Author Picture

আমাদের সমুদ্র-সাময়িকী

ময়ুখ চৌধুরী

ঠিক সাড়ে দশটায়
পতেঙ্গার উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম আমরা।
আমরা, মানে চিরকালের মতো ধূসর একজন তুমি
যে কিনা অ্যাকুরিয়ামের সংসার ভেঙে বেরিয়ে আসতে চেয়েছ;
আর একজন আমি- ছন্নছাড়া ফড়িঙের ডানা।
কথা ছিল আমাদের যৌথ সম্পাদনায়
প্রকাশ পাবে সমুদ্র-সাময়িকী, যার প্রতিটি পৃষ্ঠায়
জলের অক্ষর এসে ছুঁয়ে দেবে নুড়ি ও পাথর।

অন্যদিকে, সাড়ে দশটার মানে
একটা কাঁটা ঠিক তোমার মতো দশ আর এগারোর মাঝখানে,
আর আমি ঝুলে থাকবো সান্ধ্য সংখ্যা ছয়-এর ওপর।
দুটো কাঁটা মিলে সেদিন একটা ফুল ফুটিয়েছিল,
আমরা ফুলটার কোনো নাম দিতে পারিনি।

সামাজিক বিধিনিষেধের মতো অনেক সিগন্যাল উজিয়ে
কর্ণফুলীর হাত ধরে মোহনা পর্যন্ত উপনীত হয়েছিলাম।
সেই মোহনার পরিচয়টুকু আমরা নিতে পারিনি।
পাথরের তলা থেকে উঁকি দেওয়া সবুজ ঘাসের উদগ্রীবতা
আমরা বুঝে উঠতে পারিনি।
সংসারী শহর ফেলে, পিচঢালা অজগর পেরিয়ে
শালবীথির ছায়া, তারপর বাবলার স্রোত।
কঠিন শাসন ভেদ করে বৃক্ষের সবুজ আকুলতা
সামিয়ানার মতো নেমে আসা আকাশকে জড়িয়ে ধরেছিল।
হয়তো বা আমাদের বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিল
জিরাফের গ্রীবার মতো অসঙ্গত একটি বাসনা।
-সেই ইচ্ছেটার কোনো উচ্চারণ ছিল না।
একটার পর একটা ঢেউ প্রেরণার মতো ছুটে আসছিল
আমাদের দিকে।
এই সব পাঠ নিয়েও আমরা
পাশাপাশি বসেছিলাম, কাছাকাছি হতে পারিনি।
আদিম মানুষের মতো চকমকি পাথর ঠুকে
বের করতে পারিনি আগুন।

মাথার ওপরে সূর্য
চাঁদের চেয়েও নরম আলো দিচ্ছিল সেদিন। আর
পাথরগুলো ছিল ঘাসের চেয়েও কোমল আর মসৃণ।
আমি ক্রমশ
তোলপাড় সমুদ্রের প্রতি অমনোযোগী, দেখছিলাম
তোমাকে।
গর্তের ভিতরে ঢুকে পড়া একটা লালকাঁকড়া বলে গেল-
প্রতিটি মানুষই ভিতরে ভিতরে কবিতা, বাইরে প্রবন্ধ।

আমি সমুদ্রের ওপর অভিমান করে আকাশকে খুঁজছিলাম।
খুঁজতে খুঁজতে পেলাম তোমার পায়ের কাছে,
ঝুঁকে পড়া।

তখন তুমি
সমুদ্রের মতো নীল, অথচ স্তব্ধ;
আকাশের মতো নির্জন, অথচ মেঘের সংস্কৃতিতে শোভিত;
ফেলে আসা পাহাড়ের মতো স্থির, অথচ অগ্নিগর্ভ;
নদীর মতো তরঙ্গপ্রবণ, অথচ শানবাঁধানো;
অরণ্যের মতো ছায়াবতী, অথচ কম্পমান।

এরপরও তুমি
কাচের মতো মসৃণ, অথচ কঠিন;
ধ্রুবতারার মতো স্পষ্ট, অথচ অনেক দূর।

তুমি এসবের কিছুই বোঝনি। টের পাওনি-
নীল তরঙ্গের নিচে জলকন্যারা
তোমাকে সমুদ্রের রানী বলে ভুল করছিল;
ঢেউয়ের মাথায় করে নিজেদের শাদা মুকুটগুলি তারা
তোমার পায়ের কাছে জমা দিচ্ছিল।
পরিযায়ী পাখিবৃন্দ
ঠোঁটে করে নিয়ে এলো শুভেচ্ছার তৃণ
ডানায় করে নিয়ে এলো অন্য এক আকাশ।

যে রকম
শূন্যতার ভিতরে মেঘ
মেঘের ভিতর জলের প্রতিশ্র“তি
জলের ভিতর সমুজ সম্ভাবনা
সে-রকম
স্থরিবতার ভিতরে ছিল স্বপ্নের বাড়িঘর
আর শিশুর রঙিন খেলনা।

কিন্তু, এসকল তাৎপর্য প্রচলিত কোনো অভিধানে ছিল না,
কোনো নীলকণ্ঠ যুবক পন্ডিতও রচনা করে যাননি মায়াবী ব্যাকরণ।
এর ফলে
তোমার নির্লিপ্ত সৌন্দর্যে আহত হয়ে ফিরে যাচ্ছিল জলের নিবেদন,
ভেঙে যাচ্ছিল বাতাসের ডানা।

এই সব তুমি জানতে না। তুমি চেয়েছিলে
জলপরীদের হাত ধরে
ক্রমশ গভীরতর দেশ, লতাগুল্মের বার্জিন বিস্ময়।
কিন্তু আকাক্সক্ষার অনুকূলে উপযুক্ত উদ্যোগ ছিল না,
ছিল উৎকণ্ঠা;
ছিল দ্বিধান্বিত দিনরাত্রি, কালোশাদা রশিবাঁধা জেব্রার প্রচ্ছদ
আর, তোমার দু’টুকরো ভিতর বাহির।
সংসারের অ্যাকুরিয়ামে নন্দিত মৎস্যরানী তুমি।
লবণাক্ত দুঃখ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার গাঢ়তর কষ্ট-
বিছানায় এপাশ ওপাশ।
চোখের এক একটি পলকে ঝুলে আছে
অনিদ্র রাতের বেলকনি।

সিঁড়ি মানে শুধু উত্থান নয়
একই সঙ্গে নেমে আসা দোআঁশ মাটির কাছাকাছি।
এই প্রবণতা সত্ত্বেও
তোমার সিঁড়ি জাপানি গোলাপের ষড়যন্ত্রে আচ্ছন্ন;
সমুদ্রের চক্ষুহীন অন্ধ ভালোবাসা ঐ পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে না।
রাত্রিমাখা পান্ডুলিপি থেকে নিজেকে ফিরিয়ে আনলাম
পাটের আঁশের মতো উজ্জ্বল পারিপার্শ্বিকে।

কিন্তু, পাথর আর জলের সংঘাতে যে অর্থ ছিটকে পড়ে
সেভাবে নয়,
হাওয়ার সংস্পর্শে পাতার শিহরণে যে ব্যঞ্জনা
সেভাবে নয়।
আমরা কথা বলে যাচ্ছিলাম
আরেকটি কথার পাশ ঘেঁষে-
নদীর তীর ধরে হেঁটে যাওয়া লাঠির মত সতর্ক, সরল।
অতএব, পাখিদের ওড়াউড়িকে মনে হচ্ছিল ছেঁড়া পলিথিন।

মাঠের ওপারে কিছু শ্রমশীল সরল মানুষ
আমাদের দু’জনকে দেখে যা যা ভাবছিল
সেটা আমাদের বুকে মেঘলা কষ্টের মতো জমাট বেঁধেছে,
তা থেকে আদৌ বৃষ্টি নামবে কি না
জানি না।

আমাদের সঙ্গে কিছু খাবার দাবার ছিল,
হৃৎপিন্ডের মধ্যে কষ্ট করে লুকিয়ে রাখা
কঠিন সত্যের মতো স্যান্ডউইচ;
কয়েক পিস কেক
তার নম্রতাকে ফালাফালা করা রুপালি ছুরিটা তখন শহরের টেবিলে।
এছাড়া
ফ্লাস্কের কুয়োর মধ্যে ছিল উষ্ণ অথচ স্তব্ধ কফি
সেদিনকার প্রত্যেকটি উপকরণই কথা বলছিল রূপকের ভাষায়
আর, আমরা শুনে যাচ্ছিলাম কিংবদন্তির সাপের মতন।
কথা আরও অনেকে বলছিল-
ঠোঁট ফাঁক রেখে মরে যাওয়া ঝিনুক থেকে আরম্ভ করে
ফড়িঙের উড়ন্ত সঙ্গম পর্যন্ত অনেকেই
আমাদের পর্যবেক্ষণশক্তির অহংকারকে পরীক্ষা করে নিচ্ছিল।
ব্যাপারটা না বোঝার ভান করে আমরা নিরাপদ ছিলাম।
তারপরও আমি
দুষ্পাঠ্য পান্ডুলিপির মতো তোমার পাঠ গ্রহণ করছিলাম।

অসংখ্য নক্ষত্রের নিচে মরুভূমির অন্ধকার তোমার চোখে,
ঠোঁটের চকিত কম্পন থেকে সামান্য দূরে তৃষ্ণার্ত বালিয়াড়ি,
আনত গ্রীবায় নেকলেস হবার জন্য
তিনশ’ তেত্রিশটি নদী ছুটে এসেছে এই বঙ্গোপসাগরে,
বরফদ্বীপের মতো উপচে ওঠা বুকের চরায়
মেরুন রঙের তিল,
অপ্রকাশ্য যন্ত্রণার অভ্যুত্থান শেষে
লাবণ্যের একটি মাত্র ঢেউ,
তারপর এক ক্যারেট অন্ধকার নাভি,
তারপর কিছুই জানি না-
হয়তো বা জেগে থাকা নিঃসঙ্গ রাতের বেলকনি।

অথচ, আমিও ঠিক বোঝাতে পারিনি
শালবীথির শাখায় কেন এতো আকুলতা ছড়িয়ে পড়েছে
পবিত্র অজ্ঞতায় কেন এতো বেশি কুয়াশা
কেন পাথরের ভবিষ্যৎ এতো অন্ধ।

এইভাবে
অপমানিত সমুদ্রকে পেছনে ফেলে
আমরা জেব্রা-ক্রসিঙের সন্ধানে উঠে দাঁড়ালাম।
আমরা দু’জন আলাদা-আলাদাভাবে আবার আসবো,
ক্ষমা চেয়ে নেবো,
অন্ধ আবেগে ছুটে আসা প্রতিটি ঢেউয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবো।

আরো পড়তে পারেন

বেওয়ারিশ প্রেমের কবিতা

১. জীবনকে বিজ্ঞাপনের মতো সেঁটে দিয়ে দেখেছি, আমাকে গ্রহণ করেনা কেউ। আমাকে ভালোবাসে না ঘুমগন্ধওয়ালা সকাল— আমাকে ভালোবাসে না বাজারের জনবহুল রোদ, আমাকে ভালোবাসে না কেউ, ভিক্ষুক, শ্রমিক, চাষী আমাকে ভালোবাসে না, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে ভালোবাসে না, শোষক কিংবা শোষিত, শাসক ও প্রজা কেউই ভালোবাসে না, আমাকে ভালোবাসে না তরুণ-তরুণী-বৃদ্ধ বা যুবা, পার্থিব কোনো….

আজাদুর রহমান-এর একগুচ্ছ কবিতা

সহজাত মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে যে কোন দিন যে কোন সন্ধ্যায় তুমি কল্পনাও করতে পারবে না এমন ঘোরতর বর্ষার দূপুরে মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে। পথের পাশে ওত পেতে থাকা শিকারির মত সন্তর্পনে উঠে আসা মানুষ পায়ে পা ঘষে তোমাকে অবহেলা করবে। কোথাও না কোথাও কোন এক বয়সে কোনও না কোনও ভাবে মানুষ তোমাকে অবহেলা করবে।….

হোসনে আরা শাপলা’র একগুচ্ছ কবিতা

আলতু ব্যথা কোন এক শুভ্র সময় আমাদেরও ছিল পাশাপাশি-মুখোমুখি বসে থাকা শুধু হিসেব-নিকেশ, দাবি-দাওয়া, চাওয়া-পাওয়া এসবের বালাই ছিলো না কোন শুধু কানায় কানায় পূর্ণ ছিলো ভালোবাসা। চোখের তারায় ডুবে গিয়ে অন্বেষণ শুধু শত জনমের সুখ। ওইসব স্বপ্নমাখা দিন কোন দরজা দিয়ে পালিয়ে গেল কোথায় তারই জন্য মনের মধ্যে কেমন আলতু ব্যথা।   তৃপ্তি ভরসার হাত….

error: Content is protected !!