Author Picture

কাজী সোহেল-এর একগুচ্ছ কবিতা

কাজী সোহেল

অবগাহন

কার শরীরে কে ঢুকে আছে
অচেনা গন্ধ দেশের শরীর জুড়ে
অদ্ভুত ফোঁকরে চারপাশ ভরে।

পায়ে সুড়সুড়ি লাগায় নিচে তাকিয়ে দেখি
এক খিস্তি লেখক অবিরাম পা চেটে যাচ্ছে
তাকে কবি হিসেবে মেনে নিতে।

আমি পুড়ে যাই নদী শুকিয়ে বিরান বালুচর
আমি পুড়ে যাই খুন হচ্ছে বৃক্ষ-বনানী
আমি পড়ে যাই ঘাস মারা বিষে উজাড় তৃণদল

 

হৃদয় ভাঙ্গা জোছনা

এক গ্রামে হৃদয়ভাঙ্গা জোছনা ফুটেছে।
মধ্যবয়স্ক ব্যর্থ মানুষ একদৃষ্টে চেয়ে নদীর দিকে
নদী অমরাবতী, বুক জুড়ে মায়া ঢেউয়ের খেলা
হৃদয়ভাঙা জোছনা নেমেছে কমলডাঙায়
এলোমেলো ধূসর চুল, সুগঠিত শ্রান্ত দেহ
রিডিং গ্লাসের আড়ালে জোড়া অমরাবতী
একটা জীবন ভালোবাসার ভুলে খরচ করে
সে সমস্ত কষ্ট সযত্নে তুলে রাখে চোখ জোড়ায়
ভোরের শান্ত অনাঘ্রাতা ও সহমর্মি নদীর জন্য…

 

ভাঙ্গন

আমাদের ফুলদানি ভেঙ্গে গেছে
জল নেই ফুল নেই
ভেঙে গেছে
ধূসর স্মৃতিময়তার মায়া মেখে
পড়ে আছে শুণ্য টেবিলের কোণ

আর সব একদম ঠিকঠাক পরিপাটি
যাপনে আনন্দের কমতি নেই
এখন সুখে থাকার চেয়ে
অনেক বেশি জরুরী
সবাইকে জানানো, সুখে আছি।

ষোলো-সতেরো বছর পর
তুমি আমার মনের যত্ন নিলে খানিক
‘মন খারাপ করো না’
এক অমোচনীয় লিখনীতে
আমাদের ফুলদানিটা ভেঙে গেছে
এই ছোট্ট, আনন্দময় পৃথিবীতে
তুমি মন খারাপ করো না…

 

সমান্তরাল

সুঠাম দেহ, প্রেমমগ্ন সুপুরুষ। পাঁচ ফুট দশ।
তুমি অর্ধাঙ্গিনী।
খোলা চুলে নামাতে পারো  প্রিয়তম মেঘলা দিন।

পক্ষাঘাত চেপে ধরা গৃহবন্দি শরীরে
মুমূর্ষ স্বপ্নেরা টিকে আছে এন্টিবায়োটিকে
তবুও ভালোবাসি ভালোবাসা।

সমান্তরাল  দুই জীবনই নির্জলা সত্য।
আমাকে যাপন করতে হয়
ঘুমে ও নির্ঘুমে।

 

অসমাপ্ত

সবচেয়ে কঠিন ঝগড়ার পরেও
আরো কতো কী ছিলো বলার
দু’জনের তিক্ততার সমস্ত বিষ উগড়ে দিয়েও
আরো খানিকটা ছিলো বলার।

ঝড় শান্ত হলে আমাদের শ্রান্ত ঠোঁটেরা
তৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠে-
তির তির করে গোপনে কাঁপে
জল মাখা আলাপের ভগ্নাংশের খোঁজে।

প্রাগ ঐতিহাসিক  মানব মানবী হতে
স্পর্শ ভাব প্রকাশের সার্বজনীন মাধ্যম
আঙুলে আঙুল ভালোবাসাবাসি
বর্ণহীন শব্দহীন অনর্গল সে কথোপকথন।

চোখে দেখা যায় টলটলে মন
ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে
আমরা ঘুরিয়ে রাখি মুখ
ঝগড়া শেষে তাই সাময়িক অন্ধ হয়ে যাই।

প্রিয়তমা,
বৃষ্টিস্নাত সেই ভালোবাসা দিনের কসম করে বলছি
একবার অন্ধত্ব ভুলে চেয়ে দেখো
আমাদের না বলা কথারা
চারপাশে ফুটে আছে বর্নীল অর্কিড হয়ে…

 

কৃষ্ণচূড়া করবী অথবা মসুর ডাল

মাননীয় মহানগর দায়রা জজ
জোড়া খুনের মামলার ফাইল থেকে
একটু চোখ তুলে তাকালেন জানালায়।
কৃষ্ণচূড়া ফুটেছে তুমুল
হঠাৎ নাগরিক বৃষ্টিতে স্নান সেরে নিচ্ছে
প্রিয় লাল সবুজ। চশমা ঠিক করতে করতে
তাঁর মন আরো খানিক ভিজলো আচমকা বর্ষায়

আজ ঝুম বৃষ্টিতে ডুবছে
বাংলাবাজার স্কুলের  উদার আঙিনা
ক্লাস নাইনের কয়েকটা মেয়ে
লোভাতুর দৃষ্টিতে বৃষ্টি দেখছে
গার্লস স্কুলের হেড মিস্ট্রেস মমতাজ বেগম
পুরো বিদ্যালয় কম্পমান তাঁর ভয়ে।
বৃষ্টি তো বরাবর কৈশোরকে সাহসী করে তোলে
শেষ ক্লাসে বৃষ্টি তাই
একটি মেয়ে নেমে গেল মাতাল বর্ষণে
দেখাদেখি আরো কয়েকজন।
হেড মিস বেরিয়ে এলেন, কড়া ধমক দিলেন।
কোথায় যেনো কন্ঠ ছিলো খানিক স্নেহগন্ধি
প্রথম মেয়েটা ভেজা জামায়  আপাকে জড়িয়ে বললো,
ম্যাম আপনিও আসুন।
না-না করে তিনিও নেমে গেলেন বৃষ্টিতে।
তাঁর মন জানে এমন করে কেউ কোনদিন ডাকেনি।  সব মেয়েরা নেমে গেল মাঠে।
কোনো দুষ্টু মেয়ে
করবী ফুল গুঁজে দিলো হেডমিসের চুলে।

আজকের আকাশ-ভাঙ্গা ধুন্ধুমার বর্ষায়
মহাখালী কড়াইল বস্তি ভিজে ত্যানা ত্যানা
নয়াবস্তির শেষ দিকে একটা ঘরে
ছোট্ট পরিবার নিয়ে বিকশাওয়ালা হাবিব থাকে
আজ আর সে রিকশা নিয়ে বেরোয়নি
বউ শিউলি লাকড়ির চুলা ধরাচ্ছিলো
জলের ছাট আর ধোঁয়ায় বউটা মাখামাখি
এ সময় সাত বছরের ছেলের আবদার।
‘একদানা ডাইল নাই, খিচুড়ি রান্দুম ক্যামনে?’
মা তুমি ডাইল ছাড়াই রান্ধো।
তোমার মনে নাই,
একবার ডাইল ছাড়া রানছিলা
অনেক মজা হইছিল!’
বৃষ্টিতে ভাঙ্গা ছাতা নিয়েই বের হয়ে হাবিব
তার বুক জুড়ে অনেক ছোট-বড় ক্ষতচিহ্ন
ছেলের বহু বায়না না পূরণের লালাভ কষ্ট।
এই সামান্য বিষয়ে নাইবা নতুন হলো যোগ।
গলির মুদি দোকানদার
সহজেই বাকিতে দিলো
ভালোবাসার রঙ আধ পোয়া মসুর ডাল।

কৃষ্ণচূড়া
করবী
মসুর ডাল
আজকের বৃষ্টিতে একাকার।

 

অফেরতযোগ্য জীবন

একটা জীবন
হায়! একটা জীবন
পারলাম না মন থেকে শহর মেনে নিতে
না সাধ্যে কুলালো গ্রামের আপন হতে…

 

গোলাপি বাড়ি

একদিন ঝুম বৃষ্টিতে
তোমাদের টিনশেড গোলাপী বাড়ি
ভিজে নেয়ে একাকার।
বাড়িও গোলাপের মতো ভিজতে জানে
বাড়িও স্নান করে জোছনায়
যদি কেউ একজন সুনেত্রা সুস্মিতা
সে গৃহের বাসিন্দা  হয়
আর প্রেমিক সেদিকে তাকিয়ে থাকে নিষ্পলক।

 

দীর্ঘতম রাত

দীর্ঘতম হিমেল রাতের আক্ষেপে
পুড়ে চলেছে প্রেমিক অথবা চোর
রজনী পাতার কিছু অংশ
সে ছিঁড়ে আনতে চেয়েছিলো সচিত্র
শৃঙ্খলা শৃঙ্খলের নিরেট দেয়াল গলে
দেখা গেলো না কোনো তারুণ্যদিনে আঁকা
অপার্থিব প্রেয়সীর মুখছবি
মধ্যরাতের শুনশান স্টেশনে
প্রকৃতি যখন খানিক অন্যমনস্ক
গোপন প্রেমিকের কান শোনে কেউ বলছে-
ভালোবাসায় দীর্ঘ দিন হয় না
ভালোবাসায় দীর্ঘ রাত হয় না
কেবল দীর্ঘ জীবন জুড়ে ভালোবেসে যেতে হয়…

আরো পড়তে পারেন

বেওয়ারিশ প্রেমের কবিতা

১. জীবনকে বিজ্ঞাপনের মতো সেঁটে দিয়ে দেখেছি, আমাকে গ্রহণ করেনা কেউ। আমাকে ভালোবাসে না ঘুমগন্ধওয়ালা সকাল— আমাকে ভালোবাসে না বাজারের জনবহুল রোদ, আমাকে ভালোবাসে না কেউ, ভিক্ষুক, শ্রমিক, চাষী আমাকে ভালোবাসে না, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে ভালোবাসে না, শোষক কিংবা শোষিত, শাসক ও প্রজা কেউই ভালোবাসে না, আমাকে ভালোবাসে না তরুণ-তরুণী-বৃদ্ধ বা যুবা, পার্থিব কোনো….

আজাদুর রহমান-এর একগুচ্ছ কবিতা

সহজাত মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে যে কোন দিন যে কোন সন্ধ্যায় তুমি কল্পনাও করতে পারবে না এমন ঘোরতর বর্ষার দূপুরে মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে। পথের পাশে ওত পেতে থাকা শিকারির মত সন্তর্পনে উঠে আসা মানুষ পায়ে পা ঘষে তোমাকে অবহেলা করবে। কোথাও না কোথাও কোন এক বয়সে কোনও না কোনও ভাবে মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে।….

হোসনে আরা শাপলা’র একগুচ্ছ কবিতা

আলতু ব্যথা কোন এক শুভ্র সময় আমাদেরও ছিল পাশাপাশি-মুখোমুখি বসে থাকা শুধু হিসেব-নিকেশ, দাবি-দাওয়া, চাওয়া-পাওয়া এসবের বালাই ছিলো না কোন শুধু কানায় কানায় পূর্ণ ছিলো ভালোবাসা। চোখের তারায় ডুবে গিয়ে অন্বেষণ শুধু শত জনমের সুখ। ওইসব স্বপ্নমাখা দিন কোন দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল কোথায় তারই জন্য মনের মধ্যে কেমন আলতু ব্যথা।   তৃপ্তি ভরসার হাত….

error: Content is protected !!