Author Picture

ত্বহা হুসাইনের দিনগুলি

কাউসার মাহমুদ

আঠারো

অবশেষে বুধবার আসরের সময় আচমকাই সমস্ত কিছু থেমে যায়। সবকিছু থেমে গিয়েছিল কারণ বালকের মা এই বাড়ির ওপর একটি বিস্তৃত অশুভ দীর্ঘ ছায়া উপলব্ধি করেছিলেন। কারণ, ইতোপূর্বে কখনওই এ বাড়িতে কারও মৃত্যু হয়নি, না কখনও এই কোমল হৃদয়ের মাতা প্রকৃত বেদনার যন্ত্রণা উপলব্ধি করেছিল।

এভাবে বালক তার দিনগুলো বাড়ি, গ্রামের মকতব, শরীয়া কোর্ট, মসজিদ, পরিদর্শকের বাড়ি, উলামাদের মজলিস ও সুফিদের যিকিরে কাটিয়েছে। এতে তার জীবন না ছিল সম্পূর্ণভাবে মধুর, না ছিল তিক্ততায় ভরা। বরং কখনও তা আনন্দঘন হত কখনওবা আবার বিষাদে নিমজ্জিত। ফলে এর মাঝের গত হওয়া সময়গুলো ছিল নিস্তেজ আর অস্বস্তিকর। এরপর সেইদিন আসে, যেদিন সে প্রকৃত বেদনার স্বাদ গ্রহণ করেছিল এবং বুঝতে পেরেছিল, ইতোপূর্বে যে দুঃখবোধ ও মর্মযন্ত্রণায় সে ভুগেছে এবং যে কারণে জীবনের প্রতি তার বিতৃষ্ণা এসেছিল-তা আসলে কিছুই না। তদুপরি সে এও বুঝতে পারে, সময় মানুষকে একইসাথে সীমাহীন যন্ত্রণা ও আনন্দ দিতে পারে। তথা জীবন মানুষের কাছে কখনও অসহ্য হয় ঠিক কিন্তু সময়-একইসাথে তা আবার তাদের কাছে প্রিয়তর ও এর গতিপথ তাদের জন্য মসৃণও করে তুলতে পারে। মূলত বালকের চার বছর বয়সী ছোট একটি বোন ছিল। এখন পর্যন্ত পরিবারের সবার ছোট যে। প্রশস্ত উজ্জ্বল মুখের সাথে তার হৃদয়টি ছিল খুবই কোমল ও সূক্ষ্ম। তার কথামালা এত স্নিগ্ধ আর প্রাঞ্জল ছিল; যেন সারাক্ষণ শুনতেই ইচ্ছে করে। সেই সাথে তার ছিল আশ্চর্য এক কল্পনাশক্তি।

সে ছিল পরিবারের আনন্দ। ঘন্টার পর ঘন্টা চুপচাপ একাকী খেলাধুলায় কাটিয়ে দিত। সাধারণত দেয়ালের সামনে বসে খেলা করত সে এবং দেয়ালের সঙ্গে কথা বলত; যেমন তার মা প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলেন। এমনকি যে ধরণের খেলাধুলাই হোক না কেন, তাতে সে তার সমস্ত অনুভূতি মিশিয়ে দিত এবং নিজেকে ওটার সঙ্গে আচ্ছাদিত করে নিত। ফলে তার খেলনাটি কখনও একজন নারী, কখনও পুরুষ; কখনও একজন যুবক, কখনওবা একজন যুবতীতে মূর্ত হয়ে উঠতো। আর শিশুটিও এই সব ব্যক্তিদের মাঝে অদৃশ্যে আসা যাওয়া করত এবং তাদের সঙ্গে কাল্পনিক কথোপকথনের উদ্ভাবন করত; এতে তারাও যেন একসময় তার সঙ্গে ধীরে, খেলাচ্ছলে কথা বলা শুরু করেছিল। কখনও আবার মৃদু অভিমান বা অসন্তোষ হলেও কিছুক্ষণপর ঠিকই আবার পরস্পর ধীরভাবে, শান্ত হয়ে কথা বলত। এতে প্রায়ই পরিবারের সবাই শিশু ও তার পুতুলগুলোর এই কথোপকথন এবং বিবিধ খেলাধূলা দেখে বিমল আনন্দিত হত। যেখানে শিশুটির এ ব্যাপারে কোনো অনুভূতিই নেই যে, কেউ তাকে অপার আনন্দ নিয়ে দেখছে বা তাকে শুনছে। তখন বছরের বড় উৎসব তথা ঈদুল আযহা আসন্ন। এরই আমেজ ছিল খুব। বালকের মা’ও তার পরিবার এবং সন্তানদের জন্য সবরকম প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত। ফলে ঘরদোর পরিষ্কার করে সবকিছু যথোপযুক্ত সাজিয়ে রাখেন তিনি। রুটি বানান ও বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টান্ন তৈরি করেন। একইভাবে বালকের ভাইয়েরাও উৎসবে নিজেদের পরিপাটি করে সাজাতে শশব্যস্ত। তাই বড়রা পোষাকের জন্য দরজির কাছে এবং জুতো মেরামতে মুচির কাছে ছোটে। ছোটোরা বাড়ির এই উৎসব মুখর পরিবেশ ও হৈ-হুল্লোড়ে নিজেদের মাতিয়ে রাখে।

অন্যদিকে আমাদের বালক নিঃসঙ্গ, চুপচাপ হয়ে সবকিছুর অপেক্ষা করছিল অথবা তার দার্শনিকসূলভ ভাবালুতার ভেতর নিজেকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। কেননা তার দরজি বা মুচি; কারও কাছেই যাওয়ার প্রয়োজন ছিলো না। অথবা এসব হৈচৈ ও কোলাহল থেকে কোনোরূপ আনন্দ উদ্ভূত করতে পারেনি সে। বরং নিজের সৃষ্ট ওই কল্পনার জগতেই একাকী দাঁড়িয়ে থাকত ও নিঃসঙ্গ বাস করত; যা সে বিভিন্ন গল্প, উপাখ্যান এবং তার পঠিত অসংখ্য পুস্তক থেকে পেয়েছিল। এভাবে আর অল্প কদিন মাত্র বাকি ঈদের। এসময় একদিন সকালে হঠাৎই শিশুটি কেমন নিস্তেজ, নিঃসাড় হয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু বাড়ির কারও কোনোরূপ মনোযোগই ছিলো না তার দিকে। যেমন আজকাল গ্রামাঞ্চল ও শহুরে শিশুরা প্রায়ই এ ধরণের অবহেলার শিকার। বিশেষত তখন, যখন পরিবারে অসংখ্য সদস্য থাকে আর গৃহকর্ত্রীর কাজ থাকে প্রচুর। তাছাড়া গ্রাম ও প্রাদেশিক শহুরে নারীদের এমন কিছু অপরাধমূলক দর্শন এবং প্রথাগত জ্ঞান রয়েছে, যা কোনো অংশেই অপরাধ থেকে কম নয়। যেমন শিশুরা প্রাণপনে মায়ের কাছে অভিযোগ, অনুযোগ বা তাদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে। কিন্তু সেদিকে মায়েদের কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই। আর কোন শিশুরই বা অভিযোগ থাকে না? আর যদি করেও তাহলে তা একদিন বা এক রাতের। এবং এরপরই হয় তা ঠিক হয়ে যায় নয় তা ছাপিয়ে যায়। আর এমতাবস্থায় মা যদি তাতে কোনোপ্রকার মনোযোগ দেয়; তাহলে হয় সে ডাক্তারকে ঘৃণা করে, নয় তো বিষয়টি অবজ্ঞা করে যায়। অর্থাৎ তিনি ওই নারীদের অপরাধমূলক জ্ঞানের ওপর নির্ভর করেন; অথবা যারা তার মত তাদের জ্ঞানের ওপর।

নিজের সৃষ্ট ওই কল্পনার জগতেই একাকী দাঁড়িয়ে থাকত ও নিঃসঙ্গ বাস করত; যা সে বিভিন্ন গল্প, উপাখ্যান এবং তার পঠিত অসংখ্য পুস্তক থেকে পেয়েছিল। এভাবে আর অল্প কদিন মাত্র বাকি ঈদের। এসময় একদিন সকালে হঠাৎই শিশুটি কেমন নিস্তেজ, নিঃসাড় হয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু বাড়ির কারও কোনোরূপ মনোযোগই ছিলো না তার দিকে

এভাবেই মূলত আমাদের বালক তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। প্রথমদিকে চোখের প্রদাহে আক্রান্ত হয় সে। কিন্তু পরিবারের পক্ষ থেকে বিষয়টি ছিল একেবারেই উপেক্ষিত ও অবহেলিত। তারপর যদিও এর জন্য কাউকে আনা হয়, সে ছিল নরসুন্দর। ফলে সে তাকে এমনই চিকিৎসা করল যে, শেষতক আমাদের বালক তার দৃষ্টিই হারিয়ে ফেলে।
আর ঠিক এভাবেই শিশুটি তার জীবন হারিয়েছে। কারণ বেশ কিছুদিন ধরেই তাকে বেশ অসুস্থ, অবসন্ন, নির্জীব আর জ্বরাক্রান্ত লাগছিল। এমনকি সে তার সমস্ত উচ্ছলতা ছেড়ে ছুঁড়ে, ঘরের কোণে তার ছোট্ট বিছানাটায় পড়ে ছিল। এসময় মা অথবা বোন কখনো সখনো কাছে এসে খাবার দিয়ে যেত ঠিক কিন্তু একদন্ড বসে দেখার ফুরসত পেত না বুঝি। ওই খাবার কি ভালো না মন্দ ছিল-তা একমাত্র আল্লাহই জানেন! তাছাড়া সারা বাড়িময় নিরবিচ্ছিন্ন হৈচৈ তো ছিলোই। একদিকে রুটি, পেস্ট্রি তৈরি হচ্ছে অন্যদিকে অতিথিকক্ষ ও অভিবাদনকক্ষ পরিস্কার হচ্ছে। সেখানে শিশুরা তাদের খেলাধুলায় মত্ত। যুবারা তাদের পোশাকআশাক ও জুতো নিয়ে চিন্তিত। আর শায়খ নিয়মিতই আসা-যাওয়ায় ব্যস্ত থাকেন এবং দিনের শেষাংশ ও রাতের প্রথম অংশ বন্ধুদের সঙ্গে কাটান।
অবশেষে বুধবার আসরের সময় আচমকাই সমস্ত কিছু থেমে যায়। সবকিছু থেমে গিয়েছিল কারণ বালকের মা এই বাড়ির ওপর একটি বিস্তৃত অশুভ দীর্ঘ ছায়া উপলব্ধি করেছিলেন। কারণ, ইতোপূর্বে কখনওই এ বাড়িতে কারও মৃত্যু হয়নি, না কখনও এই কোমল হৃদয়ের মাতা প্রকৃত বেদনার যন্ত্রণা উপলব্ধি করেছিল। হ্যাঁ। তিনি তার কাজ করছিলেন, তখন হঠাৎই শিশুটি ভয়ঙ্কর নিনাদে চিৎকার শুরু করে। এই শুনে মা সবকিছু ফেলে তার কাছে দৌড়ে আসেন। শিশুটির কান্না ক্রমাগত বেড়েই চলছিল আর আওয়াজ উচ্চকিত হচ্ছিল। ফলে শিশুটির বোনও সবকিছু ফেলে তার কাছে ছুটে আসে। কিন্তু পর্যায়ক্রমে তার কান্না ও আর্তরব বাড়তেই থাকে আর সেও কেমন তার মায়ের কোলে বাকা হয়ে মুচড়ে উঠে। এতে শায়খও তার বন্ধুদের ছেড়ে তড়িৎ তার কাছে আসেন। তখনও শিশুটির ক্রন্দন ধ্বনি পূর্বের চেয়ে উচ্চ আওয়াজে চলমান এবং সে ভয়ানক ভাবে কাঁপছে তার পুরো মুখাবয়ব সঙ্কুচিত হয়ে আসে এবং তা থেকে ঘামের স্রোতধারা নেমে আসে। তখন বালক ও যুবারাও তাদের হৈচৈ ও আলাপচারিতা ছেড়ে তার কাছে ছুটে আসে। কিন্ত সবকিছু ছাপিয়ে তার কান্নার মাত্রা বেড়েই চলছিল। পুরো পরিবার তখন নির্বাক, স্তব্ধ দাঁড়িয়ে আছে। ছোট্ট মেয়েটির চারপাশে জড়পদার্থের মত তারা এভাবে স্থির যে, কি করবে বুঝতেই পারছিলো না। ফলে এভাবেই দু ঘন্টা কেটে যায়। এসময় শায়খকে সেই অবসন্নতা ও দুর্বলতা গ্রাস করে, জীবনের এসব মুহুর্তগুলোয় পুরুষদের যা আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে। সুতরাং সে বিড়বিড় করে কোরানের আয়াত পড়তে পড়তে ও আল্লাহর কাছে সানুনয় প্রার্থনা করতে করতে বেড়িয়ে যায়। আর যুবক ও শিশুরা তাদের নীরবতা থেকে পলায়ন করে ঠিক কিন্ত কোনোভাবেই না পারে তাদের খেলাধুলা ও আলাপচারিতার কথা ভুলতে, না পারে তা চালিয়ে যেতে। ফলে তারা যেন বাড়িতে কেবল হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আর তাদের মাতা নির্বাক দৃষ্টিতে তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে এবং ক্ষণে ক্ষণে তাকে সমস্ত প্রকার ঔষধ পান করান। কেউ জানে না আসলে কী ছিল ওসব!

এদিকে অবস্থা খারাপ হওয়ার সাথে সাথে কান্না ও চিৎকারের বিলাপ ক্রমাগত বাড়ছিলই। বিশ্বাস করুন! আমি কখনও কল্পনাই করিনি যে, চার বছর বয়সী একটি শিশু; কিভাবে এমন শক্তি দিয়ে কাঁদতে পারে! এ অবস্থার মধ্যেই রাতে খাওয়ার সময় হলে দস্তরখান বিছানো হয়। বালকের বড় বোন তা প্রস্তুত করে মূলত। এরপর শায়খ ও তার ছেলে এসে বসেন। কিন্ত তখনও আগের মতোই মেয়েটির কান্নার আওয়াজ বিদীর্ণ হয়ে বাজছিল। ফলে কেউ খাবারের জন্য তাদের হাত প্রসারিত করেনি; যদিও তা বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে ছিল। সুতরাং যেভাবে দস্তরখান বিছানো হয়েছিল ওভাবেই তা উঠিয়ে নেয়া হয়। মেয়েটি তখনও কাঁদছিল আর এদিকওদিক হাত পা ছুঁড়ছিল; যখন তার মা তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল এবং ক্ষণে ক্ষণে আকাশের দিকে তার হাত প্রসারিত করছিল। এসময় তার মাথা খোলা ছিল অবশ্য। যা তার অভ্যেসের বিপরীত। কিন্তু সেদিন আকাশের দরজা বন্ধ ছিল আর অপরিবর্তনীয় এক ফরমান জারি করা হয়েছিল ঠিকই। ফলে বাবা শুধু কোরানই তেলাওয়াত করতে পারেন আর মা তার মিনতি জারি রাখতে পারেন। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যপারটি হলো; এতগুলো মানুষের মাঝে একবারও কেউ ডাক্তারের কথা ভাবেনি। অথচ, রাত বাড়ার সাথে সাথে ছোট্ট মেয়েটির কান্না ক্ষীন হতে থাকে। কণ্ঠ দুর্বল হয় এবং ছটফটানিও কমে আসে। এই দেখে হতভাগিনী মা ভাবে, ঈশ্বর হয়তো তার ও তার স্বামীর প্রার্থনা শুনেছেন। যাক, অবশেষে সঙ্কটটি শেষ হলো তাহলে। আসলে মূলত সঙ্কটটি সমাধান হতে শুরু করেছিল এবং প্রভু ছোট্ট মেয়েটির ওপর করুণা করেছিলেন। যেমন তার কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে আসা এবং ছটফটানি হ্রাস পাওয়া এই করুণার দুটি লক্ষণ। মা তখন তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবে, সে হয়তো ঘুমুতে যাচ্ছে। তারপর আবার ভালোভাবে তাকিয়ে দেখে, মেয়েটি অমনই স্থির শুয়ে আছে। কোথাও কোনো শব্দ নেই, কোনো বিচলন নেই। কেবলই হালকা একটা শ্বাস তার মৃদু খোলা ঠোঁট দুটোর ওপর বারবার ভেসে আসছে। এরপর এই নিঃশ্বাসটুকুও বন্ধ হয় এবং ছোট্ট মেয়েটি এই জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়।

প্রভু ছোট্ট মেয়েটির ওপর করুণা করেছিলেন। যেমন তার কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে আসা এবং ছটফটানি হ্রাস পাওয়া এই করুণার দুটি লক্ষণ। মা তখন তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভাবে, সে হয়তো ঘুমুতে যাচ্ছে

কী ছিল তার অভিযোগ? এবং কিভাবে এই অভিযোগ মৃত্যুর কারণ হলো? এ ব্যপারে একমাত্র আল্লাহই জানেন। যাহোক, এ মুহূর্তে এখানে অন্য এক কান্না শুরু হয় এবং ক্রমবর্ধমান আওয়াজের সাথে তা অব্যাহত থাকে। সেইসাথে আরেকটি যন্ত্রণাও এখানে নিজেকে প্রকাশ করে এবং ক্রমবর্ধমান শক্তি নিয়ে তা অব্যাহত থাকে। অবশ্য ওই ছোট্ট মেয়েটির কান্না বা সমস্যা কোনোটাই ছিলো না। তা ছিল তার মায়ের গগনবিদারী কান্না। যখন তিনি দেখলেন, সে মারা গেছে। তা ছিল তার মায়ের যন্ত্রণা, যখন তিনি বুঝলেন, তিনি তাকে হারিয়ে ফেলেছেন। বালক ও যুবারা তখন তাদের মা’কে ভয় পেয়ে দুরে চলে আসে। শায়খই তার কাছে এগিয়ে এসে তাকে ধরেন। অনন্ত বেদনার উন্মত্ততায় তিনি যেন নিজেকে একপাশে বিধ্বস্ত ফেলে রেখেছেন। তার ঠোঁট জড়িয়ে গিয়েছে, তিনি অসংলগ্ন কথাবার্তা উচ্চারণ করছিলেন এবং কান্নার ফোঁপানোতে তার কণ্ঠস্বর ভেঙ্গে এসেছিল। হিংস্রের মত নিরবিচ্ছিন্নভাবে দু’হাতে নিজের বুকে চাতি মারছিলেন; যখন তার স্বামী তারই সামনে স্থির দাঁড়িয়ে আছেন। যিনি একটি শব্দও উচ্চারণ করতে অক্ষম। অথচ, তার চোখ থেকে ধীরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। তখন প্রতিবেশী নারীপুরুষ সকলেই তাদের এ কান্নার আওয়াজ শোনে এবং তাদের কাছে ছুটে আসে। সুতরাং শায়খ অবিচল ধৈর্য নিয়ে তাদের সমবেদনা গ্রহণে বাহিরে আসেন। ওদিকে যুবক ও কিশোরেরা সারা বাড়িতে বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মাঝে যাদের হৃদয় কঠিন; তারা ঘুমিয়ে পড়ে। যারা কোমল হৃদয়ের, তারা জেগে থাকে। কিন্তু মা একইভাবে তার বেদনার ভেতর হাহাকার করতে থাকেন। তার সামনে তারই ছোট্ট মেয়েটি নিথর পড়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে আর্তনাদ করে নিজের মুখ খামচে ধরেন এবং দু’হাতে লাগাতার বুক চাপড়াতে থাকেন।

চারপাশে তার মেয়ে ও প্রতিবেশী নারীরা সকলেই তখন এই এক কাজই করছিলো। তারা চিৎকার করছিল, নখ দিয়ে তাদের মুখে আঁচড় দিচ্ছিল আর দু’হাতে বুকে আঘাত করে বিলাপ করছিল। সুতরাং এভাবেই সারা রাত কাটে। তারপর ভোরবেলা সে বাড়িতে এরচেয়ে জঘন্য সময় আর ছিলো না; যখন কিছু লোক আসে এবং ছোট্ট মেয়েটিকে বহন করে এমন এক জায়গায় নিয়ে যায়; যেখান থেকে কোনোদিনই সে আর ফিরবে না। সেই দিনটি ছিল ঈদের (ঈদুল আযহার) দিন। এই ঈদ উপলক্ষেই সারা বাড়ি ঝকঝকে পরিস্কার করে সাজানো হয়েছিল। কুরবানির পশুও প্রস্তুত ছিল অবশ্যই। কিন্তু সেদিন আর কিসের ঈদ! কিসেরই বা কুরবানি। বরং কী ভয়ানক আর যন্ত্রণাপূর্ণই না ছিল; যখন শায়খ তার মেয়েকে কবর দিয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। এরপর সেইদিন থেকে কখনওই আর এ পরিবারটি প্রিয়জন বিয়োগের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত থাকেনি। যেমন, এর এক মাস পরই শায়খ তার বৃদ্ধ পিতাকে হারান। আর এই ঘটনার মাস কয়েক কেটেছে মাত্র; এরই মাঝে বালকের মা হারান তার বৃদ্ধা মাকে। এ যেন বেদনার এক পারম্পর্য থিতু হয়ে বসেছিল তাদের জীবনে, যেখানে নিরবিচ্ছিন্নভাবে একেকটি আকস্মিক দুর্দশা যেতে না যেতেই আরেকটি এসে হাজির হত; যে-সবের কিছু ছিল মর্মপীড়াদায়ক, কিছু ছিল তুলনামূলক তা থেকে হালকা। অবশেষে এরই ধারাবাহিকতায় সেই চূড়ান্ত ভয়ঙ্কর দিনটি আসে। ইতোপূর্বে যার মতো বেদনাবিধুর কোনো দিনের সঙ্গে এই পরিবার পরিচিত নয়। যা তাদের জীবনে এমনই এক চিরস্থায়ী দুঃখ গেঁথে দিয়ে গিয়েছিল, আর কখনওই যা বিচ্ছিন্ন হয়নি। এর দুঃখভার এতোটাই ব্যথাতুর ছিল যে, তা বাবা-মা দুজনের মাথার চুলকেই সাদা করে দিয়েছিল। যা মা’কে তার স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শোকের কালো কাপড় পরিধান করিয়ে দিয়েছিল। সেইসাথে যিনি হারিয়েছিলেন তার সমস্ত আস্বাদ, পরিতোষ বা আনন্দ।

যেদিনের পর থেকে কোনোদিনই তিনি হাসেননি বরং কাঁদতেন প্রায়ই। এমন একটা দিন যেত না, যেদিন তিনি না কেঁদে ঘুমুতে যেতেন, আর যখন জাগতেন তখনও তার চোখে অশ্রুই গড়াগড়ি খেত। কখনওই গরীব, অসহায় বা শিশুদের দেওয়া ছাড়া কোনো ফলমূল খেতেন না। এমনকি এরপরে ঈদেও কখনও তিনি হাসেননি। না তিনি চরম বিতৃষ্ণা ও অনিচ্ছা ছাড়া কোনো উৎসবের আমন্ত্রণ করেছেন। দিনটি ছিল ২১ আগস্ট ১৯০২ সাল। এ বছরের গ্রীষ্মটা যারপরনাই ভয়াবহ ছিল। কলেরা মহামারী পুরো মিশরে ছড়িয়ে পড়ে এবং দাবানলের মত মানুষকে আক্রমণ করে। শহর, গ্রাম সমূলে ধ্বংস করে দেয়। বসবাসরত পরিবারদের করে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন। ইতোমধ্যে শিক্ষকের মধ্যেও তাবিজ-কবচ লেখার ধুম পড়ে। শহর ও গ্রামের মকতবগুলো বন্ধ হয় আর জনস্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসক ও দূতরা সারা দেশজুড়ে তাদের যন্ত্রপাতি ও তাবু নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে, যেন অসুস্থদের বিচ্ছিন্ন করে চিকিৎসা দিতে পারে। মানুষের সমস্ত সত্তাজুড়ে তখন অসহায়ত্ব উদ্বিগ্নতা আর মনের ভেতর ভয়। জীবন যেন মানুষের কাছে তখন এক হীন বস্তুতে পরিণত হয়েছিল। প্রতিটি পরিবারই অন্যদের কি অবস্থা-এই নিয়ে কথাবার্তা বলছিল আর নিজস্ব দুর্যোগের জন্য অপেক্ষা করছিল। এদিকে বালকের মা-তার চিরস্থায়ী উৎকণ্ঠার ভেতরই পড়ে ছিলেন। ফলে দিনে হাজারবার তিনি নিজেই নিজেকে জিজ্ঞেস করতেন, তার ছেলেমেয়েদের কোন জনের ওপর বিপর্যয় নেমে আসবে! তার তখন আঠারো বছর বয়সী একটা ছেলে ছিল। যে দেখতে যেমন সুদর্শন ও মনোরম, তেমনি বুদ্ধিমান ও চমৎকার। আসলে সে ছিল পরিবারের সবচেয়ে সেরা। সবচেয়ে কোমল হৃদয়ের। সবচেয়ে উন্নত চরিত্রের। বাবা-মায়ের প্রতি সবচেয়ে বেশী কর্তব্যপরায়ণ ও সহানুভূতিশীল। ছোট ভাইবোনদের প্রতি সবচেয়ে দয়াদ্র ও বন্ধু ভাবাপন্ন। তদুপরি সবসময় হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত ছিল সে। বেশ কিছুদিন হয়েছে অনার্সের সার্টিফিকেট অর্জন করেছে এবং মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য তার নাম সম্পৃক্ত হয়েছে। মূলত এ জন্যই সে অপেক্ষা করছিল যে, গ্রীষ্মের ছুটি শেষ হলে কায়রো যাবে। আর তখনই যেহেতু মহামারী ছড়িয়ে পড়ে তাই শহরের ডাক্তারদের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করে সে। তাদের সঙ্গে এখানে-ওখানে মানুষের চিকিৎসায় বেড়িয়ে পড়ে এবং বলে, এ তার ভবিষ্যত পেশার জন্য একপ্রকার অনুশীলনও হচ্ছে।

এ বছরের গ্রীষ্মটা যারপরনাই ভয়াবহ ছিল। কলেরা মহামারী পুরো মিশরে ছড়িয়ে পড়ে এবং দাবানলের মত মানুষকে আক্রমণ করে। শহর, গ্রাম সমূলে ধ্বংস করে দেয়। বসবাসরত পরিবারদের করে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন

এভাবেই অবশেষে সেই ২০ আগস্ট আসে। রোজকার মতোই হাসিখুশি প্রানবন্ত হয়ে ঘরে ফিরেছে সে। তারপর আরাম করে বসে মায়ের সঙ্গে কথা বলে। তার সঙ্গে ঠাট্টা করে তার ভয় দূর করে জানায়, ‘আজ শহরে বিশটির বেশি রোগী ছিলো না। তাই বোঝা যাচ্ছে, এতে মহামারির প্রভাব বেশ হ্রাস পেতে শুরু করেছে।’ কিন্তু এসবের সাথে কিছু অসুস্থতার কথাও জানিয়েছিল সে। এই বলে অবশ্য সে বেরিয়ে যায় এবং অভ্যেস অনুযায়ী বাবার কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে। এরপর তার বন্ধুদের কাছে যায় এবং রোজকার মতোই তাদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে প্রিয় জায়গা ইবরাহিমিয়া খালের কিনারে গিয়ে দাঁড়ায়। এরপর সন্ধ্যা নামতেই সে বাড়ি ফিরে আসে এবং ঘন্টাখানেকের মতো তার ভাইদের সাথে হাসিঠাট্টা ও খেলাধুলা করে। এবং সে রাতে বাড়ির সবাইকে বলে যে, রসুন খেলে কলেরা থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এই বলে সে নিজেই তা খায়। তার দেখাদেখি তার ছোটো ও বড় ভাইয়েরাও তার অনুসরণ করে। অবশ্য সে তার পিতামাতাকেও এর কার্যকরিতা বোঝাতে চেয়েছিল; কিন্ত সক্ষম হয়নি। তখন মাঝরাত। সারা বাড়ি নিঝুম নিস্তব্ধ হয়ে ছিল। বাড়ির সকল বাসিন্দা ও পশুরা একইরকম গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। কিন্ত এরমাঝে হঠাৎই যেন এক অদ্ভুত কান্নার স্বরে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে এবং সেইসাথে সকলেই জেগে ওঠে। তখন শায়খ ও তার স্ত্রী দ্রুত তাদের প্রশস্ত বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় এবং তাদের ছেলের নাম ধরে ডাকে। এতে বাড়ির তরুণরা লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে এবং শ্রুত কণ্ঠস্বর অভিমুখে ছুটে যায়। যখন বালকেরা ঘুম থেকে উঠে বসেছিল এবং তাদের চোখ ঘষছিল। সেইসাথে বিরক্ত হয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল, এই শব্দটি কোথা থেকে আসছে এবং এই অদ্ভুত বিচলন এর অর্থ কী?

মূলত এই সবকিছুর উৎস ছিল যুবকের বমন চেষ্টার শব্দ। যেখানে সে এ অবস্থাতেই প্রায় এক দুই ঘন্টা যাবত আছে। এরমাঝে আলগোছে পা ফেলে বার কয়েক সে বাইরেও গিয়েছে, যেন ভালোভাবে বমি করতে পারে এবং তার শব্দে কেউ জেগে না যায়। কিন্তু উপসর্গটি তাকে এমনই কাবু করে ফেলে যে, এতে না পারে সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে চুপিসারে বমি করতে। ফলে তার বাবা-মা তার এই উদ্বমন শব্দ শোনে এবং বাড়ির অন্যান্য অধিবাসীদের মতোই শঙ্কিত হয়ে পড়ে। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে যুবককে মহামারী স্পর্শ করে। এবং এর মধ্য দিয়েই প্লেগ এ বাড়িতে তার পথ পায়। সেইসাথে যুবকের মা জানতেন, তার কোন ছেলের ওপর বিপদ নেমে আসছে। কিন্তু সে রাতে শায়খ সত্যিই প্রশংসার যোগ্য ছিলেন। কারণ আশ্চর্য রকম শান্ত হয়ে তিনি সুস্থির বসে ছিলেন। যদিও তাকে কিছুটা ভীত লাগছিল কিন্তু বেশ ভালোভাবেই তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। তার কণ্ঠে এমন কিছু ছিল; যা স্পষ্ট তার হৃদয়টা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে বোঝাচ্ছিল। কিন্তু তবু তিনি আসন্ন দুর্যোগ সহ্য করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। এরপর তিনি তার ছেলেকে তার ঘরে নিয়ে যান এবং ভাইদের কাছ থেকে তার বিচ্ছিন্নতার নির্দেশ দেন। বলেই তিনি দ্রুত বেরিয়ে যান এবং দুজন প্রতিবেশীকে ডাকেন। এরপর প্রায় একঘন্টা পর তিনি ডাক্তার সঙ্গে করে ফেরেন। এদিকে যুবকের মা তেমনই প্রবল ভীতসন্ত্রস্ত। কিন্তু চূড়ান্ত ধৈর্য আর বিশ্বাসের সাথে তিনি তার ছেলের যত্ন নিচ্ছিলেন। ফলে যখনই বমন যুবককে সামান্য বিশ্রাম দেয়, তৎক্ষনাৎ তিনি ছুটে বারান্দায় আসেন এবং দুহাত প্রসারিত করে আকাশের দিকে তাকিয়ে তার নিজস্ব প্রার্থনায় রত হন এবং ওভাবেই থাকেন-যতক্ষণ পর্যন্ত না আবার তিনি ওই উদ্বমন শব্দ শুনতে পান। তখন তিনি আবার তার ছেলের কাছে ছুটে যান। বুকে হাত দিয়ে তাকে সাহায্য করেন এবং তার মাথাটি নিজের দুহাতে নিয়ে তাকে প্রশান্ত করার চেষ্টা করেন। যদিও এই সবকিছুর মাঝে এক মুহুর্তের জন্যও তার জিহ্বা-প্রার্থনা ও মিনতি থেকে বিরত থাকেনি।

তাছাড়া কোনোভাবেই তিনি রোগীকে বালক ও যুবাদের কাছ থেকে আলাদা রাখতে সক্ষম হননি। কারণ সকলেই এসে তার ঘরে জড়ো হয়েছিল এবং তার চারপাশে নির্বাক দাড়িয়ে ছিল। বিপরীতে বমনের পর যখনই কয়েক মুহুর্ত সে বিশ্রাম পাচ্ছিল প্রতিবারই সে তার মায়ের সঙ্গে ঠাট্টা করছিল এবং তার ছোট ভাইদের সঙ্গে কৌতুক করার চেষ্টা করছিল। এভাবে শেষতক ডাক্তার আসেন এবং প্রেসক্রিপশনে যা লেখার লিখেন আর নির্দেশ দেওয়ার দিয়ে বলেন, সকালে রোগীকে দেখতে আবার আসবেন তিনি। মা তখন ছেলের ঘরেই তার পাশে থাকেন। আর শায়খ এই কামরার নিকটেই নির্বাক নিশ্চল বসে থাকেন। না কোনো দোয়া করেন, না নামাজ পড়েন। না কেউ কিছু বললে তার জবাব দেন। এভাবে বহুকাল পর যেন ভোর আসে। তখন যুবা তার পায়ে ব্যথার কথা জানালে, তার বোন এসে তার পা ডলতে থাকে। এতে কখনও সে ব্যথায় ককিয়ে উঠছিলো কখনওবা প্রাণপণে তা নিজের ভেতরই গোপন করছিলো। বমির উদ্রেক তাকে এমনই অত্যাচার করছিল যে, তা দেখে পিতামাতার হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। মূলত পুরো পরিবার এমনই এক ভয়াবহ সকাল পার করে যে, ইতোপূর্বে যেমনটা তাদের জীবনে কখনও আসেনি। একটি অন্ধকারচ্ছন্ন গুমোট সকাল; যেখানে ভীতিপ্রদ ও আতঙ্কের কিছু ছিল। ইতোমধ্যে বাড়ির বাইরে লোকদের ভীড় জমেছে। যারা শায়খকে সান্তনা জানাতে এসেছে। আর বাড়ির ভেতরে ছিল মহিলাদের জটলা; যারা যুবকের মা’কে সহানুভূতি জানাতে এসেছে। কিন্তু শায়খ ও তার স্ত্রী এতোই ব্যস্ত যে, তাদের প্রতি কোনোরূপ মনোযোগই দিতে পারে না। এদিকে ডাক্তারও প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় আসছিলেন। যুবকটি তখন কায়রোতে থাকা তার ভাই ও প্রদেশের উপরের অংশে বসবাসরত তার চাচাকে একটা খবর পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেন। ফলে একটু পরপরই সে ঘড়ি দেখতে চাইছিল; যেন সময়ের ব্যপারে বড়োই অধৈর্য হয়ে পড়েছে। সেইসাথে তার এই ভয়ও হচ্ছিল, সে হয়তো তার ভাই ও বৃদ্ধ চাচাকে না দেখেই মারা যাবে।

কী অসহ্য ভয়ানক ঘন্টাই না ছিল! সেদিন ছিল ২১ আগস্ট বৃহস্পতিবার বিকেল তিনটা। ডাক্তার সমস্ত আশা ছেড়ে দিয়ে, ভগ্ন হৃদয়ে রুম থেকে বেরিয়েছেন এবং শায়খের ঘনিষ্ঠ দুই বন্ধুকে নিশ্চিত করেন যে, যুবক তার শেষ সময়ে এসে উপস্থিত হয়েছে। লোক দুটি তখন ওই রুমে প্রবেশ করে, যেখানে যুবক তার মায়ের পাশে নিস্তেজ শুয়ে ছিল। সেইসাথে জীবনে এই প্রথমবার যেদিন তিনি (মা) কোনো পরপুরুষের উপস্থিতিতে হাজির ছিলেন। যুবকটি তখন তার বিছানায় কাঁপছিল। এরপর অবশ্য সে দাঁড়ায় এবং পরমুহুর্তেই আবার ধপ করে বসে পড়ে। তারপর ঘড়িতে সময় দেখতে চায় এবং আবারও বমনের চেষ্টা করে। তার মা তখন ভয়ে নির্বাক। এসময় লোক দুজন যখন যুবককে কিছুটা সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে, তখন সে তাদের বলে, ‘নিশ্চয়ই আমি নবীর চেয়ে শ্রেষ্ঠ নই। কিন্তু নবীও কি মৃত্যুবরণ করেননি?’ এরপর সে নিজেই বাবাকে সান্তনা দেওয়ার জন্য ডাকেন, কিন্তু শায়খ তার ডাকে সাড়া দেননি। বরং পরিবর্তে তিনি উঠে দাঁড়ান এবং ধপাস করে চৌকির ওপর বসেন। এরপর আবারও উঠে দাঁড়ান এবং ঠিক সেভাবেই অন্য একটি চৌকিতে পুনরায় অস্থির হয়ে বসেন। আমাদের বালকটি তখন একাকী, নিশ্চুপ, হতভম্ব ও বিষণ্ন মনে ঘরের এককোণে ঠায় বসে ছিল। যেন প্রবল এক বেদনাবোধ খুব সহজেই তার ছোট্ট হৃদয়টা চিড়ে ফেলছে। অবশেষে যুবক শেষবারের মতো নিজেকে বিছানার ওপর নিক্ষেপ করে এবং কোনোপ্রকার নড়তে অক্ষম হয়ে পড়ে। এসময় সে শুধু উচ্চ নিনাদে চিৎকার করতে থাকে, মাঝামাঝেই যা ম্লান হয়ে অস্তমিত হয়ে পড়ছিল। সেইসাথে তার চিৎকারের আওয়াজও ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে যেতে থাকে। আমাদের বালকটি হয়তো সবকিছু ভুলে যাবে কিন্তু যুবকের শেষ আর্তনাদ স্বরটির কথা কখনওই ভুলবে না; যা ছিল একটি ক্ষীণ, দুর্বল, দীর্ঘ হাহাকার। এর পরেই সে চিরতরে নিশ্চুপ হয়ে যায়। এই মুহুর্তে এসে যুবকের মা শীতল এক দৃষ্টি নিয়ে উঠে দাঁড়ান। যেন তার সমস্ত ধৈর্যই নিঃশোষিত হয়েছিল, সমস্ত সহ্যক্ষমতারও সমাপ্তি হলো। এসময় লোক দু’জন যদি তাকে না ধরত, তাহলে কয়েক মুহুর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থাকার আগেই মাটিতে ভূপাতিত হচ্ছিলেন তিনি। এরপর নিজের শরীরটা কোনরকম টেনে, বিষণ্ন চোখে, ঘর থেকে বের হন এবং বাহিরে আসা পর্যন্ত ধীর পদক্ষেপে চুপচাপ হেঁটে আসেন। এরপর তার বুকের ভেতর থেকে এমনই এক ক্রন্দন উত্থাপিত হয়; যখনই বালকের সে স্মৃতি মনে পড়ে, তার হৃদয়টা যেন বেদনার ভারে ফেটে যায়।

প্রবল এক বেদনাবোধ খুব সহজেই তার ছোট্ট হৃদয়টা চিড়ে ফেলছে। অবশেষে যুবক শেষবারের মতো নিজেকে বিছানার ওপর নিক্ষেপ করে এবং কোনোপ্রকার নড়তে অক্ষম হয়ে পড়ে। এসময় সে শুধু উচ্চ নিনাদে চিৎকার করতে থাকে, মাঝামাঝেই যা ম্লান হয়ে অস্তমিত হয়ে পড়ছিল

এসময় যুবক একবার মৃদু এপাশ-ওপাশ করে ওঠে। তার পুরো শরীর বেয়ে এক কম্পন খেলে যায় এবং তারপরই মৃত্যুর নীরবতা স্থায়ী হয়। তখন লোক দুটি আগে বেড়ে আসে এবং তার শরীরকে সোজা করে শুইয়ে দেয়। একটি তোয়ালে দিয়ে তার তার মাথা ঢাকে এবং মুখের ওপর একটি চাদর ছড়িয়ে দিয়ে তারা শায়খ এর কাছে যায়। তারপর তারা মনে করে, ওই ঘরের এককোণে বালক নিশ্চুপ বসে আছে। তখন তাদের কেউ একজন এসে আনমনেই তাকে ধরে বাহিরে নিয়ে যায় এবং মানুষের মাঝে এভাবে নিক্ষেপ করে, যেন কোথাও কোনো একটা বস্তু রাখা হয়েছে। এরপর দু’এক ঘন্টার মধ্যেই যুবককে দাফনের জন্য প্রস্তুত করা হয় এবং লোকেরা তাকে কাঁধে করে নিয়ে যায়। আহ ভাগ্য কি নিষ্ঠুর! মাত্রই তারা দরজায় পা রেখেছে অমনি তার বৃদ্ধ চাচা এসে উপস্থিত হন। যিনি তার প্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্রটিকে সান্তনা দিতে দেরি করে ফেলেছেন। অথচ তিনি আসবেন; এই আশাতেই যেন যুবা তার মৃত্যুকে শেষ পর্যন্ত প্রতিরুদ্ধ করে রেখেছিল। মূলত সেদিন থেকেই এই পরিবার ও তাদের সমস্ত আনন্দ-উৎসবে গভীর এক বেদনা চিরস্থায়ী হয়ে গিয়েছিল। যেকোনো উপলক্ষই হোক না কেন-বাড়ির বয়স্ক ও তরুণরা স্বাভাবিকভাবেই তা এড়িয়ে যেত। সেদিন থেকে দুপুরের আহার কি নৈশভোজ; যখনই শায়খ দস্তরখানে বসতেন, তার ছেলের স্মৃতিচারণ করতেন এবং কিছুক্ষণ অঝোরে কাঁদতেন। আর তার সম্মুখে বসা তার ব্যথাতুর স্ত্রীও তার সঙ্গে মুখ বুজে রোদন করতেন। যখন চারপাশে ছেলেমেয়েরা তাদের পিতামাকে সান্তনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করত। ফলে তারা সকলেই নিদারুণ এক কান্নায় নিপতিত হত।

এমনকি সেদিন থেকে মাঝেমাঝেই এই পরিবার নীল নদ পার হয়ে কবরস্থানে যেত। যদিও এর আগে মৃতের স্মরণে যারা কবরস্থানে যেত-তাদের দোষ ধরত তারা। আর সেদিন থেকেই জীবনের প্রতি আমাদের বালকের দৃষ্টিভঙ্গী সম্পূর্ণ পাল্টে গিয়েছিল। মূলত আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ ভরসা ছিল তার। এবং যেকোনো সম্ভাব্য উপায়ে তার নিকটবর্তী হওয়ার প্রবল আগ্রহ ছিল। এজন্য, হয় কখনও সে দান করে, কখনও নামাজের মাধ্যমে প্রার্থনা করে, কখনওবা ধারাবাহিক কোরান তেলাওয়াত জারি রাখে। কিন্তু আল্লাহ ভালো করেই জানেন যে, যা তাকে জীবনের প্রতি এভাবে চালিত করেছে-তা ভয়, করুণা বা স্নেহ নয়। বরং সত্য এই যে, সে জানত, তার যুবক ভাইটি একজন ছাত্র ছিল এবং সে তার ধর্মীয় অবশ্য কর্তব্য বিষয়গুলো পালনের প্রতি অবহেলা করেছিল। ফলে বালক সমস্ত প্রকার ইবাদাত পালনে বিশেষভাবে মনোযোগী হয়ে উঠেছিল এই আশায় যে, এর দ্বারা সে তার ভাইয়ের কিছু পাপ মোচন করাবে। তার ভাইটি যখন মারা যায় তখন তার বয়স ছিল আঠারো। আর বালক শায়খদের কাছে শুনেছে, যখন একজন মানুষের বয়স পনেরো হয়, তখন তার ওপর নামাজ-রোজা ফরজ। অতএব বালক হিসেবে করে দেখে যে, তার ভাই আল্লাহর কাছে পুরো তিন বছর এর নামাজ-রোাজার ঋণ আছে। সুতরাং বালক নিজের ওপর ধার্য করে নেয়, রোজ সে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ দুইবার পড়বে। একবার তার ভাইয়ের জন্য আরেকবার তার জন্য। তেমনি প্রতি বছর রোজাও দুই মাস রাখবে। একমাস নিজের জন্য। আরেক মাস ভাইয়ের জন্য। সেইসাথে প্রতিজ্ঞা করে, এই পুরো বিষয়টি সে পরিবারের সবার থেকে গোপন রাখবে এবং নিজের মাঝে ও আল্লাহর মাঝে বিশেষ একটি চুক্তি প্রতিষ্ঠা করবে। অধিকন্তু যেকোনো খানাখাদ্যই তার হাতে আসুক না কেন, তা থেকে নিজের অংশগ্রহণের আগে প্রথমে সে কোনো অনাথ বা দরিদ্রকে দেবে। আল্লাহ সাক্ষী! মাসের পর মাস বালক তার এই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছে এবং আল-আযহারে আসা পর্যন্ত নিজের স্বভাবের পরিবর্তন করেনি।

তদুপরি সেইদিন থেকে বালক জেনেছিল রাত্রিজাগরণ কী? এমন অসংখ্য রাত গত হয়েছে, যেখানে সে ঘন্টার পর ঘন্টা অন্ধকার আকাশের নিচে নির্জীব বসে বসে কাটিয়ে দিয়েছে। তখন হয়তো সে তার ভাইয়ের কথা ভাবত, নয় হাজার বার সূরা ইখলাস পাঠ করত; যার সমস্ত পূণ্যই সে তার ভাইয়ের জন্য উৎসর্গ করত। অথবা আনমনেই কবিতার বইয়ে পঠিত কাব্যসমূহের মত সে তার ভাই হারানোর বিরহে কবিতা রচনা করত। তবে সবসময়ই নবীর উপর দুরুদ ও শান্তি বর্ষণ করে কবিতা শেষ করত সে। এই আশায় যে, তার ভাই-এর বরকতের সাওয়াব পাবে। হ্যাঁ! সেদিন থেকেই বালক বিবিধ ভীতিপ্রদ দুঃস্বপ্নের অভিজ্ঞতা অর্জন করে। প্রতি রাতেই যাতে তার ভাইয়ের অসুস্থতার দৃশ্যসমূহ তার জন্য চিত্রিত করা হচ্ছিল। এই অবস্থা টানা কয়েক বছর এভাবেই চলতে থাকে। এরপর অবশ্য বয়স বাড়ার সাথে আল-আযহারের জীবনও তার ওপর পরিবর্তন আনে। ফলে এখন কেবল মাঝেমধ্যেই তার মৃত ভাইয়ের অসুস্থতার দৃশ্যসমূহ তার স্মৃতিতে আসে এবং সেইসাথে সে একজন তরুণ থেকে পুরুষ হয়ে ওঠে। কিন্তু তবুও জীবনের বিভিন্ন ধাপেধাপে সে যতই বদলাক না কেন; তার ভাইয়ের প্রতি আনুগত্য ও বিশ্বস্ততার ব্যপারে সে যেমন ছিল, তেমনই আছে। ফলে নিদেনপক্ষে একবার হলেও প্রতি সপ্তাহে তার ভাইয়ের কথা মনে পড়ত অথবা সে তাকে স্বপ্নে দেখত। যদিও যুবকের ভাইবোনেরা বহুদিন হয়েছে তার জন্য শোক করা বন্ধ করেছে। বন্ধু ও সমসাময়িকরা তাকে ভুলে গেছে। তাছাড়া শায়খ তথা বাবাও এখন কদাচিৎ তার স্মৃতিচারণ করেন। কিন্ত এই পুরো জগত সংসারে এখনও দু’জন মানুষ আছে, যারা তাকে সবসময় মনে করে এবং চিরকালই প্রতিদিন রাতের প্রথম প্রহরে মনে রাখবে। তার হলেন : তার মা আর এই বালক।

আরো পড়তে পারেন

একাত্তরের গণহত্যা প্রতিহত করা কি সম্ভব ছিল?

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই এক রাতেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে….

ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

আগের পর্বে পড়ুন— চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও একটি সার্থক গণআন্দোলন। এই গণআন্দোলনের মূল চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হলো দেশপ্রেম থেকে জাত সেই অনুভূতি, যার একটি রাজনৈতিক প্রকাশ রয়েছে। আর, বাঙালি জাতিসত্তাবোধের প্রথম রাজনৈতিক প্রকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে দুই হাজার মাইল দূরত্বের….

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল)

আগের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ একুশের আবেগ সংহত থাকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দেও। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। আওয়ামি লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ১৮ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটির সদস্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র….

error: Content is protected !!