Author Picture

ওসিডি (পর্ব-০৮)

হারুন আল রশিদ

পড়ুন— ওসিডি (পর্ব-০৭)

আঠারো

শপাত! শপাত!

.            কীইইই? আমি লাফ দিয়ে উঠি। সত্যিই কি চেয়ারম্যান স্যারের পিঠে জুতার বাড়ি? আমি এতক্ষণে চিত হয়ে পড়ে যেতাম, যদি আমি এক যুগ আগের শিশিরকণা হতাম। সেই পতনে আমার মাথা ফাটত। কিন্তু আমি এক যুগ আগের শিশিরকণা নই। শপাত! শপাত! চেয়ারম্যান স্যারের পিঠে আবার জুতার বাড়ি। আর আমার নাকে জুতার ধূলা। চিত হয়ে না পড়লেও আমার পিঠ সোজা হয়ে গেছে, আর বাড়িগুলি যেন আমার পিঠে পড়েছে। টেকসই চামড়ার জুতার বাড়ি। আমি বুঝলাম যদি জুতার বাড়িগুলি চেয়ারম্যান স্যারের পিঠে না পড়ে আমার পিঠে পড়ত, তবু আমি দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম হতাম। এটা নির্ঘাত আমার জীবনের একটা বড় অর্জন। আমি জীবনের যে কোনও সময়ের তুলনায় সবচেয়ে শক্তিমান, এটাই আমার মনে হল।

.            চতুর্থ বাড়ির পর চেয়ারম্যান স্যার পিঠ বাঁকিয়ে দাঁড়িয়ে যান। আমি না চাইলেও আমার মাথা পেছনে চলে যায়। না হলে আমাদের মাথায় ঠোকাঠুকি হত। আমার বাহু দু’টি, যারা স্যারকে টেনে তোলার জন্য ব্যাকুল হয়েছিল, তারা আমার পাশে শক্ত হয়ে খাড়া হয়ে থাকে।

.            আমার মন তখনও নরম। চেয়ারম্যান স্যারের অবস্থা খারাপ। তিনি বোধ হয় চাচ্ছেন আমি তাঁকে বাঁচাই। আমি এক লাফে চেয়ারম্যান স্যার আর আক্রমণকারিনীর মাঝে গিয়ে দাঁড়াই। মন চাচ্ছিল তার চুল টেনে ধরি যে স্যারকে মেরেছে। আক্রমণকারিনী আর আমি মুখোমুখি। আক্রমণকারিনীর চোখে এ কী দেখি? ছলছল করে অশ্রু ছাড়া চোখ নয়; অশ্রুতে টলমল করা চোখ। আমি চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হই। কারণ এর মধ্যে আমার হৃৎপিণ্ড এক ঝলক বিষের হিমে জমে গেছে। না হলে আক্রমণকারিনীকে আমি আমার ঘরের মেঝেতে ফেলে জবাই না করলেও তার বুকের উপর বসে তার গাল দুটিকে এলোপাতাড়ি চড়াতাম। আমার সামনে আমার মানুষকে আক্রমণ করে, পৃথিবীতে এমন সাহস কোন মেয়ের আছে? আমি তাকে উলঙ্গ করে আমার এই আটতলার জানালা থেকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলতাম। অত বড় রিস্ক না নিলেও সিঁড়ি দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিচে নামিয়ে রাস্তার মাঝখানে নিয়ে গিয়ে দশজনের সামনে তার পাছায় জোরে জোরে লাত্থি মারতাম। অথচ আমি কোনও কিছুই করছি না। কারণ হৃৎপিণ্ডের শীতলতায় আমার পুরো বুক হিম হয়ে গেছে।

.            উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি স্যারের মুখ বাঁকা হয়ে আছে। আর গালের রং এমন ফ্যাকাশে। যেন ওনার গাল থেকে ওখাস পেরেনেস হার্বাল ক্রিম এর সব জাদু চলে গেছে। গালের চামড়ার এই দশা কোনও তরুণীর কাছে সাপের চামড়া বলে মনে হবে। আমার বুক চিপে ওঠে। বাস্তব বুদ্ধিতে। ষাট কি বাষট্টি বছর যদিও এমন কোনও বয়স না। তারপরও। হার্ট অ্যাটাক করতে পারে। অথবা ব্রেইন স্ট্রোক। কিছু হলে ঝামেলায় পড়ব আমি আর আমার মা। তারপর আমার ভাই এসে আমাকে আচ্ছামতো গালি দেবে। সেই গালি যা শুনলে বাংলাদেশের শত ভাগ মেয়ের শরীরের সব চুল খাড়া হয়ে যাবে। শুধু এই শিশিরকণার ছাড়া। তাই বলে যে আমি তাকে ভয় পাই না, তা নয়। বরং ভাইয়ের তৈরি সিনেমাকে আমি যত ভয় পাই, জগতে আর কিছুকে তত ভয় পাই না।

.            স্যারকে যে পেটাল তার নাম তানিয়া, যার কথা এর মধ্যে আমি স্মরণ করেছি, যাকে আমার গোপনীয়তার অংশিদার করব বলে ভেবেছিলাম। তানিয়া আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সের শিক্ষক। তানিয়াকে ফোন করে স্যারের খবর দিয়ে আমি কি ভুল করেছিলাম? না ঠিক করেছিলাম? তানিয়া যখন বৈঠকখানায় প্রবেশ করেছে তখন আমি স্যারের রেশমি চুলের পরশে বুঁদ হয়ে ছিলাম। এতটাই যে জুতার বাড়ি স্যারের পিঠে পড়ার আগে আমি তানিয়ার আগমন খেয়ালই করতে পারিনি।

.            আমি বাস্তবতায় নেমে এসেছি। আমি বিব্রত। তানিয়া ফুঁসছে।

.            “বলেছিলি না, তালাক দিবি? দিয়েছিলি?” তানিয়া খেঁকিয়ে ওঠে।

.            “আমি একটু বসি, শিশিরকণা,” স্যার বলেন।

.            আমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিই। স্যার টলতে টলতে কয়েক কদম এগিয়ে একটা ছোট সোফার দুই হাতলে দুই হাত ঠেকিয়ে গুটিশুটি হয়ে বসে পড়েন।

.            “একটু পানি খাব,” স্যার বলেন।

.            আমি পানি আনার জন্য উদ্যত। তানিয়া আমার দুই হাত ধরে হেঁচকা টান মেরে আমাকে দাঁড় করায়। আমি নড়ার সাহস পাই না।

.            “পানি না, আমি ওরে —” তানিয়ার গলা দিয়ে তীক্ষ্ণ স্বর বের হয়, কারণ ওটা একটা এক নিনাদী স্বরের কান্না। “শিশির আপা গেলাশ আনেন। আর কোন বাথরুমে যাব সেটা বলেন।”

.            আমি একটু শ্বাস ফেলি। আমার বুকের হিম একটু একটু ছেড়ে যাচ্ছে। আমি তানিয়াকে অগ্রাহ্য করতে পারি না। তারপরও আমি নিরপেক্ষ হওয়ার কথা ভাবি। “থাক, তানিয়া,” আমি বলি।

.            “কেন? কেন থাকবে, শিশির আপা?”

.            “তুই একটু ঠাণ্ডা হ, বোন,” আমি বলি।

.            তানিয়া আমাকে পাত্তা দেয় না। জুতা নিয়ে স্যারের দিকে তেড়ে যায়।

.            “বলেছিলি তালাক দিবি। তা না করে তুই আমাকে মুক্তি ক্লিনিকে নিয়ে গেলি।”

.            মুক্তি ক্লিনিক। শব্দ দুটি শোনার পর আমার বুকের পেশিগুলি আমাকে আবার খিঁচে ধরে। আমার সুস্থ-সবল দুই বৃক্কে অদৃশ্য পাথর গড়াগড়ি খায়। আমার সহনশীল জরায়ু নিজে নিজে কেঁদে ওঠে। তার কষ্টের ঝাঁকুনিতে আমি কেঁপে উঠি। মুক্তি ক্লিনিকে আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে। আমার সামনে কেউ মুক্তি ক্লিনিকের কথা এ ভাবে উচ্চারণ করবে, আমি তা ভাবতে পারিনি। আমি বুঝি মুক্তি ক্লিনিকে গিয়ে তানিয়া মুক্ত হয়েছে। তবু ওর জন্য আমার মায়া হয়।

স্বামীর প্রেম পাওয়ার পর সেই প্রেমের আমেজ নীরবে অনুভব করার জন্য রনি দুই ঘন্টা একান্তে থাকতে চেয়েছে। রনির স্বামী রনিকে দরজার বাইরে থেকে পাহারা দিয়েছে যাতে সেই দুই ঘন্টা রনি একান্তে থাকতে পারে। ওই সময় রনি তার সুইসাইড নোট লেখে। রনি তার মৃত্যুর কারণ ব্যাখ্যা করে। রনি লিখে যায় তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়

.            তানিয়া বসে থাকা স্যারকে দুই ঘা দেয়, দুই বাহুর উপর। তানিয়া যে ছাত্ররাজনীতি করত তা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। তানিয়া পিস্তল, বন্দুক, হকি-স্টিক চালানোয় দক্ষ। হাতাহাতি আর চুলাচুলি ওর জন্য দুধভাত। এখন দেখি জুতা চালানোতেও ওর প্রতিভা কোনও অংশে কম নয়। ছাত্রনেতাদের আমরা বিশ্বাস করি না। ওরা মানুষকে যেমন আদর করে, আবার পছন্দ না হলে তেমনি মারে। আমার আশঙ্কা হয়। আমি লাফ দিয়ে গিয়ে আবার ওদের মাঝে দাঁড়াই। তানিয়া আমাকে ঠেলে সরিয়ে দেয়। তারপর স্যারের চুল ধরে হেঁচকা টান দেয়।

.            “ঝুঁটি কই তোর, ঝুঁটি?”

.            আমার চোখ পড়ে সাদা ব্যান্ডটার উপর, সোফায় শুয়ে আছে। আমার লজ্জা লাগে। আমিই স্যারের ঝুঁটিটা খুলে দিয়েছিলাম, চুলগুলো ভাল করে ধরব বলে।

.            তানিয়া স্যারের চুলে হেঁচকা টান দিতে থাকে। “কত মেয়েকে তুই মুক্তি ক্লিনিকে নিয়ে গেছিস? আমি পাঁচ জনের নাম-ঠিকানা জোগাড় করেছি। এখন আমি ওদের এক এক করে ফোন করব। সবাই এখানে আসবে। শিশির আপা জগ আনেন, নইলে বালতি। এই শুয়োরের বাচ্চা পানি খাবেতো? আমি ওরে ছয় মাগির পানি খাওয়াব। দেখি কত পানি তুই খেতে পারিস? শিশির আপা আপনি দিবেন? দেন না এক মগ? তা হলে সাত জনের হয়।”

.            তানিয়া প্রকারান্তরে আমাকে তা-ই সম্বোধন করল যা আমার ভাই আমার উপর গালি আকারে বর্ষণ করে আসছে, গত দশ বছর ধরে। আমার হাতটা সয়ংক্রিয়ভাবে আমার বুকে একটা চাপ দেয়। কিসের জন্য কে জানে? তানিয়ার দস্যিপনার ইতিহাস না থাকলেও ওর এই আক্রোশকে আমি ভয় পেতাম। বুঝতে পারি না কী করে ওর এই আক্রোশ আমি থামাব। আমি তানিয়াকে চেপে ধরি। তানিয়া ওর ডান ঘাড় দিয়ে আমাকে ধাক্কা দেয়। আমি ওকে আরও জোরে চেপে ধরি। তানিয়া এবার সরাসরি আমাকে গালিটা দেয়। ভাইয়ের গালি শুনলে আমার মাথার চুল খাড়া হয়ে যায়। কিন্তু তানিয়ার উপর আমি রাগ করতে পারি না। ধ্বংস হতে কিংবা মুক্তি পেতে, যে কারণেই একটা মেয়ে মুক্তি ক্লিনিকে যাক না কেন, আমি কোনও দিন তার উপর চূড়ান্ত রাগ করতে পারব না। তা ছাড়া তানিয়ার অবস্থা খুব খারাপ। ওর সারা শরীর কাঁপছিল আর এখন ওর চোখ অশ্রু ছেড়ে দিয়েছে, যা অবশ্য অপেক্ষাকৃত বেশি সহনীয়। কারণ এটা শ্রাবণ মাসের বিরতিহীন বৃষ্টি, যখন বন্যার ভয় কেটে যায়, কারণ আষাঢ় মাসের বারিতে ইতিমধ্যে এক বার বন্যা হয়ে গেছে। আমি তানিয়ার হাত থেকে ওর ফোনটা ছাড়াতে চাই। আর তানিয়া বোঝে এটা দুই সতিনের ধস্তাধস্তি নয়।

.            “মাপ করেন, শিশির আপা,” তানিয়া বলে। “জানি না আমি কেন আপনাকে গালি দিলাম। আমার মাথা ঠিক নাই। এই বদমাশ আমাকে পাগল করে ছেড়ে দিয়েছে। এ পর্যন্ত চার বার আমাকে মুক্তি ক্লিনিকে নিয়ে গেছে।”

.            চার বার! বলে কী? তানিয়া যে এমন ফলবতী বৃক্ষ তা ওর কাটখোট্টা শরীর দেখে বোঝার উপার নাই। ওর বুক প্রায় অদৃশ্য। লিভারে মেদ জমলে যে কোনও বেটার বুকও এর চেয়ে বড় হয়। তানিয়ার নিখাদ নারী স্বাস্থ্যের এমন অব্যবস্থাপনা আমার করুণা জাগায়।

.            আহারে! মায়া খালার মেয়ে রনি। বিয়ের সাড়ে তিন বছরের মাথার ঘটনা। স্বামী-শ্বশুর —শাশুড়ি-ননদের কটূক্তি। বাচ্চা কেন হয় না? পৃথিবীতে সবার বাচ্চা হয়। রনির বাচ্চা হয় না কেন? আল্লাহর গজব। অলক্ষ্মী। রনির পূর্বপুরুষরা মানুষের হক মেরেছে। ডাকাতি করেছে। খুন করেছে। জীবন্ত মেয়ে-শিশুকে কবর দিয়ে দিয়েছে। আল্লাহর গজবে রনি দুনিয়াতে অনুর্বর জরায়ু নিয়ে এসেছে। কে বলেছে রনিকে এই অবস্থায় শ্বশুর বাড়ি ঢুকতে? রনি সেই বাড়িতে ঢুকার পর থেকেই বাড়িটার উপর একের পর এক আল্লাহর গজব পড়েছে। ব্যবসা মার খেয়েছে। মেঘনায় লঞ্চ ডুবেছে। এক মিশরীয় দালাল পঁচিশ কোটি টাকার চিংড়ি মেরে দিয়েছে। একটা চা বাগান পুড়ে গেছে। আরও অনেক ক্ষতি হয়েছে, যা রনি জানে না বা ওকে জানানো হয়নি। রনি এক দিন ওর শাশুড়িকে বলে:

.            “আম্মা, তিন মাস ধরে আমার পিরিয়ড বন্ধ।” কথাটা বলে রনি ওয়াক ওয়াক করে কাছের বেসিনটায় ওর মাথা চেপে ধরে।

.            সাথে সাথে রনির শ্বশুরবাড়ি বদলে যায়। রনির স্বামী-শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ সবাই লাইন ধরে এসে একে একে রনিকে তাদের বুকে চেপে ধরে। রনির বমি বের না হলেও ওর শাশুড়ি নিজের হাতে সেই বেসিন ধোয়। রনির ননদও হাত লাগায়। তারা সবাই রনির কাছে ক্ষমা চায়। তারা কত নীচ, কত হীন। সত্য কথা হল রনি সে বাড়িতে প্রবেশ করার পর তাদের জীবন বদলে গেছে। রনির পূর্বপুরুষরা নবি-রাসুল ছিল। তাদের দোয়ায় রনির শশুর বাড়ির ব্যবসার অনেক উন্নতি হয়েছে। লঞ্চের বহর বেড়ে চারটার জায়গায় ষোলোটা হয়েছে। মিশরীয় ব্যবসায়ী চিংড়ির অর্ডার চারগুণ বাড়িয়েছে। সবচেয়ে বেশি মুনাফা এসেছে চায়ের ব্যবসা থেকে। রনির শাশুড়ি চোখের জল ফেলে। ননদ খুশিতে নাচে। শ্বশুর বনানী থেকে দুই মন প্রিমিয়ামের মিষ্টি কিনে নিয়ে আসে। শাশুড়ি সন্তানের অনাগত সন্তানের জন্য সোয়েটার আর কানটুপি বানানোর জন্য বহু বছর আলমারিতে তুলে রাখা উল আর কাঁটা বের করে আনে। রনির স্বামী রনিকে নিভৃতে নিয়ে গিয়ে এক ঘন্টায় এক জনমের প্রেম দেয়।

.            সে রাতে রনি গোপনে ষোলো তলা বাড়িটার ছাদে যায়। এক সময় সে পর্বতারোহন করেছে। ষোলো তলা বাড়ির ছাদের রেলিং বেয়ে উপরে উঠা ওর জন্য কঠিন কোনও বিষয় ছিল না। রনি ছাদ থেকে লাফ দেয়। রনি লং জাম্প দিয়েছিল। তাই সে রাস্তার অন্যপাশে চলে যায়। মাটিতে পড়ার আগে রনি কুণ্ডলি পাকানো তারের গোছায় আছাড় খায় আর কোমরের কাছে দুই ভাগ হয়ে যায়।

.            কীভাবে আমি এত কথা জানি? কারণ রনি সব লিখে গেছে। স্বামীর প্রেম পাওয়ার পর সেই প্রেমের আমেজ নীরবে অনুভব করার জন্য রনি দুই ঘন্টা একান্তে থাকতে চেয়েছে। রনির স্বামী রনিকে দরজার বাইরে থেকে পাহারা দিয়েছে যাতে সেই দুই ঘন্টা রনি একান্তে থাকতে পারে। ওই সময় রনি তার সুইসাইড নোট লেখে। রনি তার মৃত্যুর কারণ ব্যাখ্যা করে। রনি লিখে যায় তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। পুলিশ যদি তার লাশ নিয়ে শ্বশুর বাড়ির মানুষদের হয়রানি করে তবে রনির আত্মা কষ্ট পাবে। সুইসাইড নোট ছিল তেইশ পৃষ্ঠা। মায়া খালার কাছে তা এখনও আছে। নিজের ব্যর্থতার শাস্তি রনি মেনে নিয়েছে। উপরন্তু স্বামীকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়েছে। এই জন্য যে ও বেঁচে থাকতে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করেনি। তেইশ পৃষ্ঠার অর্ধেক জুড়ে ছিল ওর শ্বশুর বাড়ির সবাই কত ভাল সেসব কথা। যা অনুর্বর ছিল তা উর্বর হলে রনি যে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে হত, সে কথাও রনি লিখেছে।

.            একটা সন্তানের অভাবে রনি আত্মহত্যা করল। একটা সন্তানের ধ্বংসে আমার জীবন ধ্বংস হয়ে গেল। একটা সন্তান ধ্বংস হলে তানিয়া জীবন ফিরে পায়। যেন এটা আমাদের ব্যবসা। সন্তান আমাদের পণ্য। তাই আমরা সন্তানের অনুমতি নিই না। পানের দোকানদার পানের অনুমতি না নিয়ে পান বেচে আর খদ্দের তা তার মুখে আবর্জনা হিসাবে চিবায়।

শিশির আপার পেছনে তুমি কেন ঘোরো?। ঘুরতে ঘুরতে মরে গেলেও তুমি শিশির আপাকে পাবে না। শিশির আপা পুরুষ মানুষ খায়। তুমি তাকে চেনো না। সে মুখ দেখায়, বুক দেখায়, পাছা দেখায়, রান দেখায়, আর রানের মধ্যে ঢুকতে গেলে পাছায় মারে লাত্থি। আর আমি? নিজেকে খুলে দিয়েছি তোমার জন্য

.            নিজের অজান্তে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি আর ফুঁসতে থাকা তানিয়াকে দেখি। তানিয়া অনুর্বর হলে ওর কত সুবিধা হত। অথচ তানিয় কত উর্বর। দুনিয়াতে এটা নাকি অনাচারের শাস্তি, আমাকে একটা মেয়ে বলেছে। তার তিন সন্তানের মধ্যে শেষটা কীভাবে এল সে নিজেই জানে না। ওর বিশ্বাস অনেক সময় বাতাসের বাড়িতেও নাকি একটা মেয়ে গর্ভ ধারণ করে ফেলতে পারে। মেয়েটা আমাকে প্রভাবিত করে। হামিদের সাথে বিয়ের পর আমিও বিশ্বাস করতে থাকি নখ, নিষ্ঠীবন, নিঃশ্বাস এ-সবও নারীকে গর্ভবতী করতে পারে। অথচ যার একটা সন্তান দরকার তার ক্ষেত্রে কোনও কিছুই কাজে লাগে না। রনি একটা পেলেই বর্তে যেত। তানিয়া একটা রাখতে চাইলে ওর দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে। কোন প্রেমে হাবুডুবু খেলে তানিয়া চার চার বার মুক্তি ক্লিনিকে যায়? তানিয়ার ফোনটা আমার কাছে। মনে হল দিই ওর ফোন ওকে ফিরিয়ে। ও ডেকে আনুক আমাদের স্যারের অন্য প্রেমিকাদের। লাল বড় বালতিটা এনে রাখি। আমিও আট গেলাশ পানি খেয়ে ওদের দলে যুক্ত হই। আল্লাহ আমাকে শক্তিশালী বৃক্ক দিয়েছেন। দিয়েছেন শক্তিশালী স্নায়ুতন্ত্র। তাদের কাজে লাগাই। পনেরো মিনিটের মধ্যে এক জগের জোগান দেই। তানিয়ার মনে অনেক কষ্ট।

.            কিন্তু না। জমিজিরাত টাকাপয়সার হিসাব আমার মাথায়। আমি ঝামেলা চাই না। নিজের বাড়িতে এই হট্টগোল। আখেরে আমাকেই সামলাতে হবে।

.            “তানিয়া, আমি কিছু মনে করিনি,” আমি বলি। “আম্মার কথা চিন্তা কর। তুইতো সব জানিস।”

.            “তাহলে এটা করতে দেন।” এই বলে তানিয়া ওর জুতাটা মেঝে থেকে তুলে নিয়ে ওটা দিয়ে স্যারের ডান গালে মারে। তানিয়া এখন আরও দ্রুত কাঁপছে কিন্তু স্যারকে সে বেদম প্রহার করে। প্রতিটা আঘাতের সাথে স্যারের মুখ বিকৃত হয় আর দাঁত দেখা যায়।

.            “তানিয়া, বয়স্ক মানুষ। যদি কিছু হয়ে যায়?”

.            “কিচ্ছু হবে না।” তানিয়া তার জুতা দিয়ে স্যারের মাথায় মারে।

.            “থাম্ তানিয়া,” আমি বলি।

.            “কেন থামব?”

.            “তোর এত মার উনি নিতে পারছেন না।”

.            “ওওওও! তাআআআআই! কে শুইছে অর নিচে? আপনে না আমি? আপনে অর শক্তির খবর রাখেন? না কি এর মধ্যে আপনেও শুইছেন?”

.            আমার গায়ে কাঁটা দেয়। সে কাঁটা রোমাঞ্চের কাঁটাও হতে পারে। যে রোমাঞ্চ আমি ভেবেছিলাম আমি পেতে যাচ্ছিলাম। সে বুঝি আর হল না। আমার রক্তে আর একটা বিরক্তি-উৎপাদক রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে। আমার আর অনুশোচনাও হচ্ছে না। আমার দরকার ঝামেলা মুক্ত হওয়া। তানিয়ার শরীর আরও বেশি কাঁপে। তানিয়া হয়তো এবার নিজেই মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। আমি দোটানায় পড়ি। স্যারকে জুতা দিয়ে আরও কিছুক্ষণ মারলে যদি তানিয়া শান্ত হয় আমার তাতে কোনও আপত্তি নাই। সমস্যা হল স্যারের অবস্থা। যদি কিছু এখানে হয়ে যায়। মনে মনে আল্লাহকে বলি, কিছু যেন না হয়। আর অপেক্ষা করি তানিয়ার ঝাল মেটার জন্য।

.            স্যারকে আর কয়েকটা বাড়ি দিয়ে তানিয়া ওর জুতা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। নিমিষে তানিয়া স্যারের গলায় ঝাঁপ দেয়। আমি ভাবি তানিয়া চূড়ান্তভাবে পাগল হয়ে গেছে। ভাবতে গিয়ে আমার গর্দান শক্ত হয়ে যায়।

.            স্যারের গলা আঁকড়ে ধরে তানিয়া ফুঁপিয়ে কাঁদে। “আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচব না, জান্। তুমি অন্য মেয়েদের কাছে গেলে কষ্টে আমার বুক ফেটে যায়। কেন তুমি আমার কষ্ট বোঝো না?”

.            তানিয়ার পিঠের ভঙ্গি বলে তানিয়ার বুকের ভেতর আটলান্টিকের ঢেউ বাড়ি দিচ্ছে। এমন কান্না জীবনে দেখিনি। কী পরিমান অশ্রু ঝরছে তা দেখার জন্য আমি দুই কদম এগিয়ে যাই। দেখি তানিয়ার গাল বেয়ে অনেক অশ্রু ঝরছে, যা একবারও থামেনি। কোথা থেকে এত পানি আসছে শুধু আল্লাহ বলতে পারবে। তানিয়ার অশ্রু স্যারের লাল সোয়েটারের বুক কালো করে ফেলেছে। আমি মাথা ঘুরিয়ে স্যারের মুখ দেখি। সে মুখ থেকে ত্রাসের চিহ্ন চলে গেছে। স্যারের গালে উত্তর-প্রদেশীয় আর্য আভার উদয় হচ্ছে।

.            “তোমাকে ডিভোর্স দিতে হবে না, জান্,” তানিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলে। “আর কক্খনও আমি তোমাকে তাকে ডিভোর্স দিতে বলব না। তোমাকে আমি আর জ্বালাব না। আর যত বার দরকার হয় তত বার আমি মুক্তি ক্লিনিকে যাব। তবু তুমি শুধু আমার থাকো, জান্। তুমি অন্য কোনও মেয়ের কাছে আর যেয়ো না। প্লিজ, কথা দাও। শিশির আপার পেছনে তুমি কেন ঘোরো?। ঘুরতে ঘুরতে মরে গেলেও তুমি শিশির আপাকে পাবে না। শিশির আপা পুরুষ মানুষ খায়। তুমি তাকে চেনো না। সে মুখ দেখায়, বুক দেখায়, পাছা দেখায়, রান দেখায়, আর রানের মধ্যে ঢুকতে গেলে পাছায় মারে লাত্থি। আর আমি? নিজেকে খুলে দিয়েছি তোমার জন্য। যখনই তুমি চেয়েছ আমি চিত শুয়ে গেছি। যাইনি? তুমিই বলো। আমি কি বলিনি? কত খাবে খাও। বলিনি, বলো? তবু তুমি অন্য মেয়েদের কাছে যাও। কেমন লাগে আমার? তুমি আর কখনও কোনও মেয়ের কাছে যাবে না। আমাকে শুধু এই কথা দাও, জান্। প্লিজ, জান্। তুমি শুধু আমাকে এই কথা দাও।”

.            আমার দীর্ঘশ্বাস ঝরে। স্যার তা খেয়াল করেন। কিন্তু তানিয়ার কানে তা যায় না।

.            “আমার ভুল হয়ে গেছে, তানিয়া,” স্যার বলেন। “আমাকে তুমি মাফ করে দাও। তুমি ছাড়া আমার জীবনে আর কোনও নারী কখনও ছিল না। ভবিষ্যতেও থাকবে না। আমি শিশিরকণার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। শৈশবে মায়ের আদর পাইনিতো। বাবা আমার চোখের সামনে মাকে গুলি করে মেরে ফেলল। দাঁতের ব্যাথায় চেঁচানোর জন্য। আমি মাতৃহীন ছিলাম, তানিয়া, মাতৃহীন। তবে আমি তোমাকে এখন কথা দিচ্ছি। মায়ের আদর নেয়ার জন্যও আর কারও কাছে যাব না। আমাকে বিশ্বাস করো, তানিয়া। আমার প্রিয়তমা, তুমি যেভাবে চাও, সেভাবে আমি চলব। আর কখনও কারও কাছে যাব না। তুমি দেখে নিয়ো।”

.            “সত্যি বলছ? সত্যি বলছ?”

.            “প্রতিজ্ঞা করছি, প্রিয়তমা। তোমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে প্রতিজ্ঞা করছি।”

.            “কসম খাও।”

.            “খোদার কসম, তানিয়া।”

.            “আবার কসম খাও।”

.            “তুমিই বলো কার নামে কসম খাব?”

.            “বড় পিরের নামে কসম খাও। আর খাজা মইনুদ্দিন চিশতির নামে।”

.            “বড় পিরের কসম। কসম বাবা খাজা মইনুদ্দিন চিশতির। রানী আমার, আমাকে শেষ বারের মতো ক্ষমা করে দাও। আর বিশ্বাস করো।”

.            “কীভাবে তোমাকে আমি বিশ্বাস করব?” তানিয়া আবার ফুঁপিয়ে উঠে।

.            একটা বিধ্বংসী ঝড়ের পর রোদ উঠল, চারিদিকে লোকজন ঘরের বার হল। সব কিছু শান্ত। সবার মনে আনন্দ। দুর্যোগ কেটে গেছে। এমন সময় যদি হঠাৎ আর একটা ঝড় উঠে সব কিছু লন্ডভণ্ড করে দিতে থাকে, তখন কেমন লাগে? তানিয়ার কান্নায় আমার তেমনটাই লাগছিল।

পাগলের প্রেমে আমার চোখে পানি চলে আসে। আমি ভাবি জীবনটাকে নতুন করে যাপন করব। সেখানে সুখী হওয়ার জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ছাড়া শুধু আর একটা চাহিদা থাকবে। পাগলের আলিঙ্গন। যেই ভাবি, সেই কাজ। এক লহমায় আমার পেশীগুলির যেখানে যত গিট তৈরি হয়ে ছিল সব খুলে যায়। দেহে চরম সুখের অনুভূতি জাগে

.            “আমাকে বিশ্বাস করো, তানিয়া। আমাকে বিশ্বাস করো।” স্যার তানিয়ার পিঠে মৃদু চাপড় দেন, আর জোরে জোরে আহাজারি করেন।

.            “আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে পারছি না।”

.            “বিশ্বাস করো। বিশ্বাস করো। দেখো আমি আর কখনও বিগড়ে যাই কি না। অন্তত ততক্ষণ আমাকে বিশ্বাস করো।”

.            উঁউঁউঁ। উঁউঁউঁ। উঁউঁউ। তানিয় একটানা কেঁদে যায়।

.            “বিশ্বাস করো। বিশ্বাস করো। রানী আমার। আমার প্রিয়তমা।”

.            “আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না,” তানিয়া চেঁচিয়ে ওঠে।

.            আমার বুক কাঁপে। এই রামছাগল মেয়ে না আবার জুতা হাতে নেয়।

.            “বিশ্বাস করো। বিশ্বাস করো,” স্যার অনুনয় করেন।

.            আবার দীর্ঘ কান্না। তারপর তানিয়া শান্তভাবে বলে, “আমি তোমাকে বিশ্বাস করি না। আর কখনও করতে পারবও না। তারপরও আমি তোমাকে মিছামিছি বিশ্বাস করতে চাই। আমি নিজেকে ফাঁকি দিব। আমি যাতে তা করতে পারি তার জন্য তুমি আমাকে সাহায্য করো। তুমি আমাকে চুমু দাও।”

.            বলিহারি। তানিয়াকে আমার ভাই কী ডাকত, তা জানার বড় ইচ্ছা করে। ততক্ষণে স্যার আর তানিয়ার আলিঙ্গন শুরু হয়ে গেছে। তানিয়ার পক্ষ থেকে। তেইশ বছর আগে করিম চাচার স্ত্রী যেমন আমার আর আব্বার উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে করিম চাচাকে মেরেছেন, আজ তানিয়া তেমন করে আমার উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে স্যারের বড় মুখের মধ্যে ওর ছোট মুখটা ঢুকিয়ে দিয়েছে। তানিয়ার ঠোঁটের আন্দোলনের কারণে স্যারের ঠোঁটের প্রকৃত গতিবিধি কিছু বোঝা যাচ্ছে না। যতবার তানিয়া স্যারের বুকে নিজের বুক চেপে ধরে, ততবার স্যারের পিঠ শক্ত হয়ে যায়। আমার মনে হল দুই জনকেই গুলি করে মারি। আব্বার রেখে যাওয়া পিস্তল দুইটা নিয়ে বড় জ্বালায় আছি। ওগুলোর লাইসেন্স নবায়ন করতে প্রতি বছর আমাকে একবার রংপুর যেতে হয়। অন্তত একটার আজ একটু সদ্ব্যবহার করি। ওদেরকে গুলি করার জন্য আমার হাত নিশপিশ করে।

.            কিন্তু কিছু করা হয়নি। তানিয়া আর স্যার একে অন্যের হাত ধরে আমাদের বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। স্যারের আঙ্গুলগুলোর দিকে আমার চোখ পড়ে ছিল। স্যারই তানিয়ার হাতটাকে নিজের হাতের মুঠোয় ধরে ছিল। মনে হল স্যার কোনো নারীর হাত নয়, বরং একটা পান্নস সাপের মাথা ধরে আছে।

.            আমি জানতাম এ অবস্থা বেশিক্ষণ থাকবে না। মার হজম করতে করতে স্যারের মুষ্কজোড়া চুপসে যাওয়াই স্বাভাবিক। এবং হয়েছেও তা-ই। কিন্তু তাদের জাগরণ শুরু হতেও সময় লাগেনি। মারের জ্বালাতো কিছুক্ষণের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। যে বাড়িগুলি সবচেয়ে বেশি ঘা দিয়েছে, সেগুলোর ব্যথা সারতে হয়তো আরও দশ মিনিট লাগবে। তখন স্যারের বিলাতি বেগুনযুগল আবার রসে ভরতে থাকবে। সেই রস স্যারের রক্তে আবার ঝড় তুলবে। হয়তো এর মধ্যে সে ঝড়ের পূর্বের পাগল হাওয়ার নাচন শুরু হয়ে গেছে। সেই চাপ এক সময় স্যারের হাত উষ্ণ করবে, কোমল করবে, আর তখন স্যারের মুঠোয় থাকা তানিয়ার হাতে জ্বর আসবে, তানিয়া ঘামতে থাকবে। এক সময় এমনকি ওরা জোরে পা চালাবে। স্যারের চোখ রাস্তার দুইপাশে একখানা উপযুক্ত স্থাপনা খুঁজে বেড়াবে। স্যার তাঁর গাড়ির স্পিড বাড়াবেন, বার বার ভেঁপু বাজাবেন, যাতে তাড়াতাড়ি কাছাকাছি কোনো হোটেলে পৌঁছা যায়। রিক্সা আর বাসগুলিকে গালি দিবেন। কেন তারা তাঁর পথে বাধা হয়ে আছে? মাশাল্লাহ! স্যার যে সাবধান মানুষ। পাঁচ-ছয় তলা সিঁড়ি বেয়ে উঠলেও গোড়ালি মচকানোর সম্ভাবনা নাই। আমার বরং তানিয়াকে নিয়ে চিন্তা। কিন্তু তখন রক্তের ঝড় স্যারের দেহে শক্তি তৈরি করবে, আর সেই শক্তি দিয়ে স্যার তানিয়াকে তুলার মতো উড়িয়ে নিবেন। তানিয়া ভাববে আহা আমার মনের মানুষ আমাকে কত ভালবাসে। তারপর দশ মিনিটের মধ্যে যা ঘটবে তা মাস তিনেক পর তানিয়াকে আবার মুক্তি ক্লিনিকে নিয়ে যাবে। তানিয়াতো বলেই দিয়েছে, দরকার হলে ওই গণিকা হাজার বার মুক্তি ক্লিনিকে যাবে।

.            ওরা চলে গেলে আমি ড্রয়িং রুমে এসে ওদের নাটকের জায়গায়টায় চোখ রাখি। এক সময় পাগল এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমার মাথাটা খুব ভারী লাগছিল। পাগলের আলিঙ্গন এমন সময় পেলাম যখন আমি এর জন্য চরম বুভূক্ষু ছিলাম। পাগল এখন আর কাউকে আলিঙ্গন করে না, কখনও করবেও না। পাগল সবার মধ্যে জীবাণু দেখে। শুধু আমার মধ্যে দেখে না।

.            আমি মাথাটা পাগলের ঘাড়ে রেখে নিজেকে পাগলের বুকে সঁপে দিই। পাগল আমাকে তার বুকের মধ্যে পিষে ফেলে। ওসিডি হলে মানুষের সব কিছু বেড়ে যায়। শক্তিও যে বাড়ে, পাগল তার প্রমাণ। নিজেকে এমন নিরাপদ আর কিছুতে লাগে না যেমনটা লাগে পাগলের এই আলিঙ্গনে। পাগলের শরীরে মায়ের সুগন্ধ। শুধু পাগলের আলিঙ্গনে সুখে থাকব এই ভাবে যদি জীবনটাকে আমি সাজাতাম, তবে আমি সুখী হতাম। আর এভাবে সুখী হওয়াও যায়। চূড়ান্ত সুখী হওয়া যায়। এই জ্ঞানটা আমার এখন হয়েছে, কিন্তু তখন ছিল না। পাগলের এই বোধ আজও তৈরি হয়নি।

.            পাগলের প্রেমে আমার চোখে পানি চলে আসে। আমি ভাবি জীবনটাকে নতুন করে যাপন করব। সেখানে সুখী হওয়ার জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ছাড়া শুধু আর একটা চাহিদা থাকবে। পাগলের আলিঙ্গন। যেই ভাবি, সেই কাজ। এক লহমায় আমার পেশীগুলির যেখানে যত গিট তৈরি হয়ে ছিল সব খুলে যায়। দেহে চরম সুখের অনুভূতি জাগে। যেখানে তানিয়া বা চেয়ারম্যান স্যারের রক্তের ঝড়ের কোনও স্থান নাই, প্রয়োজনও নাই। “মা, মা,” আমি বলি। “তোমাকে ছাড়া আর কিছু চাই না, মা।”

.            “না, না।” পাগল আমাকে ঝাঁকি দেয়। পাগল আমাকে বুঝতে পারে না। আমি যে পাগল ছাড়া আর কিছু চাই না এবং আমার এই চাওয়া যে খাঁটি আর পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়ে আমি যে এইমাত্র নির্লোভ হলাম, পাগল তা বুঝতে পারল না। কখনও হয়ত তা বিশ্বাসও করবে না, আমি ভাবি। না করুক। আমিতো করি। আমি পাগলকে আঁকড়ে ধরি। আসলেই জীবনে আমার আর কোনও চাওয়া ছিল না।

.            আমি পাগলের কিছুই পাইনি, শুধু গায়ের রং ছাড়া। আমার চোখ, নাক, কান, চিবুক সব আব্বার। আমাকে দেখে যে আমার চেয়ারম্যান স্যারের মতো পুরুষদের রক্তে জাভা সাগরের সাইক্লোন ওঠে তার কারণ নাকি আমার মুখ। পাগল আমার চেয়ে দশগুণ সুন্দরী। চুয়ান্ন বছর বয়স। তারপরও পাগলকে এখনও অনায়াসে বিয়ে দেয়া যায়। পুরুষরা যা দেখে দাঁড়িয়ে যায় তার সবই পাগলের এখনও অক্ষুণ্ণ আছে। তানিয়া আমার পাঁচ বছরের ছোট। কিন্তু ওর শরীরের যা অবস্থা, তা মোটেই পাগলের সাথে তুলনীয় নয়। আব্বা আমার ছিল। আমার জন্য কবরে গেল। এখন এই পাগল ছাড়া আমার কেউ নাই। এক সময় ভাইটাও ছিল। কিন্তু সে এখন আমার আতঙ্ক। আমি পাগলকে কিছুতেই হারাতে চাই না। পাগলকে আমি ভাল করব। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি। কঠিন প্রতিজ্ঞা।

.            “তুইতো কিছুই পেলি না, কণামণি।” পাগল কাঁদে।

.            “আর কিছু পেতে চাই না, মা। শুধু তোমাকে চাই।”

.            পৃথিবীর বা অন্য জগতের কোনও কিছুর বিনিময়ে আমি পাগলের সেই আলিঙ্গন থেকে বের হয়ে আসতে চাইনি।

 

ওসিডি‘র প্রকাশিত পর্বগুলো পড়ুন—
ওসিডি (পর্ব-০১)
ওসিডি (পর্ব-০২)
ওসিডি (পর্ব-০৩)
ওসিডি (পর্ব-০৪)
ওসিডি (পর্ব-০৫)
ওসিডি (পর্ব-০৬)
ওসিডি (পর্ব-০৭)
ওসিডি (পর্ব-০৮)

আরো পড়তে পারেন

নীলুর প্রেমের দিন রাত্রি (শেষ পর্ব)

পড়ুন— নীলুর প্রেমের দিন রাত্রি (পর্ব: ৩) ৫. — ময়ী, দোষ আমারও ছিল। আমি একটু সাহসী হতে পারতাম। কি হতো? কত দিন আর আটকে রাখতো? আমিও তো সাহস করে তোমাকে বলতে পারতাম চলো পালিয়ে যাই। ময়ী হো হো করে হেসে উঠলো। ‘তা পারতে। কিন্তু তা হলে এতো নামি সার্জন হতে পারতে?’ — না হতাম। কি….

নীলুর প্রেমের দিন রাত্রি (পর্ব: ৩)

পড়ুন— নীলুর প্রেমের দিন রাত্রি (পর্ব: ২) ৪. আজ বিশ বছর পর দেখা হলো। অনেক অভিমান, অনেক কথা জমে জমে পাহাড় হয়েছে। নিভৃতচারী নীলুর সব কথা অনেক অপেক্ষার পর ক্লান্ত। কথা বলতে পারবে কিনা জানে না। যা জানার ইচ্ছা ছিল তা এখন আর জানতে ইচ্ছা করছে না। একবার মনে হচ্ছে দেখা না হলেই ভাল হতো।….

নীলুর প্রেমের দিন রাত্রি (পর্ব: ২)

পড়ুন— নীলুর প্রেমের দিন রাত্রি (পর্ব: ১) ৩. — নীলু পরীক্ষা তো শেষ, বাড়ি যাবা নাকি? — যাব। কিছুদিন সৃজাকে পড়াতে হবে। পরীক্ষার জন্য অনেক দিন পড়ানো হয়নি। একটানা কিছুদিন পড়াব। তুমি কোথাও যাবা ঘুরতে? — ঠিক নেই। দেখি, যেতেও পারি। নীলুর মনে হলো এই প্রথম ময়ীর চশমার পিছনের চোখে মায়া। নিলুর জন্য মায়া। কিছু….

error: Content is protected !!