
একবার বলে দিলাম তোমার বাচ্চার ভর্তি এখানে হবে না…, যখন বলে দিলাম হবে না তো হবে না। এখন ভদ্র ভাবে এখান থেকে চলে যাও তা না হলে ভাল হবে না।
নাসির এই মহিলাকে এক চোখে দেখতে পারে না, তাকে দেখলেই তার মাথায় রক্ত উঠে যায় আর সে রাগের মাথায় যা তা বলতে থাকে।
‘বিনা পয়সায় চিকিৎসা হয় তাই চালাকি করার জন্য এখানে আসো।’
‘আরে চালু হবে তোর বাপ’ নাসিরের কথা শেষ হবার আগে সে এক আহত বাঘিনীর মতো তার দিকে তেড়ে এলো, তা দেখে নাসির আরো রেগে গেলো আর তাকে বকতে শুরু করল, ‘দেখো, ফালতু কথা বলবে না, তোমার জায়গায় অন্য কোন পুরুষ হলে ধাক্কা মেরে বের করে দিতাম।’
‘খামাখা কেন তর্ক করছো, এখন তো সিস্টারও আসে নাই’, ভিড়ে দাঁড়ানো কিছু মহিলা তাকে বুঝানোর চেষ্টা করলো।
‘আমি কেন তর্ক করতে যাবো? আমি তো গার্ডকে জিজ্ঞাসা করলাম যে সিস্টার আসছে কি না? এই লোকটি কোথায় থেকে এসে চিল্লাতে শুরু করে দিল, ভর্তি হবে না, ভর্তি হবে না।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে আর বেশী বকরবকর কর না আর ভদ্র ভাবে চলে যাও…, ভর্তি হবে না তো হবে না আর যদি সিস্টারের অপেক্ষা করতে চাও কর, কি হবে নিজেই বুঝতে পারবে’ নাসির এক নিঃশ্বাসে এই কথাগুলো বলে ক্লিনিকের ভিতরে চলে গেল। তার যাবার পরই অন্য মহিলারা তার উপর রেগে গেলো-
‘তোমার জন্য আমাদেরও কাজ হবে না, খামাখা সকাল সকাল ঝগড়া শুরু করে দিলা।’
‘আরে বোন খোদার কসম, আমি তো তাকে কিছু বলিও নাই সে নিজেই বক বক শুরু করে দিল।’
‘বেশী গন্ডগোল কর না, রাস্তা ছেড়ে দাঁড়াও তোমরা’ ক্লিনিকের কিছু স্টাফকে আসতে দেখে দারওয়ান মহিলাদেরকে বলল। তার কথা শুনে কিছু মহিলা পিছনে সড়ে দাঁড়ালো আর কয়কজন মাটিতে বসে পড়লো কিন্তু ওই মহিলাটা নিজের জায়গা থেকে সড়তে সড়তে দারওয়ানকে প্রশ্ন করলো, ‘এতো দেরী কেন হচ্ছে দারওয়ান সাহেব? ভর্তি কখন শুরু হবে?’
‘তোমরা নিজেই সকাল সকাল চলে আসো, জানো যে ভর্তি নয়টা থেকে শুরু হয়। এখনও সিস্টার আসতে এক ঘন্টা বাকি আছে।’
দারওয়ানের উত্তর শুনে সে একটু স্বস্তি পেলো আর একটু চিন্তিত হয়ে পড়লো আর সবার থেকে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো যেন সিস্টার আসার পর তার সাথে প্রথম দেখা হয়।
ক্লিনিকের সামনে মহিলাদের ভীর বেড়েই চলছে, মহিলাদের দল তাদের কোলে অপুষ্টিতে আক্রান্ত বাচ্চাদেরকে নিয়ে দলে দলে আসছে। কোন মহিলার মুখে জীবনের কোন লক্ষ্য দেখা যাচ্ছে না, শুধুই অন্ধকার আর অন্ধকার। দুঃখের অন্ধকার, উদ্বেগের অন্ধকার, পরাজয়ের অন্ধকার। জীবন তাদের কি না কি স্বপ্ন দেখিয়েছে কিন্তু তাদের চোখের শূন্যতা দেখে মনে হচ্ছে তাদের সব স্বপ্ন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ধূলিসাৎ হয়েছে। খালি পা, এলো মেলো চুল, ছেঁড়া সাড়ি পরিহিতা মহিলাদের দল তাদের বাচ্চাদের নিজে বুকে আঁকড়ে ধরে ক্লিনিকের দিকে ছুটে আসছে যেন পুরস্কার দেয়ার কোন প্রতিযোগিতা চলছে। যদি একটু দেরী হয়ে গেলে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া থেকে বঞ্চিত থেকে যাবে আর পুরস্কার সেই পাবে যার বাচ্চা সবচেয়ে অপুষ্টিতে আক্রান্ত হবে।
হঠাৎ রিক্সার ঘণ্টির আওয়াজ শুনে মহিলাদের মুখে খুশীর বন্যা বয়ে গেলো, ‘সিস্টার এসে গেছে, সিস্টার এসে গেছে’ সবাই বলতে লাগলো। যে মহিলারা বসে ছিল তারা তাড়া হুড়া করে দাঁড়িয়ে গেলো। রিক্সা কাছে চলে এলো তাতে আসলেই সিস্টার ফ্রেডা ছিলেন। তিনি একজন অভিজ্ঞ ক্যানেডিয়ান নার্স ছিলেন আর সৈয়দপুর প্রজেক্টের ডাইরেক্টার হিসাবে কাজ করছেন। ক্যাম্পে বসবাসরত সবাই উনাকে চিনে যেহেতু যখন এই ক্লিনিকটি স্থাপিত হয়েছে তখন উনি সব ক্যাম্পে নিজে গিয়েছিলেন আর অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের চিহ্নত করেছিলেন। এটা তার মানবগুণ যার দরুণ ছোট বড় সবাই তাকে সিস্টার বলে সম্বোধন করে।
সিস্টারকে দেখেই মহিলারা, ‘সালাম সিস্টার, গুড মর্নিং সিস্টার’ এর স্লোগান দিয়ে রিক্সার চারিদিকে দাঁড়িয়ে গেলো। সিস্টার ফ্রেডা হেসে সবাইকে ‘সালাম সালাম’ বলতে বলতে রিক্সা থেকে নামলেন এবং সবাইকে সৌজন্যতার খাতিরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা সবাই কেমন আছেন? ভাল আছেন তো?’
‘না সিস্টার, বাচ্চার অবস্থা খুব খারাপ’, এটা সেই মহিলা ছিল যে একটু আগে নাসিরের সাথে ঝগড়া করছিল এখন সে সিস্টার ফ্রেডার একদম কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেছে।
বেচারা ফ্রেডা উর্দুর কয়েকটা শব্দেই জানতো, যেহেতু সে দেশ স্বাধীন হবার দেড় বছর পর এখানে এসেছে এবং হেড অফিস থেকে তাকে বাংলা শিখতে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এটা আলাদা ব্যপার যে উনি কাজ করছেন ক্যাম্পে থাকা উর্দু ভাষী লোকদের নিয়ে। উনি মুচকি হাসি দিয়ে হাত নাড়াতে নাড়াতে ক্লিনিকের ভিতরে চলে গেলেন।
উনাকে ভিতরে যেতে দেখে সব মহিলারাও ভিতরে ঢুকার চেষ্টা করল কিন্তু দারওয়ান বাধা দিল। ‘আরে এটা কি আপনারা কেন ভিতরে যাচ্ছেন, এখানে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকেন, সিস্টার ভিতরে গিয়ে পানি গরম আছে কি না, ওষুধ আছে কি না দেখে, নাসির সাব বা ইজহার সাবকে নিয়ে বাইরে চলে আসবেন।’ দারওয়ানের কথা শুনে মহিলারা চুপ থাকার বৃথা চেষ্টা করতে করতে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে গেল। ছয়-সাত মিনিটের পর সিস্টার ফ্রেডা, নাসির সাহেবকে সঙ্গে করে বাইরে এলেন আর সেই মহিলাটা এক দৌড় দিয়ে তার কাছে এসে দাঁড়ালো ‘একে ভর্তি করে নাও সিস্টার, রাত থেকে কোন কথাও বলছে না এই ছেলেটা’, সে তার কোলে থাকা শিশুকে দেখিয়ে বলল। ওর ময়লা ছেঁড়া শাড়ির আঁচল তার মাথা থেকে পড়ে তার বাহুতে ঝুলে আছে যেটা তার জীবনের বর্ণনা দিচ্ছে। নির্দয় সময় তার শান্তি কেড়ে নিয়ে তাকে আজ এই অবস্থানে এনে দাঁড় করিয়েছে।
হঠাৎ তাকে নিজের কাছে দেখে সিস্টার ফ্রেডাও অবাক হয়ে গেলেন কিন্তু সুব্যবহারের জন্য প্রথমে তিনি ওই মহিলা তার পর তার বাচ্চাকে দেখলেন। বাচ্চার পাঁজরের হাড় অনায়াসে গুনে নেয়ার পর তিনি তার বাম হাত দিয়ে বাচ্চার ডান হাত ধরলেন আর ডান হাত দিয়ে বাচ্চার চেহারা ডান-বাম করে দেখে মহিলাকে লাইনে দাঁড়াতে নির্দেশ দিলেন।
‘ওকে ওকে লাইন, লাইন।’
‘দয়া করেন সিস্টার, একে ভর্তি করে নেন।’ মহিলাটা উদ্বেগের সাথে মিনতি করলো। নাসির যে এখন পর্যন্ত তাকে ঘৃণা ভরা চোখে দেখছিল আবার রাগে ফেটে পড়লো আর তীক্ষ্ণ কন্ঠে তাকে বলল, “তুমি যদি তোমার কার্যকলাপ থেকে বিরত না থাকো তাহলে তোমার খবর আছে। যদি তোমার নিজের সম্মানের একটুও খেয়াল থাকে তাহলে এখনই এখান থেকে বেরিয়ে যাও।’
‘তুমি কেন মাঝখানে কথা বল, আমি তো সিস্টারের সাথে কথা বলছি, মহিলাটাও তার কন্ঠস্বর উঁচু করে বলল।’
ওই মহিলা আর নাসিরকে একের অন্যের সাথে ঝগড়া করতে দেখে সিস্টার ফ্রেডা ব্যপারটা জানতে চাইলেন কিন্তু নাসিরের বলার আগেই সেই মহিলাটি সিস্টার ফ্রেডার কাছে নালিশ করলো, ‘দেখো সিস্টার সে বলে যে ভর্তি করা যাবে না।’
‘হ্যাঁ বলে দিলাম যে ভর্তি হবে না, ভর্তি হবে না। তোমার মতো মিথ্যুক আর চতুরের জন্য এখানে দয়ার কোন স্থান…’
‘ওই মিয়া, মুখ সামলে কথা বল, মিথ্যুক হবে তোর বাপ, তোর দাদা এই জন্য অন্যদের নিজের মতো ভাবো। চাকুরী করো তাই চর্বি হয়েছে। আমার লোকও যদি চাকুরী করতো তাহলে তোমার দ্বারে ভিক্ষা করার জন্য আসতাম না।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, এখন এখান থেকে ভাগো।’
সিস্টার ফ্রেডা বিস্ময়ের সাথে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো তার পর তাদেরকে চুপ থাকতে বলেন। ‘অনেক হয়েছে এবার চুপ করো’, তারপর নাসিরের দিকে তাকিয়ে কারণ জানতে চাইলো। নাসির প্রথমে তার কুবচনের জন্য ক্ষমা চাইলো তারপর তাকে জানাতে লাগলো, ‘এই মহিলাটি এখানে আজ চতুর্থ বার এসেছে, সে নাম বদল করে করে বাচ্চা ক্লিনিকে ভর্তি করায়। দ্বিতীয়বার যখন সে এলো তখন বাচ্চার নাম জাভেদ বলল তবে প্রথমবার বাচ্চার নাম বলেছিল সেলিম। আমার একটু সন্দেহ হল তখন আমি তাকে মনে করিয়ে দিলাম যে আগে তুমি ওর নাম সেলিম বলেছিলে। তখন সে জানালো যে লোকজন তাকে দুই নামেই ডাকে। আমি রেজিস্ট্রেশন করে নিলাম আর বাচ্চা সুস্থ হয়ে ডিসচার্জ হয়ে গেলো। কিন্তু ডিসচার্জ হবার পনের–বিশ দিন পরে সে আবার চলে এলো আর ওই দিন আমি আবার রেজিস্ট্রেশন রুমে ছিলাম আর ইজহার আপনার সাথে স্লিপ ইস্যু করছিলো। সেই দিন আমি তাকে আবার বাধা দিলাম তখন সে কসম কেটে বলল যে এটা আর একটা বাচ্চা। আমি ভাল করে জানি সে একই বাচ্চাকে বার বার নিয়ে আসে। জানি না এই মহিলাটি বাচ্চার সাথে কি করে যে সে পনর-বিশ দিনের মধ্যে আবার অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে যায়।
বাচ্চাকে দেখে মায়াও লাগে তাই ভর্তি করে নেই। আর আপনার নিশ্চয় মনে আছে যে আপনি “ডিসপ্লে বোর্ড” এর জন্য এই বাচ্চার ছবি তুলে ছিলেন যেহেতু এরই বাচ্চা সবচেয়ে বেশী দুর্বল ছিল আর সেই বাচ্চা এটাই।’
‘ওঃ আই সি’ নাসিরের কথা শুনে ফ্রেডা সন্তুষ্ট হলেন এবং ইংরেজীতে বললেন, ‘ওকে নিয়ে আলীম সাহেবের কাছে যাও আর ইজহারকে এখানে পাঠিয়ে দাও আমার সাহায্য করার জন্য।’
‘ঠিক আছে ম্যাডাম’ নাসির সশ্রদ্ধ ভাবে উত্তর দিলো এবং মহিলাকে বলল, ‘চল আমার সাথে আডমিনিস্ট্রেটার সাহেবের কাছে।’ সে ভয় ভয় দৃষ্টিতে ফ্রেডার দিকে তাকালো তারপর চুপচাপ নাসিরের পিছনে হাঁটতে শুরু করলো।
আলীম সাহেব খুব ধৈর্যের সাথে সমস্ত বর্ণনা শুনলেন তারপর ওই মহিলার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘এই বাচ্চাটা কার?’ এই কথা শুনে সে ঘাবড়িয়ে গেলো আর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তার বাচ্চাকে বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়ে উত্তর দিলো, ‘আমার নিজের, আল্লাহর কসম।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে, আপনি বসে কথা বলেন’ আলীম সাহেব খুব ভদ্রভাবে বললেন। যখন সে আবার বসে গেলো তখন উনি আবার বলতে লাগলেন, ‘যদি এই বাচ্চা আপনার তাহলে আপনার কি ওর জন্য একটুও মায়া লাগে না? নাসির বলল যে আপনি আজ এই নিয়ে চতুর্থ বার এখানে এসেছেন আর যখন আপনার শিশুর এখানে চিকিৎসা হয় তখন আপনি তাকে সময় মতো নিয়ে আসেন না আর সময় মতো বাসায় ফিরত নিয়ে যান না। আর যখন বাচ্চাটা ‘ডিসচার্জ’ হয় তাকে যা উপহার দেয়া হয় যেমন সাবান, কাপড়, খেলনা, এসব আপনি বিক্রি করে দেন।’
‘না ভাই, কসম কেটে বলছি যে বাচ্চা আমার নিজের আর আজকে নিয়ে দ্বিতীয়বার এসেছি আর সময় মতো নিয়ে আসি…’
‘আবার মিথ্যা কথা বলে, এই জন্য আমি তোমাকে ঘৃণা করি’ নাসির আর সহ্য করতে না পেরে তাকে কথা পুরা করতে দিলো না। তারপর সে আলীম সাহেবকে বলল, ‘স্যার আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি আগের তিনটি রেজিস্ট্রেশন কার্ড আর ডিসপ্লে বোর্ডে লাগানো ছবি নিয়ে আসি।’ আলীম সাহেব তাকে অনুমতি দিলেন আর সে কিছু ক্ষণের মধ্যে তিনটি কার্ড যার উপর মহিলার বৃদ্ধা আঙ্গুলের ছাপ ছিল আর ছবি নিয়ে এলো। তা দেখে আলীম সাহেবের কপালের ভাঁজ আরো গাঢ় হয়ে গেলো আর তিনি তার লাল লাল চোখ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইলেন আর গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এখন তো আমারও ঘৃণা লাগছে, আপনি এতো মিথ্যা কথা বলেন, লজ্জা লাগে না আপনার?’
মহিলাটা চোখ নামিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে ভয়ে ভয়ে বলল, ‘কি করবো বলেন, আমি তো মা, বাচ্চার অসুখ সহ্য করতে পারি না।’
‘তাহলে এটাতে মিথ্যা বলার কি দরকার, ক্লিনিক তো করা হয়েছে সাস্থ্য সেবা প্রদান করার জন্য। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে যে ডিসচার্জ হবার কয়েক দিনের ভিতর আপনার বাচ্চাটা আবার কেমন করে এতো দুর্বল হয়ে যায়? অন্য কোন বাচ্চার সাথে তো এমন হয় না…, হ্যাঁ এক বা দুটি বাচ্চার এমন হয়েছে তাও সাত আট মাস পরে তারা আসছে কিন্তু আপনার বাচ্চার মতো তো কারই হয় নাই…’ উনার কথা শেষ হবার আগেই নাসির দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে বলে উঠলো– ‘আমার মনে হয় স্যার বাচ্চা ডিসচার্জ হবার পর সে তাকে নিয়ে ফিডিং সেন্টারে যায় না, যেহেতু তাকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরা ফিরা করতে দেখা যায়।’
‘কি করবো ভাইয়া, নিরুপায় হয়ে এদিক ওদিক ঘুরি, পাঁচটা বাচ্চার লালন পালন করতে হয়’, সে আসতে করে বলল।
‘আপনার স্বামী নাই?’
‘আছে, কিন্তু দেশ স্বাধীন হবার ছয় মাস পর থেকে অসুস্থ, নিঃশ্বাসের কষ্ট, আর সারাক্ষণ কাশতে থাকে। স্বাধীনের পর পরই তার চাকুরীও চলে গেলো।’
‘আপনার সংসারের খরচ কি ভাবে চলে?’ আলীম সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন।
‘ভিক্ষা করি’ এটা বলে সে তার হাতের তালু উনার দিকে প্রসারিত করলো যেখানে কয়েকটি পয়সা পড়ে ছিল, একদম সত্য সাক্ষ্যের মতো, তারপর সে বলল, ‘বাচ্চারাও ভিক্ষা করে, সারা দিন সবাই ভিক্ষা করলে এক টাকা, আঠ আনার মতো আয় হয়। এখন তো ভিক্ষা করলেও কিছু পাওয়া যায় না। এখন তো হাজার হাজার লোক ভিক্ষা করতে শুরু করেছে, কে কাকে ভিক্ষা দিবে? কেউ যদি দেয়ও তাও এক পয়সার বেশী না, শুধু একজন মেশিন ওয়ালা আছে যে এক দেড়’শ মহিলাকে লাইনে দাঁড় করিয়ে এক পয়সা করে ভিক্ষা দেয় তাও তো সে দেয়।’ সে এই কথাগুলো বলে উঠে দাঁড়ালো আর খুব নিয়ের সাথে বলল, ‘এবার একে ভর্তি করে নাও, আর মিথ্যা কথা বলব না, কসম খেয়ে বলছি।’
‘বসুন নিজের জায়গায় বসুন’ আলীম সাহেব রেগেই বললেন।
‘ভর্তি করে নাও, ভর্তি করে নাও বলে যাচ্ছ, এই ক্লিনিকটি কেন খোলা হয়েছে? সিস্টাররা বিদেশ থেকে কেন এসেছেন? উদ্দেশ্য একটাই ক্যাম্পে যারা আছে তাদেরকে সেবা সাস্থ্য সেবা প্রদান করা। আগে মাত্র পঞ্চাশটা সিট ছিল এখন তা বাড়িয়ে এক’শ বিশটা করা হয়েছে।’
‘এইসব কাদের জন্য করা হয়েছে? আগে কি এমন ক্লিনিক ছিল?’
‘তখন তো ক্যাম্পও ছিল না আর বাচ্চারাও তো এমন হতো না ভাই।’
‘আপনি নিজেই আপানার সন্তানের ভালো চাননা তাহলে আমরা কি করবো?’
‘না ভাই এমন বলবেন না নিজের সন্তানের ভালো চাইব না কেন?’ তার গলা কান্না কান্না হয়ে গেল।
‘যদি আপনি আপনার বাচ্চাকে ভালোবাসেন তাহলে সে দশ পনরো দিনের মাথায় আবার কেন অসুস্থ হয়ে একদম দুর্বল হয়ে যায়? উত্তর দেন তাকে কি ফিডিং সেন্টারে নিয়ে যান?’
‘হ্যাঁ ভাই নিয়ে যাই।’
‘আপনি মিথ্যা কথা বলছেন, বাচ্চাকে যদি ফিডিং সেন্টারে নিয়ে যেতেন তাহলে বাচ্চার অবস্থা এমন হতো না। ডিসচার্জ করার পর বলা হয় যে বাচ্চাকে প্রত্যেক দিন ওখানে নিয়ে যাবেন যেন তাকে দুধ, বিস্কুট আর ভিটামিনের ট্যব্লেট দেয়া যায় যেন বাচ্চা আবার অপুষ্টিতে না ভুগে।’
‘বাচ্চার ফিডিং কার্ড কোথায়, আমাকে দেখান?’ আলীম সাহেব কঠিন স্বরে বললেন।
‘ওটা তো বাসায়।’
‘ওটা নিয়ে আসেন’ আলীম সাহেব আদেশের স্বরে বললেন।
‘আগে একে ভর্তি করে নাও না ভাই দয়া করে, আসতে যেতে অনেক সময় লাগবে আর এর ভিতরে এর যদি কিছু…।’
‘যা কাজ আমাদের করা ওটা আমরা করবো, বাচ্চাকে এখানে রেখে যান আর আমাদের ক্লিনিকের রিক্সা করে যান আর কার্ড এনে দেখান, যতক্ষণ দেখাবেন না ভর্তি করা হবে না।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে আমি যাচ্ছি কিন্তু হাত জোর করে অনুরোধ করি ওকে ভর্তি করে নিয়েন।’ সে এই কথা বলে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো।
প্রায় আধা ঘন্টার পর সে একটি ময়লা কাগজে মোড়ানো কার্ড নিয়ে হাজির। কার্ড দেখে আলীম সাহেব রেগে লাল হয়ে গেলেন, ওর জায়গা যদি কোন পুরুষ হলে তাকে জুতা মেরে ক্লিনিক থেকে বের করে দিতেন, নিজেকে কোন রকম সামলিয়ে নিয়ে তাকে বকতে শুরু করে দিলেন ‘আপনি আসলেই একজন ইতর আর চতুর মানুষ, বের হয়ে যান এখান থেকে। ছয় মাস আগে আপনাকে কার্ড দেওয়া হয়েছিল আর আপনি মাত্র পনরো দিন ফিডিং সেন্টারে গিয়েছেন। আপনি মা না পেত্নি? আপনি মা হয়ে নিজের সন্তানের সাথে এমন ব্যবহার করেন, তার কাপড় বিক্রি করে দেন, তাকে দুধ খাওয়াতে নিয়ে যান না। আপনি মায়ের নামে কলঙ্ক। আপনি যদি স্বাধীন থাকতে চান তাহলে বাচ্চাকে কষ্ট কেন দিচ্ছে? তাকে কোন নদীতে ফেলে দেন।’
‘না না এমন করে বলবেন না সাহেব, আপনিও তো কারো বাবা’ মহিলাটি প্রায় কেঁদে দেয়ার স্বরে বলল আর তার চোখ অশ্রুজলে ভরে গেলো। সে নীচে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল যেন তার অশ্রু লুকানোর চেষ্টা করছে যেটা তার চোখ থেকে বেরিয়ে যাবার জন্য উদগ্রীব ছিল। তার পর সে কান্না কান্না স্বরে বলল ‘কে হবে এমন মানুষ যে নিজের সন্তানকে ভালোবাসে না? কিন্তু আমার তো কোন রাস্তা নেই, তাই তো…’
‘এমন কি কারণ যে আপনি আপনার বাচ্চাকে সুস্থ দেখতে চান না?’ আলীম সাহেব অনেক রেগে বললেন, উনার উঁচু কণ্ঠ শুনে সে কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে থাকল…, তারপর পাথরের বুক চিরে যে ভাবে ঝর্ণা বের হয় তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো। তারপর কাঁপা কাঁপা গলায় ধাঁধা বুঝানোর মতো আলীম সাহেবকে বলল, ‘আপনি এতো বড় অফিসের মালিক হয়েও এতো ছোট কথা বুঝতে পারছেন না সাহেব?’
আলীম সাহেব একটু শান্ত হলেন তারপর তার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কি, কি বলতে চাও?’
সে কিছুক্ষণ চুপ থাকলো তারপর ভয় আর দুঃখ মিশানো কন্ঠে বলল, ‘সুস্থ বাচ্চা কোলে থাকলে কেউ ভিক্ষা দেয় না!’
উর্দু গল্পকার এস এম সাজিদের এই গল্পটি মূল ভাষা থেকে অনুবাদ করেছেন হাইকেল হাশমী