Author Picture

ত্বহা হুসাইনের দিনগুলি

কাউসার মাহমুদ

.এগারো.

কিন্তু তার এই খুশি ও আনন্দোচ্ছ্বাস শীঘ্রই তিক্ত মোহভঙ্গের সাথে শেষ হয়। আর তা এ কারণে যে, আমাদের শিক্ষক ধৈর্য ধরে এই বিচ্ছেদ, বিভাজন সহ্য করতে পারেননি অথবা কোনোভাবেই তার ওপর শায়খ আব্দুল-গাওয়াদের এ প্রতিশোধ মেনে নিতে সক্ষম হননি। ফলে ইনিয়ে বিনিয়ে যে করেই হোক পুনরায় তিনি শায়খের আনুকুল্য অর্জন করেন। এবং এর পরদিন সকালেই শায়খ আমাদের বন্ধুটিকে আবার মকতবে যাওয়ার নির্দেশ দেন

সেদিন থেকে বালকের মক্তবে যাওয়া বন্ধ হয় সেইসাথে আমাদের শিক্ষকও এ বাড়িতে আসা বন্ধ করেন। ফলে শায়খ নতুন এক ফকিহ নিযুক্ত করেন। যিনি প্রত্যহ বাড়িতে এসে সুরা তেলাওয়াত করেন। আর বালক তার কাছে নিয়ম করে একঘন্টা বা দুই ঘন্টা পড়ে। তারপর নতুন এ গৃহশিক্ষক চলে গেলে, বাড়ির ভেতর সে খেলাধুলা করে। এদিকে বিকেলে আসরের সময় তার বন্ধুরা মক্তব থেকে ফেরার পথে, কী কী ঘটেছে ওখানে রোজ সবিস্তারে জানায় তাকে। ওসব শুনে সে হাসে খুব। তাদেরকে, তাদের মক্তব নিয়ে এমনকি আমাদের শিক্ষক ও আরিফকে নিয়েও তখন ঠাট্টা করে। কেননা সে ভেবেছিল, চিরদিনের জন্য গ্রামের ওই মক্তবে যাওয়া বন্ধ হয়েছে তার। আর কখনোই ওখানে যাবে না এবং আরিফ ও আমাদের শিক্ষক; তাদের কাউকেই দেখতে হবে না। ফলে লাগামহীনভাবে এই দুই ব্যক্তি সম্বন্ধে নানাবিধ কটু কথাবার্তা বলা শুরু করে সে। তাদের সেসব দোষত্রুটিসমূহও প্রকাশ শুরু করে; এতদিন যা নিজের ভেতর গোপন রেখেছিল। এমনকি শিশুদের সামনেই অবিরাম অভিসম্পাত বর্ষণ করে তাদের। মিথ্যাবাদী, প্রতারক ও লোভী বলে আখ্যায়িত করে। মোটকথা তাদের সম্পর্কে এমনই বিশ্রী এক জঘন্য ঢঙে কথা বলত সে; যাতে নিজের অনুভূতির আরোগ্য পেত এবং সেইসাথে তা বাচ্চাদেরও আনন্দিত করে তুলত।

তাছাড়া কেনই বা সে ওই দুই ব্যক্তির ব্যাপারে অমন স্বাধীনভাবে কথা বলবে না! যেখানে একমাসের মধ্যেই কায়রো চলে যাচ্ছে সে। কারণ এই আর কটা দিন পরই তো কায়রো থেকে তার আযহারী ভাই ফিরছে। তারপর ছুটি কাটিয়ে আমাদের বন্ধুটিকেও তার সঙ্গে আযহারে নিয়ে যাচ্ছ। যেখানে ভর্তি হয়ে প্রকৃত একজন ছাত্র হবে এবং যেখানে সে শিক্ষক ও আরিফের সমস্ত সংবাদ থেকে দূরে, বিচ্ছিন্ন থাকবে।কিন্তু সত্য হলো : এসব দিনগুলোয় মূলত সে বেশ খুশি ছিল এবং তার বন্ধু ও সমসাময়িকদের ওপর নিজের বিশেষ একটি শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করেছিল। যেমন, তাদের মতো রোজ মকতবে যেতে হয় না তার; বরং শিক্ষকই তার কাছে আসেন। তাছাড়া খুব শীঘ্রই সে কায়রো চলে যাচ্ছে। যেখানে আছে আল-আযহার মাদরাসা। আছে সাইয়েদুনা হুসাইন ও সাইয়েদা যয়নবের নামে সুবিশাল মসজিদ। তাদের মত অন্যান্য আরও বহু ওলি-আউলিয়ার মাজার। যদিও কায়রো তার কাছে কেবলই আল-আযহারের অবস্থানস্থল ও কিছু সাধু-সন্তর স্মৃতিবিজড়িত জায়গা ছাড়া আর কিছুই নয়।

কিন্তু তার এই খুশি ও আনন্দোচ্ছ্বাস শীঘ্রই তিক্ত মোহভঙ্গের সাথে শেষ হয়। আর তা এ কারণে যে, আমাদের শিক্ষক ধৈর্য ধরে এই বিচ্ছেদ, বিভাজন সহ্য করতে পারেননি অথবা কোনোভাবেই তার ওপর শায়খ আব্দুল-গাওওয়াদের এ প্রতিশোধ মেনে নিতে সক্ষম হননি। ফলে ইনিয়ে বিনিয়ে যে করেই হোক পুনরায় তিনি শায়খের আনুকুল্য অর্জন করেন। এবং এর পরদিন সকালেই শায়খ আমাদের বন্ধুটিকে আবার মক্তবে যাওয়ার নির্দেশ দেন। সুতরাং চরম বিতৃষ্ণা নিয়ে এ হিসেব করতে করতে সে মক্তবে যায় যে, কে জানে ভাগ্যে কি আছে! এই নিয়ে তৃতীয়বারের মত শিক্ষকের কাছে কোরান পড়তে যাচ্ছে। কিন্তু ব্যপারটি এখানেই থামেনি। বরং এতদিন ছাত্ররা তাদের এই বন্ধুর থেকে যা কিছু শুনেছিল, তার আগমনের সাথে এর সবকিছুই তারা আরিফ ও শিক্ষকের কাছে পুনঃপুন বলে দিয়েছে। ফলে আল্লাহ জানে কী বীভৎস দীর্ঘ দুপুরের একটি সপ্তাহ কাটিয়েছে আমাদের বন্ধু!
সুতরাং ওই সপ্তাহে সে খুব ভালো করেই নিজের জিহ্বাকে লাগাম দিতে শিখেছে। সেই সাথে আরও শিখেছে যে, মানুষের প্রতিশ্রুতি ও শপথের ওপর আস্থা রেখে কী বোকামিটাই না করেছে সে। এই যেমন, শায়খ (বাবা) কী শপথ করে বলেননি যে, তার ছেলে আর কোনোদিন ওই মক্তবে যাবে না! কিন্তু কই! দেখো! এই যে সে আবার ফিরে এসেছে! তাহলে কসম খেয়ে তা ভাঙার মাঝে শায়খ আর আমাদের শিক্ষকের মাঝে কি পার্থক্য রইলো! যেখানে আমাদের শিক্ষক স্পষ্ট মিথ্যা জেনেও অনবরত কিরে-কসম খেয়ে শপথ করে থাকেন। তদুপরি ওসব ছাত্রদের সাথেই বা কি পার্থক্য রইলো; যারা সর্বদাই তার কাছে শিক্ষক ও আরিফের বদনাম করত এবং তাকেও তা করতে প্ররোচনা দিত। এরপর যখন সে তা বলত, তখন তারা আবার তা গিয়ে শিক্ষক ও আরিফের কাছে বলে তাদের নৈকট্য অর্জন করত। এমনকি তার মা-ও; যিনি তাকে নিয়ে উপহাস করতেন এবং যখন সে ছাত্রদের কাছ থেকে আরিফ ও শিক্ষকের ব্যাপারে ওসব গালগল্প শুনে এসে তাকে বলতেন, তখন বাবাকেও তিনি তার দিকে উপহাস করতে উসকে দিতেন। এতে তার ভাইয়েরাও তার দিকে আগ্রহসহকারে মুখ টিপে তাকাত। প্রায়ই বাবার ওই ক্রুর বাক্যটির পুনরাবৃত্তি করে তাকে খোঁচাত এবং সেইসাথে তার ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধ জাগিয়ে তুলত। কিন্তু এই সবকিছুই সে চুপচাপ মুখ বুজে পরম ধৈর্যের সাথে সহ্য করে নিত। ভাবত, কেনই বা সহ্য করবে না; যখন তার আর এই নিষ্ঠুর পরিমন্ডলের মাঝে মাত্র মাসখানেকের ব্যবধান। তারপরই তে বিচ্ছিন্নতা…সেই অমল দূরের যাত্রা।

আরো পড়তে পারেন

শিখ নেতা হরদীপ সিং হত্যাকাণ্ডে ভারত কি সত্যিই জড়িত?

গত কয়েকদিনে ‘খালিস্তান আন্দোলন’-এর অন্যতম শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে  কানাডা ও ভারতের কুটনৈতিক সম্পর্কের বেশ অবনতি হয়েছে। হরদীপ সিং হত্যার ঠিক তিন মাস পর ১৮ সেপ্টেম্বর কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সে বক্তব্য দিতে গিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের পিছনে ভারত সরকারের হাত থাকার অভিযোগ করেন। তিনি স্পষ্ট করে বলেন, তার….

কথাসাহিত্যের মহানায়ক মিলান কুন্ডেরা

মিলান কুন্ডেরা (জন্ম ১ এপ্রিল ১৯২৯ ব্রনো, চেকোস্লোভাকিয়া [বর্তমানে চেক প্রজাতন্ত্রে]— মৃত্যু ১১ জুলাই ২০২৩, প্যারিস, ফ্রান্স)। অতিসম্প্রতি মাত্র দিন কয়েক আগে গত হওয়া বিংশ শতাব্দীর সমগ্র বিশ্বের শ্রেষ্ঠ লেখকদের একজন কুন্ডেরা ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক এবং কবি— যার সৃষ্টিসমূহ পৃথিবীর কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে দার্শনিক বোধ ও বিদ্রুপের সাথে প্রবলভাবে একচ্ছত্র রাজনৈতিক মতবাদের….

বর্ণবাদের ছড়া ইনি মিনি মাইনি মো

চার পঙক্তির ছড়াটি সেকালের তো বটেই, এবং একালের শিশুদেরও মুখস্তই বলা যায় : ইনি মিনি মাইনি মো ক্যাচ অ্য টাইগার বাই দ্য টো ইফ হি হোলার্স লেট হিম গো ইনি মিনি মাইনি মো হোলার মানে চিৎকার চেঁচামেচি করা, কিন্তু ইনি মিনি মাইনি মো-ও মানে কি? হাট্টিমাটিম টিম কিংবা এলাটিং বেলাটিং এর যা মানে ইনি মিনি….

error: Content is protected !!