Author Picture

আওরঙ্গজেব ও শম্ভাজির মিথ বনাম ইতিহাস: প্রসঙ্গ ছাবা চলচ্চিত্র

মজিদ মাহমুদ

বর্তমানে বিজেপির সংঘ পরিবার প্রায় তিন’শ বছর আগের ভারতের এমন এক সম্রাটের কবর মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদ থেকে সরিয়ে দেয়ার আন্দোলন করছেন- যিনি ইতিহাসে ভারতকে সর্বকালের সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রের মানচিত্র ও সংহতি উপহার দিয়েছিলেন, যার আয়তন ছিল চল্লিশ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার- যা ছিল বর্তমান ভারতের চেয়ে আট লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বড়, তাঁর অধীকৃত রাষ্ট্রটিই ভারত এখনো তারা নিজেদের বলে দাবি করে থাকে। তিনি অর্থনৈতিকভাবেও ভারতকে এতো সমৃদ্ধি এনে দিয়েছিলেন- যার বার্ষিক আয় ছিল তৎকালীন পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলোর এক চতুর্থাংশ এবং ফরাসি দেশের চেয়ে দশগুণ। তাঁর আগে এবং পরে ভারতের আর কোনো সম্রাট, এমনকি দু’শ বছরের ইংরেজ শাসন, স্বাধীন ভারতের স্যেকুলার ও ‘হিন্দু-শাসন’ কেউই তাঁর জায়গা পুনরুদ্ধার করতে পারেননি। এমনকি বর্তমানে সে-দেশে কোটি কোটি মানুষ রাতে না-খেয়ে ঘুমাতে গেলেও কারো কারো ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ এই মোগল সম্রাটের চেয়ে অনেকগুণ বেশি। বরং তাঁর স্থলে ভারতের বর্তমান শাসকগোষ্ঠী যাঁকে নায়কের আসনে বসাতে চান, তাঁর কৃতিত্ব নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হলে- ভারতকে একটি আঞ্চলিক ভূখণ্ড নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কারণ, ভারত কোনো একটি দেশ নয়, অনেক দেশ জনগোষ্ঠী ও জাতির সমাহার- যার চূড়ান্ত রূপ দিয়েছিলেন মুঘল আওরঙ্গজেব এবং শত বছর ধরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগণ তাঁর পুরো রাজ্য দখল করার জন্য হিন্দু মুসলিম উভয় শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল।

সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, যে সম্রাটের কবর তুলে অন্যত্র সরিয়ে দেয়ার আন্দোলন চলছে- তাঁর কবর নির্মাণের খরচ হয়েছিল মাত্র চৌদ্দ টাকা দশ আনা- যা মেটানো হয়েছিল তাঁরই ব্যক্তিগত টুপি সেলাই আর কোরান নকলের আয় থেকে। এমনকি তাঁর নিজের ইচ্ছাতেই তাঁর পূর্ব-পুরুষদের মতো কবরস্থানে কোনো সমাধিসৌধ নির্মাণ করা হয়নি। সোনা-জহরতের অলঙ্করণ ছাড়া একটি সমতল ভূমির ওপর অনাবৃত একটি কবর- যে স্থানটি একটি গুল্ম জন্মানোর জন্যও যথেষ্ট প্রশস্ত নয়। অথচ তাঁর নিজের মায়ের কবরটি সারা পৃথিবীর সপ্ত-আচর্যের একটি- যাঁর সমাধিসৌধ দেখার জন্য সারা বিশ্বের সর্বাধিক মানুষ প্রতি বছর ভারত ভ্রমণে আসেন এবং দেশটির ঐতিহ্যময় কীর্তির জয়গান করতে থাকেন। এটিও ভাবার বিষয়- ভারতের সবচেয়ে শক্তিমান সম্রাটদের অন্যতম, অথচ বৈশিষ্ট্যহীন অচিহ্নিত কবরটি- যা একান্ত না চাইলে কারো দৃষ্টিগোচর হওয়ার কথা নয়। সত্যিই ভাববার বিষয়- সেটি বিজেপির সংঘ পরিবারের জন্য এমন কি হুমকি তৈরি করছে!

এই দাবি সম্প্রতি তীব্রতর হয়েছে- মারাঠা রাজা শম্ভাজিকে নিয়ে নির্মিত ‘ছাবা’ নামের একটি চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে। চলচ্চিত্রটির কাহিনিকারের দাবি- মারাঠা শম্ভাজি ছিলেন একজন হিন্দু জাতীয়তাবাদি রাজা- যিনি নিজ ধর্ম ও রাজ্য রক্ষায় সারা জীবন বিধর্মী মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে প্রাণপণ লড়াই করেছিলেন, পরিণামে আওরঙ্গজেবের দ্বারা নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন- তবু তিনি বিধর্মী বিদেশির কাছে মাথা নত করেননি। এখানে ইতিহাসের এই অংশটুকুই শুধু সত্য যে, শম্ভাজি সর্বশেষ মুঘল বাহিনির সঙ্গে যুদ্ধে পরাস্ত ও ধৃত হয়ে তাঁর বন্ধু কবি কলসসহ মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিলেন। পরাস্ত রাজন্যের এই পরিণতি বাদ দিলে বাকি ইতিহাস ভুল বিকৃতি আংশিক এবং গোপনীয়তায় ভরপুর। মুঘল বাহিনির বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যে ডাক এই সিনেমায় দেয়া হয়েছিল, তা মূলত দু’শ বছরের বিদেশি শাসনের গোলামিতে পরিসমাপ্তি হয়েছিল।

 

ভারত কোনো একটি দেশ নয়, অনেক দেশ জনগোষ্ঠী ও জাতির সমাহার- যার চূড়ান্ত রূপ দিয়েছিলেন মুঘল আওরঙ্গজেব এবং শত বছর ধরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকগণ তাঁর পুরো রাজ্য দখল করার জন্য হিন্দু মুসলিম উভয় শাসকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছিল

মারাঠি শিবাজি এবং শম্ভাজিকে হিন্দু জাতীয়তাবাদের নায়ক বানানোর এই ঐতিহাসিক খনন শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ শাসনের শেষ প্রান্তে ভারতীয় জাতীয়তাবাদি আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে। শিবাজির মৃত্যুর ২১৪ বছর পরে ১৮৯৪ সালে একজন মারাঠি জাতীয়তাবাদি নেতা বালগঙ্গাধর তিলক ‘গণপতি ও শিবাজি উৎসব’ প্রবর্তন করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে স্বদেশী নায়কের অনুসন্ধান এবং তার দ্বারা জনগণ এবং ঔপনিবেশিক রাজশক্তিকে বার্তা দেয়া। এর আগে শিবাজি বা সিরাজির জাতীয়তাবাদি নেতা হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কেননা তখন পর্যন্ত ভারত কেন- সারা বিশ্বের কোথাও জাতীয়তাবাদের ধারণার বিকাশ হয়নি। তখন পর্যন্ত ছিল সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশবাদের কাল। কোনো অঞ্চলের ভাষার ধর্মের বা দেশের নামে পরিচিত হওয়ার সুযোগ ছিল না। ফলে বালগঙ্গাধর তিলক কট্টর হিন্দু নেতা হওয়া সত্ত্বেও শিবাজি উৎসব বা তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে’র একনিষ্ঠ সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও কংগ্রেসের মুসলিম নেতারা তাঁকে বরাবর সমর্থন করেছিলেন। তিনি ব্রিটিশ শাসনের দ্বারা বারংবার নিগৃহীত ও দণ্ডিত হয়েছেন, এবং তাঁর পক্ষে আদালতে সব সময় ওকালতির জন্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ দাঁড়াচ্ছেন। তিনি যখন ১৯২০ সালে মারা যান তখন কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর পক্ষে ‘দৈনিক নবযুগ’ পত্রিকায় আবেগঘন উপসম্পাদকীয় লিখে ব্রিটিশরাজের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। তিনি লিখছেন- ‘‘তিলক আর নাই!’ আমাদের জননী জন্মভূমির বীরবাহু, বড়ো স্নেহের সন্তান- ‘তিলক আর নাই!’ হিন্দুস্থান কাঁপিয়া উঠিল- কাঁপিতে কাঁপিতে মূর্ছিত হইয়া পড়িল। ওরে, আজ যে তাহার বুকে তাহারই হিমালয়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা ধসিয়া পড়িল!’ এতে বোঝা যায়, তিলকের ‘শিবাজি’ ছিলেন মূলত ব্রিটিশ বিরোধী জাতীয়তাবাদি নায়ক।

সে সময়ে এটি যে হিন্দু মুসলিমের ব্যাপার ছিল না, তার আরেকটি প্রমাণ প্রায় একই সময়ে বাংলার ভাগ্যাহত নবাব ‘সিরাজউদ্দৌলা’কে ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতার নতুন নায়ক হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। নবাবের মৃত্যুর ১৪১ বছর পরে ১৮৯৮ সালে অক্ষয়কুমার মৈয়েত্র লিখছেন ‘সিরাজদ্দৌলা’র নতুন জাতীয়তাবাদি ইতিহাস। তার কিছু আগে ১৮৭৫ সালে ব্রিটিশ সরকারে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট প্রখ্যাত কবি নবীনচন্দ্র সেন ‘পলাশীর যুদ্ধ’ যুদ্ধ মহাকাব্য লিখে ব্রিটিশ সরকারের বিরাগভাজন হচ্ছেন, তাঁর প্রমোশন ও অবসরকালীন ভাতা আটকে যাচ্ছে, সিরাজের প্রশংসামূলক অংশ বাদ না দেয়া পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার তাঁর  বই পাঠ্য থেকে প্রত্যাহার করছে। সুতরাং এসব জাতীয়তাবাদি ঐতিহাসিক চরিত্রসমূহ- যা পরদেশি ঔপনিবেশিক শাসকদের খেদানোর জন্য সৃষ্টি করা হয়েছিল- তা-ই শত বছর পরে নিজ দেশের নাগরিকদের মধ্যে বিভাজনের নায়ক হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। ভারতবর্ষেও সম্রাটের তুলনায় শিবাজি এবং সিরাজি উভয় তখন আঞ্চলিক চরিত্র। এনমকি একটি সময় পর্যন্ত বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা, শিবাজি, মীর কাসেম এবং লর্ড ক্লাইভের মর্যাদা কেন্দ্রীয় দিল্লি সরকারের কাছে খুব বেশি পার্থক্য ছিল না। কারণ স্বয়ং দিল্লির মোগল সম্রাট শাহ আলম ক্লাইভের ওপরে রাজিখুশি ছিলেন। সম্রাট শাহ আলম লর্ড ক্লাইভকে ‘দিল-এ-আং” (রণক্ষেত্রে সাহসী), ‘সাইফ-ই-আং’ (যুদ্ধের তরবারী), ‘মামিরুল মামালিক’ (সাম্রাজ্যের অভিজাত) এবং ‘সাবদাতুল মুলক’ (রাজ্যের বিশিষ্ট ব্যক্তি)- এই সব উপাধি দিয়ে ভূষিত করছেন। এবং তাঁকে বাংলায় রাজস্ব আদায়ের ক্ষমতা দেওয়ানি অর্পণ করেছিলেন। এর প্রধান কারণ বাংলার স্বাধীন নবাবদের নিকট থেকে দিল্লির রাজস্ব একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, চতুর লর্ড ক্লাইভ সেই সুযোগই গ্রহণ করেছিলেন।

২.

‘ছাবা’ চলচ্চিত্রে শম্ভাজিকে যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছে তা কতটা বাস্তবসম্মত ইতিহাসের তথ্য বিশ্লেষণে তা খোলাসা করা যেতে পারে। এই ছবির মূল উদ্দেশ্য আওরঙ্গজেবকে হিংস্র কপট ও প্রতিহিংসাপরাণ হিসাবে তুলে ধরা- যার কোনো ঐতিহাসিক দলিল নেই। অপরদিকে শম্ভাজির চরিত্রের অন্ধকার দিকগুলো বেমালুম গোপন করে দেশ প্রেমিক বীর হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা। এই ছবির মূল উদ্দেশ্য ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের প্রতি ঘৃণা সৃষ্টি করা। এবং এই সত্য থেকে ভারতীয়দের দূরে সরিয়ে নেয়া যে, মধ্যযুগের ভারতের শাসকগণের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম বলে আলাদা কোনো দ্বন্দ্ব তেমন ছিল না। যেমন শিবাজির বিরুদ্ধে মুঘলদের অন্যতম সেনাপতি জয়সিংহ যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। একই সঙ্গে শিবাজির প্রধান সেনাপতি ছিলেন দৌলত খান, সিদ্দি হিলাল, সিদ্দি ইব্রাহিম, দারিয়া সারং, এবং তাঁর প্রধান পরামর্শক ছিলেন কাজী হায়দার প্রমুখ। ছাবা ছবিতে যে ইতিহাস বিকৃতি হয়েছে সেকথা মারাঠা ইতিহাসবিদ ইন্দ্রজিৎ সায়ান্তও বলেছেন। যেমন এই ছবিতে প্রধান ভিলেন হিসাবে দেখানো হয়েছে শিবাজির দ্বিতীয় স্ত্রী সায়ারাবাই ভোঁসলেকে, অথচ তাঁর মতে প্রকৃত ভিলেন শিবাজির একজন ব্রাহ্মণ মন্ত্রী নাম আন্নাজি দাত্ত।

অথচ শম্ভাজির চরিত্র সমসাময়িক কোনো ঐতিহাসিক ভালো বলে অঙ্কন করেননি, যদুনাথ সরকারও সে কথা উল্লেখ করতে ভুলেননি। এমনকি কট্টর হিন্দুত্ববাদি রাজনীতির অন্যতম স্রষ্টা বিনায়ক দামোদর সাভারকর- ‘শম্ভাজি’কে ভালো চরিত্রের হিন্দু শাসক বলে মনে করতেন না।’  তিনি ছিলেন মূলত অবাধ ও অসমবর্ণ যৌনাচারে আসক্ত। তিনি এক ব্রাহ্মণ মহিলার সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে পিতা শিবাজি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন, এবং তাকে পানহালা দুগে বন্দি করে রাখেন। ব্রাহ্মণরা তাঁকে ক্ষত্রিয় মনে করতেন না, তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠানে কোনো ব্রাহ্মণ পৌরহিত্য করতে রাজি হননি, পরে বানারাস থেকে একজন ব্রাহ্মণ এনে তাঁর অভিষেক অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হয়। ব্রাহ্মণদের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন মূলত শূদ্র। তিনি তৎকালীন হিন্দু রাজাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ হত্যার পাপে কলুষিত ছিলেন। তিনি ২৪ জন ব্রাহ্মণকে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে হত্যা করেন। একই সঙ্গে অনেক মন্ত্রী এবং তাঁর ৪৮ বছর বয়সী বিধবা বিমাতা সোয়ারাবাইকে হাতির পায়ের নিচে পিষে হত্যা করেন।

পিতা শিবাজি কর্তৃক পানহালা দুর্র্গে বন্দি থাকাকালে তিনি পালিয়ে মুঘল সেনাপতি দিলির খানের আশ্রয় গ্রহণ করেন, এবং মুঘল সেনাপতির অধীনের ভূপালগড়ে পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। শিবাজি শুরুতে মারাঠি সামন্তদের মধ্যে কোনো সম্মানীয় রাজা ছিলেন না, আওরঙ্গজেব কর্তৃক রাজা উপাধি প্রদান এবং বিভিন্ন দরবারে সম্রাট কর্তৃক তাঁর আমন্ত্রণের দ্বারা তিনি সমগোত্রীয়দের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন। বিশেষ করে আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে সুবাদার থাকার সময়ে মারাঠা রাজাদের সম্মান বৃদ্ধি করেন। শিবাজি বা শম্ভাজি কখনো মোগল সম্রাটের সমকক্ষ ছিলেন না, তারা ছিলেন মূলত আঞ্চলিক সামন্ত রাজা, এমনকি শিবাজি এবং পুত্রের রাজা উপাধিও মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব কর্তৃক প্রদত্ত।

শিবাজি বা শম্ভাজি যে কেবল মুসললিম সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন তেমন নয়, তারা একই সঙ্গে অন্যান্য সামন্ত হিন্দু রাজাদের সঙ্গে, নিজের ভাই রাজারামের সঙ্গে, জাঞ্জিয়ার সিদ্দি, মহিশূরের ওয়াদিয়ার এবং গোয়ার পর্তুগিজদের সঙ্গেও যুদ্ধ করেছেন। সুতরাং তাঁর লড়াইকে কোনো মুসলিম সম্রাটের বিরুদ্ধে বলার সুযোগ নেই। এটা ছিল তাঁর নিজের রাজ্যরক্ষা ও ক্ষমতা অর্জনের লড়াই। খুবই আশ্চর্য যে, শিবাজির বাইশজন সেনাপতির আঠার জনই ছিলেন- পাঠান মুসলমান। সুতরাং এটি খুবই হাস্যকর যে, তাঁকে মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দু হিসাবে উপস্থাপন করা। যুদ্ধ যদি সেনাপতির নেতৃত্বে হয় তাহলে শম্ভাজির যুদ্ধ হতে পারে মুসলমানের বিরুদ্ধে মুসলমানের লড়াই। মারাঠিদের যুদ্ধ-বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠা মূলত মুঘল-পাঠান সেনাদের দ্বারা। শিবাজি ও শম্ভাজি তাঁরা নিজেরাও ছিলেন ধর্ম নিরপ্রেক্ষ শাসক। আবার যশোবন্ত সিংহ, রাজারাম সিংহ, রাজা জয় সিংহসহ আওরঙ্গজেবের হিন্দু সেতাপতির সংখ্যা ছিল মুঘল সম্রাটদের মধ্যে সর্বাধিক।

শম্ভাজির রাজত্বের শেষের দিকে তাঁর সৈন্যদের স্বপক্ষত্যাগ একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়, এবং পর্তুগিজরা তাদের সরবরাহ বন্ধ করে দিলে তাঁর সেনারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং মারাঠা সামন্ত জমিদারদের বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন, শম্ভাজির সেনাবাহিনির দ্বারা সর্বদা যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়েছে, এবং সকল কৃতি ছাপিয়ে উঠেছে তাঁর বাহিনির দ্বারা গণহত্যা ও গণধর্ষণের মতো নৃশংস অপরাধ। ১৬৬৫ সালের ১১ জুন শিবাজি মুঘলদের সাথে স্বাক্ষরিত পুরন্দরের চুক্তির শর্তানুসারে মাত্র নয় বছর বয়সে শম্ভাজিকে মুঘল সেনাপতি আম্বরের রাজা জয় সিংহের কাছে জিম্মি হিসাবে পাঠান; আর এই চুক্তি বলে তিনি মুঘল মসনবদার হিসাবে স্বীকৃত হন। কিন্তু পরের বছর ১৬৬৬ সালের মে মাসে তিনি এবং পিতা শিবাজি আগ্রায় আওরঙ্গজেবের দরবারে আমন্ত্রিত হন, কিছু চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য আওরঙ্গজেব তাঁদের নজরবন্দি করে রাখেন, তাঁদের পদচারণা এতোটা অবাধ ছিল, মাত্র কয়েক মাস পরে শিবাজি পুত্র শম্ভাজিকে নিয়ে সেখান থেকে পালিয়ে যান। শিবাজি এবং শম্ভাজি সম্রাটকে লাগাতার অস্থির করে রাখলেও অনেকবার বাগে পেয়েও সম্রাট তাঁদের হত্যা করেননি। তাই কার্ল মার্কস তাঁর ‘ভারতীয় ইতিহাসের কালপঞ্জি’ গ্রন্থে লিখেছেন, আওরঙ্গজেব অনেক বার সুযোগ পেয়েও শিবাজিকে হত্যা না করে সম্রাট হিসাবে একটি গর্দভের মতো আচরণ করেছেন। বিজাপুরের সুলতান আদিল খানের সেনাপতি আফজাল খানের সঙ্গে সন্ধি অবস্থায় ছলনা করে তাঁকে হত্যা করেন। শিবাজির মারাঠা সৈন্যদের শুরু থেকেই প্রধান পেশা ছিল লুট-তরাজ। যা পরবর্তীকালে বাংলায় বর্গী হানা হিসাবে কুখ্যাত হয়ে আছে। শম্ভাজি পরবর্তীকালে বর্গী দস্যুদের আক্রমণে বাংলায় প্রায় চার লক্ষ লোক নিহত হয়, এবং বর্গীদের ভয়ে এ অঞ্চলের মানুষ রাতে ঘর ছেড়ে বাইরে রাত কাটাতেন। বারংবার মারাঠা আক্রমণের ফলে ভারতের অভ্যন্তরীণ শাসনের দুর্বলতায় স্থায়ীভাবে বহির্শত্রুর আগমন ঘটে।

আওরঙ্গজেব ১৬৬৬ থেকে ১৬৬৮ সালের মধ্যে শিবাজিকে মুঘল সাম্রাজ্যের অধীনে রাজা উপাধি দিতে অসম্মত ছিলেন। কিন্তু শাহজাদা মুয়াজ্জমের পীড়াপীড়িতে শিবাজিকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা উপাধি প্রদান করেন। শিবাজি ও শম্ভাজির সঙ্গে আওরঙ্গজেবের বড় পুত্র শাহজাদা মুয়াজ্জমের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক- আওরঙ্গজেব সর্বদা সন্দেহের চোখে দেখতেন। তিনি তাদের সহযোগে পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারেন বলে তাঁর সন্দেহ ছিল। তবু ময়াজ্জমের মধ্যস্থতায় শম্ভাজিকে পাঁচ হাজার অশ্বারোহী বাহিনির মুঘল মসনবদার পদে পুরর্বহাল করেন। এরপর শিবাজি মুঘল ভাইসরয় যুবরাজ মুয়াজ্জমের অধীনে চাকরি নেয়ার জন্য শম্ভাজিকে সেনাপতি প্রতাপরাও গুজরের সঙ্গে আরওঙ্গবাদে পাঠানো হয়, এবং দিলের খানকে তাঁর ডেপুটি নিয়োগ করা হয়। ১৬৬৭ সালে ৪ নভেম্বর শম্ভাজি যুবরাজ মুয়াজ্জমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে অতিরিক্ত বেরার অঞ্চলে রাজস্ব আদায়ের অধিকার অর্জন করেন। সেখানে কিছুদিন থাকার পরে শম্ভাজি ঔরঙ্গবাদের তাঁর সেনা প্রতিনিধিদের রেখে রাজগড়ে ফিরে আসেন। এ সময় শম্ভাজি মারাঠা সৈন্যদের নিয়ে শাহাজাদা মুয়াজ্জমের নেতৃত্বে একত্রে বিজাপুর সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।

লক্ষ্য করার বিষয়, এখানে শত্রু মারাঠা হিন্দু নয়, বিজাপুর মুসলমান সুলতান। শম্ভাজি এবং মুঘলরা সম্মিলিতভাবে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ঠিক একইভাবে আকবর ও জাহাঙ্গীরের আমলে মুঘল সেনাপতি মানসিংহের নেতৃত্বে বাংলার স্বাধীন বারো-ভুঁইয়াদের দমনে যে সব যুদ্ধ হয়- সেখানে হিন্দু ভূ-স্বামীরাও ছিলেন, আবার মুসলিম ভূ-স্বামীরাও ছিলেন। একই সঙ্গে মুঘলরা রাজা প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে যেমন যুদ্ধ পরিচালনা করছেন, ঠিক একইভাবে সোনারগাঁওয়ের ঈসা খাঁর বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করছেন। অথচ সাম্প্রতিককালে এসে প্রতাপাদিত্যকে হিন্দু ধর্মীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে প্রমাণের জন্য ভীষণ কসরৎ করা হচ্ছে। এর জন্য কম দায়ী নন- বৃটিশ আমলের শেষ দিকের জাতীয়তাবাদি ঐতিহাসিকগণ, সে হতে পারেন যদুনাথ সরকার, রমেশচন্দ্র মজুমদার কিংবা কালিকারঞ্জন কানুনগো।

৩.

ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে হিন্দু কোনো রাজার সাক্ষাৎ পেলে তাঁরা মুসলিম শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসাবে দেখানোর চেষ্টা করতেন- কোনো রকম আবেগ সংবরণ ছাড়াই। অথচ প্রতাপাদিত্যের চরিত্র কোনোভাবেই আওরঙ্গজেব কিংবা শম্ভাজির চেয়ে উত্তম বলে প্রমাণ করার উপায় নেই। শম্ভাজির মতো প্রতাপও এতো দুরন্ত কামাচারি ছিলেন যে- তাঁকে তাঁর পিতা বীক্রমাদিত্য শ্রীহরির পক্ষে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হওয়ায় যশোহর রাজের প্রতিনিধি হিসাবে আকবরের রাজদরবারে পাঠানো হয়; এবং প্রতাপ আকবরের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। আগ্রাতে অবস্থানকালেই তিনি তাঁর পিতা বিক্রমাদিত্য এবং পিতৃব্য বসন্ত রায়ের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র পাকাতে থাকেন। প্রতাপাদিত্য জন্মের সময় তাঁর কোষ্ঠী গণনায় দেখা যায়- তিনি পিতৃহন্তা হবেন। এ কারণে তার পিতা তাঁকে নিজের কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেন, এবং পিতৃব্য বসন্ত রায় তাঁকে অপত্য স্নেহ দিয়ে লালান পালন করেন। কোষ্ঠীতে এই ভবিষ্যৎ বাণী ছিলো কি ছিলো না- তারচেয়ে বড় সত্য প্রতাপাদিত্য ঠিকই তাঁর পালিত পিতা এবং পিতৃব্য বসন্ত রায় এবং তাঁর তিন পুত্রকে হত্যা করে তাঁর শাসিত এলাকা দখন করে নেন।

শিবাজি বা শম্ভাজি যে কেবল মুসললিম সম্রাট আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন তেমন নয়, তারা একই সঙ্গে অন্যান্য সামন্ত হিন্দু রাজাদের সঙ্গে, নিজের ভাই রাজারামের সঙ্গে, জাঞ্জিয়ার সিদ্দি, মহিশূরের ওয়াদিয়ার এবং গোয়ার পর্তুগিজদের সঙ্গেও যুদ্ধ করেছেন। সুতরাং তাঁর লড়াইকে কোনো মুসলিম সম্রাটের বিরুদ্ধে বলার সুযোগ নেই। এটা ছিল তাঁর নিজের রাজ্যরক্ষা ও ক্ষমতা অর্জনের লড়াই। খুবই আশ্চর্য যে, শিবাজির বাইশজন সেনাপতির আঠার জনই ছিলেন- পাঠান মুসলমান। সুতরাং এটি খুবই হাস্যকর যে, তাঁকে মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দু হিসাবে উপস্থাপন করা

এর আগে আকবরের দরবারে থাকার সময় পিতৃব্যর খাজনা আটকে দিয়ে তিনি পিতৃব্যর রাজ্যের দায়িত্ব বাগিয়ে নেন। এমনকি পুত্র উদিত নারয়ণের সঙ্গেও প্রতাপের ভালো সম্পর্ক ছিলো না, তাঁর নরম নীতির ফলে পুত্রকে ক্ষমতাচ্যুত ও বন্দি করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বৌ-ঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাসে উদিত নারায়ণ পিতা প্রতাপের নির্দয়তার প্রতিক্রিয়ায় বলছেন,‘রাজার ঘরে কোনো পুত্র জন্মায় না, জন্মায় শুধু উত্তরাধিকার।’ এই উক্তি কেবল প্রতাপ বা উদিতের জন্য সত্য নয়, এটি শম্ভাজি এবং আওরঙ্গজেব বা তাঁর পিতা পিতামহরে জন্যও সত্য, এখানে ধর্ম জাত বা স্নেহের কোনো আলাদা মূল্য নেই।

১৬৭৮ সালে শিবাজি আবরো পুত্র শম্ভাজির কামাচার ও দুরন্ত মানসিকতায় অতিষ্ঠ হয়ে পানহালা দুর্গে বন্দি করেন। এবারও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল একজন ব্রাহ্মণের স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন। প্রকৃত হিন্দুত্ববাদিতা যে ব্রাহ্মণ্যতার দ্বারা পরিপুষ্ট- শম্ভাজি সেটি উপেক্ষা করে ক্ষত্রিয় বা শূদ্র হয়ে বহু ব্রাহ্মণ হত্যার পাপ এবং ব্রাহ্মণ নারী গমণ করেন। এর দ্বারা প্রমাণিত শম্ভাজির মধ্যে রাজ্যাকাক্সক্ষা ছাড়া হিন্দু ধর্মীয় চেতনা আলাদাভাবে কাজ করেনি। এবারও দাক্ষিণাত্যের মুঘল সেনাপতি দিলের খানের সঙ্গে যোগাযোগ করে শম্ভাজি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে দুর্গ থেকে পালিয়ে মুঘল সেনাপতির সঙ্গে যোগ দেন। এরপর দিলের খান ও মুয়াজ্জমের মধ্যস্থতায় আওরঙ্গজেব তাঁকে সাত হাজারী মসনবদার দান করেন এবং এবং আনুষ্ঠানিকভাবে রাজা উপাধি প্রদান করেন। কারণ এই সময় শিবাজি তাঁর জেষ্ঠ পুত্র শম্ভাজির দুরাচারের কারণে তাঁকে ন্যায্য উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাজারামকে ক্ষমতায় বসাতে চান। আর মুঘল সাম্রাজ্যের বশ্যতার বিনিময়ে আওরঙ্গজেব তাঁকে রাজা এবং রাজ্য উদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দেন। তাহলে এখানে ধর্ম কোথায় কাজ করল, পিতা যখন পুত্রকে বঞ্চিত করতে চাইলেন তখন সম্রাট তাঁকে স্বপদে অধিষ্ঠিত করতে চাইলেন, এতে তো প্রমাণ হয় এখানে আওরঙ্গজেব এবং শম্ভাজির স্বার্থ ছিল অভিন্ন।

১৬৮০ সালে শিবাজির মৃত্যুকালে পুত্র শম্ভাজি পানাহালা দুর্র্গে বন্দি অবস্থায় দুর্গের সেনাপতিকে হত্যা করে মা সোয়ারাবাই এবং ভাই রাজারামসহ পদস্থ মন্ত্রীদের বন্দি করেন। পরে সোয়ারাবাই এবং রাজারাম আওরঙ্গজেবের বিদ্রোহ পুত্র আকবরের সঙ্গে যোগসাজস করে শম্ভাজিকে উৎখাতের চেষ্টা করে। এই ষড়যন্ত্রের অনুমানে মা সোয়ারাবাইসহ উচ্চ পদস্থ অমর্ত্যদের হত্যা করেন।

এ কথা আগেই উল্লেখ করেছি, শম্ভাজি যে কেবল মুসলিম আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন তা-ই নয়, তিনি অসংখ্যা ব্রাহ্মণ হত্যা করেছিলেন, আশেপাশের হিন্দু রাজ্য আক্রমণ করেছিলেন, বুরহানপুর দুর্র্গ সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত করেছিলেন, বন্দিদের নৃশংসভাবে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন, এবং মারাঠা শহরটি লুট এবং বন্দরগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব অতিষ্ট হয়ে আগ্রায় রাজধানী থেকে দক্ষিণে আওরঙ্গবাদে নিজের পারিষদ নিয়ে যেতে বাধ্য হন, এবং বাকি জীবনে আর তিনি কখনো উত্তর ভারতের প্রিয় রাজধানীতে ফিরে আসতে পারেননি।

শম্ভাজি কেবল মুসলিম এবং নিজ ধর্মের লোককেই হত্যা করেননি, তৎকালীন পর্তুগিজ বিবরণকারী পাদ্রে ফ্রান্সিকো ডি সুজার বর্ণনায় আসে- ‘তাঁর সেনাবাহিনি মারাঠা দুর্গ লুঠ করেছিলেন, খ্রিস্টান মহিলাদের ধর্ষণ করেছিলেন। তারা লুটপাট ও ধর্ষণের পরে বাকি মহিলা ও শিশুদের ক্রীতদাস হিসাবে ডাচ ও আরব বণিকদের কাছে বিক্রি করে দেয়।’ যদুনাথ সরকার উল্লেখ করেছেন, মারাঠারা আক্রমণের সময় গণধর্ষণের জন্য কুখ্যাত হয়ে আছেন, বিশেষ করে শম্ভাজির গোয়া আক্রমণের সময় আরো নৃশংসভাবে এই দুষ্কর্ম ঘটানো হয়। একটি সমসাময়িক বিবরণে বলা হয়, এরা এতোই নৃশংস ছিল যে কোনো সুন্দরী মহিলা পেলে পাঁচ ছয় জন মিলে ওই মহিলাকে ধর্ষণ করতো। ভারতে এর আগে এ ধরনের নৃশংস ঘটনা অন্য কোনো জাতি দ্বারা সংঘটিত হয়নি। এই জন্য অনেক মেয়ে মারাঠিদের ভয়ে নিজেরা পুকুরে ঝাঁপ দিয়ে মারা যান। এবং যে-সব মহিলারা মারাঠি দুষ্কৃতিকারীদের প্রতিরোধ করেছিলেন, তাদের স্তন ও গোপনাঙ্গ কেটে ফেলে মারাঠা যোদ্ধারা।

যাই হোক, ১৬৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের সঙ্গমেশ্বরে এক যুদ্ধে মুকাররম খানের মুঘল বাহিনির হাতে শম্ভাজি তার ২৫ জন মন্ত্রীসহ বন্দি হন। এরপর তার পরিণতি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ আছে। তবে এটি সত্য শম্ভাজিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। কেউ বলেন, শিরচ্ছেদ করা হয়। কেউ বলেন মৃতুদণ্ড কার্যকর করার আগে গরম শলাকা দিয়ে তার চোখ অন্ধ করে দেয়া হয়। কেউ বলে তার শরীর টুকরো টুকরো করা হয়। অবশ্য মৃত্যুদণ্ড দেয়ার আগে তার কাছে কিছু শর্ত সাপেক্ষে ক্ষমার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। সম্রাটের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, মুঘল বিরোধীদের নামের তালিকা, সম্পদের তালিকা, এমনকি তাকে মুসলমান হতে প্রস্তাব দেয়া হয়, পয়গম্বর সম্বন্ধে তাঁর মতামত জানতে চাওয়া হয়। তিনি ইসলামের নবীকে নিয়ে কুৎসিৎ মন্তব্য করেন। এতেই আওরঙ্গজেব ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেন। বর্তমানে হিন্দু জাতীয়তাবাদিদের কাছে কেবল তাঁর মৃত্যুকালীন বিবরণই উদ্বুদ্ধ হওয়ার একমাত্র কারণ হয়ে আছে। আর বাকিটা তাদের মনের সাম্প্রদায়িক চেতনার দ্বারা উদ্ভূত। শম্ভাজিকে ছাবা সিনেমায় বীর যোদ্ধা হিসাবে তুলে ধরা হলেও অনেকে তা বিশ্বাস করেন না, অনেকে বলেন সঙ্গমেশ্বরে তেমন কোনো যুদ্ধ হয়নি, তিনি তাঁর বন্ধু কবি কলসের আস্তানায় বিনোদনকালে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ধরা পড়েন। শম্ভাজি নিজেও ধৃত গুপ্তচরদের জিব কেটে হত্যা করতেন। এবং তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী ব্রাহ্মণদের হাতির পায়ের নিচে ফেলে হত্যা করতেন।

৪.

সম্রাট আওরঙ্গজেবের দোষ-স্খলন এই রচনার উদ্দেশ্য নয়। কারণ আওরঙ্গজেব ঐতিহাসিক ব্যক্তি এবং ভারতীয় শাসকদের মধ্যে সর্বকালের সবচেয়ে প্রতাশালী সম্রাট, তিনি দীর্ঘমেয়াদে সর্ববৃৎ ভারত-ভূখণ্ড শাসন করেছেন। এর থেকে তাঁর ক্ষমতা যোগ্যতা প্রতিয়মান করা যায়, ন্যায় এবং সুবিচারের ওপর দণ্ডায়মান ছাড়া কেবল শক্তি প্রয়োগের দ্বারা এতোবড় সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যের তুলনায় শিবাজি শম্ভাজির রাজ্য ছিল খুবই ছোটো ও আঞ্চলিক- যা মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চল বলেই বিবেচিত। তাছাড়া এটিও এই রচনার উদ্দেশ্য নয় যে, শিবাজি শম্ভাজির কোনো ভালো গুণ সাহস বা সৌকর্য ছিল না। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে- তারাও ছিলেন মূলত ধর্ম নিরপেক্ষ মধ্যযুগের যোগ্য সামন্ত শাসকদের অন্তর্ভুক্ত।

আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগগুলোর মধ্যে ছিল- তিনি হিন্দুদের প্রতি জিজিয়া কর আরোপ করেছিলেন এবং অনেক মন্দির ধ্বংস করেন, অনেক হিন্দুকে হত্যা করেন। হিন্দু হত্যার বিষয়টি ধোপে টেকে না যেটি পূর্বেই আলোচিত হয়েছে, তাঁর ক্ষমতা সুদৃঢ় রাখতে তাঁর কাছে হিন্দু মুসলিম আলাদা কোনো বিষয় ছিল না। যুদ্ধে কিংবা কাজীর বিচারে তিনি হিন্দু মুসলিম উভয়কে সমানভাবেই শায়েস্তা করেছেন। একই সঙ্গে তাঁর বিরুদ্ধে কিছু মন্দির ভাঙার অভিযোগ থাকলেও মসজিদ ভাঙার অভিযোগও কম ছিল না। আর এর কারণ মন্দির বা মসজিদ বলে নয়, প্রতিপক্ষের দুর্গ ধ্বংস ও ক্ষমতা খর্ব করাই প্রধান উদ্দেশ্য। আর তিনি কেন জিজিয়া কর আরোপ করেছিলেন সেটি নিশ্চয় করদাতাদের পক্ষে সুখকর নয়, বরং অমুসলিম হিসাবে আপাত অবমাননাকর। কর প্রয়োগের ব্যাপারে আওরঙ্গজেবের পক্ষের যুক্তি ছিল, যেহেতু মুসলমানদের আয়ের আড়াই ভাগ বাধ্যতামূলক যাকাত দিতে হয়, সেহেতু কর এবং যাকাত মিলে হিন্দুদের প্রদত্ত পাঁচ ভাগের সমান, যা কোনোভাবেই মুসলমানদের দেয়া করের চেয়ে বেশি নয়। তাছাড়া অতিরিক্ত কর দেয়ার ফলে হিন্দুরা সম্রাটের সঙ্গে কোনো যুদ্ধে যেতে বাধ্য ছিলেন না, এমনকি তাদের সম্পত্তি ও জানমাল রক্ষা সম্রাটের জন্য বাধ্যতামূলক কর্ম হিসাবে বিবেচিত ছিল। জিজিয়া করের ফলে পুরো ভারতে হিন্দুরা ব্যবসায় বাণিজ্যে যে অবাধ সুবিধা পেয়েছিল যা মুসলমানরা কখনো পায়নি; ফলে আওরঙ্গজেবের আমলে হিন্দুদের একটি উচ্চ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটেছিল, যার ফলে কর্নওয়ালিসের সময় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে এ দেশের প্রায় সব জমিদারি তারা কিনে নিতে পেরেছিলেন; এবং মুসলমানদের কাছে অর্থ না থাকায় তারা জমিদারি হারিয়ে ফেলেছিলেন। সুতরাং জিজিয়া প্রথার ফলে আওরঙ্গজেবের প্রতি হিন্দুদের নেতিবাচক মনোভঙ্গি তৈরি হয়, এতে মুসলমানরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে আওরঙ্গজেবের শাসনকালের তিন চতুর্থাংশ সময়কালে কোনো জিজিয়া ছিল না, তিনি এ ক্ষেত্রে তাঁর পূর্বসূরীদের পথ অবলম্বন করেছিলেন। সুতরাং এটি বোঝার উপায় নেই, তিনি কেন তাঁর শাসনকালের একেবারে শেষ পর্বে এসে জিজিয়া প্রবর্তন করলেন, ধর্ম না অর্থ- বোঝার উপায় কম। তবে এ কথা সব সময় সত্য যে, এ কালেও কর প্রদানের পরিমাণ সবার জন্য এক নয়, যারা কর বেশি প্রদান করেন তারাই রাষ্ট্রে বেশি সুরক্ষা পান।

সম্প্রতি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের ওপর গবেষণা করেছেন ঐতিহাসিক অড্রে ট্রুসকি, তাঁর ‘আওরঙ্গজেব: দ্য ম্যান অ্যান্ড দ্য মিথ’ গ্রন্থে বলা হয়, ‘আওরঙ্গজেব একটি শক্তিশালী রাজপরিবারের উত্তরাধিকার। তিনি তাঁর বাবাকে বন্দি করে আর বড় ভাইকে হত্যা করে সিংহাসনে বসেছিলেন। তিনি ছিলেন যুদ্ধের ময়দানে অতুলনীয় এবং ঐক্য ও জোট গড়ার ক্ষেত্রে ছিলেন প্রভাবশালী এক নেতা।’ তার মতে ‘আওরঙ্গজেবের নীতিনির্ধারণে তাঁর প্রপিতামহ সম্রাট আকবরের প্রভাব ছিল অপরিসীম।’ তিনি বলেন, ‘আওরঙ্গজেব তাঁর সাম্রাজ্যে সব ধরনের মানুষকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছিলেন। একজন যুবরাজ হিসেবে তিনি পুরো সাম্রাজ্য ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি সবকিছু বোঝার চেষ্টা করেছেন। তিনি সব পক্ষের মানুষ- মারাঠা থেকে রাজপুত- সবার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলেছিলেন। পরে এসব মানুষকে তিনি তাঁর রাজসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিলেন।’ আওরঙ্গজেবকে হিন্দুদের ধর্মান্ধ প্রসঙ্গে ট্রুুসকি বলেন, এই মুঘল শাসক বিশ্বাস দিয়ে নয়, তিনি রাজ্য শাসন করেছিলেন ক্ষমতা দিয়ে।’ তাঁর মতে সেকালে ভারতের অন্যান্য রাজার থেকে তাঁর বিশেষ বিচ্যুতি ছিল না। ট্রুসকির মতে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকেরা আওরঙ্গজেবের নিন্দা ও সমালোচনা করে থাকেন। বিজেপি ও আরএসএসের অনুসারী হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা মূলত ঔপনিবেশিক পূর্ব যুগের সেই নিন্দার নতুন রূপ।

আওরঙ্গজেব কিংবা শম্ভাজির সমসাময়িককালের ইতিহাসে তাদের দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধের মধ্যে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রি বলেছেন- আওরঙ্গজেব যদি এতো হিন্দু বিদ্বেষী হতেন তাহলে তো সমসামযিক সাহিত্যে লোকগাঁথায় তার ব্যাপক অস্তিত্ব থাকতো।

প্রকৃতপক্ষে এর জন্য দায়ি- মারাঠা জাতির বীরত্বের ইতিহাস রচয়িতা লেফট্যান্ট কর্নেল জেমস টড এর ‘রাজস্থান’ গ্রন্থ। এটি না ইতিহাসের বই না গল্পের। যদিও কর্নেল টডের জন্ম হয়েছিল শম্ভাজির মৃত্যুর শতবর্ষ পরে, এবং তিনি স্বয়ং ‘তৃতীয় ইঙ্গ মারাঠা যুদ্ধে’ গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৮১৮-১৯ সালের যে যুদ্ধ শিবাজি সৃষ্ট মারাঠা রাজ্যকে ইংরেজরা সম্পূর্ণ রূপে বশীভূত করে চিরতরে তার অবসান ঘটায়। কিন্তু তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অপকর্মের পরিবর্তে রাজস্থানের এক নতুন ধরনের ইতিহাস রচনা করেন, যেখানে শিবাজির বীরত্ব এবং আওরঙ্গজেবের নিন্দা প্রাধান্য পায়। সুতরাং অদূর অতীতের দেড়শ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশের অত্যাচার ও শোষণ ভুলে মুসলিম ও ব্রিটিশ শাসনের মুখোমুখী দাঁড় করিয়ে দেয়া সম্ভব হয়। আর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়দের মতো ব্রিটিশ হিন্দু সিভিলিয়ানরা ইংরেজ প্রভুর বিরুদ্ধে কিছু বলার সাহস দেখানোর পরিবর্তে টডের ইতিহাসকেই অবলম্বন করে বাংলায় মারাঠাদের নায়ক করে তোলেন। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন- ‘বাঙলার আধুনিক জাতীয় ভাবসমূহের দুই তৃতীয়াংশ এই বইখানি (টডের রাজস্থান) হইতে গৃহীত।’ এটি আশ্চর্যের বিষয়- যে মারাঠারা একদিন বাংলায় লুঠ-ধর্ষণে নরক পরিণত করেছিলেন- তারাই বাঙালি লেখকদের দ্বারা নায়কের পদে বরিত হতে থাকলেন।

 

আওরঙ্গজেব তাঁর সাম্রাজ্যে সব ধরনের মানুষকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেছিলেন। একজন যুবরাজ হিসেবে তিনি পুরো সাম্রাজ্য ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি সবকিছু বোঝার চেষ্টা করেছেন। তিনি সব পক্ষের মানুষ- মারাঠা থেকে রাজপুত- সবার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলেছিলেন। পরে এসব মানুষকে তিনি তাঁর রাজসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিলেন

হিন্দু জাতীয়তাবাদিরা আওরঙ্গজেবের হোলি উৎসব বাতিলের ফরমানের কথা উল্লেখ করলেও এটি বলেন না যে, তিনি মুহররম ও ঈদের উৎসবও বন্ধ করেছিলেন। তিনি মন্দির ধ্বংস করেছিলেন বলে উল্লেখ করলেও এটি বলেন না যে, তিনি অনেক বেশি মন্দির নির্মাণ করেছিলেন, মন্দিরে জমি ও অর্থ বরাদ্দ করেছিলেন। বানারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত আওরঙ্গজেবের ফর্মানে উল্লেখ আছে- ‘আমাদের ধর্মীয় আইনে পুরনো মন্দির ভেঙে নতুন মন্দির তৈরি নিষিদ্ধ। আমাদের কাছে খবর এসেছে, কিছু মানুষ বিদ্বেষ ও শত্রুতা করে ব্রাহ্মণদের হয়রানি করছে। তারা মন্দিরের তত্ত্বাবধায়ক পদ থেকে ব্রাহ্মণদের অপসারণ চায়। এ ধরনের কাজ ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করবে। আমার আদেশ হলো- এই ফরমান পৌঁছানো সঙ্গে সঙ্গে আপনি সতর্ক হবেন, ব্রাহ্মণ বা অন্য কোনো হিন্দু যেন ভবিষ্যতে কোনো প্রকারে অন্যায়ের সম্মুখীন না হন- সেটা নজরদারি করবেন। তারা যেন শান্তিতে নিজ নিজ পেশায় নিয়োজিত থাকেন। এই নির্দেশ শিগগির কার্যকরী করবেন।’

ঐতিহাসিক রিচার্ড ইটন ‘টেম্পল ডেস্ট্রাকশন এন্ড ইন্দো-মুসলিম স্টেট’ প্রবন্ধে আওরঙ্গজেবের মন্দির ভাঙাকে মিথ প্রমাণ করে বলেছেন- ‘হিন্দু রাজারা যুদ্ধে প্রতিপক্ষ রাজার মন্দির ভাঙার জন্য আলাদা দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।’ ঐতিহাসিক এম আতাহার আলী দেখিয়েছেন- মুঘল শাসকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হিন্দু কর্মচারি কাজ করেছেন আওরঙ্গজেবের আমলে।’ তাঁর অর্থমন্ত্রী ছিলেন রাজা রথুনাথ। সম্রাট শাহজাহানের সচিব চন্দর ভান ব্রাহ্মণ অবসরের পরে তাঁকে এবং তাঁর ছেলেকে আওরঙ্গজেব মায়ের সমাধি তাজমহলের দায়িত্ব দেন। রিচার্ড ইটন দেখিয়েছেন তিনি বাংলায় মুসলমানদের সঙ্গে হিন্দু বৈষ্ণব শৈব ও শাক্তদেরও জমি দান করেন। ‘ডিড আওরঙ্গজেব ব্যান্ড মিউজিক’ প্রবন্ধে ক্যাথলিন বাটলার শোফিল্ড সঙ্গীত নিষিদ্ধকেও মিথ বলে প্রমাণ করেছেন।

ঐতিহাসিকদের ধারণা মারাঠারা জাতে উঠেছিলেন আওরঙ্গজেবের সতের বছর দক্ষিণে সুবেদার হিসাবে থাকার সময়, তিনিই প্রথম তাদের গুরুত্ব দিয়ে রাজদরবারে ডাকেন। এবং এ কথা সত্য শম্ভাজির মৃত্যুর পরে আওরঙ্গজেব তাঁর পুত্র সাহুজিকে ক্ষমতায় এনে মারাঠা সাম্রাজ্য রক্ষা করেন। অথচ আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর মাত্র বিশ বছরের মধ্যে মারাঠা সাম্রাজ্য পতন ঘটে, এবং আক্ষরিক অর্থে তাদের বাহিনি বাংলাসহ ভারতের অন্যত্র লুটতরাজ শুরু করে।

৫.

আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরে প্রায় তিনশ বছর ধরে তাঁর কবর সেখানে থাকা প্রমাণ করে সম্রাট হিসাবে তিনি শিবাজি শম্ভাজিকে দমন করলেও ধর্মীয় কোনো বিদ্বেষ ছিল না। তাছাড়া আওরঙ্গজেব প্রতিপক্ষে এ অঞ্চল কখনো পুরোপুরি বশ্যতায় আনতে না পেরেও সেখানে নিজের কবরের জন্য অসিয়ত করে যাওয়াও প্রমাণ করে- তিনি ছিলেন মূলত সাম্রাজ্য রক্ষাকারী একজন সম্রাট। একই সঙ্গে একটি পরাস্ত অঞ্চলে তাঁর কবর থাকার অর্থ- সম্রাটের চেয়ে শিবাজি ও শম্ভাজির মতো হিন্দু রাজাদের পরাক্রমতা কম নয়- যা পক্ষান্তরে হিন্দু গৌরব প্রকীর্ণ করে। তবে ছাবা সিনেমা নিয়ে শেষ কথাটি বলা যায়, এটি যত না ইতিহাস, যত না শম্ভাজির জীবনালেখ্য- তারচেয়ে বেশি বর্তমান শাসক সংঘ পরিবারের মানস প্রতিচ্ছবি। আওরঙ্গজেব- যিনি হতে পারতেন ভারতের শৌর্যবীর্যের প্রতীক পূজনীয় এবং গর্বের- অথচ তিনিই হয়ে উঠেছেন কালের উঞ্ছবৃত্তি রাজনীতির কাছে চরম ঘৃণার। তাছাড়া বর্তমান শাসকগণ আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারলে আর্থিক দুর্নীতি ও বিলাসবহুল জীবনের আহ্বান থেকে কিছুটা দূরে থাকতে পারতেন।

সহায়ক গ্রন্থ:

১.            যদুনাথ সরকার রচনা সম্ভার, সম্পাদনা ও সংকলন: নিখিলগুহ, এমসি সরকার এন্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড

২.           এ শর্ট হিস্ট্রি অব আরঙ্গজেব, যদুনাথ সরকার, খসরু চৌধুরী, ঐতিহ্য,

৩.           হিস্ট্রি অব আওরঙ্গজেব, ফল অব দি মুঘল এম্পায়ার, যদুনাথ সরকার

৪.           টডের রাজস্থান ও বাংলা সাহিত্য, ড. বরুণ কুমার চক্রবর্তী, পুস্তক বিপনী, কলকাতা

৫.           আওরঙ্গজেব: সত্য ইতিহাস বনাম মিথ, বিশ্বেন্দু নন্দ, কলম, ২৯মার্চ ২০২৫

৬.           মোগল এম্পায়ার, অড্রে ট্রুসকি

৭.           বৌ ঠাকুরানীর হাট, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আরো পড়তে পারেন

মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা: বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যা জানা গিয়েছে, যা জানা সম্ভব

এক মহান যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে অসংখ্য মানুষের অপরিসীম আত্মত্যাগ। নানা সূত্র থেকে আমরা শুনে এসেছি ৩০ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের এ স্বাধীনতা। অনেকেই আবার ৩০ লক্ষ শহীদের সংখ্যাটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমন প্রশ্ন ওঠার মূলে রয়েছে বিষয়টি নিষ্পত্তি করার ব্যাপারে ৭১-পরবর্তী শাসকদের উদাসীনতা। তারা এত বছরেও শহীদের সংখ্যা….

প্রতিটি শূন্যতা যেন নতুন শোকের জন্ম দেয়

শূন্যতার আকাশে স্মৃতির মেঘ জমে। জীবন সরে সরে আসে মৃত্যুর দিকে। ফুরিয়ে আসা সময়ের দাপট এড়াতে পারে না কেউ। একজীবনে বহু জীবনাবসানের দেখা পাওয়া যায়, হয়তো দুর্ভাগ্যক্রমেই। ব্যক্তির মৃত্যুর পরিসমাপ্তি একবারই হয়, তবে সেই ব্যক্তি যদি বহুপ্রাণের সাথে জুড়ে থাকেন, তাঁর অনুপস্থিতি বারংবার অনুভূত হয়। প্রতিটি শূন্যতা যেন এক নতুন শোকের জন্ম দেয়। ২০২৪ সালে….

অর্বিটাল’র স্রষ্টা সামান্থা হার্ভে জিতলেন বুকার প্রাইজ

আঘাতপ্রাপ্ত পৃথিবীর গল্পে আমি থাকেত চাই শুধু মানবতা আর প্রকৃতির কাছে ঋণী। ব্রিটিশ লেখিকা সামান্থা হার্ভে এমন কথা বলেছেন কি না জানা হয়নি। তবে বুকার পুরস্কারের বিচারক প্যানেল হার্ভের মানবতা আর প্রকৃতির কাছে ঋণী থাকার মনোভাবের পরিচয় পেয়েছেন তাঁর অসাধারণ উপন্যাস অর্বিটাল’র মধ্যে। যার জন্য ২০২৪ সালে বুকার পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে সামান্থা হার্ভেকেই বেছে নিয়েছেন….

error: Content is protected !!