Author Picture

আরিফা ইয়াসমিন-এর একগুচ্ছ কবিতা

আরিফা ইয়াসমিন

একটু দূরত্বে দাম্পত্য

প্রেমিকের সাথে বাড়ি হোক
শুধু একটা ফোনকলের দূরত্বে।

সমাজ স্বীকৃত প্রেমের
আহ্বানে সাড়া দিতে
মন চাইলেই যে কোন রাত
আমোদে কাটুক একসাথে
রাত ভর দামামা বাজুক
তুমুল প্রেমে, উত্তাল কামে।

স্বীকৃতির দায়ে ভারাক্রান্ত
টুয়েন্টি ফোর সেভেন
সমাজের কানে তালা পড়ুক।

ফোনকলের দূরত্বে প্রেমিকের
কোন কোনদিন আবদার
শান্তি শান্তি আলো বাতাসে
দিনের প্রথম আলো ফোটাবার।

সে মতই হোক রাত দুপুরের
দেখা সাক্ষাৎ! রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা,
বিড়ি, প্রেম যা ইচ্ছা হয় উড়াক,

স্বীকৃতির শিকলে হাসফাস
সমাজের চোখে কাটা পড়ুক।

ফোনকলের দূরত্বে
সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে
আধো আলো আঁধারে বায়না
শহর ভ্রমণ হুটখোলা রিকশায়।

কোমড়ে হাত,কাধে মাথা
কিংবা ঠোঁটে ঠোঁট যা ইচ্ছা
করে করুক যে কোন সময়।

স্বীকৃতির কলুর বলদ
সমাজের মুখে লাগাম পড়ুক।

ফোনকলের দূরত্বে
হুটহাট দুপুরের ভাত,
রাতের রুটি, সকালের নাস্তা
একসাথে যা ইচ্ছা করার
ইচ্ছেরা ইচ্ছেমতো দানা বাধুক
সমাজ যা বলে বলুক।

স্বীকৃতির বেড়িতে বাঁধা
মন কষাকষির রাত দিন মান
মুখ অদেখা-দেখির বদল
একসাথে থাকার ইচ্ছের
ফোনকলের দূরত্বে এই
প্রেম টা শুধু থাকুক।

শুধু একটা ফোনকলের দূরত্বে
সমাজ স্বীকৃত প্রেমিক প্রেমিকার
এক শহরেই স্বাস্থ্যকর দূরত্বে
হাজার ইচ্ছেরা মন-প্রাণভরে বাচুক।

 

শ্মশান হইয়া দেখ

রত্ন বোঝাই ঝিনুক হইয়া দেখলাম
মানুষ আসলে রূপ চায়।
মেলা রূপের মানুষ চায়!
তারপর রূপ হইয়া বুঝলাম
মানুষ আসলে শ্মশান চায়।

শ্মশান হইয়া বুঝলাম
হা ইশ্বর!
মানুষ তো পুইড়া পুইড়া ক্লান্ত।

মানুষ আরজন্মে পানি হইবার চায়
লুপ্তপ্রায় প্রবাল হইবার চায়, ব্যথা হইলেও
মোতি ওয়ালা ঝিনুক হইবার চায়।

তবু মানুষ পরজন্ম চায়
মানুষ আসলে
মেলা রূপের মানুষ চায়!
মানুষ আসলে পাপ
বোঝাই জাহাজ হইবার চায়।

 

ডেডবডি

একটা ডেডবডি
অসংখ্য গল্প।

মৃতকে ঘিরে আমাদের সব কৌতূহল
হাসপাতালের গেটে
পায়ের দু’পাতা বেরোনো
সাদা কাপড়ে স্ট্রেচারে
হরহামেশাই দেখি ‘লাশ’!

মৃতদেহ শব্দটা এখানে ব্যবহার করতেই পারতাম
কিন্তু তাতে কল্পনাটা ঠিক জমে না
যতটা জমে লাশে!

সিড়ি দিয়ে উঠার পরবর্তী ক্ষণিক সময়ে
হাজার প্রশ্নের বুদবুদ খেলে যায়
মগজে-
—এ লাশ ও জীবন্ত ছিল
এইতো কিছুক্ষণ আগেও!
—কেমন কেটেছে এ জীবন তার?
—কি এক অভাবনীয় পদ্ধতিতে
যাত্রা হলো একাকী গ্রহে!

—আজ মধ্যরাতে,
তার অনুপস্থিতিতে
ঠিক কতজন পাবে ভয়
—কতজনের হবে হৃদয় ভাঙা কষ্ট!
—লোক দেখানো শোক,
সেটাও ঠিক কতকজনের!

মৃত কে ঘিরে আমাদের
সমস্ত উৎকন্ঠা!

ফটাফট উত্তরে নিবিয়ে দিতে পারে
জানার আকাঙ্ক্ষা
এমন জীবিত বা পীড়িত কে নিয়ে নয়।

যা হোক, অব্যহিত সময় পরেই
মজে যাই জীবন্ত দের নিয়ে
সুস্থ, অসুস্থ, যন্ত্রণায় কাতর-
অল্প অথবা বেশি!

তাদের দেখি, কথা বলি, ধরি-ছুঁই
অহেতুক কৌতূহল ছাড়াই
প্রয়োজনীয় প্রশ্নের উত্তর ক’টা
ঝটাপট টুকে নেই কাগজে।

কোন গল্প সাজাই না
জেনে নেই না,
কেমন কাটছে জীবন তাদের!

যাত্রা হলে একাকী গ্রহে
কতজন ভুগবে অনুপস্থিতিতে
কতজনের হবে মৃত্যু সমান কষ্ট
ঠিক কতজন পাবে ভয়!

মৃতদের নিয়ে জমে উঠে গল্প,
সমস্ত জল্পনা কল্পনা!
সুস্থ অসুস্থ জীবিতদের নিয়ে নয়!

অপঘাতে কাটা পড়া পা
ব্যান্ডেজ নিয়ে কাতরানো পোড়া
কিংবা প্রসবে রক্তপাতের ঘটনায়
পেশাদারিত্বের সাথে পালন করে যাই
সমস্ত দায়িত্ব!
জীবন সম্পর্কে কৌতুহল শূন্য
নিজের চারদিকে ঘনীভূত করি
বিস্তর নিস্পৃহা!

লাশের মতো জীবিতকে নিয়ে
কল্পলোকে ঘোড় দৌড়ালে
সকল সময় কি আর চলে!

লাশ পড়ে থাকতে দেখলে রাস্তায়
ফিসফাস অসংখ্য কথা বলি আমরা
একা থাকলে রিক্সাওয়ালা
পাশের জন কিংবা সকলে মিলেও।
তাদের ও দেখেছি কথা বলতে
একনাগাড়ে।

লাশ ব্যাপারটা যতটা উৎসাহের
জীবিত ও পীড়িত ততোধিক নয়
হাসপাতালের চেয়ে চাকঘর তাই অনেক বেশি
কৌতুহল উদ্দীপক, উৎসাহের
অনেক বেশি কল্পনার।

জাগতিক কিছুতে আমাদের বড্ড অনাগ্রহ
যার মুখে ফুটে ভাঁড় ভাঁড় উত্তরের খই
যে চাইতে পারে ভালো ও মন্দ
তাতে কদাচিৎ আমাদের ঔৎসুক্য
আমাদের সকল উদ্বেগ
নিশ্চুপ কে নিয়ে তাই!

মৃত কে ঘিরে আমাদের সব কৌতুহল
সকল আগ্রহ তাকে ঘিরে
যার চাওয়ার ক্ষমতা
জাগতিক কিছুতেই আর কিছু প্রয়োজন নাই!

আমরা মানুষ মূলত দুর্বল
কিছু দেয়ার ক্ষমতা আমাদের নেই
জীবিতের চেয়ে মৃত চিরকাল তাই
থেকে যায় আগ্রহের কেন্দ্রেই।

আমরা মানুষ মূলত কৌতূহলী
চেনা জীবনের চেয়ে অচেনা মৃত্যু
খুব সহজেই টেনে নেয় কল্প জগতে,
উৎসুক ভাবের উদয় ঘটায় চিত্তে!

তাই লাশ এবং মর্গ নিয়ে
আমাদের যত উৎসাহ!
কত সহজে এসব নিয়ে গল্প সাজাই
যেতে যেতে অবলীলায়
ভেবে নিতে পারি,
কেমন কাটবে অনুপস্থিতি
কেমন কেটেছে জীবন তার!

হাসপাতাল, রোগ ও রোগী
বরাবর আমাদের আগ্রহের বাহিরেই।
জানা জগজ্জীবনে জানবার
আরও যা যা আছে তা চাপুক
সে বিষয়ের কর্মবিদের ঘাড়ে!

সাধারণ মানুষের বানানোর মতো
লাস ও চাকঘরের মতো কল্পলোকের
নির্ভেজাল গল্পের প্লট হলেই চলে!

মৃতদেহ কিংবা মর্গ
শব্দ দুটো এখানে ব্যবহার করতেই পারতাম
তাতে কল্পনা টা ঠিক অতোটা কি আর জমে!
যতটা জমে লাসে!লাসকাটা চাকঘরে!

 

ভাগ্যঃ চৌকস খেলোয়াড়

ইচ্ছা করে সাবলীলতায় হেটে
গভীরতার পুস্কুনিতে ডুবসাতার দিয়ে
মরলে মরি
বাচলে দারুণ এক কবিতা হই।

পিছন তাকিয়ে যা দেখি-
লাগামের ক্রাউন পিস মুকুট বলে
মাথায় পরিয়ে প্রধানফটকে
আমি এক তৈরি ঘোড়া।

পিঠে খেয়ালি রাজা।
আমি ঘোড়া
ভাগ্য তুমি চৌকস ঘোড়সওয়ার!

 

ফসিল সময়ে

একটা সময়ের পর
পুরতনে আর না যাওয়াই ভালো।

সময় কতো পেরিয়ে গেছে না!
বদলে গিয়েছি তো আমরাও!

এ যুগের মানুষের মন
উপরে যতটা পরিপাটি
ভেতর ততোধিক অগোছালো!

পুরতন জায়গা পুরতন সম্পর্ক
অথবা পুরতনের স্মৃতি
কোনটাতেই আর না ফেরাই ভালো!

অতীত পেরিয়ে আসা এই আমি,
একত্রে এক যুগ পেরিয়ে আসা
এই আমাদের উপর
পুরতন জায়গা, বাসা বাড়ি,
পুরতন মানুষের মায়া, ভালোবাসা
নেহাৎ একত্রে কাটানো সময় গুলোর
দাবী নিয়ে কিছু পেতে চাইলেও
তাতেও হয়তো হতে হবে-
আঘাতে শুধু ক্ষতবিক্ষত!

জীবনের বিস্তারিত না হোক
নিতান্ত সরল দু’একটা প্রশ্ন
উত্তরে শব্দ হলে তো হলোই
নয়তো নিঃশব্দে পরস্পর জর্জরিত!

ভেঙ্গে যাওয়া বাসা বাড়ি
মরে যাওয়া আত্মীয়
সেসব তো গেছেই
সাথে বেঁচে থাকা মানুষেরাও
ইট পাথরের ছোট বড়
বাসা বাড়িতে জীবন্মৃত!

একটা সময়ের পর যাওয়া গেলেও
পুরতনে আর না যাওয়াই ভালো।

সময় কতো পেরিয়ে গেছে না!
সে যুগ আর এ যুগ!
তফাৎ আছে বড়ই!
যুগ বদলের কালে দূরে থাকা
আমাদের মন ও বদলে গেছে কত!

এ যুগের মানুষের মন
উপর থেকে যতই পরিপাটি
আসলে ভেতরে ঠুনকো,
বড্ড এলোমেলো।

ছোট থেকেও ছোট্ট কিছুতে
সহসাই হয়, সহজেই করে
পরস্পরে ক্ষত বিক্ষত!

তাই একটা সময়ের পর
পুরতন শুধু স্মৃতি।
পুরতনে আর না ফেরাই ভালো।
খুব কসরতে বদলে যাওয়া
খানিকটা আদিম খানিকটা অন্তিম
আমরা এখন শুধুই কালের জীবাশ্ম

আরো পড়তে পারেন

বেওয়ারিশ প্রেমের কবিতা

১. জীবনকে বিজ্ঞাপনের মতো সেঁটে দিয়ে দেখেছি, আমাকে গ্রহণ করেনা কেউ। আমাকে ভালোবাসে না ঘুমগন্ধওয়ালা সকাল— আমাকে ভালোবাসে না বাজারের জনবহুল রোদ, আমাকে ভালোবাসে না কেউ, ভিক্ষুক, শ্রমিক, চাষী আমাকে ভালোবাসে না, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে ভালোবাসে না, শোষক কিংবা শোষিত, শাসক ও প্রজা কেউই ভালোবাসে না, আমাকে ভালোবাসে না তরুণ-তরুণী-বৃদ্ধ বা যুবা, পার্থিব কোনো….

আজাদুর রহমান-এর একগুচ্ছ কবিতা

সহজাত মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে যে কোন দিন যে কোন সন্ধ্যায় তুমি কল্পনাও করতে পারবে না এমন ঘোরতর বর্ষার দূপুরে মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে। পথের পাশে ওত পেতে থাকা শিকারির মত সন্তর্পনে উঠে আসা মানুষ পায়ে পা ঘষে তোমাকে অবহেলা করবে। কোথাও না কোথাও কোন এক বয়সে কোনও না কোনও ভাবে মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে।….

হোসনে আরা শাপলা’র একগুচ্ছ কবিতা

আলতু ব্যথা কোন এক শুভ্র সময় আমাদেরও ছিল পাশাপাশি-মুখোমুখি বসে থাকা শুধু হিসেব-নিকেশ, দাবি-দাওয়া, চাওয়া-পাওয়া এসবের বালাই ছিলো না কোন শুধু কানায় কানায় পূর্ণ ছিলো ভালোবাসা। চোখের তারায় ডুবে গিয়ে অন্বেষণ শুধু শত জনমের সুখ। ওইসব স্বপ্নমাখা দিন কোন দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল কোথায় তারই জন্য মনের মধ্যে কেমন আলতু ব্যথা।   তৃপ্তি ভরসার হাত….

error: Content is protected !!