Author Picture

আবুবকর সিদ্দিক: দ্যুতিময় কবির প্রয়াণ

হাসনাত আসিফ কুশল

দ্যুতিময়, জ্যোতির্ময়, ভাস্বর। আছেন প্রেমে, আছেন দ্রোহে। যার চয়িত শব্দগুচ্ছ অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলনকারীদের। সেই কবি, কবি আবুবকর সিদ্দিক।

বার্ধক্যজনিত রোগে বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) ভোর পৌনে ছয়টার দিকে খুলনা নগরীর ৫ নম্বর মুন্সিপাড়ায় ছোট বোনের বাসায় প্রয়াত হন কবি আবুবকর সিদ্দিক।

আবুবকর সিদ্দিকের জন্ম ১৯৩৪ সালে ১৯ আগস্ট, বাগেরহাটের গোটাপাড়া গ্রামে মাতুলালয়ে। একই জেলার বৈটপুর গ্রামে তার পৈতৃক নিবাস। বাবা মতিয়র রহমান পাটোয়ারী ছিলেন একজন সরকারি চাকরিজীবী। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে ১৯৩৫ সাল থেকে হুগলি শহর ও ১৯৪৩ সাল থেকে বর্ধমানে বসবাস করেন এই কবি।

শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন কবি আবুবকর সিদ্দিক। বাগেরহাট মাধ্যমিক সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৫২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৫৪ সালে বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট ও একই কলেজ থেকে ১৯৫৬ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বাংলা বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৮ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।

পেশাগত জীবনে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। চাখার ফজলুল হক কলেজ, দৌলতপুর বিএল কলেজ, কুষ্টিয়া কলেজ, বাগেরহাট পিসি কলেজ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন তিনি।

১৯৯৪ সালের ৭ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে কুইন্স ইউনিভার্সিটি ও ঢাকার নটর ডেম কলেজে অধ্যাপনা করেন।

সাহিত্যপ্রিয় আবুবকর সিদ্দিক ছেলেবেলা থেকেই সাহিত্যপ্রীতি ও পড়াশুনার প্রতি তার ঝোঁক ছিল। ১৯৪৬ সালে পঞ্চম শ্রেণিতেই তার প্রথম কবিতা আবদুস সাত্তার সম্পাদিত ‌‘বর্ধমানের কথা’ পত্রিকায় ছাপা হয়।

কবি আবুবকর সিদ্দিকের সাহিত্যমানস

সাহিত্যের একাধিক শাখায় ব্চিরণ হলেও কবিতায় তাকে স্বচ্ছন্দ দেখা গেছে। তার অজস্র কবিতা বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি করেছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মননশীল কবি আবুবকর সিদ্দিকের কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১৮। এর মধ্যে প্রণিধানযোগ্য হলো— ধবল দুধের স্বরগ্রাম’ (১৯৬৯), ‘বিনিদ্র কালের ভেলা’ (১৯৭৬), ‘হে লোকসভ্যতা’ (১৯৮৪), ‘মানুষ তোমার বিক্ষত দিন’ (১৯৮৬)। ছড়াগ্রন্থ- ‘হট্টমালা’ (২০০১)।

‘জলরাক্ষস’ (১৯৮৫), ‘খরাদাহ’, ‘একাত্তরের হৃদয়ভস্ম’, ‘বারুদপোড়া প্রহর’সহ (১৯৯৬) ১০টি গল্পগ্রন্থ লিখেছেন।

কাব্য ও প্রবন্ধ— দুইয়েই ঋদ্ধ আবুবকর সিদ্দিক। তার চয়িত শব্দমালায় এখনও বাঙালি সাহিত্যসচেতন তরুণসমাজকে আলোড়িত করে তোলে। কবির প্রয়াণ হয়েছে সত্য, কিন্তু তিনি তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকরা তাকে স্মরণ করতে থাকবেন আজন্ম

তার বেশির ভাগ কবিতায় স্বদেশপ্রেমের শিল্পীত চেতনা প্রতিভাত হয়েছে। পরিশীলিত ও স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত চেতনার এই কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ধবল দুধের স্বরগ্রাম’ প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। আপাতদৃষ্টিতে ‘ধবল দুধ’ বিশেষণের অতিশায়ন মনে হলেও তিনি দুধকে আরও ধবল করেছেন। অর্থাৎ মাতৃভূমির প্রতি গভীর অনুরাগ ও ভালোবাসার নিদর্শন রেখেছেন। যা কবির ভাষায় ‘শুদ্ধতার প্রতীক’ হিসেবে ঋদ্ধ।

দেশ ও গণমানুষের চেতনার মূলকল্প ‘বিনিদ্র কালের ভেলা’ কাব্যগ্রন্থটিতে স্বদেশকে ভালোবাসার মন্ত্র উদ্ভাসিত হয়েছে।

জীবনবোধ ও শৈল্পিক প্রতিবাদ

কবিতাকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে থাকতে চেয়েছেন কবি আবুবকর সিদ্দিক। তার কবিতায় যেমন প্রেম ও প্রকৃতির সারাৎসার উঠে এসেছে, তেমনই বিপ্লব, সংগ্রাম, আন্দোলনের ইতিকথাও তার কবিতায় মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।

স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কবি আবুবকর সিদ্দিকের কবিতার বৈশিষ্ট্য সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। তার প্রকাশিত উপন্যাস চারটি: দক্ষিণবঙ্গের জনজীবন নিয়ে রচিত ‘জলরাক্ষস’ (প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৫, দ্বিতীয় প্রকাশ: ২০০১), উত্তরবঙ্গের খরাপীড়নের ভয়াবহ শিল্পনির্মাণ ‘খরাদাহ’ (প্রথম প্রকাশ: ১৯৮৭, দ্বিতীয় প্রকাশ: ২০০০), স্বৈরাচারবিরোধী গণআন্দোলনের পটভূমিতে রচিত ‘বারুদপোড়া প্রহর’ (১৯৯৬) এবং ‘৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধের আলেখ্য ‘একাত্তরের হৃদয়ভস্ম’ (১৯৯৭)।

দেশের খরাপ্রবণ উত্তরাঞ্চলের নিসর্গপট ও মঙ্গাপীড়িত গণজীবনভিত্তিক ‘খরাদাহ’ উপন্যাসের পাঠপ্রতিক্রিয়ায় আবুবকর সিদ্দিককে ভারতীয় কবি সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘একজন লেখক সোনার দোয়াত-কলম কামনা করে। আমি কামনা করবো আপনার লোহার দোয়াত-কলম হোক।’ উপন্যাসটি পড়ে সমরেশ বসু বরেন্দ্র অঞ্চল নিজ চোখে দেখার বাসনা করেছিলেন (কালি ও কলম)।

‘জলরাক্ষস’ ও ‘খরাদাহ’ উপন্যাস বিষয়ভাবনার গুরুত্ব ও স্বাতন্ত্র্যবোধই শুধু নয়, আয়রনি ও স্যাটায়ারেও প্রাণবন্ততা পেয়েছে। ‘বারুদপোড়া প্রহর’ উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে ‘৯০’র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের রাজনৈতিক দৃশ্যপট। এখানে তিনি স্বৈরাচার এরশাদের শাসনামলকে ‘এ গলিত-উত্তেজিত প্রহর’— উপমায় চয়ন করেছেন।

আবুবকর সিদ্দিকের ভাষ্য

মৌলিক সাহিত্যের পাশাপাশি কবি আবুবকর সিদ্দিক গবেষণাধর্মী ও মননশীল প্রবন্ধ রচনায় অনন্য ছিলেন। তার প্রবন্ধে স্বাধীনতাকামী মানস এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ, সংগ্রামের দিক প্রতিফলিত হয়েছে। তার প্রকাশিত প্রবন্ধগ্রন্থ: ‘কালের কলস্বর’ (২০০১) ও ‘সাহিত্যের সংগপ্রসংগ’ (২০০১)। জীবনীগ্রন্থ ‘রমেশচন্দ্র সেন’ (১৯৯২)। স্মৃতিকথা: ‘সাতদিনের সুলতান’ (২০০২), ‘প্রীতিময় স্মৃতিময়’ (২০১০) ও ‘স্মরণের মুখশ্রী’ (২০১১)।

কাব্য ও প্রবন্ধ— দুইয়েই ঋদ্ধ আবুবকর সিদ্দিক। তার চয়িত শব্দমালায় এখনও বাঙালি সাহিত্যসচেতন তরুণসমাজকে আলোড়িত করে তোলে। কবির প্রয়াণ হয়েছে সত্য, কিন্তু তিনি তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। বাংলা ভাষাভাষী পাঠকরা তাকে স্মরণ করতে থাকবেন আজন্ম।

আরো পড়তে পারেন

আওরঙ্গজেব ও শম্ভাজির মিথ বনাম ইতিহাস: প্রসঙ্গ ছাবা চলচ্চিত্র

বর্তমানে বিজেপির সংঘ পরিবার প্রায় তিন’শ বছর আগের ভারতের এমন এক সম্রাটের কবর মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদ থেকে সরিয়ে দেয়ার আন্দোলন করছেন- যিনি ইতিহাসে ভারতকে সর্বকালের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রের মানচিত্র ও সংহতি উপহার দিয়েছিলেন, যার আয়তন ছিল চল্লিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার- যা ছিল বর্তমান ভারতের চেয়ে আট লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বড়, তাঁর অধীকৃত রাষ্ট্রটিই ভারত এখনো তারা….

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা: বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যা জানা গিয়েছে, যা জানা সম্ভব

এক মহান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের অপরিসীম আত্মত্যাগ। নানা সূত্র থেকে আমরা শুনে এসেছি ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা। অনেকেই আবার ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমন প্রশ্ন ওঠার মূলে রয়েছে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে ৭১-পরবর্তী শাসকদের উদাসীনতা। তারা এত বছরেও শহীদের সংখ্যা….

প্রতিটি শূন্যতা যেন নতুন শোকের জন্ম দেয়

শূন্যতার আকাশে স্মৃতির মেঘ জমে। জীবন সরে সরে আসে মৃত্যুর দিকে। ফুরিয়ে আসা সময়ের দাপট এড়াতে পারে না কেউ। একজীবনে বহু জীবনাবসানের দেখা পাওয়া যায়, হয়তো দুর্ভাগ্যক্রমেই। ব্যক্তির মৃত্যুর পরিসমাপ্তি একবারই হয়, তবে সেই ব্যক্তি যদি বহুপ্রাণের সাথে জুড়ে থাকেন, তাঁর অনুপস্থিতি বারংবার অনুভূত হয়। প্রতিটি শূন্যতা যেন এক নতুন শোকের জন্ম দেয়। ২০২৪ সালে….

error: Content is protected !!