Author Picture

একজন বীর, একটি বই ও বিশাল সাম্রাজ্য

সাইফুর রহমান

বর্তমান সময় থেকে প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বের কাহিনী। সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় সেটা ছিল ১ অক্টোবর ৩৩১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। পারস্য দেশের গাউগামেলা প্রান্তরে দুই বাহিনী পরস্পরের সম্মুখীন হয়েছে। প্রায় পঞ্চাশ হাজার সেনাসামন্ত নিয়ে একদিকে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, অন্যদিকে দুই লক্ষাধিক সৈন্য নিয়ে সম্রাট দারিয়ূসের পক্ষে পারস্য সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সেই যুদ্ধে প্রজারা যোগ দিয়েছে দলে দলে। ব্যাবিলনের দিক থেকে সৈন্যরা এলো সপ্তাহ ধরে। লোহিত সাগরের তীরঘেঁষে আরবরা এলো উটের পিঠে চড়ে। দামি পোশাক পরিহিত ভারতীয়রা এলো বর্ম সজ্জিত হয়ে হাতি নিয়ে। দুর্ধর্ষ ব্যাকট্রীয়রা এলো বিশাল অশ্বারোহী বাহিনী সঙ্গে নিয়ে। পর্বতসংকুল আফগানিস্তান থেকে আফগান বাহিনীর হিরকানীয়রা এলো ঘোড়ায় চেপে হাতে সুতীক্ষ্ণ ধারালো বল্লম নিয়ে। এভাবে আরও অসংখ্য যোদ্ধা এসে যোগ দিল সেই মহাযজ্ঞে।

আলেকজান্ডারের প্রাচীন জীবনী লেখকদের অন্যতম আরিয়ানের মতে, আলেকজান্ডারের সঙ্গে ছিল ৪০ হাজার পদাতিক ও ৮ হাজার অশ্বারোহী সেনা। দারিয়ূসের সেনাবাহিনীর তুলনায় আলেকজান্ডারের বাহিনী ক্ষুদ্র হলেও তাদের মধ্যে ছিল শৃঙ্খলা এবং দক্ষ সেনাপতিত্ব।

যেদিন যুদ্ধ শুরু হওয়ার কথা অর্থাৎ ১ অক্টোবর ভোরে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে তার বেশ কয়েকজন সেনাপতি ও সঙ্গী-সাথি আলেকজান্ডারের তাঁবুতে এসে হাজির। সেখানে পৌঁছাতেই তাদের বিস্ময়ের সীমা রইল না; কারণ, তখনো আয়েশ করে ঘুমাচ্ছেন আলেকজান্ডার। গভীর ঘুমে ব্যাপৃত আছেন তিনি। সবাই মিলে তাঁবুর বাইরে পায়চারি করলেন কিছুক্ষণ। দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে আলেকজান্ডারের এক বন্ধু ও সেনাপতি পারমেনিও বেশ কয়েকবার ডেকে জাগালেন তাকে। ভ্রু দুটো কুঁচকে পারমেনিও আলেকজান্ডারকে উদ্দেশ করে বললেন— বলুন তো এও কী সম্ভব! এমন একটি সাংঘাতিক ও ঘোরতর যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েও আপনি কী করে নিরুদ্বেগে ঘুমাচ্ছেন? আলেকজান্ডার মৃদু হেসে উত্তর দিলেন— আমরা তো জয়ী হয়েই আছি। পারমেনিও দ্বিগুণ বিস্ময়ে বললেন-সে কীভাবে? আলেকজান্ডার তক্ষুণি বালিশের নিচ থেকে হোমারের ‘ইলিয়াড’ বইটি বের করে সবাইকে দেখিয়ে বললেন— এ বইটা ভালো করে দেখ। এটা আমার প্রায় মুখস্থ বলতে পার। এ বইয়ে লিখিত প্রতিটি যুদ্ধ কৌশল আমার নখদর্পণে। তবুও ভাবছ দারিয়ূস জিতবে এ যুদ্ধে? আলেকজান্ডার আরও বললেন— তাছাড়া পারস্য সম্রাট দারিয়ূস এ রণাঙ্গনেই অবস্থান করছেন। উনি যদি আড়াল থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করতেন, তাহলে কি কষ্টটাই না হতো বল। বিশাল সাম্রাজ্যের দুর্গম অঞ্চলে দারিয়ূসের পেছন পেছন ধাওয়া করার কষ্ট থেকে তো অন্তত বাঁচা গেছে। সে যাই হোক, সত্যি সত্যি আলেকজান্ডারের বালিশের নিচে যে দুটো জিনিস সব সময় থাকত, তার মধ্যে একটি হচ্ছে হোমারের বিশ্ববিখ্যাত মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে একটি ধারালো খড়্গ। আলেকজান্ডারের পিতা দ্বিতীয় ফিলিপ আঁততায়ীর হাতে নিহত হয়েছিলেন বলে আলেকজান্ডারের মনেও সর্বদা এক ধরনের ভয় কাজ করত, ফলে তিনি বালিশের নিচে একটি ধারালো ড্যাগার নিয়ে ঘুমাতেন সব সময়।

এবার তার পড়াশোনার বিষয়ে কিছু বলা যাক। আলেকজান্ডারের মাত্র তের বছর বয়সে শিক্ষক হিসাবে পেয়েছিলেন ভুবনখ্যাত দার্শনিক ও জ্ঞানতাপস অ্যারিস্টটলকে। তার পিতা সম্রাট ফিলিপ-ই অ্যারিস্টটলকে অনুরোধ করেছিলেন আলেকজান্ডারকে পড়াতে। ফিলিপের অনুরোধ ফেলতে পারেননি অ্যারিস্টটল। তার পিতা নিকোম্যাকাস দীর্ঘদিন ম্যাসিডোনিয়ার রাজগৃহে চিকিৎসক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ফলে চক্ষুলজ্জার কারণে হলেও এ অনুরোধ উপেক্ষা করা অ্যারিস্টটলের পক্ষে অসম্ভব ছিল। অ্যারিস্টটলের শিক্ষাগুরু বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক প্লেটোর তিরোধানের পর তিনি চলে গিয়েছিলেন লেসবস শহরে। ফিলিপের আহ্বানে তিনি নিযুক্ত হলেন রাজমহলের শিক্ষক হিসাবে। অ্যারিস্টটলের সংস্পর্শে এসে বইপাঠে ভীষণভাবে অনুরাগী হয়ে ওঠেন আলেকজান্ডার। জ্ঞান অন্বেষণে প্রবলভাবে ব্রতী হন তিনি। অ্যারিস্টটল, বালক আলেকজান্ডার হাতে তুলে দেন অন্ধ গ্রিক কবি হোমারের ইলিয়াড, অডিসি ও অন্যান্য বহু মূল্যবান গ্রন্থ। ইলিয়াড ও অসিডি পড়ে ভীষণ মুগ্ধ হন তিনি। বিশেষ করে ইলিয়াড তাকে এতটাই চমৎকৃত করে যে, আজীবনের মতো তিনি সঙ্গী করে নেন ইলিয়াড বইটি।

আলেকজান্ডার মৃদু হেসে উত্তর দিলেন— আমরা তো জয়ী হয়েই আছি। পারমেনিও দ্বিগুণ বিস্ময়ে বললেন-সে কীভাবে? আলেকজান্ডার তক্ষুণি বালিশের নিচ থেকে হোমারের ‘ইলিয়াড’ বইটি বের করে সবাইকে দেখিয়ে বললেন— এ বইটা ভালো করে দেখ। এটা আমার প্রায় মুখস্থ বলতে পার। এ বইয়ে লিখিত প্রতিটি যুদ্ধ কৌশল আমার নখদর্পণে

আলেকজান্ডারের কাছে ইলিয়াড বইটি নতুন হলেও এর কিছু কিছু কাহিনি আলেকজান্ডারের কাছে নতুন নয়। বিশেষ করে একিলিসের বীরত্বগাথা কাহিনি তিনি বহুবার শুনেছেন মা অলিম্পিয়াসের মুখে। রাতে ঘুমানোর আগে মা অলিম্পিয়াস ছেলের পাশে শুয়ে শোনাতেন ট্রয়ের গল্প, একিলিসের গল্প। আলেকজান্ডার তন্ময় হয়ে শোনেন সেসব কাহিনি। মনে মনে সংকল্প করেন, তিনিও একদিন হবেন একিলিসের মতো শ্রুতকীর্ত যোদ্ধা। আলেকজান্ডার যে কী অসামান্য সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন, সে আলোচনায় আসব পরে; কিন্তু আগে এ ইলিয়াড প্রসঙ্গে আরেকটি গল্প বলি।

সম্রাট দারিয়ূসের পরিত্যক্ত প্রসাদ থেকে বহুমূল্যবান জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছিল, তন্মধ্যে ছিল মণিমুক্তা খচিত অদ্ভুত ছোট একটি বাক্স। তিনি তার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলেন— এর মধ্যে কী উপযুক্ত জিনিস রাখা যেতে পারে। সতীর্থ মহল থেকে বিভিন্ন জিনিসের নাম প্রস্তাব করা হলো। কিন্তু তিনি বললেন যে, মহাকাব্য ‘ইলিয়াড’ই হচ্ছে একমাত্র উপযুক্ত বস্তু; যা এর মধ্যে রাখা যেতে পারে। সৈন্যদলের মধ্য থেকে কেউ কেউ অস্ফুট স্বরে ফিস ফিস করে বললেন— সে তো বটেই! আলেকজান্ডারের যুদ্ধ পরিচালনায় মহাকবি হোমারের এ মহাকাব্যটিই তো তাকে ভীষণভাবে সাহায্য করেছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, আরেকটি বই দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল আলেকজান্ডারকে। সে বইটিও তিনি পড়তেন বারবার। দার্শনিক জেনোফেন লিখিত ‘অ্যানাবাসিও’ সত্যিই একটি মনোমুগ্ধকর গ্রন্থ। বইটি জেনোফেনের স্মৃতিচারণমূলক একটি বই। মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের যে দু-চারজন বিখ্যাত ছাত্র ছিল, তাদের অন্যতম ছিলেন জেনোফোন ও প্লেটো। প্লেটোর ছাত্র অ্যারিস্টটল আর অ্যারিস্টটলের ছাত্র আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট; যা হোক, জেনোফোনের কথা বলছিলাম। জেনোফেন ছিলেন একাধারে লেখক, দার্শনিক, ইতিহাসবিদ ও সেনাদক্ষ। তিনি দশ-বারোটির মতো গ্রন্থের জনক ছিলেন। শুধু ‘অ্যানাবাসিও’-ই নয়, তার অন্যান্য বইও ইতিহাসে সমান গুরুত্বপূর্ণ। আগেই বলেছি, জেনোফেন একজন সেনাদক্ষ ছিলেন। গ্রিক সেনাবাহিনীর একটি অংশ ছিল, যারা টাকার বিনিময়ে অন্য দেশের হয়ে যুদ্ধ করত। জেনোফেন ছিলেন সেই সৈন্যদলের একজন জেনারেল। একবার তিনি পারস্যের সিংহাসনচ্যুত সম্রাট সাইরাস দ্য ইয়াংয়ের পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। সেই সেনাদলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জেনোফেন। সাইরাসের সৈন্যদলটি জেনোফেনের নেতৃত্বে এজিয়ান সমুদ্র অতিক্রম করে আনাতোলিয়া (তুরস্ক) হয়ে আধুনিক সময়ের ইরাক পর্যন্ত অগ্রসর হয়। যদিও জেনোফেনের বাহিনী এ যুদ্ধে জয়লাভ করে ঠিকই, কিন্তু সাইরাসের হঠাৎ মৃত্যুতে সৈন্যবাহিনীর জন্য এক অনিশ্চয়তা নেমে আসে এবং দলটি পারস্য অঞ্চলের গভীরে একা পড়ে যায়। সৈন্যদলটিকে ইরাক থেকে আর্মেনিয়া হয়ে গ্রিসে ফিরে যেতে হবে। অতিক্রম করতে হবে কৃষ্ণসাগর, থ্রেস এরপর তাদের পৌঁছাতে হবে গ্রিসে। জেনোফেন তার এ বইটি সৈন্যদলের নেতৃত্ব, যুদ্ধ এবং গুরুত্বপূর্ণভাবে সংঘবদ্ধভাবে মার্চ করে গ্রিসে ফিরে যাওয়ার সময় লিখেছিলেন। জেনোফেন এ বইটিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন শত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও কীভাবে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হয় এবং শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। উপরন্তু এ বইটিতে ছিল পারস্য অঞ্চলের একটি দুর্দান্ত মানচিত্র। ‘অ্যানাবাসিও’ নিঃসন্দেহে একটি বিনোদনমূলক এবং তথ্যপূর্ণ বই। বইটি পড়া সহজ। একজন সৈনিক এবং একজন জেনারেল উভয়ের দৃষ্টিকোণ থেকেও সে সময় সম্পর্কে অসাধারণ একটি গ্রন্থ। ইতিহাস থেকে আমরা এ-ও জানি যে, এ বইটি শুধু আলেকজান্ডারকেই অনুপ্রাণিত করেনি বরং এটি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন জুলিয়াস সিজার, নেপোলিয়ন থেকে শুরু করে ম্যাকিয়াভেলি পর্যন্ত।

আলেকজান্ডার সম্ভবত বিখ্যাত চৈনিক দার্শনিক ও সমরবিদ সান জুর লেখা ‘দ্য আর্ট অফ ওয়্যার’ বইটিও পড়েছিলেন। পৃথিবী জয় করতে গিয়ে তার রণকৌশলে সান জুর ‘দ্য আর্ট অব ওয়্যার’ বইটির প্রভাব ভীষণ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, সান জু তার লিখিত বইয়ে তিনি লিখেছেন— কোনো রাজ্য একবারে অধিকার করা সম্ভব না হলে অল্প অল্প অঞ্চল অধিকার করে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ রাজ্য জয় করে নেওয়ার দর্শন। আলেকজান্ডারও সান জুর দর্শন অনুযায়ী-সমুদ্রোপকূলের অঞ্চলগুলো দখল করে সে অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত সম্পদ দ্বারা নিজকে আরও শক্তিশালী করে তারপর দারিয়ূসের বিরুদ্ধে অভিযান করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। ফেয়েনিশিয়া, সিলিশিয়া পর্যন্ত সব ভূ-ভাগ জয় করার জন্য দ্রুত অগ্রসর হলেন। তিনি যে থিওভেক্টেসের দর্শন কতটা ভালোবাসতেন, তার নজির পাওয়া যায় একটি ঘটনায়। থিলিশিয়া জয় করার সময় তিনি কিছু সময়ের জন্য একটি স্থানে অবস্থান করছিলেন, তখন তিনি সেখানকার বাজারে প্রয়াত দার্শনিক থিওডেক্টেসের প্রতিমূর্তি দেখতে পান। অ্যারিস্টটলের কাছ থেকে এবং দর্শন অধ্যয়নের মাধ্যমে তার সম্বন্ধে তিনি বিশদ জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। এ মৃত দার্শনিকের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য তিনি তার প্রতিমূর্তি মাল্য দ্বারা ভূষিত করেন।

তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, পৃথিবীর সব জাতিকে তিনি একত্রিত করবেন। তারা পরস্পর যুদ্ধ করবে না। তারা মিলেমিশে শান্তিতে-সমৃদ্ধিতে বাস করবে। কিন্তু তিনি জানতেন, তার এ মহান স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে হলে তাকে যুদ্ধ করতে হবে। যুদ্ধ করে সব জাতিকে বশ করতে হবে। তার কথা শুনতে বাধ্য করতে হবে

মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত ও তার গুরু চাণক্যের মধ্যেও এ ধরনের একটি ঘটনা ঘটেছিল। সেই কাহিনিটি এখানে তুলে ধরার লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। চাণক্য তার শিষ্য চন্দ্রগুপ্তকে দীর্ঘকাল ধরে প্রশিক্ষিত করেছিলেন, যাতে করে মগধের রাজা নন্দকে উৎখাত করে চন্দ্রগুপ্তকে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা যায়। সেই লক্ষ্যে চাণক্য চন্দ্রগুপ্তকে দিয়ে মগধরাজ্য আক্রমণ করান; কিন্তু প্রথমবার ব্যর্থ হয়ে চন্দ্রগুপ্ত ও চাণক্য দুজনই ফেরার হন। দুজনই ছদ্মবেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। এমন সময় একদিন রাতে এক গৃহস্থের গৃহের পেছনে দুজন ক্লান্ত হয়ে অবস্থান নিয়েছেন। এমন সময় শুনতে পেলেন বাড়ির গৃহকর্ত্রী থালায় গরম গরম খিচুড়ি তুলে দিচ্ছেন ছেলেমেয়ের পাতে। হঠাৎ গৃহকর্ত্রীর এক ছেলে থালার মাঝখান থেকে খাবার তুলে মুখে তুলবেন হঠাৎ উহ্ শব্দে চিৎকার করে উঠলেন-খিচুড়ি তো আগুনের মতো গরম! খাব কীভাবে? গৃহকর্ত্রী বললেন— তুই কী চাণক্যের মতো মূর্খ হয়েছিস। থালার মাঝখান থেকে কেন খাচ্ছিস? পাশ থেকে অল্প অল্প করে মুখে তোল। চাণক্যের চোখ খুলে গেল। তিনি বুঝলেন, একবারে নন্দরাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করা যাবে না। মগধের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলো আগে জয় করতে হবে, তারপর ধীরে ধীরে অধিকার করতে হবে সম্পূর্ণ মগধ। চাণক্য বহু বিষয়ে পণ্ডিত ছিলেন। তিনি সান জুর ‘দ্য আর্ট অফ ওয়্যার’ পড়েছিলেন কিনা বলতে পারব না। তবে চাণক্য চন্দ্রগুপ্তকে আলেকজান্ডারের সৈন্যশিবিরে পাঠিয়েছিলেন যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল শিখতে। আলেকজান্ডার যখন ভারতের পাঞ্জাবে অবস্থান করেছিলেন, তখন চন্দ্রগুপ্ত বেশকিছু দিন অবস্থান করেছিলেন আলেকজান্ডারের সৈন্যবাহিনীতে। তারপর এক সময় পালিয়ে আসেন সেখান থেকে। আমার ধারণা, চন্দ্রগুপ্ত সান জুর এ যুদ্ধ কৌশল আলেকজান্ডার মুখ থেকে শুনতে থাকবেন এবং চাণক্যকে বলে থাকবেন।

কবিতা পাঠও ছিল আলেকজান্ডারের একটি প্রিয় বিষয়। অনেকের মধ্যে তার অন্যতম প্রিয় ছিল গ্রিক কবি পিন্ডার। থিবস অঞ্চল আক্রমণ করার সময় তিনি শুধু পিন্ডারের বাড়িটিকেই রেহাই দিয়েছিলেন।

একশ বছরের অধিককাল আগে কবি পিন্ডার এ বাড়িটিতে বাস করতেন। আলেকজান্ডারের কাছে এ বাড়িটি ছিল পবিত্র; যেমন তিনি পবিত্র মনে করতেন, গ্রিকদের গৌরবের যুগের জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য সাধনাকে। তিনি সংকল্প করেছিলেন, গ্রিকদের সাধনাকে জগতের দিকে পরিব্যপ্ত করবেন। সমগ্র এশিয়া এবং প্রাচ্যের দেশে দেশে গ্রিকজাতির মর্মবাণী বহন করে নিয়ে যাবেন। সেসব দেশের অধিবাসীর মধ্যে গ্রিকদের সাধনা আবার নতুন করে বাঁচবে।

তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, পৃথিবীর সব জাতিকে তিনি একত্রিত করবেন। তারা পরস্পর যুদ্ধ করবে না। তারা মিলেমিশে শান্তিতে-সমৃদ্ধিতে বাস করবে। কিন্তু তিনি জানতেন, তার এ মহান স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে হলে তাকে যুদ্ধ করতে হবে। যুদ্ধ করে সব জাতিকে বশ করতে হবে। তার কথা শুনতে বাধ্য করতে হবে।

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ডায়োজেনিসের দর্শন পড়ে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি নিজেই ডায়োজেনিস হতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্বজয়ের আগে নানা স্থান থেকে খ্যাতনামা ব্যক্তি, মন্ত্রী, দার্শনিক জাতীয় মানুষ তাকে অভিবাদন জানাতে এলেন এবং জেনারেলরূপে অধিষ্ঠিত হওয়ার জন্য আনন্দ প্রকাশ করলেন। সিনোপির দার্শনিক ডায়োজেনিস সে সময় করিন্থে বাস করতেন। আলেকজান্ডার প্রত্যাশা করেছিলেন, ডায়োজেনিস তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসবেন। কিন্তু তিনি নিরাশ হলেন, ডায়োজেনিস এলেন না। তারপর তিনি নিজেই সপরিষদ দার্শনিককে সাক্ষাৎ দিতে গেলেন। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে আলেকজান্ডার বললেন— আপনার জন্য আমি কী করতে পারি? ডায়াজেনিস উত্তরে ঈষৎ হেসে বললেন, এ মুহূর্তে আমার সামনে থেকে একটু সরে দাঁড়ান। রোদের আলোয় আমাকে একটু উষ্ণ হতে দিন। আপাতত এতটুকু করলেই আমি সন্তুষ্ট। দার্শনিক ডায়াজেনিসের কথায় আলেকজান্ডারের সঙ্গে আসা তার সঙ্গীরা খেপে গেলেন। আলেকজান্ডার তাদের থামিয়ে দিয়ে বললেন— তোমরা সবাই শান্ত হও ‘আমি যদি আলেকজান্ডার না হতাম, তবে ডায়াজেনিস হতে চাইতাম।’

আরো পড়তে পারেন

আওরঙ্গজেব ও শম্ভাজির মিথ বনাম ইতিহাস: প্রসঙ্গ ছাবা চলচ্চিত্র

বর্তমানে বিজেপির সংঘ পরিবার প্রায় তিন’শ বছর আগের ভারতের এমন এক সম্রাটের কবর মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদ থেকে সরিয়ে দেয়ার আন্দোলন করছেন- যিনি ইতিহাসে ভারতকে সর্বকালের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রের মানচিত্র ও সংহতি উপহার দিয়েছিলেন, যার আয়তন ছিল চল্লিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার- যা ছিল বর্তমান ভারতের চেয়ে আট লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বড়, তাঁর অধীকৃত রাষ্ট্রটিই ভারত এখনো তারা….

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা: বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যা জানা গিয়েছে, যা জানা সম্ভব

এক মহান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের অপরিসীম আত্মত্যাগ। নানা সূত্র থেকে আমরা শুনে এসেছি ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা। অনেকেই আবার ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমন প্রশ্ন ওঠার মূলে রয়েছে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে ৭১-পরবর্তী শাসকদের উদাসীনতা। তারা এত বছরেও শহীদের সংখ্যা….

জর্জ অরওয়েলের নৌকাডুবি

১৯৪৪ সালের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে হিটলার যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে যুদ্ধে জয় পেতে। তার মরণকামড়ের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে নানা দেশের নানা শহর ও জনপদ। জার্মান বাহিনীর ভি-ওয়ান নামক উড়ন্ত যুদ্ধজাহাজগুলো মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ করেছে লন্ডন শহরে। বিমানবাহিনীর এমন দুর্দৈব তাণ্ডবে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষজন সব আশ্রয় নিচ্ছে মাটির তলার বাঙ্কারে ও পাতাল রেলের সুড়ঙ্গে। এমনই একদিন….

error: Content is protected !!