Author Picture

অক্ষরের ভেতরে একটা মাদকতা আছে -শাহাদুজ্জামান

মাসউদুল হক

শাহাদুজ্জামান পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ দেখতে পান, তিনিই কেশের আড়ে পাহাড় আবিষ্কার করেন। কয়েকটি বিহ্বল গল্পে ঘোরগ্রস্ত- করে রাখেন বাংলা ছোট গল্পের পাঠকদের। অন্য এক গল্পকারের গল্প নিয়েও লেখেন তিনি, অনুভব করেন বিসর্গতে দুঃখ, প্রতিটি বর্ণমালাই জীবনের সাথে হয়ে ওঠে প্রাসঙ্গিক, ব্যঞ্জনাময়। কখনো ক্রাচে ভর করা এক কর্নেলের জীবনকে পাঠ করেন নিবিড় আগ্রহে। আবার বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে প্রহেলিকাময় কবি জীবনানন্দ দাশকে একজন কমলালেবু রূপে নতুন করে অনুসন্ধান করতে সচেষ্ট হন। গল্প উপন্যাস অনুবাদের গ-ি পেরিয়ে তাঁর ভাবনার জগত ছড়িয়ে পড়ে শিল্পকলা, চলচ্চিত্র, নৃবিজ্ঞান, জনস্বাস্থ্য, সমাজ, সংস্কৃতি, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিবিধ বিষয়ে। তিনি আধাসামরিক বিদ্যাপীঠে কৈশোর কাটানো নস্টালজিয়া থেকে লিখেছেন খাকি চত্বরের খোয়ারি। দীর্ঘ নয়, বিস্মৃত জীবনের সান্নিধ্য চাওয়া একজন মানুষ শাহাদুজ্জামান। বর্তমান বাংলা কথাসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ একজন লেখক। বহুমাত্রিক লেখক শাহাদুজ্জামানের লেখালেখি এবং তাঁর বিচিত্র ভাবনার জগত নিয়ে কথা হয় এ সময়ের আরেক প্রতিশ্রুতিশীল কথাসাহিত্যিক মাসউদুল হকের সঙ্গে। দীর্ঘ এ আলাপচারিতায় শাহাদুজ্জামানকে অনেকটাই নিঙরে তুলে ধরেছেন মাসউদুল হক। সে আলোচনার অংশ বিশেষ ‘সৃজন’র পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।


মাসউদুল হক :
লেখালেখি কবে শুরু করলেন, কিভাবে শুরু করলেন? বা কোন তাড়না থেকে লেখালেখি শুরু করলেন?

শাহাদুজ্জামান : আমি বেড়ে উঠেছি যে পরিবারের ভেতরে সেখানে আমার বাবা মূলত সাহিত্যের পাঠক ছিলেন। ভীষণ রকম পেটুক পাঠকও বলা যায়। সব রকম বই উনি পড়তেন। আমাদের বাসায় একটা লাইব্রেরি ছিল। আমার মা ছিলেন সাহিত্যের ছাত্রী এবং পরবর্তীতে সাহিত্যের শিক্ষিকা। ফলে বইপত্রের ভেতর দিয়ে আমার শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে। তাতে যেটা হয়েছে যে অক্ষরের ভেতর দিয়ে পৃথিবীকে দেখা, অক্ষরের ভেতর দিয়ে জীবনকে দেখার একটা পাঠ আমার শুরু হয়ে গেছে শৈশব এবং কৈশোরেই। সেটার ভেতর থেকে আপনি বলতে পারেন সাহিত্যের প্রতিও একটা ঘোর তৈরি হয়েছে। সাহিত্যের ভেতর দিয়ে জীবনকে দেখা যায়। অক্ষরের ভেতরে একটা মাদকতা আছে। এ ব্যাপারটা আমার শুরু শৈশবেই। রাজনীতির সাথে শিল্পের সম্পর্ক, আমি শিল্প সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী ছিলাম। কোনটা গুরুত্বপূর্ণ, একটার সাথে আরেকটার কি সম্পর্ক, এগুলো দিয়ে খুব তাড়িত ছিলাম। এবং নানা রকম পড়াশোনা করেছি এগুলো নিয়ে। বিদেশের সাহিত্য, বিদেশের লেখকরা কি বলছেন, কারণ এ বিষয়ে অনেক রকম তাত্ত্বিক বইপত্র আছে। তো সেসব পড়তে পড়তে এক সময় আমার মনে হলো যে এই, ব্যাপারগুলোকে আরেকটু ভালোমত বুঝতে আমি অনুবাদ করা শুরু করি। আমার লেখার শুরুটা হয়েছে অনুবাদ দিয়ে। বেশ জটিল বিষয়ে অনুবাদ দিয়ে।

মাসউদুল হক : সচেতন ভাবে হোক বা অবচেতন ভাবে হোক একজন লেখকের কিন্তু প্রস্তুতি পর্ব থাকে। কোন সময়টাকে আপনি আপনার লেখালেখির প্রস্তুতি পর্ব বলে মনে করেন?

শাহাদুজ্জামান : প্রস্তুতি এই অর্থে যে, সাহিত্যের প্রতি একটা মমতা তৈরি হওয়া। সাহিত্য যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, এটা যে একটা আনন্দের বিষয়, এই বিষয়টা তো একটা প্রস্তুতির অংশ। তখন আমি না লিখলেও সাহিত্যের প্রতি আমার আগ্রহের জায়গাটা শুরু হয়েছে কৈশোরেই। সেটাকে আমি আমার প্রস্তুতি হিসেবে ধরি।

মাসউদুল হক : আপনি শুরু করলেন অনুবাদ দিয়ে। বেশ কিছু সময় পরে আপনি চলে এলেন সৃজনশীল সাহিত্যে। এই অনুবাদে না থেকে সৃজনশীল সাহিত্যে চলে আসা এবং পরবর্তীতে সৃজনশীল সাহিত্যে স্থায়ী হওয়া এই যে আপনার পরিবর্তন। এই পরিবর্তন কি কারণে হলো বলে আপনি মনে করেন?

শাহাদুজ্জামান : আমি এখন যখন বিষয়টি নিয়ে ভাবি তখন মোটামুটি একটা উত্তর খুঁজে পাই। আমি শুরু করেছিলাম একটা প্রশ্ন দিয়ে। আমার লেখালেখির শুরুটা একটা কৌতূহল থেকে। প্রশ্ন থেকে। সৃজনশীলতা ব্যাপারটাই কি? এ নিয়ে আগ্রহী হলাম। তখন আমি নানা রকম সৃজনশীল মানুষের সাক্ষাৎকার নিই। সে সময়ে আমাদের সাক্ষাৎকার নেবার এক ধরণের যে প্রবণতা ছিল, প্রশ্নোত্তর পর্ব। সেগুলোর বাইরে এসে আমি আরেকটু ইনডেপথ ইন্টারভিউ যেটাকে বলে, আমি ইন্টারভিউকে মনে করি ইন্টার এক্সচেঞ্জ অফ ভিউজ। এখানে যিনি সাক্ষাতকার নিচ্ছেন এবং যিনি সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন দুজনেরই একটা সমান প্রস্তুতি থাকবে। এক ধরনের বিতর্কে নিয়োজিত হবো। সে রকম একটা ভাবনা থেকে আমি বেশকিছু স্বনামধন্য লেখক, সাহিত্যিকদের ইন্টারভিউ নিয়েছি। এছাড়া আমার পছন্দের কিছু মানুষ যাদের প্রতি আমার আগ্রহ ছিল যেমন এস এম সুলতান, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ইন্টারভিউ করেছি। আমার যে ব্যক্তি অভিজ্ঞতা সেগুলো আমি অন্যের লেখা অনুবাদ করে, অন্যের সাক্ষাৎকার নিয়ে এক ধরনের আড়াল নিচ্ছি। আমি ফ্রয়েড অনুবাদ করছি, এস এম সুলতানের সাক্ষাৎকার নিচ্ছি, এরকম প্রথিতযশা মানুষের আড়ালে থেকে তাঁদের ঢালটা ব্যবহার করছি। তখন এক সময় মনে হলো, আমি আমার নিজের কথাগুলো বলি না কেন। তাদের এই আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে আমি আমার অভিজ্ঞতার কথা বলি। তখন আমার নিজের কিছু কথা তৈরি হয়েছে। এই কথাগুলো আমার বলা দরকার।

মাসউদুল হক : আপনার লেখা ‘অগল্প’ তে দেখি মূল বিষয় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। পরবর্তীতে আপনার লেখা যদি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করি তবে দেখি যে সেভাবে কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ অনেক জায়গায় আসলেও মুক্তিযুদ্ধকে মূল উপজীব্য করে আপনি আর কিছু লেখেননি। এই কারণটা কি?

শাহাদুজ্জামান : এর উত্তরটা কিন্তু পাওয়া যাবে কেউ যদি অগল্প গল্পটা মনোযোগ দিয়ে পড়ে। এই গল্পের ভেতরে আমার সমাজ ভাবনার বীজ প্রোথিত আছে। অগল্প গল্পটার বিষয় যদিও মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু ওটার আঙ্গিক লক্ষ করলে দেখবেন যে আমি একটা গল্প বলার চেষ্টা করেছি। মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলার চেষ্টা করছি এবং সেটার চেষ্টা করে আমি ব্যর্থ হচ্ছি। তখন আমি আবার আরেকটা গল্প লিখছি। গল্পের ভেতরে গল্প। এই যে আমার প্রথম গল্প লেখা, আমি ঢুকছি একটা জগতের ভেতরে সেটার যে দ্বিধা। আমার মনে হচ্ছে দুটো ব্যাপার। প্রথমত, আমি গল্পটা যেভাবে লিখতে চাই সেভাবে ঠিক হচ্ছে না। আমি পারছি না। এই যে আমি পারছি না, এটাকেই আমি আমার গল্পের বিষয় করে তুলেছি। আর দ্বিতীয় যে বিষয় হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমাদের যে গল্পটা তৈরি করা দরকার, যে স্বপ্নটা আমাদের ছিল, সে স্বপ্নটাও আমাদের তৈরি হয়নি। যে কারণে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গল্পটা ভেঙে গেছে। এই দুটো থিমই গল্পটার ভেতরে আছে। এ কারণেই আমি এটিকে গল্প বলিনি। বলেছি অগল্প।

বইপত্রের ভেতর দিয়ে আমার শৈশব এবং কৈশোর কেটেছে। তাতে যেটা হয়েছে যে অক্ষরের ভেতর দিয়ে পৃথিবীকে দেখা, অক্ষরের ভেতর দিয়ে জীবনকে দেখার একটা পাঠ আমার শুরু হয়ে গেছে শৈশব এবং কৈশোরেই

মাসউদুল হক : আপনি যৌবনে যা লিখেছেন সেগুলোতে সে অর্থে কিন্তু রোমান্টিকতা নেই। আপনাকে তরুণ বয়স থেকেই চরম বাস্তববাদী এবং মেন্টালি খুব ম্যাচিউরড মনে হয়। সে সময়ে সমবয়সীদের সাথে কমুনিকেশন করতে আপনার অসুবিধা হতো?

শাহাদুজ্জামান : প্রথাগত অর্থে যে প্রেম গল্পের ভেতরে, তা হয়তো নেই। তবে আমার গল্পের ভেতরে প্রেম আছে। খুবই সূক্ষ্মভাবে।

মাসউদুল হক : কিন্তু যদি আপনার লেখাগুলো পড়ি তবে দেখবো যে আপনার ভেতরে কবিসত্তা খুব প্রবল। যেমন ধরেন আপনার কাঁঠাল পাতা ও একটি মাটি ঢেলারগল্প। এই গল্পের লাইন যদি আমরা একটার পর একটা সাজিয়ে নেই তবে দেখি যে একটা চমৎকার কবিতা তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু আপনি কখনো কবিতা লিখতে চাননি, বা লেখেননি। এর কারণটা কি?

শাহাদুজ্জামান : সব ধরনের কবিতা বাংলাসাহিত্য বা বিশ্বসাহিত্যের কবিতা আমি পড়েছি। কিন্তু আমি কবিতা লিখতে উদ্বুদ্ধ হইনি। এর আগে আপনি প্রশ্ন করেছেন যে আমার সমবয়সীদের সাথে আমার এক ধরনের দূরত্ব ছিল কি না? হ্যাঁ, সেটা ছিল। কারণ, আমার আশেপাশের যারা সাহিত্য চর্চা করতেন তাঁর ভেতরে খুবই সীমিত মানুষ যারা আমার বন্ধু ছিল এবং আমি আমার ভাবনাগুলো শেয়ার করতে পারতাম। অধিকাংশের সাথেই আমি পারতাম না। শুরুতেই বলছিলাম, আমার নানাবিধ মাধ্যমের সাথে আমার আগ্রহ ছিল সবসময় এবং আমি একটা মাল্টিডিরিূপ্লনারি আগ্রহের জায়গা থেকেই জীবন যাপন করি। অনেকের কাছেই আমার গল্পগুলোকে কবিতা মনে হতে পারে। আপনি কাঁঠাল পাতা ও একটি মাটি ঢেলার গল্পটির কথা বললেন, এই গল্পটা আমি কিছুটা বিস্ময়ের সাথেই দেখেছি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আবৃত্তি অনুষ্ঠানে একটি মেয়ে এটি কবিতা হিসেবে পড়ছে। আমি খুশিই হয়েছি। আমার গল্পকে কবিতা বলে যদি কেউ মনে করে আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার নানা শাখার দেয়াল ভেঙে দেয়ার ব্যাপারে একটা ইচ্ছা আছে।

মাসউদুল হক : একটা বিষয় আপনি বললেন যে, কবিতার পাশাপাশি একটা মাল্টিডিসিপ্লিনারি জায়গায় আপনি কাজ করতেন এবং কাঁঠাল পাতা, ঢেলার গল্পেই দেখা যাচ্ছে আপনি যখন বর্ণনা করছেন রূপবানের কাহিনী সেখানে আপনি দেখছেন যে, একটা শ্বাপদসংকুল অরণ্যে একটা শিশু কোলে নিয়ে একজন রূপবান হেঁটে যাচ্ছে। আমরা দেখি যে, আপনার একটা প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি। এ ধরণের দৃষ্টিভঙ্গী আমরা সাধারণত দেখি যে ফিল্ম যারা তৈরি করে তাদের এই ধরণের একটা প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গী থাকে। অনেক বড় জায়গা নিয়ে দেখা একটা বিষয়কে। তো আপনার সেই জায়গা থেকে আমরা স্বাভাবিক ভাবেই ধারণা করতে পারি চলচ্চিত্র আপনি নির্মাণ করতে পারতেন এবং এই নিয়ে আপনার আগ্রহ আছে। কথা চলচ্চিত্রের নামে এ বছর আপনার একটা বইও বের হয়েছে। এর আগে চ্যাপলিন আজো চমৎকার সেই নামে আপনার একটা বই ছিল। তো সেই কথাটাই জানতে চাচ্ছি যে, এই জায়গাতে আপনি বিস্তর সময় দিয়েছেন একসময়, চলচ্চিত্রের জায়গাতে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণের সাথে যারা জড়িত তাদের সাথে একসময় অনেকটা সময় কাটিয়েছেন আপনি। তারপরে, আপনি শেষ পর্যন্ত এখন আর চলচ্চিত্র বানাবেন কি না আমি জানিনা। কিংবা এ নিয়ে আপনার কোন আগ্রহ আছে কি না?

শাহাদুজ্জামান : একটা নন্দন তাত্ত্বিক জায়গা থেকে, রাজনৈতিক জায়গা থেকে ফিল্মের অনেক বড় সম্ভাবনা দেখতাম। এবং ফিল্ম মেকিংটাকে মানে আমি যদি শিল্পের কোন মাধ্যমের সাথে যুক্ত হই তবে চলচ্চিত্র নির্মাণ করবো এ রকম একটা ইচ্ছাতো ছিল। যখন ফিল্ম আর্কাইভ কোর্স হয় আমি, তারেক মাসুদ একসাথে সে কোর্স করি। ফিল্ম মেকিং এ যুক্ত হয়েছিলাম। আমি ছোট ফিল্ম তৈরিও করেছিলাম। অনুধাবন করলাম আমার জীবন যাপনের যে পদ্ধতি, যে ধরনের পেশার সাথে আমি যুক্ত, আমার পরিবার, জীবন যাপন ইত্যাদি মিলিয়ে চলচ্চিত্রে নির্মাণের জন্য যে জীবনযাপন দরকার আমি অনুভব করলাম যে, এটা আমার পক্ষে খুব দূরহ হবে। আমি তারেককে খুব কাছ থেকে দেখেছি। এবং আমার মনে হয়েছে একজন ফিল্ম মেকারের জীবন যাপন এরকমই হওয়া উচিৎ। যে ধরনের চ্যালেঞ্জ সে নিয়েছে, ফিল্ম তো একই সাথে শিল্প এবং ইন্ডাস্ট্রি,আর্ট এন্ড ইন্ডাস্ট্রি তো সেই ইন্ডাস্ট্রি মেইনটেইন করার জন্য যে শক্তি এবং সময় দরকার আমি অনুভব করলাম যে সেটা আমার পে দেয়া সম্ভব না। বরং লেখাটা এমন একটা কাজ যেটা এক ধরণের নিভৃতে করা যেতা পারে। পৃথিবীর যে প্রান্তে আমি থাকি না কেন, আমার এই মাথাটা আমার সাথে থাকলেই চলে।

ঐতিহাসিকভাবে জানি যে, কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছে। এখন, কে কাকে আবিষ্কার করেছে সেটা একটা প্রশ্নের ব্যাপার। কারণ, ওখানে আদিবাসী যারা তারা হাজার বছর ধরে ওখানে আছেন। আমি প্রথম তাদের দেখলাম বলে আবিষ্কার করলাম, উল্টোভাবে দেখলে আদিবাসীরাও কলম্বাসকে আবিষ্কার করেছে সে সময়ে

মাসউদুল হক : আবার আমরা যদি আরেকটু গভীরে যাই, একাডেমিক সাইড থেকে যদি বিবেচনা করি, বলা হয়ে থাকে যে বাংলাদেশের মেডিকেল এনথ্রোপলজি নিয়ে প্রথম যে বইটি সেটি হচ্ছে ‘একজন হাসপাতাল, একজন নৃবিজ্ঞানী, ও কয়েকটি ভাঙা হাড়’। এবং এটি সম্ভবত আপনি মেডিকেল এনথ্রোপলজিকাল আসপেক্ট থেকেই লিখেছেন, আপনার পিএইচডি থিসিসের অভিসন্দর্ভ ছিল। এবং এটি লিখতে গিয়ে আপনি বলছেন যে, রোগ মানুষেরই বয়সী। রোগের সাথে সংগ্রামও মানুষের আদিম কাল থেকে। একেক সভ্যতায় গড়ে উঠেছে একেক রকম চিকিৎসা ব্যবস্থা। ভারতে আয়ুর্বেদ, চীনে আকু পাংচার, ইউরোপে এলোপ্যাথি, হোমিওপ্যাথি। কালের ধারাবাহিকতায় ইউরোপের চিকিৎসা ব্যবস্থা এলোপ্যাথি পৃথিবীর অন্যতম একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা হিসেবে দেখা দিয়েছে এবং হাসপাতাল হয়ে উঠেছে চিকিৎসার প্রাণ কেন্দ্র। এই প্রেক্ষিতে আমি আপনার কাছে জানতে চাইবো যে, আপনি মূলত একজন চিকিৎসক। হাসপাতাল দিয়ে একটি অভিসন্দর্ভ তৈরি করার ইচ্ছে আপনার কেন জাগলো?

শাহাদুজ্জামান : অধ্যাপনা এবং গবেষণার সাথে চিকিৎসা পেশার সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছিলাম যেন আমি একটু সময় পাই। আমি যে খুব শখ করে মেডিকেলে পড়তে গিয়েছি সেটা না। আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে একটু ভালো রেজাল্ট থাকলে বাবা মা মনে করে যে, ডাক্তার না হয় ইঞ্জিনিয়ার হবে। আমার বাবা ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার সুতরাং পুতুল খেলার মতো আর কি। অর্থাৎ, আমিতো বাবা ইঞ্জিনিয়ার। তুমি একটু ডাক্তার হও। তো, আমি মেডিকেলে পড়তে গেলাম। পড়লাম। কিন্তু দেখলাম যে, পড়ছি ডাক্তারি কিন্তু সাহিত্য তো আমার পিছু ছাড়ে না। আমি তার থেকে বেরোতে পারলাম না। এরপর মেডিকেলে পাশ করে প্রথাগত ডাক্তার না হয়ে আমি মূলত গবেষণার দিকে গেলাম, শিক্ষকতার দিকে গেলাম। আমি পাবলিক হেলথে পড়াশোনা করেছি। তারপরে মেডিকেল এনথ্রোপলজিতে পিএইচডি করেছি। এবং আমার যেহেতু সমাজবিজ্ঞানে আগ্রহ এবং জীবনের অন্যপ্রান্তগুলো নিয়ে আগ্রহ, সংস্কৃতি নিয়ে আগ্রহ, আমি যেটা করলাম যে, হাসপাতাল আমাকে তৈরি করেছে একজন ডাক্তার হিসেবে এই হাসপাতালকে আমি অন্য একটা লেন্স দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। নৃবিজ্ঞানের কাজ হচ্ছে যেকোন কিছুর সাংস্কৃতিক মাত্রাটাকে দেখা। আমি তখন হাসপাতালের ওপর একটা নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণা করলাম। যেটা মূলত হাসপাতালের জীবন, হাসপাতাল কিভাবে আমাদের এই দেশের নানা মাত্রাকে উপস্থাপন করে সেটার উপর ভিত্তি করেই আমার এই বই। এটা আমার পিএইচডি থিসিস ছিল। এটা বলতে পারেন যে, হাসপাতালের একটা সমাজতাত্ত্বিক এবং নৃবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ।

মাসউদুল হক : এই বইটি সে অর্থে বহুল পঠিত নয় বলে আমি মনে করি, তারপরেও আমার মনে হয় যে ইদানীং এই বইটি আগের চেয়ে অনেক বেশি পঠিত হচ্ছে।

শাহাদুজ্জামান : কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের পাঠ্যসূচিতে এটি অন্তর্ভূক্ত আছে। এ ধরণের লেখা যারা নৃবিজ্ঞানে পড়ে তাদের জন্য প্রথম।

মাসউদুল হক : আপনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে ভাবনা ভাষান্তর। ভাবনা ভাষান্তর বইটিতে আপনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমা লেখকদের লেখা অনুবাদ করেছেন এবং যাদের মধ্যে আছে হাওয়ার্ড জিন, কাজানা জাকিচ, কার্ল গুস্তুইয়ং, চিনুয়া আচেবে। বইটি পড়তে গিয়ে আমার কাছে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে হাওয়ার্ড জিনের লেখাটি। কলম্বাস আমেরিকা যে আবিষ্কার করেছিল এটিকে একটু ভিন্ন আঙ্গিকে দেখার চেষ্টা করেছে। এই বিষয়টিকে আপনি আলাদা ভাবে অনুবাদ করার প্রয়োজনীয়তা কেন অনুভব করলেন?

শাহাদুজ্জামান : আমার মূল আগ্রহের জায়গাটা ছিল সমাজ এবং রাজনীতি। যে কারণে আমি যখন সাহিত্য পড়তে যাচ্ছি, ইতিহাস পড়তে যাচ্ছি তখন রাজনৈতিক লেন্সটা আমার সবসময় কাজ করে। আমরা ঐতিহাসিকভাবে জানি যে, কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করেছে। এখন, কে কাকে আবিষ্কার করেছে সেটা একটা প্রশ্নের ব্যাপার। কারণ, ওখানে আদিবাসী যারা তারা হাজার বছর ধরে ওখানে আছেন। আমি প্রথম তাদের দেখলাম বলে আবিষ্কার করলাম, উল্টোভাবে দেখলে আদিবাসীরাও কলম্বাসকে আবিষ্কার করেছে সে সময়ে। কলম্বাস একরকমভাবে আদিবাসীদের দেখেছে, আদিবাসীরাও কিন্তু কলম্বাস সম্পর্কে লিখেছে। তারা কি ভাবছে তাকে নিয়ে। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ হাওয়ার্ড জিন আদিবাসীদের প্রেতি থেকে কলম্বাসকে দেখবার চেষ্টা করেছেন। আমি একটা ছোট উদাহরণ দেই, কৌতূহল উদ্দীপক ব্যাপার, স্পেনিশরা যখন প্রথম আমেরিকায় নামে আদিবাসীরা প্রথম এরকম পোশাক পরা মানুষ দেখে। স্যুট পরা, নানা রকম কাপড় পরা মানুষ। তাদের নিজস্ব ভাষায় তারা এসবের নোট রেখেছে। তাদের স্মৃতি থেকে তারা এসব বিষয় নিয়ে লিখেছে এই যে নতুন একরকম মানুষজন আসলো। খুব মজার বিষয় যে, এমন একটা স্ক্রিপ্ট পাওয়া গেছে সেখানে তারা বলছে যে আমরা ভাবছি যে নিশ্চয়ই তাদের চামড়ায় কোন সমস্যা আছে, রোগ আছে এ কারণে শরীর এভাবে ঢেকে রাখা হয়েছে। তাদের কাছে পোশাকটা খুব একটা ইম্পরট্যান্ট একটা ব্যাপার না ঐ কাইমেটে। হাওয়ার্ড জিন বলছেন যে, কলম্বাস সম্পর্কে আমেরিকায় যে ইতিহাস শেখানো হয় তার একটা ভিন্ন ইতিহাস আছে। যেটা আদিবাসীর দৃষ্টিকোণ থেকে। উনি সেই, ইতিহাসটা এক্সপ্লোর করেছেন। করে প্রকাশ করেছেন। আমি এটা পড়ে খুবই চমৎকৃত হয়েছিলাম। আমি ভাবলাম যে, এই দৃষ্টিকোণটাকেও প্রচার করা দরকার। এই ভাবনা থেকেই অনুবাদটি করা।

মাসউদুল হক : বুদ্ধিবৃত্তিক অনুবাদের বাইরেও আপনার একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদগ্রন্থ আছে সেটি হচ্ছে ক্যাঙ্গারু দেখার শ্রেষ্ঠ দিন। সম্ভবত বিদেশী গল্পের এটিই আপনার প্রথম অনুবাদ ছিল। ক্যাঙ্গারু দেখার শ্রেষ্ঠ দিনটি লেখার পেছনে আপনার কি অনুপ্রেরণা কাজ করেছে?

শাহাদুজ্জামান : আমি যখন একটা পর্যায়ে গল্প লিখতে শুরু করলাম তখন গল্প লিখে আনন্দ পাচ্ছি, আবার এমন একটা সময় আসে যখন তাকে রাইটার্স ব্লক বলে, আমি নতুনভাবে আর গল্প লিখতে পারছি না। সেই ইন্সপায়েরেশনটা পাচ্ছি না। ওরকম একটা ব্লকের সময় আমার মনে হলো যে গল্প লিখতে হাত নিশপিশ করছে। আদ্রেজ জিতকে একজন প্রশ্ন করেছিল, যে আপনি লেখেন কেন? উনি বললেন যে, না লিখলে আমার হাত ব্যথা করে। অনেকে যেমন বলে যে, লিখলে হাত ব্যথা করে, ওনার না লিখলে হাত ব্যথা করে। আমার মনে হচ্ছিল যে, গল্প লিখতে পারছি না এতে আমার এক ধরণের কষ্ট হচ্ছে।

মাসউদুল হক : মানসিক যন্ত্রণা।

শাহাদুজ্জামান : হ্যাঁ। যখন গল্প লিখতে পারছিলাম না, তখন আমি অন্যের গল্প অনুবাদ করা শুরু করলাম। অনুবাদ করার ভেতর দিয়ে গল্প লেখার আনন্দটাকে অনুভব করার চেষ্টা করলাম। তারই ফসল এই বইটি।

মাসউদুল হক : আমরা যদি খেয়াল করি তবে দেখবো এই ক্যাঙ্গারু দেখার শ্রেষ্ঠদিনের পরপরই আপনি মহাশূন্যে সাইকেল নামে বাংলা সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ গল্প লিখেছেন। এবং মহাশূন্যে সাইকেলের আগের লেখা গল্পগুলো এবং পরের লেখা গল্পগুলোর মধ্যে আঙ্গিকে একটা বড় পরিবর্তন রয়েছে। আপনি আগে একটু ছোট আকারের গল্প লিখতেন, আমরা দেখি যে এরপরে যে গল্পগুলো লিখলেন তা দৈর্ঘ্যে অনেক বড় এবং বিষয় ভাবনাতেও পরিবর্তন এসেছে। এটি আপনি নিজে ধরতে পারেন কি না? এবং কারণ কি বলে মনে হয়?

শাহাদুজ্জামান : আমি সচেতনভাবে এটি খেয়াল করিনি। কিন্তু আপনি বলার পরে যেটা ভাবা যেতে পারে যে, হ্যাঁ আমার সে সময়টায় জীবন যাপনের ভেতরে একটা পরিবর্তন হয়েছে। আমি বিদেশে থাকা শুরু করি। বিদেশে পড়াশোনা করতে যাই। সেগুলোর কারণে এক ধরনের নতুন বোধদয় হয়। দেশের সাথে একটা দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। আবার দেশের নৈকট্যের জন্য প্রচণ্ড একটা আকাক্সক্ষা আছে। এই যে একটা দ্বন্দ্ব, এই দূরত্বের বোধটা নিয়েই গল্পটা। এবং সেটা বলতে পারেন যে, আমার এই ব্যক্তি জীবনের এই পরিবর্তনের কারণ।

মাসউদুল হক : দূরত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা। খুব কাছাকাছি শব্দ কিন্তু যদি এর প্রকাশ ভঙ্গি বলি, এ দুটোর ভেতরে যে ওয়েট এটার মধ্যেও কিন্তু অনেক পার্থক্য। এই দুটো শব্দকে কাছাকাছি নিয়ে আসা এবং বিচ্ছিন্ন করে দেখানো এই ভাবনাটি আপনার নিজস্ব, মৌলিক কি না?

শাহাদুজ্জামান : এটা মৌলিক কি না জানি না তবে গল্পে ঠিক এই বিষয়টি এর আগে ঠিক গল্পে আমি কাউকে চর্চা করতে দেখিনি। এটা আমি পাঠকের জায়গায় ছেড়ে দিলাম। তারা গল্পটি পড়লে অনুধাবন করবে কেন এ শব্দ দুটি নিয়ে আমি এক ধরণের খেলা খেলেছি।

মাসউদুল হক : আপনি যে গল্প লেখেন, সেখানে কিন্তু সেভাবে নারী চরিত্র উপজীব্য করে লেখেন না। আপনার গল্পগুলোতে কিংবা উপন্যাসগুলোতেও নারী চরিত্র খুব একটা প্রাধান্য পায় না। এবং আমরা খুব একটা উপস্থিতিও দেখি না নারী চরিত্রের। দেখা যায় কোথাও কোথাও নারী চরিত্র হয়তো আছে। কিন্তু মূল উপজীব্য নয়। একটা চরিত্রকে প্রকাশ করার জন্য হয়তো আপনি একজন নারী চরিত্রকে নিয়ে এসেছেন। এটা কি আপনি সচেতনভাবেই করেন না কি আপনার মনে হয় যে নারী চরিত্র নিয়ে কাজ করা একটু দূরহ?

শাহাদুজ্জামান : প্রচলিত অর্থে সবসময় নারী পুরুষের প্রেমকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় সেভাবে হয়তো নেই। আমার গল্প ‘আন্না কারেনিনার জনৈক পাঠিকা’র মূল চরিত্র একজন নারী। ‘অন্য এক গল্পকারের গল্প নিয়ে গল্প’ এই গল্পেরও মূল চরিত্র একজন নারী। তারপরে ‘চীনা অর এবং দেয়াল’ সেখানেও নারী চরিত্র রয়েছে।

মাসউদুল হক : খুব বিখ্যাত গল্প ‘জ্যোৎস্না লোকের সংবাদ’ এ রিজিয়া নামে নারী চরিত্র রয়েছে।

শাহাদুজ্জামান : হ্যাঁ, এই গল্পটি মূলত একজন নারীকে কেন্দ্র করেই।

আমি মনে করি যে, একজন লেখককে যেমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে কি লিখবে, পাশাপাশি তাকে এই সিদ্ধান্তও নেয়া উচিৎ সে কি লিখবে না। আমি নানা বিষয় দিয়ে তাড়িত হই। কিন্তু এটাও ঠিক যে, আমি এক ধরনের সেন্সর করি

মাসউদুল হক : যারা লেখালেখি করেন তারা লেখক হিসেবে কিছু সেলফ সেন্সরশীপ আরোপ করেন। যেমন ধরেন, আমি লিখতে গিয়ে ভাবি যে আমি যে লেখাটা লিখছি এটি যদি আমার স্ত্রী পড়েন তবে কি ভাববেন, আমার সন্তান যদি পড়ে সে আমার সম্পর্কে কি ভাববে। এভাবে করে কিন্তু আমরা অনেক কিছু থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেই। আপনি ব্যক্তিগতভাবে একজন লেখক হিসেবে কোন কোন বিষয়গুলোতে সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করেন?

শাহাদুজ্জামান : আমি মনে করি যে, একজন লেখককে যেমন সিদ্ধান্ত নিতে হবে সে কি লিখবে, পাশাপাশি তাকে এই সিদ্ধান্তও নেয়া উচিৎ সে কি লিখবে না। আমি নানা বিষয় দিয়ে তাড়িত হই। কিন্তু এটাও ঠিক যে, আমি এক ধরনের সেন্সর করি। আমি কোনটা নিয়ে লিখবো, কোনটা নিয়ে লিখবো না। ব্যক্তিগতভাবে যদি বলি, আমার লেখা আমার পরিবারের সবাই পড়ে। আমার স্ত্রী আমার যেকোনো গল্পের প্রথম পাঠিকা সে। তার মন্তব্য নিয়ে আমি লেখা ছাপাই। সে খুবই বোদ্ধা পাঠিকা। সে টা আমি ভেবে করি না। তবে খুব গভীর অর্থে বলা যায় যে, অনেক কথা আছে আমরা মুখে সবাইকে বলি। আবার কিছু কথা আছে আমরা কিছু মানুষকে বলি। আবার কিছু কথা আছে আমরা কেবল নিজেকে বলি। আবার এমন কিছু কথা থাকে যা আমরা নিজেকেও বলি না। একেবারে ভেতরের গোপন কিছু কথা। অনেক বড় মাপের লেখকেরা কিন্তু এই চার ধরনের কথাকে আনতে পারে। আমি স্বীকার করবো যে, একদম যে কথাগুলো আমি নিজের সাথেও বলতে ভয় পাই সে কথাগুলো যদি সাহিত্যে আনা যায় এটা অসাধারণ একটা জায়গায় যাবে। আমি এখনও সেটা আনতে পারিনি। আমি সে জায়গা গুলো ছুঁতে পারিনি।

মাসউদুল হক : আপনার উপন্যাসের নায়কেরা সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার উপর খুব দুর্বল। মূলত আপনারও যে এই সমাজব্যবস্থার উপর দুর্বলতা আছে সেটাও আপনি লুকান না। ‘জ্যোৎস্না লোকের সংবাদ’ গল্পটিও উত্তম পুরুষে বর্ণনা করা এবং শেষ পর্যন্ত দেখা যায় যে, সেই গল্পেও আপনি সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রতি আপনার যে দুর্বলতা সেটি লুকাননি। এই যে সারা পৃথিবীতে বিশ্বায়নের কারণে পরিবর্তন হয়ে গেল, সমাজতন্ত্রের পতন হলো, ধনবাদী সমাজের উত্থান হলো, আর সত্তরের দশকে আপনি যে স্বপ্নটি দেখেছিলেন। এর মধ্যে কিন্তু বিস্তর ফারাক হয়ে গেছে। এখন আপনি এত বছর পরে এসে যদি আপনার ভাবনাকে মূল্যায়ন করেন তবে একে কিভাবে দেখেন?

শাহাদুজ্জামান : আমরা যে প্রজন্মের মানুষ সে সময়ে পৃথিবীটা দুইভাগে বিভক্ত ছিল। একটা পুঁজিবাদী বিশ্ব, আরেকটা সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব। যেকোন সচেতন, বিবেকবান তরুণ তরুণীর জন্য সে সময়ে একটা বৈষম্যহীন, সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন দেখাটা স্বাভাবিকই ছিল। আমরা চেয়েছিলাম তা। আমাদের জেনারেশন সে জায়গাটাতে সময় ব্যয় করেছি। সেই স্বপ্নটাকে আরেকটু সামনে নিয়ে যাওয়ার জন্য। নিঃসন্দেহে আমার শুরুটা সেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শ থেকে তার প্রতি দুর্বলতা আমার আছে। কিন্তু আপনি যেটা বললেন যে, সময়ের সাথে সাথে তো পৃথিবীর এই সমাজতন্ত্রের ভাঙন হয়েছে। ‘বিসর্গ তে দুঃখ’ নামে আমার একটা বই রয়েছে। সে বইটা কিন্তু ঐ ভাঙনের সময়টাকে নিয়েই। আমরা যারা স্বপ্ন দেখেছিলাম এবং স্বপটা আমরা চোখের সামনে ভেঙে যেতে দেখেছি কিন্তু স্বপ্নটাকে ছাড়তে পারছি না। অনেকটা প্রেম ভেঙে যাওয়ার মতো। প্রেম ভেঙে গেছে কিন্তু প্রেমিকাকে ভুলতে পারছি না। এই যে একটা মাঝখানের সময় সমাজতন্ত্রের ব্যাপারটাও তেমন। বিসর্গ তে দুঃখও সেরকম একটা মানসিক অবস্থা থেকে লেখা। আজকের পৃথিবীতে নানা বিবর্তনের ভেতর দিয়ে একটা বিশেষ পর্যায়ে আমরা এসে পৌঁছেছি। এই মুহূর্তে আমি মনে করি না যে বাজার অর্থনীতি পৃথিবীর সমাধান। আবার সেভাবে আমরা সমাজতান্ত্রিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলাম সেখানেও নানা সীমাবদ্ধতা ছিল। এখন নতুন সমাজের নানা রকম ভাবনা হচ্ছে। এই দুটো বোধের একটা সংশ্লেষের কথাবার্তা হচ্ছে। অনেক নতুন তত্ত্ব দাঁড়িয়েছে। সেগুলোর দিকে আমি লক্ষ্য রাখছি। সুতরাং আমি মনে করি যে, নতুন করে ভাবার জায়গা আছে।

মাসউদুল হক : আপনার উপন্যাসগুলো ‘বিসর্গ তে দুঃখ’, ক্রাচের কর্নেল, এবং অন্যটি হচ্ছে এ বছরে প্রকাশিত ‘একজন কমলালেবু’। এই তিনটি উপন্যাস তিনটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের উপরে। বিসর্গ তে দুঃখ নিয়ে আপনি খানিকটা আলোকপাত করেছেন। এর বাইরে আমি বলতে চাই যে, ক্রাচের কর্নেল বইটি কর্নেল তাহেরকে উপজীব্য করে লেখা। এই ভাবনাটি আপনার কেন এল যে কর্নেল তাহেরকে উপজীব্য করে উপন্যাস লিখবেন?

শাহাদুজ্জামান : ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৫, এই সময়টা বাংলাদেশের ইতিহাসের জন্য সবচেয়ে নাটকীয় একটা সময়। আমি এ সময়টাকে বুঝতে চেষ্টা করেছি। এবং আমি যেটা বারবারই বললাম যে, প্রশ্ন দিয়ে তাড়িত হয়েছি। আমার প্রশ্ন ছিল যে, বাংলাদেশের ইতিহাসকে যেভাবে নানাভাবে বিকৃত করা হয়েছে, নানা রকম ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছে, পৃথিবীর খুব কম দেশেই এমন ইতিহাস নিয়ে এতরকম টানা হেঁচড়া করা হয়েছে। আমরা যে প্রজন্মে বড় হয়েছি, পরবর্তী প্রজন্মেও এক ধরণের বিভ্রান্তি তৈরি করা হয়েছে। আমার চিন্তাটা ছিল যে, কোন নির্দিষ্ট প্লাটফর্মের বাইরে দাঁড়িয়ে যতোটা সম্ভব একটা নিরপেক্ষ জায়গা থেকে ইতিহাসের ঐ সময়টার দিকে তাকানো। বলতে পারেন যে, আমি এমন একটা মানুষকে নিয়েছি যে পরাজিত একজন মানুষ। জয়ীরা তাদের মত করে ইতিহাস তৈরি করে। পরাজিত একটা মানুষ, তার একটা স্বপ্ন ছিল, সে সেই স্বপ্নটাকে, আদর্শের জায়গায় নিজেকে নিবেদন করতে গিয়ে একটা মানুষ যা যা বিসর্জন দিতে পারে, উনি সেটা দিয়েছেন। উনি ওনার অনেক বড় সামরিক চাকরী ছেড়েছেন। ওনার একটি পা হারিয়েছেন। উনি ওনার জীবনও দিয়েছেন। একটা আদর্শকে নেবার জন্য বা প্রতিষ্ঠার জন্য। আদর্শটাকে নিয়ে আমরা বিতর্ক করতে পারি। তার সাফল্য নিয়ে আমরা বিতর্ক করতে পারি, তাকে রোমান্টিক বলতে পারি, তাকে হঠকারী বলতে পারি, এই বিতর্ক চলতে পারে। আমার মূল উদ্দেশ্যটা হচ্ছে সেই স্পিরিটের দিকে লক্ষটা করা। এমন একটা প্রজন্ম এখন বড় হচ্ছে যে নিজের বাইরে ভাবার সুযোগ এত কমে গেছে। এমি এখন একটা কথা বলি যে, মিউজিয়াম অফ মি। সবকিছু আমাকে কেন্দ্র করে। এবং আমার বাইরে একটা কিছুর জন্য যে জীবনকে দেয়া যায়, এই ভাবনাগুলোই আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে।

মাসউদুল হক : আমরা সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছি।

শাহাদুজ্জামান : এই মানুষটাকে উপস্থাপন করা, তার রাজনীতি নিয়ে আমরা বিতর্ক করি, ঠিক আছে। কিন্তু এই বাংলাদেশেই কিছু কিছু মানুষ, ইউনিভার্সিটি, বুয়েট তারা সবকিছু ছেড়েছুড়ে দিয়ে দেশের জন্য একটা কিছু করতে চাচ্ছে। এই স্পিরিটটাকেই আমি ধরতে চেয়েছি।

মাসউদুল হক : শাহবাগ ১৩ ও সেই স্পিরিট থেকে লেখা?

শাহাদুজ্জামান : শাহবাগ আন্দোলনকে আমি বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটা ঘটনা বলে মনে করি। বাংলাদেশের বাঁক ফেরানোর। আবারো বলি যে, শাহবাগ নিয়ে তর্ক বিতর্ক হতে পারে, এর পক্ষবিপক্ষ, এটা কার এজেন্ডা ছিল, এটা কি একটা ষড়যন্ত্র কি না, সে নিয়ে বিতর্ক চলতে পারে কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই ঘটনাটা ঘটেছিল। এবং এই ঘটনাটার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির একটা মোড় ঘুরে গিয়েছিল। নাইনটিন্সিক্সটি এইটে প্যারিসে এমন একটা মুভমেন্ট হয়েছিল। পনেরদিনের মতো এই আন্দোলন ছিল এবং পরে তা বন্ধ হয়ে গেছে। এই মুভমেন্ট ফ্রান্স তো বটেই পুরো ইউরোপের ইতিহাস বদলে দিয়েছে। আজকে যখন ওদের ইলেকশন হয় তখন প্যারিসের এই আন্দোলনের কথা আসে। আমি মনে করি যে, শাহবাগের যে পরিবর্তনটা হয়েছে, কিছু কিছু জিনিসের অভিঘাত বুঝতে অনেক সময় দিতে হয়। ইতিহাসের একটা গতি যে ঘুরেছে সেটা ওই সমাবেশের জায়গায়। একইভাবে আমি সে সময়টাকে বুঝতে চেয়েছি আমার মত করে যে, কেন হঠাৎ করে ব্যাপারটা ঘটলো।

শারীরিকভাবে আমি কোথায় অবস্থান করছি তার চেয়েও অনেক বড় ব্যাপার আমি মানসিকভাবে কোথায় নিজেকে বিলং করি। আমি বহু ছেলে পেলেকে দেখি, বহু মানুষকে দেখি উনি বাংলাদেশে থাকেন কিন্তু সমস্ত মাথা মন হচ্ছে বিদেশে

মাসউদুল হক : সে সময়টায় যখন আমাদের দেশে শাহবাগ আন্দোলটা চলে আপনি কিন্তু তখন দেশের বাইরে। তো, আপনি ইংল্যান্ডে বসে যখন দেখতেন বিষয়টাকে তখন আপনি কিভাবে এই বিষয়টার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে বিষয়টাকে এনালাইসিস করতেন?

শাহাদুজ্জামান : শারীরিকভাবে আমি কোথায় অবস্থান করছি তার চেয়েও অনেক বড় ব্যাপার আমি মানসিকভাবে কোথায় নিজেকে বিলং করি। আমি বহু ছেলে পেলেকে দেখি, বহু মানুষকে দেখি উনি বাংলাদেশে থাকেন কিন্তু সমস্ত মাথা মন হচ্ছে বিদেশে। সারাক্ষণ উনি ঘুরছেন এই স্বপ্ন নিয়ে যে কোনদিন উনি ইউরোপের মাটিতে পা রাখবেন। কিন্তু আমি ইউরোপে থাকলেও আমার সমস্ত মন, সত্তা থাকে বাংলাদেশে। এবং আমি আমার সমস্ত ইফোর্ট আমি বাংলাদেশকে দিয়ে দিই। আমি লিখি এইখানে, আমার ভাষায় আমি লিখি, আমি রেগুলার এখানে আসি। যখন এখানে আসি, সব রকমভাবেই আমি আমার সময়টাকে ব্যয় করি বাংলাদেশের পেছনে। আপনি হোচিমিনের নাম জানবেন। হোচিমিন ৫২ বছর বয়সে ভিয়েতনামে এসেছেন, উনি সারাজীবন প্যারিসে থাকতেন। কিন্তু সমস্ত ভিয়েতনামের ইতিহাস উনি বদলে দিয়েছেন। আমি মনে করি যে, কোথায় আমি শারীরিকভাবে আছি, তার চেয়ে মানসিকভাবে কোথায় আছি সেটা ইম্পরট্যান্ট।

মাসউদুল হক : একজন কমলালেবু, যেটি এবছর বের হয়েছে। একটি পত্রিকাতে আমরা দেখেছি যে বিশেষভাবে আলোচিতই হয়েছিল। যখন ঈদসংখ্যায় বের হয়েছিল। তারপর বোধহয় আপনি আঙ্গিকে অনেক পরিবর্তন এনেছেন। পরবর্তীতে আরো কাজ করেছেন। এ বিষয়ে আমি জানতে চাই যে, আপনি জীবনানন্দকে নিয়ে উপন্যাস লেখার আগ্রহ বোধ করলেন কেন?

শাহাদুজ্জামান : এটা নিয়ে আমি একটা ছোট লেখা লিখেছি। এটার ব্যাকগ্রাউন্ডটা। আমার তাহলে আরেকটু পেছনে যেতে হয়, আমি যখন ক্যাডেট কলেজে পড়ি তখন ক্যাডেট কলেজে তো একটা বন্দী জীবন ছিল। আমি যদ্দুর জানি আপনারও সে ব্যাকগ্রাউন্ড। আপনি ক্যাডেট কলেজের জীবন সম্পর্কে জানেন। এক ধরনের গন্ডির জীবনের ভেতরে বড় হচ্ছিলাম। কিন্তু আমার মনটা সবসময়েই গন্ডির বাইরে যেতে চাইতো। খাকি পরে প্যারেড পিটি করি। মায়াকোভোস্কির একটা কবিতা আছে পাতলুন পরা মেঘ। আমি তখন নিজেকে ভাবতাম খাকি পড়া মেঘ। কারণ, থাকতাম ওখানে কিন্তু মনটা থাকতো বাইরে। আমাদের একজন বাংলা শিক্ষক একদিন ক্লাসে এসে বললেন, তোমাদের সিলেবাসে তো অনেক রকম কবি আছে। তো, আমি মাইনর কবিদের কোনো কবিতা পড়াবো না। আমি শুধু মেজর কবিদের কবিতা পড়াবো। আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। মেজর-মাইনরের ব্যাপারটায় বিভ্রান্ত হয়ে যাই। তারপর উনি বললেন যে, আমি একটা মেজর কবির কবিতা তোমাদের শোনাই। এ কথা বলেই উনি আমাদের সিলেবাসের বাইরে জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটা শোনালেন। এই কবিতাটা এক ধরনের ঘোর তৈরি করলো। আমি ওই লেখায় লিখেছিলাম যে, তখন শুনতাম ছেলেধরা বস্তাবন্দী করে নিয়ে যায় লোকজনকে। আমার মনে হলো এই কবিতাটা আমাকে বস্তার ভেতরে ভরে ক্যাডেট কলেজের বাইরে নিয়ে গেল। এরপর জীবনানন্দের কবিতা আমি পড়তে শুরু করলাম। আমি মার্চপাস্ট করি আর আমার মাথার ভেতরে ঘোরে চমৎকার, ধরা যাক দু-একটি ইঁদুর এবার। কিন্তু আমি যখন লিখতে শুরু করলাম, গল্প লিখছি কিন্তু অনুভব করলাম জীবনানন্দের আবহ আমার ভেতরে তৈরি হচ্ছে। আমার একটা বইয়ের নাম আছে, পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ, এটা জীবনানন্দ দাশের লেখা থেকে নেয়া। মারাত্মক নিরুপম আনন্দ নামের আমার একটা গল্প আছে, সেটাও জীবনানন্দের কথা। অন্য এক গল্পকারের গল্প, সেটাও জীবনানন্দ দাশের একটা গল্প নিয়ে লেখা। আমার একসময় একটা বোধ হলো যে, জীবনানন্দ আমাকে এক ধরনের আছড় করেছে। সিন্দাবাদের ভূতের মতো আমার ঘাড়ের উপর বসেছে। আমার এই ভর থেকে আমাকে আছড়মুক্ত হতে হবে। আমি জীবনানন্দকে নিয়ে একটা বই লিখবো। তাহলে আমি এই সিন্দাবাদের ভূতকে নামাতে পারবো আমার মাথা থেকে।

মাসউদুল হক : এই দুটো উপন্যাস নিয়ে কিছুটা সমালোচনাও আছে। কোন কোন সমালোচক মনে করেন এটি আসলে সে অর্থে উপন্যাস নয়। কেউ কেউ বলছেন ডকুফিকশন। আপনি এই সমালোচনাকে কিভাবে এড্রেস করেন?

শাহাদুজ্জামান : আমার লেখাগুলোকে আমি একটা সাহিত্যকর্ম হিসেবে দেখি। এটাকে লেভেল দেয়ার দায়িত্ব পাঠকের। এটাকে কেউ যদি কবিতা বলতে চায়, উপন্যাস বলতে চায়, জীবনী বলতে চায় আমার কোনো আপত্তি নেই। আমি উপন্যাসিক হবার জন্য লিখিনি। আমি জীবনানন্দকে বুঝবার জন্যে এটা লিখেছি। সেখানে আমি যেটা সবসময় করি, অন্যান্য মাধ্যমের যে সম্ভাবনাগুলো আছে আমি সবগুলোকে কাজে লাগাতে চাই। কবিতার যে উপাদান আছে, প্রবন্ধের যে উপাদান আছে, গবেষণার যে উপাদান আছে এগুলোকে আমি এক জায়গায় আনি। এটাকে এজন্য জীবনী বলিনা কারণ জীবনী যারা লেখেন যেমন প্রভাত কুমার দাশ জীবনানন্দের জীবনী লিখেছেন। তিনি একধরনের অবজেক্টিভ থেকে ওনার জীবনকে বর্ণনা করেছেন পুরোটা। এটা গবেষণা বই না। গবেষণা করেছেন কিনটন বুথ সিলি। সেটার কাজ হচ্ছে একটা থিয়োরি বিল্ড আপ করা। আমি জীবনানন্দের জীবনকে কিন্তু অবজেক্টিভলি দেখিনি। এটা আমার একটা সাবজেক্টিভ প্রেজেন্টেনশন। জীবনানন্দের প্রতি আমার একটা ব্যাক্তিগত জার্নি। সুতরাং এটা সে অর্থে জীবনী নয়। আবার কোন থিয়োরি বিল্ড আপ আমি করিনি যে একে গবেষণা বলা যাবে। এটা ভূমেন্দ্রগূহের মত স্মৃতিচারণও না। এটাকে আমি গল্পও বলতে পারছি না। একে কবিতাও বলা যাবে না। একটা নাম যদি দিতে হয়, আমি মনে করি উপন্যাসের সংজ্ঞাকে আরো বিস্তৃত করার সুযোগ আছে। উপন্যাস মাধ্যমটা কিন্তু দুশ তিনশো বছরের, বেশি পুরনো নয়। এর আগে উপন্যাস বলে কিছু ছিল না।

মাসউদুল হক : এটাকে স্ট্রাকচারালাইজড করারও কোনো মানে হয় না।

শাহাদুজ্জামান : আমাদের সমস্যা যেটা হয় যে আমরা ক্যাটাগোরাইজেশন করতে অভ্যস্ত। একটা বই যখন আমরা নেই তখন আমরা একে ক্যাটাগোরিতে ফেলি। যেমন, আমি এখন একটা কবিতার বই পড়া শুরু করবো। বা আমি একটা উপন্যাস পড়ার জন্য বইটা খুলছি। পড়তে গিয়ে কিছুক্ষণ পর দেখি যে, একটু কবিতা হচ্ছে আবার দেখি যে কোথাও ইন্টারপ্রেটিশন হচ্ছে। ব্যাখা, সাহিত্য সমালোচনা হচ্ছে। কিছু কিছু পাঠকের জন্য এটা খুব বিরক্তিকর। আমি সে ধরনের পাঠককে একটু পুশও করতে চাই। উপন্যাসের সংজ্ঞা এক রকম ছিল, এখন এক রকম আছে, ভবিষ্যতে কি হবে আপনি বলতে পারেন না। সে অর্থে আমি মনে করি যে, এটা একটা নতুন ভাবে উপস্থাপন করা।

মাসউদুল হক : অসাধারণ কিছু অনুবাদ, গবেষণা, প্রবন্ধের বই থাকার পরও আপনি কিন্তু ধীরে ধীরে কথা সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি পাওয়া শুরু করেছেন। আপনাকে যদি আমরা শুধুমাত্র কথাসাহিত্যিক হিসেবেই ব্র্যান্ডিং করি তাহলে দেখা যাচ্ছে যে আপনার অনেকগুলো অনুবাদ কর্ম, অনেকগুলো গবেষণা কর্ম, ডকুফিকশন যেমন আধো ঘুমে ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে, এগুলো আড়ালে পড়ে যাবার আশংকা আছে বলে আপনি মনে করেন কি না?

শাহাদুজ্জামান : উপন্যাস্যিক যেমন একটা নির্দিষ্ট পরিচয়ে নিজেকে উপস্থাপন করতে চান বলে লিখছেন। আমি সেভাবে কখনো ভাবিনি যে একটা নির্দিষ্ট ক্যাট্যাগরিতে আমার কাজ করতে হবে। যেমন, আমার ক্রাচের কর্নেলের কিছু পাঠক আছে যারা আমার গল্প কখনও পড়ে না। আবার আমার গল্পের পাঠক আছে যারা আমার ক্রাচের কর্নেলকে কোন কাজই বলে মনে করে না। আমি কলাম লিখি। আমার শুধুমাত্র কলামের কিছু পাঠক আছে। সেই দিক থেকে আমি মনে করি যে আমার যদি বিভিন্ন ধরনের পাঠক থাকে আমার ব্যাক্তিগতভাবে কোনো অসুবিধা নেই।

লেখার ভেতর দিয়ে একটা দ্বিতীয় জীবন যাপন করি। আমি একজন চাকুরীজীবী হিসেবে, একজন স্বামী হিসেবে, একজন পিতা হিসেবে, সন্তান হিসেবে একটা জীবন আমি যাপন করি

মাসউদুল হক : আপনি ব্রিটেনের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছেন, অধ্যাপনা করছেন। এ ধরনের বড় একাডেমিক দায়িত্ব পাওয়ার পাশাপাশি এত রকরম লেখালেখিও করছেন। এই ভারসাম্যটা রাখেন কি করে?

শাহাদুজ্জামান : এটি নিঃসন্দেহে বেশ কঠিন। একদম সুতোর উপরে হাঁটার মতো। একটা পেশার ভেতরে যখন আছি, তখন অন্যান্য শিল্প মাধ্যমের প্রতি যে লোভ তা ছাড়তে চাই না। একটাই তো জীবন। একটা পর্যায়ে আমাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। আমি সবচেয়ে খুশি হতাম আমি যদি লেখাকে পেশা হিসেবে নিতে পারতাম। আমি সম্পূর্ণ সময় এবং শ্রমকে যদি লেখায় দিতে পারতাম। কিন্তু আমি এমন একটা সময়ের দেশের বাসিন্দা আমাকে লেখাকে পেশা হিসেবে নেয়া কঠিন। কিংবা যদি নেই তবে আমাকে এমন অনেক লেখা লিখতে হবে যেটা আমার প্রাণের লেখা না। সে কারণে আমি দুটো পেশা রক্ষা করছি। দেখা যায়, আমার দিনের বেলার পেশা হচ্ছে অধ্যাপনা। আমার রাতের চাকরী হচ্ছে লেখালেখি। আমি রাতে লিখি। কিন্তু, এটাকে ভারসাম্য করতে হয়। আমাকে যে কারণে অনেক সামাজিকতাকে বর্জন করতে হয়। এবং একটা ডিসিপ্লিনে জীবনকে চালিত করতে হয়। কিন্তু এটা কঠিন। সহজ না।

মাসউদুল হক : এ বছর বাংলা একাডেমি পুরষ্কার পেলেন। তবে আমরা যদি খেয়াল করি যে, ১৯৯৬ সালে আপনি মাওলা ব্রাদার্স তরুণ কথাসাহিত্যিক পুরষ্কার পেয়েছিলেন। এবং ৯৬ সাল থেকে শুরু করে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এই সময়টাকে যদি আমি ধরি দীর্ঘ সময় কিন্তু সে অর্থে কিন্তু আপনার কোন প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই আপনার লেখালেখির। তখন কি আপনি কখনো উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছিলেন?

শাহাদুজ্জামান : আমার লেখার অনুপ্রেরণা হচ্ছে প্রশ্ন। জিজ্ঞাসা। আমি লিখে গেছি। আমি খুবই আনন্দের সাথে লিখেছি। একটা কাজ ভালোবেসে শ্রম দিয়ে করলে স্বীকৃতি পেলে অবশ্যই ভালো লাগে। কিন্তু এটি আমাকে উৎসাহিত কিংবা নিরুৎসাহিত করার ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা রাখেনি। উৎসাহিত হয়তো করে, কিন্তু স্বীকৃতি না পেলে লিখবো না তাহলে তো বহু আগেই লেখা ছেড়ে দিতাম।

মাসউদুল হক : আশির দশকের মধ্যভাগ থেকে লিখছেন। এবং আজকে ২০১৭ সাল। তো, আমরা ধরতে পারি যে শাহাদুজ্জামান লিখছেন প্রায় ত্রিশ বছর ধরে। এই ত্রিশ বছর লেখালেখির জগতে যে ব্যয় করলেন। এই সময়টাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?

শাহাদুজ্জামান : লেখার ভেতর দিয়ে একটা দ্বিতীয় জীবন যাপন করি। আমি একজন চাকুরীজীবী হিসেবে, একজন স্বামী হিসেবে, একজন পিতা হিসেবে, সন্তান হিসেবে একটা জীবন আমি যাপন করি। কিন্তু এর বাইরে আমার অন্তরের যে একটা জীবন আছে, সে জীবন যাপন করার একটা তৃষ্ণা আমার সবসময় আছে। এবং সেই তৃষ্ণাটা আমি মেটাই অক্ষর দিয়ে একটা দ্বিতীয় জীবন তৈরি করার মাধ্যমে। এই যে এত বছর ধরে আমি করে যেতে পেরেছি, সেটা আমি মনে করি আমার একটা সমান্তরাল জীবন। এবং এই সমান্তরাল জীবন যে আমি যাপন করে যেতে পারছি সেটা আমার জন্য ভীষণ আনন্দের এবং নানা রকম প্রতিকূলতার ভেতরেও আমি করে গেছি। সেটা আনন্দের। আপনি মূল্যায়নের কথা যদি বলেন, এটা আমাকে বেঁচে থাকার একটা অনুপ্রেরণা দেয়।

মাসউদুল হক : ভাবেন কি যে, জীবনের একটা পর্যায়ে আপনি পেশাগত জীবনকে বাদ দিয়ে শুধুই লেখালেখিতে ব্যস্ত হবেন। এমন কোন স্বপ্ন আপনি দেখেন কি না?

শাহাদুজ্জামান : সেই দিন যখন আসবে আমি হবো সবচেয়ে আনন্দিত মানুষ। সেটা ক্রমশ ভাবছি। ভাবছি যে আস্তে আস্তে গুটিয়ে আনবো। গুটিয়ে এনে হয়তো আরো বেশি সময় দিতে পারবো লেখালেখিতে।

মাসউদুল হক : সে ইচ্ছেটা এখনও নিজের ভেতর আছে?

শাহাদুজ্জামান : হ্যাঁ। সেটা আছে।

মাসউদুল হক : আপনি থিতু হবার ক্ষেত্রে ইংল্যান্ডকে বেছে নেবেন নাকি বাংলাদেশকে বেছে নেবেন? এখন তো আপনি অনেকটা প্রবাসী লেখক হয়ে গেছেন।

শাহাদুজ্জামান : প্রবাসী লেখক কিংবা স্বদেশী লেখক এই বিতর্ক তো আমিও আগেও করলাম। কে প্রবাসী কে স্বদেশী লেখক সেটা বিষয় নয়।

মাসউদুল হক : আমি অবস্থানগত কারণ বলছি। মেন্টাল নয়, ফিজিক্যাল।

শাহাদুজ্জামান : সেটা সময় বলবে। আমি নানাবিধ বাস্তবিক কারণে আছি। কিন্তু আমার মন তো এখানে আছেই শরীরটাও চলে আসবে বলে আমি মনে করি।

মাসউদুল হক : অনেক কথা তো হলো, এবার আপনার কাছ থেকে একটি গান শুনতে চাইবো। গান শুনতে শুনতে আমরা বিদায় নেব।

শাহাদুজ্জামান : শরৎ বাবু, খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে…

শ্রুতিলিখন : রাব্বী আহমেদ

আরো পড়তে পারেন

দৃঢ়তা ও প্রতিরোধের গল্পগুলোর মাধ্যমে আপনি একটি শক্তিশালী চরিত্র তৈরি করতে পারেন: মোহাম্মদ এল-কুর্দ

গাজা, যেখানে কিছুই নেই, আছে শুধু ধ্বংসাবশেষ। তবুও তো আছে! স্মৃতির গহিন থেকে উঁকি দেয় এক সময়কার সেই ছাদ, সেই বারান্দা, সেই অলিভ বাগান। স্মৃতিতে যা অক্ষত, তারই ক্ষতবিক্ষত রূপের সামনে আজ দাঁড়িয়ে গাজার মানুষ। তবু বৈধ তাদের মাতৃভূমিকে ভালোবেসে কষ্ট ভুলে থাকার আদিম আকাঙ্ক্ষাটুকু। তাদেরই একজন মোহাম্মদ এল-কুর্দ। এই লেখক, কবি, সাংবাদিক তার Perfect….

সোলেইমানি ছিলেন একজন বীর এবং তার ধর্ম, মাতৃভূমি ও জনগণের রক্ষক: ওলেগ রয়

তার জীবনের শেষ কয়েক দশকে দেশপ্রেম আর মানবতা বহুরূপে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। প্রতিবারই তিনি দেশপ্রেম আর মানবতাকে আরও উঁচুতে নিয়ে গিয়েছেন। তিনি শুধু একজন সৈনিক ছিলেন না-তিনি ছিলেন একজন অভিভাবক, একজন রক্ষক। সত্যের রাজ্যে একজন বীর, যার লড়াই শুধু নিজের মাতৃভূমিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং অন্যদের জন্যও বিস্তৃত ছিল। তিনি শহিদ হয়েছিলেন সেই সাম্রাজ্যের হাতে,….

নিজেকে বাদ দিয়ে অন্য কেউ হয়ে ওঠার সুযোগ খুব বেশি পাওয়া যায় না: হারুকি মুরাকামি

তখনো শহরের ষড়যন্ত্রে পা দেয়নি গ্রাম, মানুষের মনের দখল মানবতার কাছেই ছিল। সেই বিংশ শতাব্দীর প্রতিনিধি হারুকি মুরাকামি আধুনিক জাপানি সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় লেখক। তার রচনাগুলো শুধু জাপান নয়, বরং সারা বিশ্বের পাঠকদের মন জয় করেছে। তার লেখার অনন্য শৈলী, গভীর চরিত্র বিশ্লেষণ এবং বাস্তবতার সঙ্গে অলৌকিকতার মিশ্রণে গড়ে ওঠা গল্পগুলো তাকে বিশ্ব….

error: Content is protected !!