
(একটি কাল্পনিক বিতর্ক। যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : গ্যালিলিও (Galileo Galilei, ১৫৬৪-১৬৪২): ইতালির বিজ্ঞানী। তিনি প্রথম দূরবীন দিয়ে শুক্রগ্রহের অর্ধেকের বেশি কলা (gibbous phase of Venus) আবিষ্কার করে পৃথিবী-কেন্দ্রিক সৌরজগত-তত্ত্বের মরণ নিশ্চিত করেন। ‘পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে,’ এই ঘোষণার জন্যে রোমের ধর্মযাজক পোপের নির্দেশে তাঁকে জীবনের শেষ দশটি বছর গৃহবন্দী অবস্থায় কাটাতে হয়। কেপলার (Johannes Kepler, ১৫৭১-১৬৩০): জার্মান গণিতবিদ এবং জ্যোতিবিজ্ঞানী। পৃথিবী এবং আর সব গ্রহের সূর্যের চারদিকে ঘোরার নিয়ম অংক কষে বের করেছিলেন। কোপার্নিকাস (Nicolaus Copernicus, ১৪৭৩-১৫৪৩): পোল্যান্ডের গণিতবিদ এবং জ্যোতিবিজ্ঞানী। তিনি প্রথম প্রমান-সহ সূর্য-কেন্দ্রিক সৌরজগতের মডেল প্রতিষ্ঠিত করেন। টাইকো (Tyco Brahe, ১৫৪৬-১৬০১): ডেনমার্কের জ্যোতিবিজ্ঞানী। দূরবীন আবিষ্কারের আগে তিনি-ই ছিলেন ইউরোপের সবচেয়ে বড় নক্ষত্রবিজ্ঞানী। ক্যাথেরিনা (Tyco Brahe, ১৫৪৬-১৬০১): জ্যোতিবিজ্ঞানী কেপলারের মা।)
গ্যালিলিও : আমার আগে কেউ টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশের পানে তাকায় নি। বৃহস্পতি গ্রহের বড়বড় চারটি চাঁদ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আইও, ইউরোপা, গ্যানিমেড, এবং ক্যালিস্ট বৃহস্পতির চারপাশে ঘুরছে। দূর আকাশের সবাই তাহলে পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে না! পাদুয়া ইউনিভার্সিটির দর্শন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আমাকে মিথ্যেবাদী বলেছেন। অনেকবার বলেছি, “একবার এসে নিজের চোখেই দেখুন না কেন?” এখানে না এসে উনি ডিউক সাহেবের দরবারে গেছেন। ওখানে দার্শনিক যুক্তি দিয়ে আমার দেখা উপগ্রহগুলোকে যেন আকাশ থেকে তাড়াতে চাচ্ছেন! কেমন বেকুব! কেপলার, আজকে তুমি আমার পাশে থাকলে দুজনে মিলে একসাথে হো হো করে হাসা যেত।
কেপলার : আমি হাসতে ভুলে গেছি! আমার মা ক্যাথেরিনাকে খৃষ্টধর্মের পেয়াদারা জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। আমার মা না কি ডাইনি! কিছুদিন আগে সাতজন মেয়েকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছে। রাত তিনটে বাজে, একটুও ঘুমাতে পারি নি, মাথার ভিতরে তীব্র যন্ত্রনা। মা’কে বাঁচাই কি করে?
কোপার্নিকাস : আমি বলেছিলাম যে পৃথিবী এবং আর সব গ্রহ সূর্যের চারদিকে ঘোরে। মহাবিশ্বের কেন্দ্র যে পৃথিবী নয় সেটা অনেকদিন আগেই বুঝেছিলাম, শুধু নিরাপত্তার কথা ভেবে ভয়ে মুখ খুলিনি। যখন মৃত্যু আসন্ন জেনেছি, তখনই সত্য কথাটা ফাঁস করে দিয়েছি। মৃত্যুপথযাত্রী মানুষকে মারার উৎসাহ ধর্মমোড়লদেরও নেই। মরা মানুষকে ওরা আর কি করে মারবে?
টাইকো : খুব প্রভাবশালী পরিবারে জন্ম আমার, টাকা পয়সার কোনো অভাব ছিল না। বানিয়েছিলাম শখের মানমন্দির (observatory), সেখান থেকে ক্যাসিওপিয়া নক্ষত্রপুঞ্জের মাঝে আবিষ্কার করেছিলাম এক নুতন তারা। “নক্ষত্ররা স্বর্গের অলংকার, ওদের জগতে সবকিছুই অপরিবর্তনীয়,” এই বিশ্বাসের মুখে চুনকালী লেপে দেয় আমার দেখা নবীন তারাটি। ধর্মের মোড়লরা ক্ষুব্ধ হয়েছিল। পারিবারিক প্রতিপত্তির কারণে কেপলার আর গ্যালিলিওর মতো দুর্দশায় পড়তে হয় নি। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, মেজাজটা আমার বেজায় চড়া, এক তলোয়ার যুদ্ধে আমার নাকটি হারিয়েছিলাম। মদে এবং ভোজনে ছিল ভীষণ আসক্তি। তাই বেশি দিন বাঁচি নি। মরার আগে কেপলারকে আমার মানমন্দিরের সব দায়িত্ব দিয়েছিলাম। ওর জন্যে দুঃখ হয়।
ক্যাথেরিনা : আমি একজন মা। আমি সম্পূর্ণ নির্দোষ। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, আমি জাদু জানি, জাদুর ভেলকি দেখিয়ে অন্যকে অসুস্থ করে ফেলতে পারি। অথচ ছেলেমেয়ের ভালোমন্দ ছাড়া আমি এই পৃথিবীর আর কিছুরই খবর রাখি না। আমাকে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়েছে, আমাকে নিপীড়ণের ভয় দেখানো হচ্ছে। আমার ছেলে কেপলার সৌরজগতের গ্রহদের চলাফেরা নিয়ে তিনটি সূত্র আবিষ্কার করেছে। সে সব আমি কিছুই বুঝি না। শুনেছি খ্রীষ্টধর্মগুরু পোপ খুব রেগে গেছেন। আমাকে ডাইনি অপবাদ দিয়ে কারাগারে বন্দী করে রাখার আসল কারণ হয়তো সেটাই। কেপলারের জন্যে দুঃখ হয়, সৌরজগতের কথা না ভেবে ও এখন শুধু এই হতভাগিনী মায়ের কথা ভাবছে। শুনেছি দোষী রায় হলে গলায় ফাঁস পরিয়ে চেয়ারের সাথে বেঁধে রেখে চারদিকের কাঠে আগুন জ্বালানো হয়। ফাঁসের টানটা জোরে হলে আগুনে পোড়ার আগেই নাকি অনেকের মৃত্যু ঘটে। যীশুর কাছে প্রতিদিন চোখের জলে বুক ভিজিয়ে প্রার্থনা করি, জল্লাদ যেন আমাকে একটু দয়া করে, গলার ফাঁসের টানটা যেন ভীষণ শক্ত হয়, আগুনে পোড়ার আগেই যেন মরে যাই।
কেপলার: খ্রীষ্টান ধর্মযাজক (Pope Sixtus IV), স্পেনের রাজা ফার্ডিনান্ড, রানী ইসাবেলা, এবং উঁচু বংশের লোকেরা (nobles) হাতে হাত মিলিয়েছে। ওরা গড়েছে, “The Tribunal of the Holy Office of the Inquisition (১৪৭৮-১৮৩৪)।” দয়ালু ঈশ্বরের নামে মিথ্যে অপবাদে চরমতম নির্যাতন করে সাধারণ মানুষকে খুন করা ওদের কাজ। প্রথমে ওরা মেরেছে স্পেনের মুসলমান এবং ইহুদিদের, এখন খৃষ্টানদেরও রেহাই নেই। ওদের বিচারের রায় শুনলে রক্ত হিম হয়ে আসে, “ডাইনি, দয়ালু ঈশ্বরের আদালতে তোমার বিচার করে তোমাকে দোষী বলে রায় দেয়া হয়েছে। তুমি শয়তানের অনুচর। তোমাকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হবে। এখনই দোষ স্বীকার করে অনুতাপ করো যাতে ঈশ্বর তোমাকে ক্ষমা করতে পারেন। যদি তা না করো তবে এই আগুনে এখন যেমন পুড়বে, পরকালে নরকের আগুনে তেমনি অনন্তকাল ধরে ছটফট করবে।”
হেরোড এন্টিপাস এবং পন্টিয়াস পাইলেটার দরবারে যীশুর মৃত্যুদন্ডের রায় কি এতো দয়াহীন ছিল? আর মৃত্যু-যন্ত্রণার ছবিটা?
“চেয়ারের সাথে বেঁধে ফেলা হয়েছে। শক্ত দড়িটা ওর গলাকে জাপ্টে ধরেছে। চারিদিকে কাঠে আগুন জ্বালানো হয়েছে। আগুনে পোড়া শরীরটা যন্ত্রনায় মোচড় দিচ্ছে। ওর সামনে উড়ছে ক্রুশকাঠে বিদ্ধ নির্যাতিত যীশুর ছবি!”
যীশু, ক্রুশকাঠে বিদ্ধ হয়ে তোমার যন্ত্রনা কি এর চেয়ে বেশি ছিল? যীশু, তুমি কি আবার আসবে?
লেখক : কোপার্নিকাস, তুমি বলেছিলে “Earth revolves” সেই থেকে “revolutionary” কথাটির জন্ম, বামপন্থীরা এই শব্দটি এখন ঘনঘন ব্যবহার করে। টাইকো, তুমি যে নতুন তারাটি দেখেছিলে ওটা ছিল একটি সুপারনোভা বিস্ফোরণ, দূর আকাশের একটি অনুজ্জ্বল তারা মরার আগে হটাৎ লক্ষ তারার আলো নিয়ে জ্বলে উঠেছিল। মর্তলোকের অধিবাসীদের মতো তারাদেরও মরণ হয়। তোমার আবিষ্কার অপরিবর্তনীয় স্বর্গলোকের শাশ্বত দেবতাদের ঘরছাড়া করেছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানে আমরা এখন তোমাদেরকে এইভাবে চিনি : কোপার্নিকাস (the revolutionary), টাইকো (the observer), কেপলার (the analyst), এবং গ্যালিলিও (the defender)। যীশু আসেনি। ধর্মযাজকদের আদালতে হাজির হয়ে কেপলার তাঁর অতুলনীয় বিতর্কশক্তি দিয়ে মা’কে বাঁচিয়েছিলেন।
লেখক: পদার্থবিদ ও ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ইমিরিটাস প্রফেসর।