা ছোট হয়ে আসা বিকেলে; অনুজ্জ্বল বিকেলে, কেননা সারা দিন তেমন রোদ নেই, তেমন সুন্দর হাওয়াও নেই; রুবির হঠাৎ চোখ পড়ে গেল ওর ওপর। হলো কি, মহিলা প্রথমে বিশ্বাস করতে চাইল না নিজের চোখকে। একটু আগে সে বারান্দায় এসে সিঁড়িতে বসেছে। লাঞ্চের পর রুবি ঘুমায় না। ঘুম আসে না। চিতকাত হয়ে পড়ে থাকে দু-আড়াই ঘণ্টা। কিন্তু আজ আগস্টের ২৩। আজ তার মন খুব খারাপ হয়েছিল। আজ রুবির স্নায়ু ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আজ সে ভরদুপুরেই না ঘুমিয়ে পরেনি।

ওদিকে দৃষ্টি যেতেই অবাক রুবি বলে ওঠে, আরে এ ঘোড়া! সে নিজেকে বলে, আমি ঠিক দেখছি তো? তার দুই হাতের মধ্যমা আলতো ভঙিতে রগড়ে নিল দুই চোখ। না কোনো সমস্যা নেই। সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। হ্যাঁ, ওটা ঘোড়াই। অন্য কিছু নয়। ছোটখাটো একটা ঘোড়া। একাগ্রচিত্তে ঘাস চাচ্ছে প্রাণীটা। এতটাই মগ্ন যেন আশপাশে বোমা ফাটলেও টের পাবে না। মহিলার যে কী হলো, সে ভয় পেল না একটুও। ওটা কোথা থেকে এলো, কীভাবে এলো কিচ্ছু ভাবল না; গুটিগুটি আলতো পায়ে এগিয়ে গেল প্রাণীটার দিকে। দুয়ের মাঝখানে দূরত্ব এখন বড়জোর পাঁচ হাত। ঘোড়াটা করল কী, ওর মাথাটা অল্প একটু ঝাঁকাল। সামান্য দুলে উঠল ঘাড়ের কেশর। ওর মুখ ঘাস থেকে অনেকটা ওপরে তখন। ও কিন্তু রুবির দিকে তাকায়নি। তবে বুঝতে পেরেছে কেউ একজন তাকে নিঃশব্দে লক্ষ করছে। রুবি বলল, ছোট্ট ঘোড়া! কি সুন্দর! ওই নিঃশব্দ উচ্চারণ কেবল সে-ই শুনল। প্রাণীটা কিছু শুনতে পেল না। নাকি সেও শুনল? একটু বাতাস উঠল। ভাদ্রের ভেজা বাতাস। ঘোড়াটা যেখানে ঘাস খাচ্ছিল তার পাশেই একটা আমগাছ। ওই গাছের তিনটা শুকনো পাতা ভাসতে ভাসতে নিচে নামল। দুটো মাটিতে পড়ল সরাসরি। একটা ওই প্রাণীর পিঠে প্রায় নিঃশব্দে রুবি বলে; বাহ, সুন্দর তো! ঘোড়ার চোখ-যে এত আকর্ষণীয় হয়, গায়ের পশম এতটা মসৃণ হয় তার জানা ছিল না। সে ওর সারা দেহ লক্ষ করল এবং দেখল, লেজটা আরও সুন্দর। লেজের খয়েরি-কালো চুলগুলো লম্বা ঝাড়–র দীর্ঘদিন মসৃণ শলার মতো ঝোলানো! রুবি এবার বলে ওঠে, হাউ নাইস! হাউ নাইস ইউ আর…। ছোট ঘোড়া কি শুনতে পেল ও কথা? সে এবার, ওই প্রথমবার, গলা বাঁকিয়ে তাকাল রুবির দিকে। চোক-চোক চোক-চোক শব্দ করে মহিলা দু-তিন পা এগিয়ে গেল। তারপর প্রাণীটার গায়ের একদম কাছে দাঁড়াল। ছোট্ট সুন্দর ঘোড়াটার চোখে চোখ রাখল। সেও তখন রুবিকে দেখছে। তার কেশর নড়ছে ঘনঘন। রুবি শব্দ করে চলেছে চোক-চোক চোক-চোক চোক-চোক…। হাতের মোলায়েম স্পর্শ পেয়ে কি চোখ জোড়া মুদে আছে ওর! রুবি হাত বুলিয়ে চলেছে ওর গলার নিচে! ঘোড়াটা লেজ নাড়াচ্ছে একটুা পরপর। এক্ষুনি যেও না, ঘাস খাও যত ইচ্ছা, রুবি ওর উদ্দেশে বলে। কিচেনের দিকে পা বাড়িয়ে তিন কদম হাঁটে। হঠাৎ ঘুরে তাকায়। আবার বলে, চলে যেও না কিন্তু! আমি আসছি। এ সময়টায় মানে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ মহিলার কফির তেষ্টা পায়। চা সে পছন্দ করে না। কফিটাই প্রিয়। রোজ অন্তত চারপেয়ালা তার চাই। কিচেনে ঢুকে মিনিট দশেকের ভেতর বেরিয়ে আসে। হাতে কফির মগ। তার ইচ্ছা উঠোনে নামার ওই সিঁড়ির ওপরের ধাপে বসে অনেকটা সময় নিয়ে পান করবে আর ছোট্ট সুন্দর অতিথির ঘাস খাওয়া দেখবে। কিন্তু আমগাছটার নিচে তাকাতেই রুবি বুঝল ওখানে প্রাণীটা নেই। বেশি বড় নয় উঠোন। চারদিকে দেওয়াল আছে। একটা গেটও আছে পেছন দিকে। আধা মিনিটের ভেতর এটা পরিষ্কার হলো, এখানে কোথাও সে নেই। হ্যাঁ, রুবির অতিথি চলে গেছে। মহিলা এখন দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মূর্তির মতো। হতবাক দৃশ্যবিহ্বল। কফির পেয়ালা থেকে ধোঁয়া উঠছে। চুমুক দিতে ভুলে গেছে সে। হতভম্ব রুবি কিছু উচ্চারণ করতে চাইল। শব্দ বেরোল না। কান্নার মতো কিছু একটা বেরিয়ে আসত চাইল; হলো না। বুকের ওপর অদ্ভুত ধরনের চাপ অনুভব করতে থাকল সে।

রাতে ডিনারের সময় রুবি ঘটনাটা বলে। বৃত্তান্ত শুনে জেসমিন অবাক হয়, বলিস কি! তোর ভয় করেনি?

একদম না। আমার বরং ভালো লেগেছে। জানিস ও এত ভালো… তাই তো ‘ভালো’ বলছিস। আমি ভাবছি, ওটা এলো কি করে। কোত্থেকেই বা এলো। মাই গড! একেবারে আমাদের উঠোনে! তুই কিন্তু ওটাকে আশকারা দিবি না। তোর তো আবার পশু-পাখির ওপর খুব দরদ!

এভাবে বলিস না। আমার খারাপ লাগে।

রুবি বলে, উটকো ঝামেলা এড়াতে চাই। স্বাধীন পশু। বেশি আদর দিলে যদি মাথায় ওঠে!

রুবি হাসে না, মাথায় উঠবে না। আমি ওকে মাথায় উঠতেই দেব না। জেসমিন কাঁধের প্রায় ঝুলেপড়া আঁচল ঠিক করে নেয়। চমৎকার করে গলা বাঁকিয়ে বলে, আচ্ছা আ, তাই যেন হয়।

অবাক রুবি বলে ওঠে, আরে এ ঘোড়া! সে নিজেকে বলে, আমি ঠিক দেখছি তো? তার দুই হাতের মধ্যমা আলতো ভঙিতে রগড়ে নিল দুই চোখ। না কোনো সমস্যা নেই। সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে। হ্যাঁ, ওটা ঘোড়াই। অন্য কিছু নয়। ছোটখাটো একটা ঘোড়া। একাগ্রচিত্তে ঘাস চাচ্ছে প্রাণীটা

রুবি আর জেসমিন। বাসায় এ দুটি মানুষই থাকে। কাজের বুয়া সব সময় থাকে না। সকালে আসে দুঘণ্টার জন্য। বাসন মাজা, মাছ কাটা ও ঘর মোছা-এ তিনটা কাজ করে দিয়ে যায়। বাকি কাজ ওরা নিজেরাই করে। বুয়া বেশি সময় দিতে পারে না। দিতে চায়ও না। সৈকতের কাছাকাছি ওর একটা দোকান আছে। ঝিনুক দিয়ে তৈরি নানা কিছু বিক্রি করে। ওর ছেলে এখনো ছোট। সংসারের কাজগুলো ভাগ করে নিয়েছে দুই বান্ধবী। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে জেসমিনের, আট বছর ঘর করার পর। রুবি স্বামী হারিয়েছে রোড অ্যাকসিডেন্টে, তা প্রায় এগারো বছর হলো। পরে আর বিয়ে করেনি কেউই। জেসমিন এখন তেতাল্লিশ প্লাস। রুবি একচল্লিশ।

অ্যাটাচ্ড বাথ সম্পন্ন দুই রুমের সুন্দর বাসা। গ্রিল দেওয়া বারান্দাসহ নানা সুবিধা আছে। কিন্তু এটা একটু নিরিবলি জায়গায়। রুবি এখন পছন্দ করলেও প্রথমে বাসাটা নিতে চায়নি। কিছুটা ভেতরের দিকে শহরসংলগ্ন কোথাও থাকতে চেয়েছিল, নিরাপত্তার কথা ভেবে। জেসমিন যুক্তি দেখিয়েছে এ বাসায় সহজে কেউ ঢুকতে পারবে না। তাছাড়া দুইশ গজের ভেতর পুলিশ ফাঁড়ি আছে। দিন-রাত টহল দেয় ওরা। বরান্দা থেকে সমুদ্র দেখা যায়। ঝাউয়ের সারি চোখে পড়ে। গাঙচিল উড়তে উড়তে কখনো-কখনো বাসার খুব কাছে চলে আসে। গলা বাঁকিয়ে ডানে-বামে তাকিয়ে আবার উড়ে চলে যায়। বিকেলে তরুণ-তরুণীরা যখন সৈকতে আসে, ওদের হৈ-হুল্লোড় আর ভেজা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমাগত শব্দ করতে থাকে সি-গালগুলো; আর খালি চক্রাকারে ওড়ে! রুবি এক সময় কবিতা লিখত। ইচ্ছা ছিল এক সময় বইও করবে। ফিডব্যাক ভালো হলে লেখা চালিয়ে যাবে আজীবন। স্বামী হুট করে মরে যাওয়ায় তার অনেক ইচ্ছার সমাধি হয়ে গেছে। এখন আর লিখতে পারে না। তবে পড়ার অভ্যাসটা আছে। এ বাসায় ওঠার তিন-চার দিন পর গোছ-গাছ শেষ হলে, দুই বান্ধবী হাঁটতে হাঁটতে বিচের দিকে গিয়েছিল। অনেকক্ষণ হাঁটার পর ওরা বসে পড়ে। অসংখ্য ছেলেমেয়ে এসে গেছে। তারা চিৎকার করছে। হা হা করে হাসছে। বয়স্করা অমন করছে না। চুপচাপ দেখছে, কেউ বা সিগারেট খাচ্ছে। বাদাম চিবাতে চিবাতে রুবি কথা বলে, সমুদ্র দেখা হয়ে গেলে মানুষ কী করে জানিস?

জেসমিন বলে কী করে?

মানুষ তখন নিজেকে দ্যাখে, নিজের ভেতরটা। তারপর মন খারাপ হয়ে যায়।

মন খারাপ হবে কেন? লোকে তো বিচে আসে মজা করার জন্য।

রুবি বলে, সেটা ঠিক। কিন্তু সমুদ্রের বিশালতা দেখে মানুষ তার ক্ষুদ্রতা টের পায়। তখনই মন খারাপ হয়।

অল্প কিছু লোকের হতে পরে, জেসমিন যুক্তি দেয়, সবার হবে কেন?

সব মানুষ তো নিজের ভেতর ঢুকতে পারে না সব সময়!

রুবি আর কিছু বলে না এ বিষয়ে। এ সময় অদূরে এই যে এ দিকে ইউক্যালিপটাস গাছগুলো তার কাছাকাছি দুটো ঘোড়া দেখা যায়। পাশাপাশি ঘাস খাচ্ছে। একটা বেশ ছোট। ওদিকে চোখ পড়তেই জেসমিন জিজ্ঞেস করে, বাসায় আবার এসেছিল নাকি ঘোড়াটা? যে উত্তর আসে তাতে জেসমিন বোঝে ওটা পরদিনই সন্ধ্যার আগে আগে এসেছিল। শুধু আসেইনি, ও কমপক্ষে আধা ঘণ্টা ছিল। রুবি আরও বলেছিল যে তার প্রতি প্রাণীটার অদ্ভুত একটা টান সৃষ্টি হয়েছে। সে পুরোটা সময় বারান্দার সিঁড়িতে বসেছিল এবং ঘোড়াটা পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। রুবির আদর পাওয়ার জন্য ওর গলাটা বাড়ানো ছিল। আরও জানা যায়, রুবি শুধু গায়ে-গলায় হাত বুলিয়ে ওকে আদরই দেয়নি, দু-তিনটি গাঢ় চুমুকও দিয়েছে।

মার্টিন বাজার জেলা শহর। রাজধানী থেকে সাতশ মাইল দূরে এ ছোট শহরের প্রধান আকর্ষণ সমুদ্রসৈকত। মাস ছয়েক হলো এখানে অনেকটা জায়গা নিয়ে সুপার মার্কেট গড়ে উঠেছে। বসেছে, শুঁটকি মাছের বড় বাজার। নন্দন কানন নামে সুন্দর একটা পার্কও হয়েছে সম্প্রতি। ফলে লোকজনের সমাগম এখন বেশি। মানুষের আশা-অভিরুচির কোনো সীমা নেই। আর মানুষ নিজেও জানে না, অনেক সময়ই এমন হয়, সে কি পছন্দ করে এবং কি পছন্দ করবে অদূর ভবিষ্যতে। জেসমিন নিজেও কি জানত এখানে, এই ছোট জায়গায়, ‘ফ্রেন্স ল্যাংগুয়েজ সেন্টার’ নামে স্কুল খুলবে এবং সে এক অদ্ভুব দুর্বোধ্য আত্মপ্ররোচনা দ্বারা তাড়িত হয়ে ওই স্কুলে ভর্তি হবে। প্রথমে ভেবেছিল কী হবে ওসব শিখে। এখন, দু’মাস পার হওয়ার পর সে ভাবে; সপ্তাহের তিনটা দিন ভালোই তো কাটছে। কিছু না করলেও তো বিকেলের এই ঘণ্টাতিনেক সময় এমনি-এমনি খরচ হতো। বেশ মজাই লাগছে। যেনমটা ভেবেছিলাম ওরকম কঠিন কিছু না। ফ্রেন্সটা যদি মোটামুটি আয়ত্ত করতে পারি কাজে লাগতেও পারে। ছ’মাস পর একটা সার্টিফিকেট পাব। পরে না হয় বই-টই জোগাড় করে ল্যাংগুয়েজের প্র্যাকটিস করা যাবে। অন্যদিকে, রুবি চিন্তা করে, ছাতার ফরাসি ভাষা শিখে জেসমিন কী করবে? এমন তো না ও স্কলারশিপের জন্য চেষ্টা করছে না কি করছে তলে-তলে? হঠাৎ একদিন শুনব বিদেশে যাচ্ছে, অমুক দিন ফ্লাইট! কে জানে বাবা! তারপর তার মাথার ভেতর ঢুকে পড়ে ওই ছোট্ট সুন্দর ঘোড়া। চোখ বন্ধ করে রুবি ওকে দ্যাখে আর ভাবে, আমার জন্য ভালোই হয়েছে। জেসমিন ল্যাংগুয়েজ স্কুলে থাকে। ওই সময়ের ভেতর ও আমার কাছে আসে। কিন্তু আজ কয়েকদিন হলো ও আসছে না। কেন আসছে না? রুবি ক্যালেন্ডারে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্মরণ করার চেষ্টা করে। হ্যাঁ, গত বুধবার এসেছিল। আজ সোমবার। মাঝখানে চার দিন চলে গেছে। আজ পাঁচ দিন হয়ে গেল ও আসে না। কেন যে আসে না! ওর শরীরটা ভালো আছে তো? ভাবতে ভাবতে চোখ ছলছল করে উঠল রুবির। ছোট্ট সুন্দর ঘোড়াটা এখন তার গভীর মায়াবী চোখ রেখেছে রুবির চোখে। কৌতূহল শুধু মানুষের থাকে না; অন্য প্রাণীরও থাকে। যে ভালোবাসে আর যাকে ভালোবাসে তারা উভয়েই উভয়ের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে। যেন মনে পড়ার জন্যই মন ভুলে যায় প্রিয় মানুষের কথা, প্রিয় কিছুর কথা! রুবি এখন কি করে জানবে তার প্রিয় জন্তুটা কোথায় হারিয়ে গেছে, কার সঙ্গে?

মুচকি হাসে ঘোড়া। বলে, দাও, ভালো করে মলে দাও যাতে আর দূরে না যাই। আস্তে আস্তে ও কান দুটো নাড়াতে থাকে এবং তখন চোখ ছলছল করে ওঠে রুবির। পর মুহূর্তেই দেখা যায় ওরা সমুদ্রের কিনার ধরে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে

মাঝে মাঝে দুই বান্ধবী একসঙ্গে শপিংয়ে যায়। নাটক দেখতে যায়। এখানে ‘শিখা নাট্যগোষ্ঠী’ আছে। ওরা ২-৩ মাস পর পর নাটক মঞ্চস্থ করে। সপ্তাহব্যাপী চলে। দু’বছর পরপর আয়োজন করে আন্তঃজেলা নাট্য উৎসবের। শহরের লোকজন তখন পাঁচ সপ্তাহ ধরে নাটক দেখতে পারে। রুবি-জেসমিন দুজনেরই মঞ্চ নাটক পছন্দ। আন্তঃজেলা উৎসবে ওরা কমপক্ষে ৮-১০টা নাটক দেখবেই। গতকাল দেখে এসেছে ‘মেরাজ ফকিরের মা’। লাঞ্চে বসেছে দুই বান্ধবী। ঝোল দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে রুবি বলে, কালকের নাটকটা সুবিধা মনে হলো না।

আমারও ভাল্লাগেনি, জেসমিন উত্তর দেয়, গল্পটা খারাপ ছিল না; অ্যাকটিং জমেনি।

ঠিকই বলেছিস। খালি ওই ফকিরের পারফরম্যান্সটাই যা খানিকটা হয়েছে। এরচেয়ে আমাদের ছেলেমেয়েরাই অনেক ভালো করে।

জেসমিন বলে, ‘শিখা’র ছেলেমেয়েরা? ওরা অনেক বেটার। রনি, মোরশেদ আর শম্পার অ্যাকটিং তো দুর্দান্ত।

রুবি বলে, ওরা হচ্ছে জেনুইন আর্টিস্ট। সুযোগের অভাবে এখানে পড়ে আছে। দেখিস একদিন ওরা সেলিব্রেটি হবে।

জেসমিন হঠাৎ উঠে আচারের বয়াম আনার জন্য কিচেনের দিকে এগোয়। বয়ামটা হাতে নিয়ে টেবিলে ফিরে আসতে আসেত বলে, তোর-না আমের আচার এত ফেবারিট। খাস না তো!

অদ্ভুত এক আধা-হাসি দিয়ে রুবি বলে, মনে থাকলে তো খাব! আমার মনেই থাকে না। তুই খেয়ে শেষ করিস। নইলে ফাঙ্গাস পড়ে যাবে।

এক তৃতীয়াংশ ভাত প্লেটে রেখেই উঠে পড়ল রুবি। বেসিনে হাত ধুয়ে প্লেটটা সিঙ্কে রেখে আসার জন্য ফিরতেই জেসমিন বলে, কিরে অর্ধেক খেয়েই উঠে গেলি যে! কোনো সমস্যা?

না। এমনিতেই। খেতে আর ইচ্ছা করছিল না।

কিচেন থেকে বেরিয়ে সোজা বোডরুমে ঢুকে গেল রুবি। পরিষ্কার আকাশ মেঘে ঢেকে যেতে কতক্ষণ? মানুষের মনও ওই আকাশের রঙের মতো। এই আছে, এই নেই। এই হালকা এই গাঢ়। না হলে ওই ঘোড়াটা রোববারের চমৎকার দুপুরে, এই লাঞ্চ আওয়ারে, রুবিদের ডাইনিং টেবিলের এত কাছে এসে যাবে কেন, কেনইবা মেয়েটাকে অন্য মনস্ক করে দেবে আলটপকা?

‘একবিংশ’ নামে শিল্প-সাহিত্যের একটা মাসিক পত্রিকা রাখে রুবি। বিছানায় শুয়ে কারেন্ট সংখ্যাটা চোখের সামনে মেলে ধরেছিল। বেশিক্ষণ পড়তে পারেনি। ভারী হয়ে আসা চোখ পড়তে দেয়নি। তার একটু পরই ওই ঘোড়া এসে হাজির। ছোট, সুন্দর মায়াবী চোখের ঘোড়াটা। ওর চিবুক, গলা, পশ্চাৎদেশ আরও সুন্দর লাগছে। অপরাধীর ভঙ্গিতে সামান্য দূরে, মাথা নিচু, দাঁড়িয়ে আছে। আদরবোধক শব্দ করে রুবি ওকে কাছে ডাকল। প্রাণীটা এগিয়ে এলো তিন কদম। আরও কাছে ডাকলে ও রুবির একদম কোমর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর গলাটা বাঁকি বলে, আমার ওপর রাগ করেছ না?

রুবি বলে, রাগ করব না! কোথায় ছিলে একদিন?

সাথিরা বললো, চল টিলাগড়ের ওদিকে যাই। ওদিকের জঙ্গলে ঘাস খুব সতেজ। আর জায়গাটাও ভারি সুন্দর…

আর অমনি চলে গেলে ওদের সঙ্গে! রুবি অভিমানী কণ্ঠে বলে, আর ফেরার নাম নেই! আমার কথা একদম মনে ছিল না বুঝি?

ঘোড়া বলে, মনে ছিল তো! কিন্তু কী করব? ওরা আমাকে একা ফিরতেই দিল না।

কি সুন্দর কথা, ফিরতেই দিল না! কান মলে দিই এখন?

মুচকি হাসে ঘোড়া। বলে, দাও, ভালো করে মলে দাও যাতে আর দূরে না যাই। আস্তে আস্তে ও কান দুটো নাড়াতে থাকে এবং তখন চোখ ছলছল করে ওঠে রুবির। পর মুহূর্তেই দেখা যায় ওরা সমুদ্রের কিনার ধরে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে। অনেকটা সময় ধরে হেঁটে চলে এ যুগল যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা অদূরের ওই ঝাউবনের কাছাকাছি পৌঁছে যায়। তারপর রুবি দেখল অনেকটাই জেসমিনের মতো, লম্বা মুখ, চওড়া কাঁধসম্পন্ন একজন ক্রুদ্ধ নারী যার তলোয়ারের মতো দীর্ঘ নাকটা বাঁকানো, ডাইনিসদৃশ, যার চুলগুলো সোনালি কিন্তু এলোমেলো, ডাইনিসদৃশ…। লম্বা একখণ্ড কাঠ দিয়ে পেটাচ্ছে ওই ঘোড়াটাকে। শেকল দিয়ে বাঁধা ঘোড়াটা ওখান থেকে পালাতে পারছে না। ক্রুদ্ধ ওই নারী পেটাচ্ছে আর উচ্চস্বরে বলছে, হারামি! তোর জন্য আমি রাতে ঘুমাতে পারি না! বদশাম, খচ্চর! বল আর আসবি? আসবি এখানে? পিঠের ব্যথায় কঁকিয়ে উঠছে প্রাণীটা। একটা করে আঘাত পড়ছে শরীরে আর লাফিয়ে উঠছে ও। প্রথম দর্শনে হতভম্ভ পর মুহূর্তে সম্বিতপ্রাপ্ত রুবি জে-সি-মি-ন বলে দীর্ঘ চিৎকার দিয়ে ওঠে। ঘুম ভেঙে যায়। বিছানার মাঝখানে হাঁটু মুড়ে বসা হতচকিত, বিহ্বল রুবির মাথায় ভিড় করে আসে নানা সাত-পাঁচ চিন্তা।

সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বাঁশির খুব মিহি ও চ্যাপ্টা শব্দের মতো শব্দ উঠছে হাওয়ায়। বিমূঢ় দাঁড়িয়ে আছে রুবির ছোট্ট সুন্দর ঘোড়া। সে শুনতে পাচ্ছে ভাববিহ্বল এক মাধ্যবয়সী রমণীর বেদনার্ত কণ্ঠস্বর, তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না, প্লিজ একদম ভুল বুঝবে না!

প্রথম সাক্ষাতের পর দুমাস চলে গেছে। এর ভেতর মাত্র তিনবার দু থেকে চার দিনের গ্যাপ হয়েছিল। তাছাড়া এক কি দুদিন পরপরই ওদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। ঘোড়াটা কেন প্রতিদিন রুবির কাছে আসে না বা আসত না সেটা এক রহস্য। জেসমিন ভাবে, ওদের এখন দেখা হয় সপ্তাহে একদিন বা দুদিন। কিন্তু রুবিকে জন্তুটার ব্যাপারে আগের মতো আর উচ্ছ্বসিত হতে দেখি না। সে আরেক রহস্য। জন্তুর সঙ্গে মানুষের এ বন্ধুত্ব নাকি প্রেম নাকি বোঝাপড়া কী বলব বড় অদ্ভুত বড় অস্বাভাবিক ঠেকে আমার কাছে। অন্য প্রাণীর প্রতি মমতা বা টান মানুষের থাকতে পারে কিন্তু তার জন্য কান্নাকাটি বা হা-হুতাশ করা এই প্রথম দেখলাম। রুবি ভাবে অন্যরকম। জেসমিন তো একটা ভিক্ষুককেও দুটাকা দেয় না। পশু-পাখির কষ্ট ও বুঝবে কী করে? যে মানুষ মানুষের ভেতরটা দেখতে পায় না, সে একটা বিড়াল বা কুকুরের বন্ধু হতে পারবে না কখনোই। জানি আমার ছোট্ট সুন্দর ঘোড়াটাকে ও দেখতে পারে না, উপরে-উপরে যদিও প্রশংসা করে আর বলে, আমার যদি ওরকম কেউ থাকত, সেটা যদি একটা বেড়ালও হতো! হিপোক্রিট এক ধরনের, মেয়েটা। তবু আমি ওর সঙ্গে থাকি। এক বছর ধরে একসঙ্গে আছি আমরা। দুজনের মধ্যে অনেক কিছুতেই মিল নেই আবার অনেক বিষয়ে মিল আছে। আমরা একে অন্যের মুড বুঝতে পারি। প্রাইভেসি যাতে বিঘ্নিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখি। জেসমিন অবশ্য কিছু কিছু ব্যাপারে ইমপেশেস্ট, কোনো যুক্তি ছাড়াই। কী করব? মেনে নিয়েছি। একসঙ্গে থাকতে হলে অনেক কিছু ছাড় দিতে হয়। এটা শুধু হাজব্যান্ড-ওয়াইফের বেলায় নয়, দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর বেলায়ও সত্য।

তিনটার একটু পরে বেরিয়ে গেছে জেসমিন। ওর ক্লাস সাড়ে তিনটায়। ছটার মতো বাজে। দুপুরে এক পশলা ভারি বৃষ্টি হয়েছিল। হালকা ঠান্ডা ভাব চারদিকে। সুন্দর বিকেল। রুবির মুডও এখন খুব ফ্রেশ। এক কাপ কফি নিয়ে সে বসেছে ভেতরের বারান্দায় সেখান থেকে উঠোনের পুরো ভিউ আসে। রুবি পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ভাবে, আজ-কাল ও সাত-আট দিন পরপর আসে। কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি বিরতি দিয়ে। কই আমার খারাপ লাগে না তো! অথচ একবার ও চার দিনের ভেতর একবারও আসেনি বলে কী উতলা হয়েছিলাম! আশ্চর্যই লাগে। একটা সময় সবকিছুই সয়ে যায়। জীবন বোধ হয় এমনই। রুবি আরও চিন্তা করে, এর মানে কী? আমি ওকে আগের মতো ভালোবাসি না? না না বাসি। ও এলে আগের মতোই তো আদর করি ওকে। এখন বরং আগের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছি আমরা। গভীর রাতে আমরা যে কী পাগলামি করি সে তো কেবল আমরাই জানি। তার বিন্দু-বিসর্গ জেমসিনও জানে না। তারপর এটা ভেবে মুহূর্তেই আতঙ্কিত হয়, কিন্তু যদি জানে; কোনোভাবে জেনে ফেলে একদিন তখন কী হবে? পর মহূর্তেই রুবির ডেসপারেট মূর্তি আবির্ভূত হয়, জানলে জানবে! হু কেয়ার্স? বেশি বাড়াবাড়ি করলে ওর সঙ্গে থাকব না। ব্যাস!

সপ্তাহে একদিন বেশি করে বাজার করি আমরা। শেষের দিকে দরকার পড়লে এটা-ওটা কিনে আনি। বাজার করতে ভালোবাসে রুবি, ও-ই যায়। আমি রান্নার কাজটা সারি। মাঝে মধ্যে ও আমাকে হেল্প করে। আজ রোববার। রুবি বাজারে। ইলিশ মাছ কিনতে বলেছি। আর পাঁচমিশালি মাছ। কটা বাজে? ওয়ালক্লকের দিকে চোখ রাখল জেসমিন। পৌনে দশটা। রুবির ঘোড়াটা আসবে না কি? আসতেও পারে। দু-তিন দিন নাকি সকালে এসেছিল! আমি দেখিনি, আমি বাসায় ছিলাম না। মাছটা ও দেখে শুনে কিনতে পারে। আমি একবার এনেছিলাম। পচা মাছ দিয়েছিল ব্যাটারা! হ্যাঁ, ও যে শাকসবজি কেনে সেগুলোও বেশ তাজা হয়। রুবি তো ওর ঘোড়াটার মহাভক্ত। আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকে ওর শেপ। ঘোড়া না তো, আসলে ওটা খচ্চর। ঘোড়ার পেটের দিকটা ওরকম ঝুলানো হয় না। কিন্তু কে বোঝাবে ওকে। আজ ইলিশ ভাজা করব। ইলিশ বাজারে উঠলেই হয়। জেসমিন এ পর্যন্ত মোটে দুদিন দেখেছে প্রাণীটাকে। একদিন খুব কাছ থেকে। আরেকদিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে। প্রথম দিনের কথা মনে পড়ে। রুবি ওর গলা জড়িয়ে ধরে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ ‘জেসমিন জেসমিন’ ডাক শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এসেছে মেয়েটা! হাসি মুখে রুবি ডাকল, এদিকে আয়। তুই-না দেখতে চেয়েছিলি ওকে। কাছে আয়। দেখ, চোখ বুঝে কেমন দুষ্টমি করছে আমার সঙ্গে! রুবি ওর গালে খুব আস্তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। জেসমিনের মনে হলো, প্রাণীটা দুষ্টমি করছে না; ঝিমাচ্ছে। হঠাৎ তার চোখ পড়ল প্রাণীটার কানের ওপর। কান দুটো অনেক লম্বা মনে হচ্ছে! একদম কাছে গিয়ে লক্ষ করল, হ্যাঁ, তাই তো! বেশ লম্বা কান! এরকম কান তো থাকে গাধার। গাধার কান অবশ্য আরও লম্বা। আর গাধার মুখ ঘোড়ার মতো অতটা লম্বা নয়। জেসমিন এবার প্রাণীটার তলপেট নিরীক্ষণ করে। আরে! এর পেটটাও গাধার পেটের মতো। কেমন ঝুলানো-ঝুলানো! তার মন তখন বলে ওঠে, এ ঘোড়া তো নয়ই; গাধাও নয়। এতো দেখছি খচ্চর। অ্যানিমেল সিরিজের একটা বিদেশি সচিত্র বইয়ে জেসমিন দেখেছে খচ্চরের কয়েকটা ছবি। ওই গ্রন্থে ঘোড়া, গাঁধা এবং খচ্চরের পার্থক্য দেখানো হয়েছি ছবির মাধ্যমে। মাথার ভেতর সেঁটে থাকা ওই বইয়ের ছবিও চোখের সামনে দাঁড়ানো গাধাসদৃশ প্রাণীর অস্তিত্বÑদুয়ে মিলে জেসমিন নিশ্চিত হলো এটা খচ্চর। রুবির ‘ছোট্ট সুন্দর ঘোড়া’ এখন বোঝা গেল, হায়! গাধাও নয়, খচ্চর! সে এবার মুখ ফুটে উচ্চরণই করে ফেলে, খ-চ্চ-র! ছোট, সুন্দর খ-চ্চ-র! সঙ্গে সঙ্গে কী দুষ্টমি মাথায় জাগল কে জানে, ডান হাত দিয়ে সজোরে তিনটা চড় দেয় প্রাণীটার পশ্চাৎদেশে। ফলে ছোট একটা লাফ দেয় ও। আর রুবি হায় হায় করে ওঠে। এটা কি করলি তুই! মারলি কেন্?

মারলাম কোথায়? একটু টেস্ট করলাম; তোর আদরের ঘোড়াকে। বিরক্তির সঙ্গে রুবি বলেছিল, কিছু বুঝি না ভেবেছিস? সবই বুঝি আমি। ও-ও বোঝে। সর! আর কক্ষনো ওর কাছে ঘেঁষবি না!

একদিন ডিনার পরবর্তী রাতে আড্ডায় জেসমিন কথাটা তুলেছিল। গাধা আর খচ্চরের প্রসঙ্গ। মন ভালো ছিল রুবির তাই মাইন্ড করেনি। জেসমিন বলেছে কীভাবে খচ্চরের জন্ম হয়। এবং কী কারণে তার বান্ধবীর প্রিয় জন্তুটি ঘোড়া বা গাধা নয়। মন দিয়ে শোনার পর রুবি অবাক হয়েছে। বিশ্বাস করেনি, শুধু অবাক হয়েছে, কী বলছিস এসব? আমার ছোট ঘোড়াটা খচ্চর! ঘোড়া নয়?

 ঘুরে দাঁড়াল মন্টি অর্থাৎ রুবির সেই ছোট্ট সুন্দর ঘোড়া। রুবি কাছে এগিয়ে গেল। মন্টি কিন্তু কোনো ধরনের আবেগ প্রকাশ করল না। লেজ নাড়াল না। পা মাটিতে ঘষল না। রুবি ওর পিঠে হাত রাখতেই দ্রুত সরে গেল। রুবি আবার ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কুয়াশা জড়ানো গলায় বলে ওঠে, কোথায় ছিলা তুমি বল তো? আমি কত খুঁজেছি তোমাকে!

হাস্কি গলায় হেসে জেসমিন বলেছিল, বিশ্বাস হচ্ছে না, না? ছবি দেখাই? আমার কাছে একটা বই আছে। তুই নিজেই ডিফারেন্সটা ধরতে পারবি।

দরকার নেই। আমি কিছু দেখতে চাই না। একটু পরই রুবি আরও বলেছে, না, না খচ্চর হতে যাবে কেন? ও ঘোড়াই! তারপর অবুঝের মতো আর্দ্র গলায় বলে ওঠে, খচ্চর একটা প্রাণী হলো! নামটাই তা কেমন জানি? ছিঃ! এত সুন্দর একটা ঘোড়া খচ্চর হতেই পারে না। জেসমিন হাসে। ভালোবাসা কোনো যুক্তি মানে না। মানেনি কখনো। ভালোবাসা কখনো নিকৃষ্ট বা কদাকার হয় না। সে সবখানে, সব সময় অতি সুন্দর। স্বপ্নে এবং জাগরণেও! জেসমিন ভাবে, প্রেম অন্ধ। প্রেমে অন্ধ হলে মানুষ সম্পর্কের ভেতরের কোনো খুঁত বা অস্বাভাবিকতাও দেখতে পায় না। সে কি কখনো চিন্তা করেছে অমন একটা রাত আসবে তার অভিজ্ঞতায়? পশুপ্রেমে দিওয়ানা এক মধ্যবয়স্ক মহিলা তার মহত্বের খচ্চরকে পাশে নিয়ে কাটাবে গভীর রাতের প্রহর; ভেবেছে কখনো? নাকি ভাবা যায়? কিন্তু তা ঘটেছে। দৃশ্যটা কল্পনা করলেই গা রি রি করে ওঠে জেসমিনের। রাত পৌনে তিনটা। অসুস্থ শরীরে ধীর পায়ে ওয়াশরুমে গেল জেসমিন। জ্বরের কারণে কিছু ভালো লাগছিল না। মুখটা তিতা হয়ে আছে। রাতে দুপিস পাউরুটি খেয়েছে শুধু। শরীর খুব দুর্বল। রুমে ফিরে আসার সময় হঠাৎ খেয়াল করে রুবির ঘরের দরজা সামান্য ফাঁক করা। কৌতূহলবশত দরজার কাছে গিয়ে ভেতরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেই থ হয়ে যায় সে, বিছানায় শুয়ে আছে রুবি। প্রায় উলঙ্গ। খচ্চরটা পাশে দাঁড়িয়ে ছোট্ট একটা শব্দ করল। অদ্ভুত শব্দ। ভীষণ অপ্রস্তুত, কিছুটা বোধ হয় ভীত জেসমিন দ্রুত সরে আসে দরজা থেকে। হায় আল্লাহ এটা কি দখলাম আমি? মাই গ…ড! এও কি সম্ভব! সে নিজের কপালে হাত রাখে, গলায় হাতের পিট রেখে তাপের মাত্রা বুঝতে চেষ্টা করে। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে শরীর। আরেকটা নাপা খাব নাকি? এক বড়ি নাপা এক্সট্রা গিলে বিছানায় সটান হয় সে। ও মাই গড! রুবি এসব কী করছে? কেন করছে ও এসব? আমি কি ঠিক দেখলাম? জ্বরের ঘোরে ভুল দেখিনি তো? আমি ঠিক দেখেছি তো? মাথা ঢকঢক করছে জেসমিনের। সে ঘুমাতে পারছে না কিছুতেই।

ওই ঘটনার তিন দিন পর বিষয়টি নিয়ে প্রথমে কথা কাটাকটি পরে তুমুল ঝগড়া হয়েছিল দুবান্ধবীর মধ্যে। মনোরোগের ডাক্তারের কাছে তোকে নিয়ে যাব। অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না আমার-এটা বলায় রুবি সম্মতি তো দেয়ইনি বরং জেসমিনের ওপর খুব নাখোশ হয়েছিল। এতটাই যে, সারা দিন কথাই বলেনি ওর সঙ্গে। দুদিন পর্যন্ত একত্রে বসে খাওয়া-দাওয়াও করেনি। একটু দূরত্ব তো তৈরি হয়েছিলই দুজনের ভেতর। আবার সব ঠিক হয়ে গেছে। তারপর কেটে গেছে তিন মাস। উঠোনের দেওয়ালে যে টিনের গেট ছিল সেটা স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওটা বন্ধ হওয়ার পর মন খারাপ করে বসে থাকত রুবি। জেসমিন লক্ষ করেছে, বিকেল ও সন্ধ্যার মাঝখানের সময়টায়, যখন প্রাণীটা আসত ওর কাছে, রুবির চোখ ছলছল করে উঠত। এখন ওই চোখে কান্নার চিহ্ন দেখা যায় না বটে কিন্তু কান্না কি সব সময়ই ভেজা? আজকাল রুবি যদিও একবারও ওই জন্তুটার কথা বলে না, জেসমিন ঠিকই বোঝে এটা এমন জিনিস যা ভুলে যাওয়ার নয়। মনোকষ্ট তুষের আগুন। একেবারে নিভে যায় না; ক্ষয়ে-ক্ষয়ে জ্বলতে থাকে অনেক ভেরত পর্যন্ত, বাইরে থেকে তুমি বুঝবে না।

এই তিন মাস দুবান্ধবী একসঙ্গে বেরোয়নি। সকালের দিকে বিশেষ প্রয়োজনে জেসমিন একা ঘরের বাইরে গেলেও বিকেলে যায়নি। আজ ওরা বেড়াতে বেরিয়েছে। আজ রুবিই ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। মেয়েটা ঘরে বসে থাকে বিষণ্ণ হয়ে এটা ভেবে জেসমিন ওকে সঙ্গে নিয়ে বেরোল। হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর যায় ওরা। বেলাভূমির পথ ধরে ফিরে আসে। একটা কফি শপে ঢোকে। ওখানে কিছু সময় কাটিয়ে বেরিয়ে আসে। খুব চমৎকার বিকেল। আকাশটা এত নীল হয়ে আছে। শিশুদের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। বেলুন উড়ছে। কয়েকটা ছেলেমেয়ে ফুটবল খেলছে সৈকতে। একটা বাদামওয়ালা দেখে জেসমিন বলে, বাদাম খাবি, নিই? দশ টাকার বাদাম কেনে ও। অনেকক্ষণ পর প্রথম কথা বলে রুবি, ঝাউগুলো না দূর থেকেই বেশি সুন্দর লাগে!

জেসমিন সাড়া দেয়, হ্যাঁ অনেককিছুই দূর থেকে সুন্দর। কাছে গেলে ভালো লাগে না।

হাঁটু পানিতে দাঁড়িয়ে উল্লাসে ফেটে পড়া বাচ্চাগুলোর দিকে তাকিয়ে রুবি বলে, দ্যাখ দ্যাখ, কী খুশি বাচ্চাগুলো। ছেলেবেলার কোনো তুলনায় হয় না রে। টেনশন নাই, চিন্তা নাই! খুব হ্যাপি একটা টাইম।

জেসমিন বলে, আসলেই! ছোটবেলার দিনগুলো এখন স্বপ্নের মতো লাগে।

জোয়ারের সময় সমুদ্র ফুলে ওঠে। ভাটায় আবার নেমে যায় পানি। এখন ভাটা চলছে। রুবির কিন্তু মনে হয় সমুদ্র কিছুটা দূরে সরে গেছে। গর্জনটাও আজ আগ্রাসী মনে হচ্ছে না। কিন্তু হাওয়া! হাওয়া! আজকে হাওয়ার তো হুটোপুটি! একটাও গাঙচিল দেখা যাচ্ছে না। কোথায় গেছে ওরা? নারিকেল গাছগুলোর মাথা ভীষণ নড়ছে। অদূরে একটা মাঝারি ঢেউ আছড়ে পড়ল। ঢেউ না, খুন হয়ে যাওয়া হতভাগী এক মা এলোচুলসমেত উদভ্রান্ত মাথা ফুটল মাটিতে! সন্ধ্যা হতে দেরি নাই। আলো পড়ে গেছে। ওরা উঠে দাঁড়ায়। জেসমিন প্রথমে পা বাড়িয়েছে। এ সময় রুবি ‘এক মিনিট, প্লিজ!’ বলে প্রায় দৌড়ে পৌঁছে যায় ঝাউগাছগুলোর ওদিকে। জেসমিন কিছু বুঝে ওঠার আগেই রুবি মুখোমুখি হয়ে গেছে ওই প্রাণীটার। আর ওই জন্তু যেন রুবিকে দেখে হতভম্ভ ও অপ্রস্তুত, এড়িয়ে যেতে চায় তাকে। রুবি বলে, দাঁড়াও, যেও না! আমার দুটো কথা শোনো!

কিন্তু সে কিছুই শুনতে পায়নি ভঙিতে চলে যাওয়ার জন্য পা ফেলে। তার ঘাড়ের কেশর ফোলা ফোলা। মুখে রাগ-রাগ ভাব। রুবি কাতর কণ্ঠে এবার ডাক দেয়, ম-ন-টি, এমন করো না প্লিজ! তুমি-না কত ভালো! আমাকে কত্তো ভালোবাসো!

এবার ঘুরে দাঁড়াল মন্টি অর্থাৎ রুবির সেই ছোট্ট সুন্দর ঘোড়া। রুবি কাছে এগিয়ে গেল। মন্টি কিন্তু কোনো ধরনের আবেগ প্রকাশ করল না। লেজ নাড়াল না। পা মাটিতে ঘষল না। রুবি ওর পিঠে হাত রাখতেই দ্রুত সরে গেল। রুবি আবার ওর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। কুয়াশা জড়ানো গলায় বলে ওঠে, কোথায় ছিলা তুমি বল তো? আমি কত খুঁজেছি তোমাকে!

ভারী গলায় ও জবাব দেয়, আমাকে খুঁজেছ! কী দরকার খোঁজার?

খোঁজার দরকার নেই? মন্টি! তুমি আমাকে এ কথা শোনালে!

হ্যাঁ, শোনালাম। কারণ তুমি তো আর ভালোবাস না আমাকে!

ভালোবাসি না আমিই? তোমাকে?

না ভালোবাস না। ভালোবাসলে গেট বন্ধ করে দিয়েছ কেন?

আমি বন্ধ করতে চাইনি। বিশ্বাস কর…

আচ্ছা বুঝলাম, মন্টি বলে, কিন্তু আমাকে মারলে কেন তোমরা?

রুবি আকাশ থেকে পড়ল, কই, আমি তো মারিনি কখনো তোমাকে!

মন্টির গলা অভিমানী শোনায়, মানুষ এত নিষ্ঠুর হতে পারে আমি জানতাম না! দ্যাখো, কী মার আমাকে মেরেছে ডাইনিটা! বলেই যেন জামা খুলে ক্ষতস্থান দেখাচ্ছে এমন ভঙিতে রুবির একদম মুখের সামনে পিঠ এগিয়ে দেয় জন্তুটা। রুবি নিস্তেজ আলোর মধ্যেও বুঝতে পারে ওর পিঠের জখমটা ছোট নয় আর তা এখনো শুকায়নি। এবার চুলে বিলি কাটার মতো আলতো করে ওই ক্ষত স্থানের চারদিকে আঙুল বুলায়। মন্টি কিছু বলে না। একটু আরাম পায় বোধ হয়। রুবি তখন ধরা গলায় বলছে, আমি বেশ বুঝতে পারছি কে তোমাকে আঘাত করেছে। আমি ডিসাইড করেছি ওর সঙ্গে আর থাকব না।

সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বাঁশির খুব মিহি ও চ্যাপ্টা শব্দের মতো শব্দ উঠছে হাওয়ায়। বিমূঢ় দাঁড়িয়ে আছে রুবির ছোট্ট সুন্দর ঘোড়া। সে শুনতে পাচ্ছে ভাববিহ্বল এক মাধ্যবয়সী রমণীর বেদনার্ত কণ্ঠস্বর, তুমি আমাকে ভুল বুঝবে না, প্লিজ একদম ভুল বুঝবে না! আমি তোমাকে ভালোবাসি আগের মতোই, সেই যখন তোমার গলা জড়িয়ে ধরে আদর করে ডাকতাম ‘মন্টি’, সেই দিনগুলোর মতোই…

মিথ্যা কথা! আমি বিশ্বাস করি না! আমি কোনো মানুষকে আর বিশ্বাস করি না! ভীষণ ভুল করেছি। আমি আর কষ্ট পেতে চাই না!…

রুবির চোখ দুটো কি অশ্রুতে একেবারে ভিজে গিয়েছিল? ওর ছোট্ট সুন্দর ঘোড়া, ওর মন্টি অবশেষে দৌড়ে চলে যাওয়ার পর বালুমাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছিল রুবি। কতক্ষণ, কেউ জানে না। যখন সে উঠল, হাওয়া পড়ে গেছে। ঘষা তামার পয়সার মতো খরখরে লালচে একটা চাঁদ উঠেছে ঝাউগাছের মাথায়।

আরো পড়তে পারেন

কানু কাকা

আঁধার হারিয়ে গেলেও, সেভাবে ভোরের আলোর উপস্থিতি নেই, রোদ যেনো ফেরারি আসামি হয়ে পালিয়ে। মরুভূমির বালুকণা যেনো উড়ছে। কুয়াশা জানান দিচ্ছে, ক্ষমতাধর কোনো মন্ত্রীর মত। সাথে যুক্ত হয়েছে লাঠিয়াল বাহিনির মত কোনো শীতের তীব্র উপস্থিতি। কিন্তু এসব কিছু উপেক্ষা করে বিদ্রোহী কবিতার শ্লোকের মত রওনা হয়েছে কানু কাকা। হেমন্তের হেলে পড়া সূর্যের মত, তার শরীর….

চারটি অণুগল্প

১. পৃথিবীর শেষ গাছটা হাতে নিয়ে ফিহান সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। চিরকাল দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগা ফিহান সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, এই ছোট্ট চারাটা নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বে, নাকি আরেকটা বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজতে দেবে?   ২. —আমার না প্রায়ই খুব মায়া হয় এদের জন্য —কেন?! —এই যে দেখো, সারারাত জেগে থাকার কথা আমাদের, আর জেগে থাকে ওরা।….

বিবশ

এক. আমাদের আব্বা বড্ড নিশ্চুপ। চুপচাপ-চাপা স্বভাবের। সারাদিনে তিনটা শব্দও তার মুখ দিয়ে বের হয় না। অন্যদিকে আম্মা কথার খই ফোটান। তার সংসার, সংগ্রাম, সীমাহীন দুঃখ এসব। এক রথে একাকী বয়ে চলা জীবনের ঘানি। বাপের বাড়ির রকমারি কেচ্ছা, ছোটবেলায় মা-খালাদের সাথে করা হরেক কাহিনির গপসপ। আমাদের মামারা কেউ বোনের খবর নেয় না। এরপরও সন্ধ্যা করে,….

error: Content is protected !!