আঁধার হারিয়ে গেলেও, সেভাবে ভোরের আলোর উপস্থিতি নেই, রোদ যেনো ফেরারি আসামি হয়ে পালিয়ে। মরুভূমির বালুকণা যেনো উড়ছে। কুয়াশা জানান দিচ্ছে, ক্ষমতাধর কোনো মন্ত্রীর মত। সাথে যুক্ত হয়েছে লাঠিয়াল বাহিনির মত কোনো শীতের তীব্র উপস্থিতি। কিন্তু এসব কিছু উপেক্ষা করে বিদ্রোহী কবিতার শ্লোকের মত রওনা হয়েছে কানু কাকা। হেমন্তের হেলে পড়া সূর্যের মত, তার শরীর হেলে পড়ার পথে। শরীরের চামড়া সমুদ্রের ঢেউয়ের মত ভাজ না পড়লেও, বয়সের ছাপ শরীরে। মাথার চুলগুলো আধেক কাঁচা, আধেক পাকা। মুখে ঁেখাচা খোঁচা দাড়ি, সাথে গোঁফ রেখেছে। বুড়ো বা জুয়ান তাকে এক নামেই চেনে কানু কাকা। সে যেনো একই বয়সে নিজেকে ধরে রেখেছে, হালকা পাতলা গড়নের মানুষ। পেশায় নরসুন্দর। তার চুল কাটা মানে একই ডিজাইন। এলাকাতে ‘আর্মি ছাট’ বাচ্চা কাচ্চা ভীষণ পছন্দ, বড় মানুষদের কাছেও পরিচিত। তাই যেকোনো পোলাপানকে চুল ছোট করতে, আর্মি ছাট বলে বেড়ান তিনি। কখনো বড়দের চুল মনের অজান্তে বেশি ছোট করে ফেললে, তাকে সান্ত¡না দেন এটা আর্মি ছাটের নতুন রুপ।

কানু কাকা ছুটছে খোলা আকাশ, মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে, ছোট্ট রাস্তা অনেকটাই আইলপথের মত পথ ধরে। তিনি ঝড় বাদল কিছু বোঝেন না, শীত-বসন্ত বা কোনো ঋতু কিছুই মানেন না। ভয় ডর তাকে ছুঁতে পারে না। তার দরকার জীবন ধারনের জন্য কিছু অর্থ আয়। গত পড়শুদিন এসেছিল ছদবের, তার মায়ের বয়স বেড়ে গেছে। চুলগুলো কোকড়া হয়ে জট বেঁধেছে। পরেরদিন ভোর বেলা যাবার কথা ছিল, কিন্তু যেতে পারেনি। তার কারণ ছিল পাড়ার জমিলা চাচী ভীষণ অসুস্থ। যেকোনো সময় না ফেরার দেশে চলে যেতে পারেন। বয়সও তার ভারি হয়ে গেছে। চুল কাটাতে আট সাট বেঁধে ধরেছিলেন তার পরিবারের সন্তানেরা। অনেকটাই কানু কাকাকে হাইজ্যাকের মত নিয়ে যান। তাকে সেদিন চুল ছাটাই শেষ করে বেরুবেন, কিন্তু অনেকেই এসে হাজির। পরে বাড়ির উঠানে টুল নিয়ে বসে যান। একের পর একজনকে চুল ছাটাই করতে থাকেন।

কেউ নানা বাড়ি ঘুরতে এসেছেন। চুল কাটানোর সুযোগ হয়নি। সে এসে হাজির তার কাছে। কেউ সড়ক দূর্ঘটনায় মাথা কেটে গেছে, চুল ফেলে দেওয়া দরকার, তার ডাক পড়ে। সেও হাজির হয় তার কাছে। তারপর কালো পাতলা একটি কাপড় দিয়ে শরীর প্যাঁচিয়ে নেয়, সেটা আবার গলার সাথে বেঁধে নেয়। দুই হাঁটুর চিপায় মাথা রেখে, ঘ্যাচাং ঘ্যাচাং করে কেটে ফেলে চুল। ছোট্ট বাটিতে টিউবয়েল থেকে পানি নিয়ে আসে। ক্ষুর দিয়ে চুল কাটার সমাপ্তি ঘটে।

হেমন্তে তার একটু আয় বেশি হয়। মন মেজাজ ফুরফুরে থাকে। গ্রামে নবান্ন উৎসব শুরু হয়। ঘরে ঘরে ধান তোলার প্রতিযোগিতা বাড়ে। ধান কাটা শেষ হলে দিনে চলতো লাঠিবাড়ি খেলা। আর রাতে বসতো সং দেয়া। গ্রামের মানুষ সব দুঃখ ভুলে মিলিত হতো রাতের আনন্দ উৎসবে। কানু কাকা এখানে নারীর অভিনয়, কখনো চুল কাটার নাটিকাতে অভিনয় করতো। তার অভিনয়ে সবাই বেশি আনন্দ পেত। সে স্টেজে এলেই দর্শক হাত তালি দেয়া শুরু করতো

এমন অনেক অসুস্থ মানুষ উঠতে পারে না, চুলগুলো বড় বড়। কানু কাকা সেখানে গিয়ে হাজির। তার চুল কেটে দিতে সে সব যন্ত্রপাতি নিয়ে সরব উপস্থিত, সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েই সেখানে যায়। সেসবের জন্য তাকে আলাদা বকশিস দিতে হয়। তাছাড়া এলাকাতে অনেক বয়স্ক মহিলার চুল জট লাগে। কোকড়া হয়ে যায়, দেখতে অনেকটাই ভূতুরে টাইপের। সেসব জট ছাড়াতেও, তিনি গিয়ে হাজির হন। বাচ্চারা তাকে দেখে ভয় পায়। এটাই এক ধরনের সৌন্দর্য। বেশিরভাগ সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে চুল কাটে। আরও দুয়েকজন এই পেশায় যুক্ত কিন্তু তার মত এত পরিচিতি কেউ পায়নি। এসবের অনেক কারণ আছে।

তিনি চুল কাটার পাশাপাশি মানুষের বিনোদন দিয়ে থাকেন। তাছাড়া গ্রামের সংস্কৃতি অনুষ্ঠানে, হাসির অভিনয়ের মাধ্যমে সবার কাছে পরিচিতি অর্জন করেছেন। একদিকে চুল কাটছে অন্য দিকে গল্প বলছে। চুল কাটার মাঝেই অনেক সময় গল্প বলতে থাকেন। একই গল্প বারবার বলে না। তবে অনেক গল্পই ঘুরিয়ে ফিরে বলেন। একদিন বলবে, ‘আরেহ অনেক দিন আগের কথা। দুপুর বেলা পাশের গ্রামে চুল কেটে বাড়ি ফিরছি। এক বাড়ীতে মুড়ি আর তেলের পিঠা ভেজেছে। আমাকে খাবার জন্য দেয়, আমি গামছার একপাশে মুড়ি, আরেকপাশে তেলের পিঠা বেঁধে নেই। মনে মনে ভাবি বাড়ি গিয়ে পরিবারের সবাই মিলে একসাথে খাবো। বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হই। খোলা আকাশের নীচ দিয়ে, ক্ষেতের ভেতর দিয়ে চলতে শুরু করি, পথ সহজ করার জন্য। তারপর বুড়ামারা বিলে পানির ছোট্ট ডোবার পাশে আসতেই গায়েবী আওয়াজ। প্রথমে আমি বিষয়টি পাত্তা না দিলেও, এমন গায়েবি শব্দ শুনে অবাক। এই দেখ ঘটনাটি বলছি, আর শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেছে, যখনি ঘটনাটি বলি, তখনি আমার বুকের ভেতর, চুল কাটার সময় কেঁচি যেমনি চলে, তেমনি হার্টবিট চলছে। তখনকার অবস্থা আমি বলে বুঝাতে পারবো না।

তারপর আমি বললাম, ‘কে, কে? কিসের শব্দ করো।’ তারা বলল, ‘এই কানু কাকা। একটা গরম তেলের পিঠা দে, একটু খাই। এল্লা গরম মুড়ি দে, একটু খাই। দে না কানু কাকা। বাড়ি গিয়ে পরিবার নিয়ে খাবি, আমাদের এল্লা দে না।’ তোমরা কে কে বলে আওয়াজ তুলি। তারপর বলি সামনে আয়, আয় তোরা, এই নে মুড়ি, এই নে পিঠা। কিন্তু তারা সামনে আসে না। হাঁটতে থাকি তরিঘরিতে। তবু পিছ ছাড়ে না। পিছে পিছে আসে আর বলে, ‘এই কানু কাকা, এল্লা পিঠা দেনা, এক মুঠ মুড়ি দে না।’ আমি ভয়ে কান্না করে ফেলি। তারপর দৌঁড়ে চলে আসি।’

এবার পিছন থেকে একজন এসে বলবে, গল্প বাদ দিয়ে জলদি করেন। এসব গল্প অনেকবার শুনেছি। তখন তিনি চুল কাটতে থাকবেন আবার। কিছুক্ষণ পর আরেকটি গল্প বলবেন। নতুন একটি গল্প যুক্ত করেছে। ইদানিং এটা বেশি বলছে। চুল কাটার সময় মাঝেমধ্যে বলবে, ‘মুক্তাহার নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে আসছি। তখন নদীর ধারে এক বয়স্ক মহিলা বলল, আমার চুল জট ধরে গেছে। কাটাতে হবে।’

অপরিচিত মহিলা। কেউ নেই আমি কাটাতে রাজি হই না।

তখন সে বলল, ‘চুল কাটাবি না, তোকে নিয়ে পানিতে চুবিয়ে মারবো। দেখি তুই পালিয়ে যাস কোথায়।’ আমাকে ধরতে এলেই দৌঁড়ে ছুটতে থাকি। পিছন থেকে সে জোরে জোরে খিলখিল শব্দ করে হাসে। বলেই পানিতে নেমে পড়ে। আর দেখা যায় না। আমি ভয়ে দৌঁড়ে চলে আসি।

কেউ কেউ ভীষণ বিরক্তি হন। সিরিয়াল দিয়ে বসে আছেন, তার সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। গল্প বলার ভেতর তিনি ডুব সাঁতার কাটছে। তবে যারা এর আগে এসব গল্প শোনেনি, তারা বিষ্মিত হন। কথা শুনে অবাক হন। বেশিরভাগ আবার মনে করেন এটা কাল্পনিক। তবে কানু কাকার বড় সমস্যা বিড়ি টানা। সে চুল কাটার মাঝেও বিড়ি টানবে। কতদিন এর জন্য ধমক খেয়েছে কিন্তু তা মনে রাখেনি। পরেরদিনই ভুলে গেছে।

এসবের বাইরে হাঁটবারে সে চুল ছাটাই করে থাকে। বেশিরভাগ হাঁটবার তার ভীষণ পছন্দের। এই পছন্দের অন্যতম কারণ টাকা আয় বেশি। এই হাঁট নিয়ে কত স্মৃতি। বাবার কাছ থেকে তার চুল কাটার দীক্ষা, এই হাঁট থেকেই শুরু হয়। প্রতি হাঁটে তার বাবা নিয়ে আসতো। তাকে সামনে রেখে চুল কাটতো। এভাবেই দিন দিন সেও নিজেকে গড়তে থাকে। তারপর এক সময় সে কেঁচি ধরে ঘ্যাচাং ঘ্যাঁচাং করে কাটতে থাকে। প্রথম প্রথম কানু কাকার কাছে বড় মানুষকে চুল ছাটাই করতে দিত না, কেউ এসে সাহস পেত না। ছোট কেউ এলে চুল কাটাতো। ধীরে ধীরে তার দীক্ষা পরিপক্কতা পায়, চুলের গ্রাহক বেড়ে যায়। সবার কাছে দিন দিন বিশ^স্ত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে তার বাবা মারা যায়। তার বাবার পেশা নিজের ভেতর আত্মস্থ করেছে। তার সন্তানকেও সেভাবে গড়ছে। কয়েক ক্লাস পাশ করার পর পুরোপুরিভাবে এই পেশা নেবে।

হাঁটে আগে এত বড় ছিল না। মানুষের তেমন সমগম হতো না। এখনতো বড় হয়ে গেছে। কোনো কোনো খানে ছন দিয়ে ছোট খুপড়ি তুলেছে। রোদ বা বৃষ্টিতে এটা দারুণ উপকার হয়। হাঁটে বেশি টাকা আয় হতো, তার কারণ অনেক মানুষ সেদিনের জন্য চুল কাটার অপেক্ষায় থাকতো। পাশে আরেকজন এলেও, তার তেমন সিরিয়াল নেই। কিন্তু তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে চুল কাটার জন্য। সে টাকা নিয়ে কোনো জোরাজুরি করে না। একজন দাড়ি কামিয়ে, চুল কেটে বলবে এটা রেখে দাও কাকা। সামনেবার পুষিয়ে দেব। আরেকজন এসে বলবে, কাকা আমার টাকা নেই। সামনে মাসে দেব। আজকে একটু চুল কেটে দেবা? তাকে বলে অপেক্ষা করো, একটু পর দেব। সে মানুষটি হয়তো এদিক সেদিক ঘুরে। তারপর এসে চুল কাটাবে। আরেকজন এসে বলবে, আজ আমার ভীষন জরুরি। একটু আগে কেটে দাও। চুল কাটা শেষে টাকার হিসেব করতে থাকে। খুচরা টাকা, ভাজ দেয়া। সব এক করে গুনতে থাকে। তারপর যেদিন আয় বেশি হয়, সেদিন কানু কাকা গামছা ভর্তি চাল, হাট থেকে অনেক সবজি, আর ছোট মাছ আনতো। ফেরার সময় ছেলে-মেয়েদের জন্য বাদামী মটকা, কোনো কোনো দিন বোনাস হিসেবে সন্দেশ কিনে বাড়ি ফিরতো। হাটের দিন তার ছেলে মেয়ে অপেক্ষা করতো কখন আসবে তার বাবা। কখন তারা পছন্দ অনুযায়ী মটকা বা সন্দেশ খেতে পারবে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করতো। কখন আসবে বাবা।

তবে শরৎকালে হুটহাট বৃষ্টি নেমে পড়তো। দৌঁড়ে খুপড়ির নীচে যেতে যেতেই বৃষ্টি থেমে যেতো। হাঁটবারে কানু কাকা একই স্থানে টুল নিয়ে বসতো। পাশেই বটগাছ। তার পাশে নদী। চুল কাটা শেষে বটগাছের পাশে চুল ফেলে দেয়া হতো। তবে বর্ষাকালের সময় হাঁটবার অনেক ভোগান্তি হতো। ঝুম বৃষ্টিতে এলোমেলো হয়ে যেতো সবকিছু। টুলটা রেখেই ফাইভ জি গতিতে ছুটে যেতো। কোনোদিন বটতলা আবার কোনো দিন খুপড়ি ঘরে আশ্রয় নিতো। সেখানে মানুষ গিজ গিজ করতো মৌমাছির মত। বৃষ্টি ঝরতো অঝরে, এদিকে কানু কাকার মনের ভেতর ছটফট করতে থাকতো। কখন বৃষ্টির কোলাহল থামবে, নৈঃশব্দের আহাজারি কমবে। বৃষ্টির সময় যত গড়তো, জবাই করা মুরগীর মত ছটফট করতে থাকতো তার মনের ভেতর। বাড়ীতে চাল নেই, পোলাপান অপেক্ষায় আছে। এসব চিন্তা তাকে তাড়িত করতো বেশি।

কোনো কোনো দিন এই বৃষ্টির জন্য, আয় হতো না। চাল বাকীতে কিনলে, নগদ টাকায় কিছু সবজি, সন্তানদের জন্য বাড়ীতে শূণ্য হাতে ফিরতো। এই শূণ্য হাতে ফেরা যেনো তার জন্য কাল হয়ে যেতো। কারণ বাজার করে টাকা শেষ। মটকা বা সন্দেশ কেনার টাকা নেই। সেসব মানতে চাইতো না তার সন্তান, বুঝতেই চাইতো না। তাদের দাবী কেনো সন্দেশ বা মটকা আনোনি। দুজন পাল্লা দিয়ে কান্না করতো। তাদের প্রতিযোগিতা শুরু হতো কান্নার। কোনো রকমভাবে কান্না না থামলে, পিঠের উপর গুরুম গুরুম কিল দিতো কানু কাকার বউ। কান্নার পরিমাণ বেড়ে গেলেও, এই কিল খেয়ে থেমে যেতো।

এসবের বাইরে হেমন্তে তার একটু আয় বেশি হয়। মন মেজাজ ফুরফুরে থাকে। গ্রামে নবান্ন উৎসব শুরু হয়। ঘরে ঘরে ধান তোলার প্রতিযোগিতা বাড়ে। ধান কাটা শেষ হলে দিনে চলতো লাঠিবাড়ি খেলা। আর রাতে বসতো সং দেয়া। গ্রামের মানুষ সব দুঃখ ভুলে মিলিত হতো রাতের আনন্দ উৎসবে। কানু কাকা এখানে নারীর অভিনয়, কখনো চুল কাটার নাটিকাতে অভিনয় করতো। তার অভিনয়ে সবাই বেশি আনন্দ পেত। সে স্টেজে এলেই দর্শক হাত তালি দেয়া শুরু করতো। তার বউ আবার এসব বেশি পছন্দ করতো না। কত দিন বলেছে ছেলে মেয়ে বড় হতে চলেছে, এখন এসব বাদ দাও। তারা স্কুলে গেলে সবাই তামাশা করে।’ কানু কাকার কথা, ‘আমি কি সারা বছর এসব করে বেড়াই। তাছাড়া সবাইতো আমার এসব পছন্দ করে। আমিতো চুরি করি না, খুন করি না। মানুষকে একটু বিনোদন দেই। তাতে কে কি ভাবলো। এসব দেখার সময় নাই।’ রাতে এসব আয়োজনে অনেক দোকানের মেলা বসতো। সেখান থেকে টাকা তুলে কিছু দিত তাকে।

হাঁটবার ছাড়া অন্য দিনগুলোতে একটি ব্যাগ নিয়ে চলে যেতো। তারপর পথ ধরে বিড়ি টানতো, আর বলতো ‘কেউ আছেন নাকি চুল কাটাতে।’ যারা তাকে চেনে, তারা আসতো, অচেনা মানুষও আসতো। কেউ থাকলে বাড়ির উঠানে বা রাস্তার পাশে বা বাঁশ ঝাড়ের নীচে বসতো। বসার জন্য একটা টুল আর পীড়ি নিয়ে আসতো। তারপর শুরু করতো কানু কাকার কাজ। এভাবেই সে জীবিকা নির্বাহে সংসার জীবন পার করে চলছে।

কোনো কোনো দিন অর্ডারি চুল কাটাতে, কোনো বড় বাড়িতে না খেয়েই ভোরে চলে যেতো। বাড়ির উঠানে গিয়ে বসে থাকতো। তারপর হাজির হতো বড় কর্তা। এসেই বলতো, ‘কিরে কানু? এত সকালে এসেই হাজির হয়েছিস। কিছু খেয়েছিস কি?’ বিনয়ের সাথে মাথা নাড়িয়ে বলতো, এইতো কাকা কিছুক্ষণ আগে পেট ভরে পান্তা ভাত খেয়েছি। পেয়াজ দিয়ে পান্তা ভাত খাবার আলাদা শান্তি। পেটের অবস্থা এমন এক ঢোক পানি খাবার যায়গা নেই। আপনি অনুমতি দিলে চুল কাটা শুরু করতে পারি।’ তারপর কতবার খেতে বললেও, সে রাজি হয় না। নিজে না খেয়ে থাকলেও, কারো কাছে চেয়ে খাওয়ার অভ্যাস তার নেই।

একটি বিষয় অলস শব্দ তার জীবনাভিধান থেকে বাদ দেয়া। গরীবের অলসতা করলে পেটে ভাত জুটবে না। কানু কাকার এভাবে ভালোই চলছিল। সময়ের সাথে জীবন চলতে থাকে তার নিজ গন্তব্যের দিকে। সন্তানদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে, তার বয়স বাড়তে থাকে। হঠাৎ করেই তার বউ একদিন চলে যায় না ফেরার পথে। সে যেনো একাকী হয়ে যায়। ছেলেটা নতুন সেলুন দিয়েছে, ঘরে বউ এনেছে, তার আবার সন্তান হয়েছে। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। কানু কাকার আগের মত শরীর পারে না চলতে। একদিন জ্বর, আরেকদিন কাশী, আরেকদিন ঠাণ্ডা এভাবেই চলতে চলতে ঘরে পড়ে যায়। উঠার শক্তি হারিয়ে যায়।

একদিন ফ্যাল ফ্যাল চোখে তাকিয়ে কানু কাকা। কথা বলার শক্তি ক্ষয়ে গেছে। রক্ত বমিতে চোখ মুখ ফ্যাকাশে। তুলসীতলায় শুইয়ে রেখেছে। বেশকিছুক্ষণ এভাবে রাখার পর, ধরাধরিতে তাকে রুমে নিয়ে যায়। অথচ এখন রুম থেকে বেরুনোর সুযোগ হাতছাড়া। তাকে দেখার কেউ নেই। সে যেনো ফুটপাতে পড়ে থাকা সিগারেটের শূন্য প্যাকেট। কত জনের পাঁয়ের নীচে পিষ্ট হচ্ছে। ছেলেটি সেই সকালে বের হয়, দুপুরে কোনোদিন ফেরে। কিন্তু দেখা হয় না কানু কাকার সাথে।

জীবনের সেসব স্মৃতি তাকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। চোখের সামনে তারার মত জ্বলে। ঘুম থেকে উঠেই মুখটা বুলেট ট্রেনের গতিতে ধৌত করবে। তারপর একহাতে ব্যাগ, আরেক হাতে টুল নিয়ে ফাইভ জি গতিতে ছুটবে। মাঝেমধ্যে বিড়ি টানবে, কখনো গামছা থেকে মুড়ি নিয়ে খেতে খেতে রওনা হবে। তারপর মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে, আঁকা বাঁকা মেঠো পথ দিয়ে চলে যাবে দূর কোনো গাঁয়ে। পাড়ার ভেতর গিয়ে ডাকবে। এত মাঠ-ঘাট, গ্রাম পেরিয়ে যাওয়া মানুষটি এখন একা বাথরুমে যেতে পারে না, একা উঠতে পারে না। কিছু খেতে দিলে, সেটাও ঠিকমত মুখে তুলে নিতে পারে না। বাড়ির সবার চোখে সে যেনো এখন বাড়তি মানুষ। ভালো চিকিৎসার টাকা পয়সা নেই। কারো কাছে সাহায্য তুলে চিকিৎসা করবে, সেটাও সে মেনে নিতে চায় না। এক বছরে তার শরীর একদম অন্য রকম হয়ে গেছে। সে চলে যেতে পারলে যেনো সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। অপেক্ষায় পার করছে, কখন যমদূত এসে তাকে নিয়ে যায়। একটু ঘরে ঠক ঠক শব্দ করলেই মন করেন, এই বুঝি যমদূত এসেছে। তাকে নিয়ে যাবে, দুনিয়া থেকে জীবনাসান ঘটবে!

আরো পড়তে পারেন

চারটি অণুগল্প

১. পৃথিবীর শেষ গাছটা হাতে নিয়ে ফিহান সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। চিরকাল দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভোগা ফিহান সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না, এই ছোট্ট চারাটা নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়বে, নাকি আরেকটা বিশ্বযুদ্ধের দামামা বাজতে দেবে?   ২. —আমার না প্রায়ই খুব মায়া হয় এদের জন্য —কেন?! —এই যে দেখো, সারারাত জেগে থাকার কথা আমাদের, আর জেগে থাকে ওরা।….

বিবশ

এক. আমাদের আব্বা বড্ড নিশ্চুপ। চুপচাপ-চাপা স্বভাবের। সারাদিনে তিনটা শব্দও তার মুখ দিয়ে বের হয় না। অন্যদিকে আম্মা কথার খই ফোটান। তার সংসার, সংগ্রাম, সীমাহীন দুঃখ এসব। এক রথে একাকী বয়ে চলা জীবনের ঘানি। বাপের বাড়ির রকমারি কেচ্ছা, ছোটবেলায় মা-খালাদের সাথে করা হরেক কাহিনির গপসপ। আমাদের মামারা কেউ বোনের খবর নেয় না। এরপরও সন্ধ্যা করে,….

শীতকালের প্রোফাইল পিকচার

শীতকাল যখন ফেসবুকে প্রথম পা রাখল, তার অনুভূতি ছিল একেবারে মিশ্র। সে জানে, শীতের সঙ্গেই জন্মেছে তার পরিচিতি— কুয়াশা, সাদাকালো দৃশ্যপট, আর বিষণ্ণতার মোড়কে জড়ানো অনুভূতির কথা। তবু সে মনে করে, শীত মানেই বিষণ্ণতা নয়। শীতের বুকে উষ্ণতার যে আলিঙ্গন, তার গল্প মানুষ প্রায় ভুলেই গেছে। কুয়াশার একটা সাদাকালো ছবি আপলোড করতে চেয়েছিল প্রথমে। কিন্তু….

error: Content is protected !!