Author Picture

মঈনুস সুলতানের একগুচ্ছ কবিতা

মঈনুস সুলতান

ঋষিবৃক্ষের রূপালি ছায়ায়
.
ভালো হয়েছে, এসেছো আজ গল্ফ ক্লাবে
বসেছো কার্ড টেবিলে পরদেশী তিন যুবকের সাথে
বলছো কথা মৃদু স্বরে শোভণ সদভাবে;

কালকেও দেখেছি তোমাকে
মামবা পয়েন্টে পানশালায়
বসে ছিলে ফ্রেঞ্চ উইন্ডোর পাশে একা,
ঘুরে ফিরে ফ্রিটাউনের হরেক চবুতরায়
নানা মাইফেলে বারবার
আমাদের হয়ে যাচ্ছে দেখা;

মোমের আলোয় অদৃষ্ট ছুঁয়ে কাল বেজায় বিষন্ন ছিলে
বার কাউন্টার থেকে যখন ড্রিংকস নিলে,
মৃদু হেঁটে মৎস্যকন্যার লাস্যে
কটিতটে দোলনচাপার ছন্দ মাধুরী রটে
চোখে চোখে অভাজনের ধারাভাষ্যে;

আজকে সাবলীল ক্লাবখানায়
নৃত্যের মেহগিনি পাটাতনে
দেহে তোমার বক্ররেখা নিসর্গের খেয়ালে,
আঙিনায় ঋষিবৃক্ষের পাতা কাঁপে আনমনে—

বাটিকের চিত্রিত বনে আদিম গুহার দেয়ালে
আঁকা গুল্মময় ত্রিভুজ
সারাসিনের স্থাপথ্য বিশেষ,
বুকে ধরে রাখো কম্পমান জোড়া গুম্ভুজ;

এসো, কথা বলি
কিনে দেই কাটগ্লাসে টলটলে ককটেল,
এভাবে হয় জেনো, মাছের ছায়া দেখে
সৈকতে শুভ্র সিগাল উদ্বেল;

কাছে এসো, বাইরে যাই
সিগ্ধ আঙিনাতে ঋষিবৃক্ষের রূপালি ছায়ায়
একটু দাঁড়াই,
দ্যাখো —ঘাসের সবুজ ধনেখলিতে
পপকর্নের মতো ঝরছে জেসমিন,
তুমি ভালোবাসো ধ্বনি
পাঁজরের আইপডে মৃদুস্বরে শোনো
হৃদয়ের তাধিন;

রূপজীবা নও তুমি
না-আঁকা চিত্রপটের বিমূর্ত ভাবনায় বিভোর ভার্জিন,
ওভাবে চাইনি তো তোমাকে
শুধু পরশের পাপড়িতে বিভোর হয়েছি
অচল মুদ্রার মতো বহু ব্যবহারে আমি অর্বাচীন;

ঠোঁটে ধরে আছো যে সিক্ততা
তিতমধুর সুরভীতে ভরা ভারমুথ,

গ্রীবার আকাশনীলে কীভাবে যেন
আঁকা হয়ে যায়
মহুয়ার মোহরের ছাপ নিখুঁত;

কালকে আবার এসো
সমুদ্রপাড়ে ক্যাফে সাফরানে বসি আমি
দুপুরবেলা প্রতিনিয়ত,
সৈকতসূর্যের নিরিবিলিতে পান করো
এক পেয়ালা মাকিয়াতো,
জানা যাবে আগ্রহ তোমার প্রণয় না পারফিউমে,
আমি আছি প্রাচীন মুদ্রা মানচিত্র
আর অপ্রকাশিত পান্ডুলিপির ভলিয়ুমে;

আসবে কিন্তু
জানো তো ফ্রিটাউনে উড়ছে আজকাল অজস্র বাদুড়—
তাদের কালো ডানায় ছড়াচ্ছে কলংকিনী ইবোলা,
বলা তো যায় না কখন কীভাবে রদ হয়ে যায়
আমাদের পথচলা।

 

সার্কাসের নারী, গ্রীক যুবক ও ক্রুজের প্রস্তাব
.
আমি জানি—কালপুরুষের তরবারী ঢলে পড়লে পশ্চিম আকাশে
চুপিসারে ঢুকবে তুমি রিক্রিয়েশন ভিহেকুলের কেবিনে আধো অন্ধকারে,

পরিমিত পান ও অন্তরঙ্গ উষ্ণতায় দাঁড়াবে গ্রীক যুবকটির পাশে
মঞ্চের মেকাপ মুছে মেখলায় জড়িয়ে কটি পরবে সিল্কের লনজারে।

ছেলেটি তুখোড় এথলিট— শরীরে তার বর্শার মতো ঋজু পৌরুষ
পরফরমেন্সের শেষে শুভেচ্ছা জানাতে তোমার সাথে কথা হয়েছে সামান্য,
তারপর এসেছি ফিরে সার্কাসে— তোমার কুশলী প্রদর্শনীতে হয়েছি বেহুঁশ
তারিফের ফুলঝুরি ফুটেছে আমার অভিব্যক্তিতে— রূপালি বাসনা হয়েছে বন্য।

কেনিয়ার হানিগাইড পাখিটির মতো এসেছি ফিরে মঞ্চের বর্ণিল মৌচাকে
এক চাকার সাইকেলে প্যাডেল মেরে তুমি— হাতে অস্ট্রিচ পাখির জোড়া ডিম,
অবলোকনে উদ্দীপ্ত হয়ে আমার চোখের রঙতুলি অবচেতনে তোমাকে আাঁকে
অগ্নিকুন্ডের উপরে দাড়ির সাঁকো তুমি পেরিয়ে যাও —রুদ্ধশ্বস দর্শকের রক্ত হিম।

শেষ অংকে জলাশয়ের ভেতর বৃত্তাকার এক চিলতে দ্বীপাণুতে রোলারস্কেট পায়ে
তাকিয়ে থাকি— নৃত্যে উষ্ণ হও তুমি— কম্পমান অর্কিড তোমার কাঁচুলির গিঁটে,
ঘূর্ণয়মান শরীরে ওড়িশি নৃত্যের মুদ্রা ফুটে— দর্শক বিহ্বল তার লীলুয়া ঘায়ে
প্রশংসার মল্লিকা ঝরে জলপাইয়ের নির্যাস মাখা তোমার আধখোলা পিটে।

প্রদর্শনী শেষে এসে দাঁড়াও টিকিট বুথের চাতালে গনসংযোগের প্রয়াশে
পুষ্পের অঞ্জলিতে ভরপুর হয়ে মৃদু হাসো— গ্রীক যুবকের হাতে রাখো হাত,
খুব কাছ থেকে হলো যে দেখা—এ-ও বা কম কী করমর্দনের জোশাল উচ্ছাসে
যাবে সামুদ্রিক ক্রুজে— এ বর্ণিল প্রশ্নে ঝরে তোমার চোখে আলোকের সম্পাত।

 

দিনের শেষে এসে পৌঁছি
.
দিনের শেষে আমরা এসে পৌঁছি চম্পাসাকে
পেনিনসুলায় তৈরী হয়েছে
তিনটি গোলমোহরের ত্রিবেনী রেখায় একটি ত্রিভুজ,
আমাদের নাওখানি বাঁধা খানিক দূরে নদীর বাঁকে,
উপবনে হাঁটি— ঝরা বকুলে ঢাকা উঁইঢিবিতে
পেয়ে যাই ইস্পিত সৌরভের খোঁজ।

বাগিচায় কাঠের সেঁতু
পাড়ি দিতে গিয়ে আমরা সেরে নেই দিনযাপনের কথা,
ভাবি—চম্পাসাকে এলাম কী হেতু
জানি না তো রাজবাটিতে বসবাসের প্রচলিত প্রথা,
সিরামিকের জোড়া হাতির পাহারায়
চিত্রিত টাইলসের সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে যাই
নির্বাসিত কুমারের রাজপ্রাসাদে,
পোষা রোহিতের সঞ্চালনে সচকিত হয় গড়খাই,
আমাদের যুগল খোয়াব আটকা পড়ে পড়ো পুরির ফাঁদে।

ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি— পাহাড়ি নদী
প্যাঁচিয়ে ধরেছে শিলাপাহাড়ের কোমর,
আধডোবা পাথর ছুঁয়ে বয়ে যায় গোধূলি মাখা জলধি
অপ্রত্যাশিত অন্তরঙ্গতায় আমার পাললিক ভূমি হয় উর্বর।

জলজ গুল্ম জড়ানো ঘাসের আড়ালে শুভ্রতা ছড়ায়
খেয়ালি গ্রীবা তুলে অন্যমনস্ক এক বৃদ্ধ বক,
অঙ্গিকার শব্দটি ছলকে আমার ভাবনার পরিখায়

বেভুল ভবঘুরে— হবো না তো ফের বিশ্বাসঘাতক?

 

কালাহারির চেরাগ শিহরিত নিশীথে
.
কালাহারির বালুকালিপ্ত ধূসরে যখন খুঁজে পাইনি তাঁবুর ঠিকানা
ঊঁইপোকার শয়ণমন্দির ছাপিয়ে— প্রপাতের ঝরঝর জলপদ্যে
বেজেছে ঝিল্লির টংকার— শুনেছি যেন দিব্য পরোয়ানা,
চেরাগ শিহরিত নিশীথে কবোষ্ণ হয়েছি তোমার সান্নিধ্যে
কেন জানি মনে হয়েছে—তুমিই ঈস্পিত ইবাদত,
নিক্ষিপ্ত নক্ষত্রের ঘায়ে তবে কী দেখিয়েছিলে সঠিক পথ;

হরস্কোপে যদি লেখাই ছিলো— থেকে যাবো জনমভর বেভুল বিভ্রান্ত
কালাহারির কালনিদ্রা থেকে সদ্য জেগে ওঠেছে যে বালুকার ডুন,
জলমগ্ন চোরাবালির গোলকধাঁধায় কেন ঘুরালে অবিশ্রান্ত..
দেখালে কেন উটকন্ঠক উদ্ভিদের বিরল প্রসূন?

না, পাইনি খুঁজে পাথর-বালুকায় লিপ্ত প্রাণীর জীবাষ্মে জনমের বিশ্বাস
নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে সন্ধান করেছি দুঃসাহস— হ্রাস করোনি সন্ত্রাস..
কর্পূরের কাসকেটে পুরে দিয়েছো প্রত্যাশা,
রুদ্রাক্ষের বিশুষ্ক কোষে গুনেছি প্রতীক্ষার প্রহর—
নিরুপম চালে খেলেছি পাশা,
কখনো মনে হয়নি— তুমি শ্বশত অবিনশ্বর;

সরে গেছো বহুদূরে ..তারপরও মনে হয়েছে
নিসর্গ নিত্য সহনশীল.. শিশিরের সিক্ত মঞ্জীরে সুদৃশ্য,
থেকেছো ম্যামথের তৃষায় তুমি.. জনমভর অদৃশ্য।

আরো পড়তে পারেন

রিয়াসাত আল ওয়াসিফের একগুচ্ছ কবিতা

রেট্রোসপেক্টিভ বই সাজাতে সাজাতে জনৈক কবির মনে হলো— এত এত বই কবে পড়ব! এই ফোকাস হারানো সময়ে মানুষ যেন গুড়ো গুড়ো কাচ। হঠাৎ তাঁর মনে হলো বই বাদ দিয়ে আজ বরং পাপগুলোকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা যাক। কতদিন দেখেনি দেখতে চায়নি, দেখা হয় না, দেখা যায় না। যাপিত জীবনের কাদায় শুধু মুখ ঢেকে যায়। মুখ….

সাযযাদ আনসারীর একগুচ্ছ কবিতা

ঋতু রমনী অন্তহীন পথের মত ছিলো ঋতু রমনী চেনা পাতা ও পাখি থেকে অচেনা ফুলের পথে চলে গেল সে। কথা ছিলো তার সাথে রাগ-রাগিনীর কথা ছিলো অসংখ্য পত্র-পল্লবীর, কথা ছিলো আমাদের নাম উড়াবার কথা ছিলো কত কথা দেবার নেবার। এই খানে আমাদের মন অন্ধ অধীর এই খানে না বাঁধা ঘাট জীবন নদীর, এই খানে পথে….

আজাদুর রহমানের তিনটি কবিতা

দূরত্ব একটা ধারণা আমাদের মধ্যে কোন দূরত্ব নেই। তুমি যেভাবেই থাকো, শুয়ে-বসে-দাঁড়িয়ে সামনে-পিছনে-ডাইনে-বায়ে তোমার যেভাবে মন চায় এমনকি পরস্পর গভীর আলিঙ্গনেও। তুমি যেখানেই থাকো ঢাকা বগুড়া চট্রগ্রাম আমেরিকা কোস্টারিকা কিংবা পৃথিবীর যে কোণাতেই, আমাদের মধ্যে এতটুকু দূরত্ব নেই। দূরত্ব বলে আসলে কিছুই নেই এই যে ছায়াপথের পর সুদূরে জ্বলছে যে তারা সেখানে কেউ কারও দূরে….

error: Content is protected !!