Author Picture

আজও শরণার্থী ‘আফগান গার্ল’

সুদীপ্ত সালাম

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের আলোকচিত্রী স্টিভ ম্যাককারি ১৯৮৪ সনে পাকিস্তানের পেশোয়ারের কাছাকাছি এক শরণার্থী শিবির থেকে কিশোরী শরবত গুলার ছবি তোলেন। পরের বছর ছবিটি ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ হওয়ার পরপরই আলোচনার শীর্ষে উঠে আসে এই কিশোরী। আর ছবিটি ওয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত পোরট্রেটগুলোর একটি।

গুলার পাথরের মতো চোখ দুটি ছিল বিস্ময়কর। সবুজ চোখে একই সঙ্গে ভয় ও রহস্য খেলা করে। তখন শরবত গুলার বয়স ছিল ১২ বছর। সে তখন আফগানিস্তানের একটি উদ্বাস্তু শিবিরে পড়তো। ছবিটি প্রকাশের পর থেকেই সে বিশ্ববাসীর আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে। তার নাম হয়ে যায় ‘আফগান গার্ল’। তখন অবশ্য তার অন্য পরিচয় কারো জানা ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই গণমাধ্যমগুলো মেয়েটির সন্ধানে উঠে-পড়ে লাগে। শেষে ১৯৯২ সালে মেয়েটির পরিচয় জানা যায়।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের প্রচ্ছদে শরবত গুলা

২০০২ সালে স্টিভ ম্যাককারি আবার খুঁজে পান তাকে। সেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে একই বছরের এপ্রিল সংখ্যায় প্রচ্ছদ-কাহিনী করে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক। ম্যাককারি বলেছিলেন, শরবতের চোখের দৃষ্টি তখনো ছিল সেই আগের মতোই তীক্ষ্ণ। ম্যাককারির ছবির কারণে শরবত গুলাকে ‘আফগান যুদ্ধের মোনালিসা’ও বলা হয়।

তবে এতো পরিচিতি, এতো খ্যাতির পরও গুলার জীবনে খুব একটা শান্তি আসেনি। তার বিশ্বখ্যাত পোরট্রেটটি ম্যাককারি যেদিন তুলেছিলেন সেদিনও তিনি শরণার্থী ছিলেন, প্রায় ৪০ বছর পরও তিনি শরণার্থী। এখনো তাকে আশ্রয়ের জন্য এক দেশ থেকে আরেক দেশে ছুটে বেড়াতে হয়। ২০১৬ সনে শরবত গুলাকে পাকিস্তানের পেশোয়ার থেকে গ্রেপ্তার করে দেশটির কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা (এফআইএ)। তার বিরুদ্ধে জাল পাকিস্তানি পরিচয়পত্র রাখার অভিযোগ আনা হয়। পরে গুলা পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে ফিরে যান আফগানিস্তানে। এক ছেলে এবং তিন মেয়েকে নিয়ে তিনি আফগানিস্তানের কাবুলে বসবাস শুরু করেন। তবে তিনি চাইছিলেন একটি স্বাভাবিক-সুন্দর জীবন। যে জীবনের আশায় তিনি পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। সেখানে আশ্রয়ের বদলে বঞ্চনার শিকার হতে হয় তাকে। পরে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের ভুল বুঝতে পেরে শরবত গুলাকে পাকিস্তানে থেকে যেতে বলে। কিন্তু গুলা রাজি হননি। কারণ হিসেবে তিনি বিবিসিকে জানিয়েছিলেন, পাকিস্তান তাকে ৩৫ বছর থাকতে দিলো, কিন্তু দিন শেষে অপমান করায় তিনি কষ্ট পেয়েছেন। যদিও গুলার স্বামী ও বড় মেয়ের কবর পেশওয়ারে।

২০১৬ সনে শরবত গুলা

গুলার পাকিস্তানে গ্রেফতার হওয়ার খবর পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন আলোকচিত্রী ম্যাককারি। তিনি ইনস্টাগ্রামে লিখেছিলেন, ‘শরবত এবং তাঁর পরিবারকে আইনি ও আর্থিক সযোগিতা দিতে যা কিছু করা প্রয়োজন, তার সবকিছুই করতে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’

যাহোক, আফগানিস্তানেও বেশি দিন টিকতে পারলেন না গুলা। ২০২১ সনের আগস্টে তালেবানেরা ক্ষমতা দখল করলো। ওই বছরই ইতালিতে পাড়ি জমান তিনি। ইতালির প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এক বিবৃতিতে জানায়, তালেবানের পুনরুত্থানের পর গুলা আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে ইতালি সরকারের সাহায্য চেয়েছিলেন, ইতালি সে আবেদনে সাড়া দিয়েছে। দেশটিতে নতুন করে জীবন গড়তে গুলার পরিবারকে ইতালীয় সরকার সাহায্য করবে বলেও বিবৃতিতে জানানো হয়।

আলোকচিত্রী স্টিভ ম্যাককারি

জলবায়ু পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক সংকটের কারণে সারা বিশ্বে শরণার্থীর সংখ্যা হুহু করে বাড়ছে। ইন্টারনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার (আইডিএমসি) ও নরওয়েজিয়ান রিফিউজি সেন্টারের (এনআরসি) এক যৌথ প্রতিবেদন বলছে, বিশ্বে ২০২১ সনে নিজ দেশের ভেতর নতুন বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৮০ লাখ। সব দেশের জন্যই শরণার্থী একটি প্রধান সমস্যা। আর এজন্যই এখনো প্রাসঙ্গিক ‘আফগান গার্ল’ ছবিটি। এটি শরণার্থী-সংকটের মূর্ত প্রতীক।

আরো পড়তে পারেন

আওরঙ্গজেব ও শম্ভাজির মিথ বনাম ইতিহাস: প্রসঙ্গ ছাবা চলচ্চিত্র

বর্তমানে বিজেপির সংঘ পরিবার প্রায় তিন’শ বছর আগের ভারতের এমন এক সম্রাটের কবর মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদ থেকে সরিয়ে দেয়ার আন্দোলন করছেন- যিনি ইতিহাসে ভারতকে সর্বকালের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রের মানচিত্র ও সংহতি উপহার দিয়েছিলেন, যার আয়তন ছিল চল্লিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার- যা ছিল বর্তমান ভারতের চেয়ে আট লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বড়, তাঁর অধীকৃত রাষ্ট্রটিই ভারত এখনো তারা….

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা: বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যা জানা গিয়েছে, যা জানা সম্ভব

এক মহান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের অপরিসীম আত্মত্যাগ। নানা সূত্র থেকে আমরা শুনে এসেছি ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা। অনেকেই আবার ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমন প্রশ্ন ওঠার মূলে রয়েছে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে ৭১-পরবর্তী শাসকদের উদাসীনতা। তারা এত বছরেও শহীদের সংখ্যা….

জর্জ অরওয়েলের নৌকাডুবি

১৯৪৪ সালের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ মুহূর্তে হিটলার যেন মরিয়া হয়ে উঠেছে যুদ্ধে জয় পেতে। তার মরণকামড়ের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে নানা দেশের নানা শহর ও জনপদ। জার্মান বাহিনীর ভি-ওয়ান নামক উড়ন্ত যুদ্ধজাহাজগুলো মুহুর্মুহু বোমাবর্ষণ করেছে লন্ডন শহরে। বিমানবাহিনীর এমন দুর্দৈব তাণ্ডবে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষজন সব আশ্রয় নিচ্ছে মাটির তলার বাঙ্কারে ও পাতাল রেলের সুড়ঙ্গে। এমনই একদিন….

error: Content is protected !!