
পড়ুন— ওসিডি (পর্ব-০৮)
এরপর আমার আসল পরীক্ষা শুরু হয়। পাগল এক বালতি পানি আর একটা নতুন তোয়ালে নিয়ে এসে দরজার সামনে বসে যায়। পাগল পানিতে তোয়ালে ভিজিয়ে ফ্লোর মোছে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে দরজার সামনে আর যাওয়ার উপায় থাকে না। প্রথম ঝগড়াটা হয় আমার চপ্পল-জোড়া নিয়ে। আমার চপ্পল পাগলের মোছা ফ্লোর ময়লা করে। সেই চপ্পল যেই চপ্পল সোনিয়া আর চেয়ারম্যান স্যারের বহন করা জীবাণু ধরে রেখেছে। পাগল বকাবকি করার সময় আমাকে কোনও মায়া করে না। অক্টোবর থেকে মার্চ, বছরের এই ছয় মাস, আমি চপ্পল ছাড়া খালি ফ্লোরের উপর হাঁটতে পারি না। আমি আসলে বছরের কোনও সময়ই খালি ফ্লোরে খালি পায়ে হাঁটতে পারি না। পাগলকে ছয় মাসের ছাড় দিয়েছি অনেক কষ্টে। পাগলের ভয়ে আমি আলমারি থেকে নতুন এক জোড়া চপ্পল বের করি। প্লাস্টিকের পেকেটে মোড়ানো সাদা চপ্পল। আমি মোড়ক উন্মোচন করে তাদের তলা দেখি। শুধু পরিষ্কারই নয়, মনে হলো চপ্পল দু’টি জীবাণুমুক্তও করা আছে। আমি নতুন চপ্পল পায়ে দিয়ে পাগলের কাণ্ড দেখতে যাই। নতুন চপ্পল পরেছি বলে পাগলের মেজাজ মোটেও ঠাণ্ডা হয় না। আর আমিও অবাক হই। কারণ জীবনে প্রথম জানলাম নতুন চপ্পলও ভেজা ফ্লোরে ময়লা দাগ ফেলে। এত দিন জানতাম এই অনাচার শুধু পুরান চপ্পল করে।
. বাধ্য হয়ে আমি পা থেকে চপ্পল দু’টি ছুঁড়ে ফেলে দিই। এবার আমার পায়ের তালুর ঘষায় মেঝের ওপর আরও বেশি দাগ পড়ে। তা দেখে আমি আঁতকে উঠি। এক মুহূর্তের জন্য গলা শুকিয়ে যায়, আমি গলার পেশি আগুপিছু করে আর্দ্রতা খুঁজি, কারণ ঢোক গিলতে পারছিলাম না। পাগল সেটাই খেয়াল করে, এবং আরও বেশি ক্ষেপে যায়। পাগল আমাকে বান্দি বলে গালি দেয়। আমি পাশ ফিরে দেখি সোনিয়ার মুখ শুকিয়ে গেছে, তারপরও সোনিয়া পাগলের সাথে তর্ক করে। বলে, “নানি, আপনেতো পাগল।”
. পাগল তোয়ালেটা বালতিতে রেখে উঠে এসে সোনিয়াকে কষে একটা চড় মারে।
. সোনিয়ার কালো গালে পাগলের আঙ্গুলের ছাপ কাঁঠাল পাতার মতো মনে হয়। সোনিয়ার মুখ ভার হয়। “থাকমু না। আমি থাকমু না। এইহানে সব পাগল,” সোনিয়া গাল ডলতে ডলতে বলে।
. আমি চোখ রাঙিয়ে সোনিয়াকে চুপ করাই। কিন্তু আমি পাগলের অনাচার থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারি না। পাগল এর মধ্যে পুরো ফ্লোর ভিজিয়ে ফেলেছে। বালতির পানি বদলেছে দুই বার। বাথরুমে যায় আবার নতুন পানি নিয়ে আসে। আবার ফ্লোর মোছে। মুছতে মুছতে ড্রয়িং রুমের দিকে যায়।
. “মা, সরো। আমি আর সোনিয়া মুছব,” আমি বলি।
. পাগল সরে না। আমি জানি সে সরবে না। আমাদের ঘর মোছায় সে তৃপ্তি পায় না। অথচ আমরাই কেবল ঘর পরিষ্কার করতে পারি। পাগল তা ভেজানো ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। আফরোজ ম্যাডামের প্রভাব আমাদের উপর দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আফরোজ ম্যাডামের ঘটনার পরও পাগলকে আমি অনেক দিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। তারপর কী করে যেন তা বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ থাকে পাগলের চিকিৎসা। দীর্ঘদিন। এর জন্য পাগল নিজেই দায়ী। পাগল বড় ডাক্তার ছিল বলে পরিচিত কোনও ডাক্তার পাগলের চিকিৎসা করতে চাইত না। তারা হাসাহাসি করত। কী যে বলেন ম্যাডাম? আমি করব আপনার চিকিৎসা? বেয়াদবি হবে, ম্যাডাম, মাফ করবেন। ম্যাডাম, পৃথিবীর কোন রোগ নাই, আপনি যা ভাল করতে পারেন না? কোন ওষুধ নাই, যেটার নাম আপনি জানেন না? আমি হামিদকে যে রাতে খুন করি, তার আগের দিনও পাগল হাসপাতালে গিয়েছে। সেখানে সে মাসে তিন লাখ টাকা বেতন পেত। সপ্তায় চল্লিশ ঘন্টা কাজ করত। হাসপাতালের টাকা উঠত না। তবু পাগলের নামের জন্য তারা পাগলকে এত বেশি বেতনে চাকরিতে রাখত। হামিদের খুনের পরের দিন থেকে পাগল আর চাকরিতে যায়নি।
. ডাক্তাররা পাগলকে এটা সেটা বলে বিদায় করে। তবু আমি চেষ্টা করেছি। অনেক সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছি। পাগল প্রায়ই তাদের সাথে ঝামেলায় জড়িয়ে যেত। নারী ডাক্তারের কাছেতো যাওয়াই যেত না। পাগল সবাইকে আফরোজ ম্যাডাম বলে সন্দেহ করত। এক বার এক সাইকোথেরাপিস্টের চুল টেনে পাগল তাকে চেয়ার থেকে ফেলে দিয়েছিল। এরপর আমি পাগলকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া বন্ধ করি।
. সপ্তাহখানেক আগে পাগলের হাত-পা ধরে তাকে আবার ওষুধ খাওয়াতে রাজি করিয়েছি। করাতে পেরেছি কারণ এবারকার ডাক্তার পাগলের বন্ধু। জরিনা খালা। উনি বহু বছর জার্মানিতে ছিলেন। পাগল যে এত সহজে ওষুধ খেতে রাজি হবে, তা আমি ভাবতে পারিনি। জরিনা খালা দিনে তিনটা করে ক্যাপসুল খেতে বলেছেন। নিজে প্রেসক্রিপশন লিখে দিয়েছেন। পাগল গত আট দিন ধরে নিজে মনে করে নিয়ম করে ওষুধ খাচ্ছিল। অনেক ভালো বোধ করছিল। রাতে ভালো ঘুমাচ্ছিল। আমি অনেক আশাবাদি হয়ে উঠেছিলাম। এর মধ্যে এ রকম ঘর মোছা! এটা পাগল অনেক দিন ধরে করেনি। অন্তত গত আট দিনতো নয়ই। আমি জরিনা খালাকে ফোন করি। জরিনা খালা বলেন, করতে দে। কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটা মোটেও স্বাভাবিক মনে হয় না। “খালা, একটু আসেন না!” আমি বলি।
. উনি রাজি হন।
. “কী করছ, মা?” আমি দরজার দিকে দৌড়াই।
যদি আমি খাটের ওপর শুয়ে শুয়ে গর্ভ ধারণ করতাম, তবে আমাদের জীবনে এতগুলি বিপদ নেমে আসত না। হামিদের কী খাটের অভাব ছিল? বাংলাদেশে, সিঙ্গাপুরে, দুবাইতে, নিউইয়র্কে, টরন্টোতে হামিদের খাট ছিল। আমি খাট ছেড়ে জঙ্গল বেছে নিয়েছি। আমাকে বিপদমুক্ত করার জন্য সবাই মিলে জঙ্গলচারিকে জঙ্গলের নিচে পাঠিয়ে দিয়েছে। সে জন্য আমি খাটের মালিককে মেরে ফেললাম। এমন কাজ কে করতে পারে?
. পাগল আমার দিকে এক বার তাকায়। তার কালো চোখে অপরাধবোধের কুয়াশা। বোধ হয় আমাকে গালি দেয়ার জন্য। ঘর মুছতে গিয়ে পাগলের ম্যাক্সির পাড় থেকে কোমর পর্যন্ত ভিজে গেছে। পাগল দরজার কাছ থেকে শুরু করে সারা ড্রয়িং রুম একবার মুছে শেষ করে দ্বিতীয় বার একই কাজ আবার শুরু করেছে।
. এক ঘন্টা পর জরিনা খালা হেলতে ঢুলতে আমাদের বাসায় ঢোকেন। আমার মনে হল জরিনা খালা পাঁচ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে পাঁচ ঘন্টা লাগালেন। তখন পাগলের ম্যাক্সি ভিজে শরীরে ল্যাপ্টে আছে। জরিনা খালা তার কালো বোরকার মাথাটা খুলে হাতে নেন। জরিনা খালাকে দেখে পাগল আমার দিকে তাকায়। পাগলের চোখ দু’টি জ্বলে ওঠে। আমি কোনও মতে আগুনের শিখা সহ্য করি। জরিনা খালা তা পারেন না। ওনার মুখ সাদা হয়ে যায়। পাগল পাকঘরে গিয়ে সেখান থেকে দা নিয়ে আসে। এটা পাগলের পুরনো অভ্যাস। দা নিয়ে কোপাতে আসা। জরিনা খালা দা দেখে কাঁপতে থাকেন। আমি বলতে চাই, খালা আপনি ভয় পাবেন না, কিন্তু আমার মুখ দিয়ে কথা সরে না। জরিনা খালাকে অবশ্য পাগলের চিকিৎসা শুরুর প্রথম দিনই জানানো হয়েছিল, কোনও কিছু হলেই পাগল দা নিয়ে বের হয়ে আসে। তার মাথায় খুন চেপে যায়। “কণামণি না থামালে আমি এর মধ্যে অনেক খুনখারাবি করে ফেলতাম,” পাগল নিজেই জরিনা খালাকে বলেছিল। সে জন্য কি না, জানি না, জরিনা খালার অবস্থা কাহিল। ওনার হাত থেকে ব্যাগ আর বোরকার ঘোমটাটা পড়ে যায়।
. তারপর বোধ হয় জরিনা খালার একটু শরম হয়। ওনার মনে হয়, উনি পাগলের ডাক্তার। ওনার অন্তত সাহস দেখানোর দরকার। উনি ব্যাগটা তুলে একটু হাসির চেষ্টা করেন। “মরিয়ম, কী হয়েছে তোর?” উনি পাগলের দিকে তাকিয়ে বলেন। কিন্তু আমি দেখি জরিনা খালার কাঁধ দুটি কাঁপছে।
. “কিছু হয়নি, কাছে আয়,” পাগল বলে।
. জরিনা খালা নড়েন না। পাগলের দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। আমার বুক ধুকধুক করে। যদি সত্যি সত্যি জরিনা খালাকে কোপ দেয়। আজকের মতো এত খারাপ অবস্থা আগে কখনও পাগলের মধ্যে দেখিনি।
. “তোকে কে ডেকে এনেছে?” পাগল প্রশ্ন করে।
. “শিশির আমাকে ফোন করে আসতে বলল,” জরিনা খালা বলেন।
. “আয়। কাছে আয়,” পাগল বলে।
. আমি দেখি জরিনা খালার হাঁটু দু’টি কাঁপছে।
. আশঙ্কা আমার উপর চেপে বসে। আমি পাগলকে ঝাপটে ধরি। পাগল আমাকে এক ঝটকায় ফেলে দিয়ে জরিনা খালার দিকে তেড়ে যায়। জরিনা খালার তখন অবস্থা এমন যেন উনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবেন। আমি আবার পাগলরে হাত টেনে ধরি। এবার আর পাগল আমাকে ফেলতে পারে না। আমি পাগলের ডান হাত পাকড়াও করি, যে হাত দিয়ে পাগল দা কব্জা করে রেখেছে। জরিনা খালা বুঝলেন আমি পাগলকে আটকে ফেলেছি। তিনি কিছুটা স্বাভাবিক হন। এক মুহূর্তের জন্য বুঝি ওনার কাঁপুনি বন্ধ হয়েছে। তারপর সে কি দৌড় জরিনা খালার। দৌড়ে তিনি বারান্দায় চলে যান। লিফটের বাটন চাপেন। অস্থিরতায় ওনার পা দু’টি জগিং করতে থাকে। তবে তিনি পাঁচ সেকেন্ডের বেশি লিফটের সামনে দাঁড়ালেন না। এর মধ্যে পাগল আমার হাত থেকে আবার ফসকে যায়। আর দা নিয়ে জরিনা খালার দিকে ছুটে। জরিনা খালা আর্তচিৎকার করে সিঁড়ির দিকে দৌড় দেন। মনে হল নীচ পর্যন্ত যেতে যেতে খালার চিৎকারে সব ফ্ল্যাট থেকেই লোক বের হয়ে এসেছে। আমি দোয়া পড়তে থাকি। ম্যানেজার মাজহার পর্যন্ত পৌঁছলে জরিনা খালার সমস্যা ঘুচবে। মাজহার সব জানেন। উনি খালার বহির্গমনের জন্য নিরপাদ আর কোলাহলমুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
. জরিনা খালার নাগাল না পেয়ে পাগল আরও উত্তেজিত হয়ে যায়। তার গাল এমন লাল, চোখমুখ এমন উন্মত্ত, আগে কখনও দেখিনি। এমন জোরে সে আমার দিকে তেড়ে আসে, আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আর ঘরের ভেতরের দিকে পালাতে থাকি। পাগল আমাকে বাড়ির এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত তাড়া করে। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না পাগল আমাকে এ ভাবে তাড়া করবে। পাগল এবার আমাকে আরও খারাপ একটা গালি দেয়। এটা সেই গালি যা আমার ভাই আমাকে দেয়। পাগল বলে আমার ভাই সঠিক। আমার ভাই যা বলে আমি সত্যিই তা-ই। আজ পাগল আমার জন্যেই পাগল। রমনা পার্কের ভেতরে ঝোপের আড়ালে এক পা তুলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি গর্ভ ধারণ করেছি। এক ভূমিহীন গৃহহীন পানদোকানদারের ছেলের কাছে। সে আমাকে জঙ্গল ছাড়া আর কোথায় নিয়ে যেতে পারত? সেই জন্য সে গর্ভ মুক্তি ক্লিনিকে নিয়ে সাফ করেছে। যদি আমি খাটের ওপর শুয়ে শুয়ে গর্ভ ধারণ করতাম, তবে আমাদের জীবনে এতগুলি বিপদ নেমে আসত না। হামিদের কী খাটের অভাব ছিল? বাংলাদেশে, সিঙ্গাপুরে, দুবাইতে, নিউইয়র্কে, টরন্টোতে হামিদের খাট ছিল। আমি খাট ছেড়ে জঙ্গল বেছে নিয়েছি। আমাকে বিপদমুক্ত করার জন্য সবাই মিলে জঙ্গলচারিকে জঙ্গলের নিচে পাঠিয়ে দিয়েছে। সে জন্য আমি খাটের মালিককে মেরে ফেললাম। এমন কাজ কে করতে পারে? পাগল বলে, এখন থেকে সে আমার ভাইয়ের দলে। সে আমার কল্লা কাটবে।
আমি একটা খুন করেছি। আজ নিজে খুন হয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করি। মরতেতো হবেই। যত নিজেকে এ কথা বলি তত নিজের খুন হওয়াকে তামাশা মনে হয়। জীবনের সবচেয়ে ঘোর দুর্দশার দিনেও আমার কখনও এক মুহূর্তের জন্যও আত্মহত্যা করার কথা মাথায় আসেনি। আসলে আমি আত্মহত্যাকারিদের দলে নই। তাই বুঝি প্রাণ এত সহজে আমার থেকে পালাতে চায় না
. আমার মাথা গরম হয়ে যায়। মনে হয় পাগলই জহিরকে হত্যা করিয়েছে। যদিও আমি জানি তা সত্য নয়। তারপরও আমার সব রাগ গিয়ে পাগলের ওপর পড়ে। পাগল আগে কখনও আমাকে এভাবে অপমান করেনি। এ কথাতো সত্যি যে আমার জন্য আমার ভাইটা নষ্ট হয়ে গেছে, আমার আব্বা কবরে গেছে। আমার জন্য পাগলের আজ এই দশা। ঠাণ্ডা মাথায় এক বার ভাবি। ভাবি, দেই সুযোগ, পাগলকে। আমাকে কেটে ফেলতে। তারপর তার ঝাল মিটুক। আমি মরেই যাই। পাগল শান্তি পাক। আর আমিও পাগলের পাগলামি থেকে মুক্তি পাই। আমি একটা খুন করেছি। আজ নিজে খুন হয়ে তার প্রায়শ্চিত্ত করি। মরতেতো হবেই। যত নিজেকে এ কথা বলি তত নিজের খুন হওয়াকে তামাশা মনে হয়। জীবনের সবচেয়ে ঘোর দুর্দশার দিনেও আমার কখনও এক মুহূর্তের জন্যও আত্মহত্যা করার কথা মাথায় আসেনি। আসলে আমি আত্মহত্যাকারিদের দলে নই। তাই বুঝি প্রাণ এত সহজে আমার থেকে পালাতে চায় না। বরং পাগলের দায়ের কোপ থেকে আমি নিজেই পালাই।
. পাগল আমাকে কোপাবে না, আমার এমনটাই ভাবার কথা ছিল। কিন্তু পাগলের উন্মত্ততায় আমি তা ভাবতে পারিনি। যদি না কোপায়, তা হলে সে আমাকে এমন ভাবে তাড়া করছে কেন? আসলে আমি কিছুতেই পাগলকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হল এত বছর ধরে তাকে পাগল ডাকার গজবটা আমার ওপর পড়ল। আর এ জন্যই সে সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছে। চার হাজার বর্গফুটের বাসা। পাগলের ত্রাসে পালাতে গিয়ে আমার কাছে মনে হয় ওটা মুরগরি খোঁয়াড়। আমি এমাথা থেকে ওমাথা দৌড়াই। সোনিয়া নিশ্চয়ই কোনও বাথরুমে ঢুকে আছে। ড্রয়িং রুমের কোনায় পাগল প্রায় আমাকে ধরেই ফেলেছিল। আমার বুক ব্রেইনডেড মানুষের মতো উঠানামা করছে। নিশ্বাস যেন কণ্ঠনালীর মাঝে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে, আর নিচে নামে না। আমার শক্তি কমে আসে। ভাবি কী হবে পাগল যদি দা’টা আমার দিকে ছুঁড়ে মারে? সেটা যাতে সে না করে, তার জন্য আমি কয়েকটা পৃথিবী বিধাতার কাছে বন্ধক রাখি। আমি খুঁজতে থাকি কোনও একটা ঘর। যেখানে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেব। পেয়েও যাই আমার সামনে একটা। সেটা আমার ঘর। আমি সেটাতে ঢুকি। কিন্তু দরজা বন্ধ করার সুযোগ পাই না। পাগলও আমার পিছে পিছে রুমে ঢোকে। আমি ভাবলাম শেষ। আর পারব না। আত্মসমর্পণের চিন্তা মাথায় আসে। জীবনের সব পীড়ন এক সাথে চোখের সামনে ভেসে আসে। ভাবি শিশিরকণাতো মৃত্যুর আগেই মরে গেছে। কোনও আধ্যাত্মিক মৃত্যু নয়। রাস্তার পাশে পড়ে মরে থাকার মতো। তারপরও শেষ চেষ্টা হিসাবে আমি একটা বালিশ তুলে নিই। পাগলের মুখোমুখি হই। যেই গালি দিয়ে পাগল আমাকে তাড়া করছে সেই গালি আমি পাগলকে দিই। বালিশটাকে বর্মের মতো বুকের সামনে ধরে আমি পাগলকে বলি, “…আর আসবি না। শুধু একটা সুযোগ পাই। আমিই তোকে জবাই করব।” পাগল আমার পেছনে চলে যায়। পিছন থেকে আমাকে আঘাত হানার জন্য। কারণ আমার পেছনে বালিশের কোনও বর্ম নাই। আমি উল্টা দিকে ঘুরি, পেছনে চলতে চলতে দরজার কাছে সরে আসি। দরজার বার হয়ে আবার আমি দৌড়াতে থাকি। এবার ড্রয়িং রুমের দিকে। ড্রয়িং রুমের বাইরে পাগল পা পিছলে পড়ে যায়। আমি পেছন ফিরে দেখি পাগল মাটিতে লুটানো। দা’টা ছিটকে পড়ে আছে। পাগলের ভাগ্য ভাল। অন্ধ অস্ত্রটা তার তলপেটে ঢুকে যায়নি। কিন্তু আমার রগ চটে গেছে।
. আমি পাগলের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ি। তার চুল মুঠি করে ধরে তাকে টেনে মাটিতে বসাই। তারপর এক হাতে চুল ধরে আর এক হাতের তালুতে যত শক্তি ছিল তত শক্তি দিয়ে তার গালে আঘাত করি। তার গালের ওপর আমার আঙ্গুলের সংখ্যা গুনি। চারটা আঙ্গুল ছাপ ফেলেছে। বৃদ্ধাঙ্গুল তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। আমার রাগ একটুও কমেনি। আমি হাত বদল করি। চুলগুলো ডান হাতে নিই। আর বাম হাত দিয়ে এবার পাগলের ডান গালে মারি। খেয়াল রাখি যাতে পাঁচ আঙ্গুলেরই দাগ পড়ে। তারপর পাগলের চোখে চোখ রেখে পাগলকে আমার যন্ত্রণার আগুনে বিদ্ধ করি। গলা ফাটিয়ে পাগলকে জিজ্ঞেস করি, “…আমাকে দোষ দিস কেন? আমি তোকে দুনিয়াতে এনেছি? না ত্ইু আমাকে দুনিয়াতে এনেছিস? বাচ্চা তোদের কাছে বোয়াল মাছের ডিম। পানিতে ছেড়ে দিবি আর বড় হয়ে যাবে। তুই যদি পাগল তাইলে তুই বিয়াইলি কেন? এই দায় তোর না আমার?” যেমন আমি চেঁচাই তেমন আমি পাগলের চুলে হেঁচকা টান মারি। আমি নিয়ন্ত্রণহারা। চুলের মুঠি ধরে আমি পাগলকে মেঝেতে ফেলে চেপে ধরি।
. “এখন আমি তোকে জবাই করব।”
তারা বলে, কাবিন নাই, ভাল কথা, স্বাক্ষী আছে? কাবিন নাই। স্বাক্ষী নাই। আমার গর্ভে জারজ। তারা বলে, এটা কিছুতেই রাখা যাবে না। কাবিন নাই, স্বাক্ষী নাই। রাশেদ পিস্তল নিয়ে বের হয়ে আসে। জহিরকে সে খুঁজে বের করবেই। যে জারজ তার বোনের পেটে জারজ রেখে পালিয়ে যায়, তাকে খুন না করে রাশেদ বাড়ি ফিরবে না
. আমার রাগ না পড়ে বাড়তে থাকে। মনে হয় আমিও পাগল হয়ে গেছি। আর এ দিকে পাগল কোনও প্রতিবাদ করে না। আমি আমার ধ্বংসের জন্য পাগলকে দায়ী করি। আমার আব্বাকে দায়ী করি। আব্বা থাকলে আব্বাকেও জবাই করতাম এখন। আব্বা আর এই মহিলা দু’জনেই আমার মূল ঘাতক। এরা আমাকে না মারলেও আমার জীবন মেরে ফেলেছে। আর সত্য হোক মিথ্যা হোক, পাগলতো সগর্বে ঘোষণা দিয়েছে, জহিরের তিরোধানের কাজ তারা সম্মিলিতভাবে করেছে। পৃথিবীর যাবতীয় ভয় দেখিয়ে আমাকে মুক্তি ক্লিনিকে নিয়ে গেছে। আমি যেতে চাইনি। তখন এই মাগী, আর আমার বাপ নামের কলংক, ভাই নামের পশু, ডবকা পাছার হামিদ, মুরগি ছানা আমিন, কইতরি, এরা সবাই আমাকে চেপে ধরে। সবাই আমার কাছে কাবিন চায়। ওই প্রথম আমার তেজে পানি পড়ে। তারা বলে, কাবিন নাই, ভাল কথা, স্বাক্ষী আছে? কাবিন নাই। স্বাক্ষী নাই। আমার গর্ভে জারজ। তারা বলে, এটা কিছুতেই রাখা যাবে না। কাবিন নাই, স্বাক্ষী নাই। রাশেদ পিস্তল নিয়ে বের হয়ে আসে। জহিরকে সে খুঁজে বের করবেই। যে জারজ তার বোনের পেটে জারজ রেখে পালিয়ে যায়, তাকে খুন না করে রাশেদ বাড়ি ফিরবে না। “অন্তত একটা কাবিন রেখে পালাত,” মুরগি ছানা আমিন বলে। “আরতো কিছুর দরকার ছিল না। একটা কাবিন, একটা কলমা।” অথচ কাবিন নাই, স্বাক্ষী নাই। ওরা সবাই তখন ফেরেশতা। আমার চূড়ান্ত বিশ্বাস তখন হয়ে গেছে, জহির পালিয়েছে, আমার পেট বাঁধিয়ে। আর ওরা সবাই এই সুযোগটা নিল। কাবিন কই? স্বাক্ষী কই? এখন পাগল আমার কব্জায়। আমার কানে প্রশ্ন দুইটা বাজে। কাবিন কই? স্বাক্ষী কই? আমি পাগলকে দুইটা চড় মারি। সে তখন আমাকে মুক্তি ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিল। মুক্তি ক্লিনিক থেকে ফেরার পর, আমি যাতে সেরে উঠি, সেই জন্য সে আমাকে পৃথিবীর আনাচে কানাচে নিয়ে গেছে। এখন আমার অপরাধবোধ হয়। কিন্তু তখন পিরামিড দেখে, আক্রোপলিস দেখে, কলোসিয়াম দেখে, কোস্টা ব্রাভা দেখে, নায়াগ্রা দেখে, গ্রান্ড ক্যানিয়ন দেখে আমি আমার আসল জীবনের কথা ভুলে গিয়েছিলাম। আমি তখন নকল জীবনের স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি হামিদের ডবকা পাছা। এখন যখন পাগল আমার কব্জায়, আমার মনে আসে, এরা আমার অর্ধেককে রাস্তায় গুলি করে মেরেছে। আর অর্ধেককে মুক্তি ক্লিনিকে অঙ্কুরে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। এরা সবাই কি তা করেনি? কোনও না কোনও ভাবে? সত্য কোনটা? মিথ্যা কোনটা? ভাবতে ভাবতে আমার রাগ আরও চড়ে যায়। আমি পাগলের বুকের উপর উঠে বসি। পাগল শুয়ে থাকে। নড়ে না। চড়ে না। আমাকে দেখে। অপরাধীর দৃষ্টিতে। শিশুর দৃষ্টিতে। না আছে তাতে ভয়। না আছে বেঁচে থাকার আকুতি। আমি দা’টা তুলে আনি। পাগলকে কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিই। তারপর যা হবে তার কথা পরে ভাবব। আগে এই আপদকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিই।
. “দোয়া পড়,” আমি বলি। “কলমা মুখে আন্।”
. পাগল আমার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করে না।
. “খালাম্মা! আপনি এইডা কী করতাছেন?”
. সোনিয়া আমার পেছনে। সোনিয়ার কারণেই আমার সচেতনতা ফিরে আসে। আমার মনে আসে আমিতো পাগলকে মাফ করে দিয়েছিলাম। সোনিয়া পেছনে এসে না দাঁড়ালে আর ওই কথা না বললে কী হত শুধু আল্লাহ জানেন। তবে পাগলকে আমি পুরোপুরি ছেড়ে দিতেও নারাজ। আমি দায়ের পিঠ দিয়ে পাগলের গলায় পোঁচ দিই। “আর পাগলামি করবি?” আমি চেঁচিয়ে বলি। “আর পাগলামি করবি?”
. পাগল কিছু বলে না। পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণ করে বসে আছে। আমি আর এগুতে পারি না। আমি পাগলের ওপর থেকে উঠে যাই। আমার হাত পা ম্যালেরিয়া রোগির মতো কাঁপে।
. পাগল উঠে তার ঘরে চলে যায়। তারপর বাকি দিনটা আমার পাগলের মতো কাটে। অনেক বারই পাগলকে পাগল ভেবে নিজে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু হতে পারিনি। ছাদে ওঠার আগে পাগলকে যে দশায় দেখেছি তা মনে আসে আর আমার চোখ ভিজে যায়। গাল ভিজিয়ে চোখের জল পড়ে। দশ বছর ধরে এভাবে তাকে দেখে এসেছি। তবে আজকের অবস্থা ভিন্ন। আজ সে একবারও বাথরুমে যায়নি। তার গায়ে এখনও সেই কালো ম্যাক্সি। এটা অভাবনীয়। কোনও দিন ঘর মুছতে মুছতে সে তিন বার ম্যাক্সি বদলায়। আর মোছার পর তিন ঘন্টা বাথরুমে কাটায়। আজ যেন তার ওসিডি ভাল হয়ে গেছে।
. আমি মীমাংসিত বিষয়গুলো ভাবি। যে খুন মাথায় চেপেছিল তার জন্য অনুতাপ হয়। পাগলের বিষণ্ণতা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা আগে কখনও এমন করে ভাবিনি। আমি ধরে নিয়েছিলাম আমার বিষণ্ণতার যত্ন নেয়ার দায়িত্ব তার। তার বিষণ্ণতার যত্ন নেয়ার দায়িত্ব আমার নয়। আমি ভুল ছিলাম। আমার কান্না থামে না। অনুশোচনায় বুক ভেঙ্গে যেতে চায়। আর অশ্রুর গতিও বাড়ে। সোনিয়া আমাকে দেখে।
. “খালাম্মা, নানির জন্য কাঁইদতাছুন?”
. “হুঁ।”
. অনেক্ষণ কাঁদলাম। নিজে নিজে। ঘন্টা দুয়েক আমরা ছাদে আছি। এই সময় ওরা থেমে থেমে আতশবাজি জ্বালিয়েছে, গান শুনিয়েছে অবিরাম, আর অনেক হৈ-হল্লা করেছে। শেষের দিকে মিনিট দশেক অবিরাম আতশবাজির স্ফূরণে আকাশ আলোকিত হয়। সোনিয়াকে বলি, অনেকে হয়েছে, চল। ঘরে যাই। প্রতিজ্ঞা করি ঘরে গিয়ে পাগলের পায়ের ওপর পড়ব। যতক্ষণ না সে আমাকে ক্ষমা করছে ততক্ষণ তার পা ছাড়ব না। তারপর নিজ হাতে তাকে গোসল করাব। নিজ হাতে খাওয়াব। গত দশ বছর আমাকে সে দিয়েছে। এখন থেকে তার মৃত্যু পর্যন্ত আমি তাকে দিব।
. আমার দেয়ার আকুতি বাড়ে। আমি জোরে জোরে পা ফেলি। আমার প্রতি পদেক্ষপ দ্রুততর, দীর্ঘতর হয়।
ওসিডি‘র প্রকাশিত পর্বগুলো পড়ুন—
ওসিডি (পর্ব-০১)
ওসিডি (পর্ব-০২)
ওসিডি (পর্ব-০৩)
ওসিডি (পর্ব-০৪)
ওসিডি (পর্ব-০৫)
ওসিডি (পর্ব-০৬)
ওসিডি (পর্ব-০৭)
ওসিডি (পর্ব-০৮)
ওসিডি (পর্ব-০৯)