Author Picture

সক্রেটিসের কাছ থেকে একজন নেতা কী শিখবেন?

রেজাউল করিম রনি

আমাদের প্রত্যেকের মনেই একজন সক্রেটিস বাস করে। কথাটা সাধারণভাবে একটু বাড়িয়ে বলা বা বাহুল্যদোষে দুষ্ট মনে হতে পারে কিন্তু আমরা যদি সক্রেটিসকে একজন ব্যক্তি হিসেবে না দেখে একটা চরিত্র বা একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্যসুলভ আচরণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি তখন আর মেনে নিতে সমস্যা হওয়ার কারণ থাকে না। মানে সক্রেটিস একটি নাম মাত্র নন বরং একটি স্বভাব। সেটা কেমন স্বভাব? এই কথাটির উত্তর চট করে দেয়া যাবে না। এটাকে সক্রেটিসীয় স্বভাব বলা গেলেও। এক কথায় ভালো বা মন্দ স্বভাব বলা যাবে না। আপাত ভাবে এটাকে আমরা সত্য/ প্রজ্ঞানেস্বী স্বভাব হিসেবে আখ্যায়িত করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারি।

সক্রেটিসের জীবনকথা এতো এতো বলা হয়েছে যে, আগ্রহীদের জন্য নতুন করে বলার কিছু নাই। ফলে এখানে আমরা সক্রেটিসের জীবনের সন্ধানের বদলে আজকের দিনে একজন নেতা/লিডারের জন্য সক্রেটিসের শিক্ষা কি কাজে আসতে পারে সেই দিকগুলোই সংক্ষেপে আলোচনা করতে চেষ্টা করবো। এই প্রসঙ্গে যতখানি সক্রেটিসের জীবনকে আমাদের দরকার ততখানিই এখানে অবতারণা করা হবে। সক্রেটিস এমন ব্যক্তি যার নিজের জীবন ও তাঁর প্রচারিত দর্শনের মধ্যে কোন ভেদরেখা নাই। ফলে তাঁর জীবন আলোচনা আর তাঁর দর্শনের আলোচনা শুধু সমার্থকই না। বরং দর্শনের ইতিহাসে সক্রেটিসই প্রথম দর্শনকে অতি বায়বীয় বা শুধু অলৌকিক, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের আলোচনার পরিমন্ডল থেকে প্রতিদিনের জীবনের অপরিহার্য অংশ করে তুলেন। নৈতিক জীবনের জন্য অপরিহার্য করে তুলেন। ফলে তাঁর প্রতিদিনের জীবন যাপন ও তাঁর দর্শন একাকার হয়ে উঠেছে স্বাভাবিক ভাবে। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি সক্রেটিস যেই অর্থে নিজের জীবন ও দর্শনকে একাকার করে যাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে মৃত্যুর মধ্য দিয়ে অমরত্বের শিখরে পৌঁছে আজ তিনি একটি নাম শুধু নয় একটি বৈশিষ্টে পরিণত হয়েছে এবং এটা একজন রাজনৈতিক নেতার জন্য খুবই জরুরী। বা একজন নেতার চরম সার্থকতার উড়ান্ত পর্বে এই বাসনাই বিরাজ করে। তিনি একটি নাম থেকে হয়ে উঠতে চান একটি— গুন, নীতি বা ইতিহাস। ফলে সক্রেটিসের জীবন/দর্শনকে এই দিক থেকে পাঠের সরাসরি কিছু উপকারীতা রয়েছে।

ক.
জ্ঞানের মূল কথাই হলো আত্মজ্ঞান
—সক্রেটিস

‘নলেজ ইজ পাওয়ার’ বা জ্ঞানই শক্তি এই কথাটি আমরা অনেকদিন থেকে শুনে আসছি। ফলে ক্ষমতার জন্য জ্ঞান দরকার। আর যে দর্শনিক প্রকৃত অর্থে সত্যিকারের জ্ঞানের সন্ধান করেছিলেন তিনি হলেন, সক্রেটিস। জ্ঞান কী? এই প্রশ্নের সুরাহা না করেই তখনকার গ্রিসের সমাজে যেমন বহু মানুষ নিজেদের জ্ঞানী হিসেবে পরিচিত করাইতেন এখনও তেমন প্রবণতার জোয়ার বেড়েছে বই কমেনি। ফলে সক্রেটিসকে জ্ঞানের প্রকৃতি কি তা সন্ধান করতে দেখা যায়। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি যেই সিদ্ধান্তে উপনিত হন তা হলো, আত্মজ্ঞান বা নিজেকে জানা। আর নিজেকে জানার একমাত্র উপায় হলো সদগুণ অর্জন করা। সেই দিক থেকে তিনি মনে করতেন, সদগুণই জ্ঞান। এবং বেশ কিছু সদগুণকে তিনি পরীক্ষা করে দেখেন। তিনি গ্রিসের সেই সময়ের সেরা চিন্তক, সাধারণ নাগরিক, কবি, রাজনীতিবিদ সবার সাথেই আলাপে শামিল হন। যেসব সদগুণকে আমরা জানি বলে ধরে নিয়ে সেগুলোর চর্চা করি তিনি সেগুলোর প্রকৃত সত্যরুপ খতিয়ে দেখতে শুরু করেন। এবং এই বিষয়গুলো একজন নেতার জন্যও সুরাহা করা জরুরী। যেমন তিনি প্রশ্ন করেন— সংযম কী? জ্ঞান কী? অভিমত কী? সাহস কী? বন্ধুত্ব বা প্রেম কী? ধার্মিকতা কী? রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সম্পর্ক কী? নৈতিকতা বা ব্যক্তিগত নৈতিকতা কী ইত্যাদি বিভিন্ন প্রশ্নই আজ আমরা সক্রেটিসীয় সংলাপ আকারে পাই। যেগুলোর বেশির ভাগই তার শিষ্য বা অনুরাগী প্লেটো আমাদের জন্য লিখে রেখে গেছেন।

সেই সময়ের ছদ্দ চিন্তক ও বুদ্ধিজীবীর কাছে সক্রেটিস একটি বিড়ম্বনা আকারে হাজির হয়। তাদের জ্ঞানী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার এই ছল তিনি উম্মোচন করে দিতে শুরু করেন

সক্রেটিসের জীবনের অন্যতম মিশন ছিল যে কোন বিষয়ের ‘সত্য জ্ঞান’ অর্জন করা। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি সেই কালের সফিস্ট বা ছদ্দ চিন্তকদের পরখ বা বিচার করতে শুরু করেন। তিনি দেখাতে চান আমরা যা জানি বলে দাবি করি তা আসলেই কী আমরা জানি? তিনি অন্যদের চেয়ে নিজেকে এই জায়গায় আলাদা করেন যে, অন্যরা নিজের অজ্ঞতা নিয়ে জানে না, আর আমি জানি যে আমি জানি না। ফলে সেই সময়ের ছদ্দ চিন্তক ও বুদ্ধিজীবীর কাছে সক্রেটিস একটি বিড়ম্বনা আকারে হাজির হয়। তাদের জ্ঞানী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার এই ছল তিনি উম্মোচন করে দিতে শুরু করেন। এবং এরই পরিনামে এইসব সফিস্টদেরই মিথ্যা অভিযোগে তাকে মৃত্যদন্ড দেয়া হয়। এবং তিনি তা মেনে নিয়ে পশ্চিমা দর্শনের ইতিহাসে এক বিরাট ইভেন্ট বা নয়া সূচনা বিন্দুর আরম্ভ করেন। যা আজকের দর্শনের ইতিহাসের এক অন্যতম প্রধান পাটাতন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

চিন্তা করলে দেখা যাবে সক্রেটিস যেসব সমস্যার মোকাবেলা করেছিলেন একজন প্রকৃত নেতাকেও একই সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। কেউ যখন বুঝতে পারেন তিনি প্রকৃত অর্থেই নেতা। তিনি নেতা ও নেতৃত্বের সব গুণের অধিকারী এবং জনগনের কল্যাণের জন্য যথার্থ কাজের উপযোগি ব্যক্তি। কিন্তু তিনি বিপুল ছদ্দ নেতাদের দ্বারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন। অন্যদিকে তিনিই যে আসলে প্রকৃত বা সত্য নেতা তা-ই বা প্রমাণ করবেন কী ভাবে— এটাও একটা বড় সমস্যা। আর এই ক্ষেত্রে সক্রেটিসের পদ্ধতি এখনও বেশ কার্যকরী। আর সেই পদ্ধতি হলো তাকে সব কিছুর উপরে স্থান দিতে হবে সত্যকে। তিনি সাময়িকভাবে পরাজিত হতে পারেন কিন্তু তার ধারণ করা সত্য কখনও পরাজিত হবে না। ফলে নিজের ব্যক্তি যোগ্যতার নিরিখে নয়, বরং তাঁকে সেরা হতে হবে সত্যের মাপকাঠিতে এবং চারপাশের ছদ্দ নেতা বা নেতৃত্বকে এই সত্যের বিচারে উপনিত করতে হবে বা চ্যালেঞ্জর মুখে ফেলতে হবে। এই পরীক্ষায় ছদ্দ নেতাগুলো ছিটকে পড়লে প্রকৃত নেতার পক্ষে সহজেই নিজের জরুরতকে হাজির করা সম্ভব হবে। কেননা মানুষের জীবনে সব কিছুর চেয়ে বেশি প্রয়োজন সত্যের। সত্যের পথে অটল থাকার জন্য, আত্মজ্ঞান অর্জনের জন্য সক্রেটিস যে নীতি-দর্শনের সূচনা করেন একজন নেতার জন্য আজও তা কাজের হতে পারে। বিশেষ করে এখন যখন সত্য আর মিথ্যার পার্থক্য করতে না পেরে জনতা চরমভাবে বিভক্ত ও বিভ্রান্ত।

খ.
আমার বিশ্বাস হাতেগোনা দুই-একজন অ্যাথেনীয়র মধ্যে আমি একজন সম্ভবত একমাত্র অ্যাথেনীয় যে সত্যিকার রাজনীতি চর্চা করে এবং সমকালের লোকজনদের মধ্যে আমিই সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়ক।
— সক্রেটিস
(গর্জিয়াস। অনুবাদ: আমিনুল ইসলাম ভুইয়া, প্রকাশক: পাঠক সমাবেশ, ঢাকা)

সারাজীবন কঠিন দারিদ্রতার সাথে লড়তে হয়েছে সক্রেটিসকে। সমৃদ্ধ অ্যাথেন্সের পথে পথে ঘুরে বেড়োনো মলিন পোষাক আর নগ্নপায়ের এই দার্শনিক নিজেকে প্রকৃত রাষ্ট্র-নায়ক বলছেন! নগরীর প্রচলিত আইনও তিনি মেনেই চলতেন। তিনি অ্যাথেনীয় গণতন্ত্রের হুবহু পক্ষে ছিলেন এমন কথা যেমন বলা যায় না, আবার তার জীবদ্দশায় অ্যাথেন্সে যখন স্বৈরশাসন কায়েম হয়েছিল সেটার পক্ষে ছিলেন তাও বলা যায় না। বরং তিনি তার সময়ের অ্যাথেন্সের জ্ঞানগত উন্নতি সাধনের চেষ্টায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। তিনি যে বিচারের নামে অবিচারের কবলে পড়ে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত হলেন তা তথাকথিত গণতান্ত্রিক আইনের মাধ্যমেই কার্যকর করা হয়েছিল। ৫০০ জন জুরীর ভোটে এই রায় নির্ধারিত হয়েছিল। যার মধ্যে অনেকেই সক্রেটিসের অনুসারী ছিলেন। অনেক ছদ্দ চিন্তক তখন সক্রেটিসের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন এবং তাদের সংখ্যাই ছিল বেশি। সক্রেটিস দেখেছিলেন, প্রকৃত সদগুণ ও সত্যকে পাশ কাটিয়ে যে ধরণের শাসননীতি চালু করা হয়েছে তা গণতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র বা অভিজাত শাসনতন্ত্র যাই হোক না কেন তাতে নাগরিকদের কোন কল্যাণ হবে না। আত্মার উন্নতিকে অবজ্ঞা করে নগরের উন্নয়ণের যে নীতি নেয়া হয়েছে তাতে কাজের কাজ কিছু হবে না। মৃত্যুর আগে তিনি জবানবন্দিতে বলেন, “সারা জীবন আমি চুপ থাকিনি। অধিকাংশ মানুষ যেসব জিনিস নিয়ে মাথা ঘামায়— অর্থকড়ি, সহায়-সম্পত্তি বানানো, সামরিক পদ লাভ, বক্তৃতায় নাম কামনো, রাজনৈতিক পদ দখল করা, ষড়যন্ত্র আর দলবাজিতে অংশগ্রহণ করা— এইসব আমি অবহেলা করেছি। তাই আমি এমন পথে হাঁটিনি যাতে আমার নিজের কোন উপকার হবে না, আপনাদেরও হবে না; বরং প্রত্যেকের দুয়ারে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে আমি আপনাদের সেবা করার চেষ্টা করেছি। আমার দৃষ্টিতে যে সেবা সবার জন্য সবচেয়ে সেরা সেবা তাই’ই করার চেষ্টা করেছি। আমি আপনাদের বুঝানোর চেষ্টা করেছি, কেউ যেন কেবল নিজের বিত্তবৈভব নিয়ে মাথা না ঘামায়, নিজের প্রকৃত উৎকর্ষ ও জ্ঞান অর্জনের চেষ্টা করে নিজের পরিচর্যা করে। নগরীর সম্পদের কথা চিন্তা না করেই খোদ নগরীর পরিচর্যা করে।” ( সক্রেটিসের জবানবন্দি, অনুবাদ, আমিনুল ইসলাম ভুইয়া)

নিজের জীবন নিয়ে সেই কাজ করে গেছেন। তাঁর সময়ে অ্যাথেন্স গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের এক গৌরবজনক সমৃদ্ধিতে পৌঁছেছিল

এই বক্তব্য থেকে সক্রেটিসীয় রাজনীতির একটা ধারণা পাওয়া যায়। এই জন্যই তিনি নিজেকে রাষ্ট্রনায়ক বলছেন। তিনি সমাজের প্রতিটি মানুষের সবচেয়ে জরুরী যে জ্ঞানগত উন্নতি করা— সেই দিকে মনযোগ দিয়েছেন। এবং নিজের জীবন নিয়ে সেই কাজ করে গেছেন। তাঁর সময়ে অ্যাথেন্স গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের এক গৌরবজনক সমৃদ্ধিতে পৌঁছেছিল। এবং এটা নিয়ে নগরের বাসীন্দাদের গর্বেরও সীমা ছিল না। কিন্তু তিনি দেখছেন এই গণতন্ত্রের মধ্যে ফাঁক রয়ে গেছে। আর সেই গলদ কাটিয়ে উঠতে হলে দরকার জ্ঞানের সাধনা। এবং যেই ধরণের ছদ্দ/নকল জ্ঞানের গর্বে অ্যাথেন্স ভাসছে তাকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠিত সব মূল্যবোধকে পরীক্ষা করার এক অভিনব পদ্ধতী গ্রহণ করলেন। এই পদ্ধতীকে এলেংকাস বা খন্ডননীতি বলা হয়। তিনি নগরীরর সেরা রাজনীতিবিদ, দার্শনিক ও সাধরণ নাগরিক, শ্রমিক এমনকি দাসদের সাথেও সংলাপে বসেন। এইসব সংলাপে আমরা দেখতে পাই একটি বিষয়ের প্রতিষ্ঠিত যে সংজ্ঞা, মত বা জ্ঞান জনগণ পোষণ করেন তা প্রকৃতই ‘সত্য’ জ্ঞান কী না। এর মধ্যে কোনো সত্য আছে কিনা তা তিনি খতিয়ে দেখতে চান। এমন না যে তিনি দাবি করছেন তিনি সেইসব বিষয়ের সত্যজ্ঞান রাখেন বা জানেন। তিনি যে সব সংলাপে এইসব বিষয়ের সমাধান দিয়েছেন এমনও না। তিনি কার্যকরভাবে, সংলাপে খন্ডন পদ্ধতির যুক্তিশীল প্রয়োগের মাধ্যমে এইসব বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। আমরা যা নিশ্চিতভাবে জানি সেই জানার, সেই নিশ্চিত জ্ঞানের সত্যতার যাচাই করে দেখতে চেয়েছেন। এবং সবাইকে সাথে নিয়ে প্রকৃত ও সত্য জ্ঞানে পৌঁছানো যায় কিনা সেই চেষ্টা করেছেন। নগরীর সবাইকে তিনি প্রকৃত জ্ঞানের আলোকে নিজেকে ও সমাজকে উন্নত করার কাজে আহবান করেছেন। এটাই তাঁর রাজনৈতিক প্রকৃয়া। এই জন্যই তিনি নিজেকে প্রকৃত রাষ্ট্রনায়ক বলছেন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, সক্রেটিস তথাকথিত গণতন্ত্রের ও স্বৈরতন্তের কোনটিই নয় বরং সত্য জ্ঞানের শাসনের জন্য নগরীর মানুষকে প্রকৃত জ্ঞানের দিকে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছিলেন। সেইদিক থেকে সক্রেটিসের রাজনৈতিক দিশা বা শাসন পদ্ধতিকে জ্ঞান ও সত্যের শাসন কায়েমের সংগ্রাম হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।

এবার আমাদের চলতি সময়ের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখা যাবে তখনকার অ্যাথেন্সে যে সমস্যা ছিল তা আজও রয়ে গেছে। গনতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্র কায়েম হচ্ছে দেশে দেশে। কারণ গনতন্ত্রের যে নীতিগুলোকে সত্য বলে ধরে নেয়া হয়েছে তার মধ্যে প্রকৃত সত্য নাই। সবাই সত্যের কথা বলছে কিন্তু মিথ্যা আর লুটের প্রতিযোগিতায় সাধারণ মানুষের জীবন দিনদিন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এই সমস্যার সামাধনে সক্রেটিসের পদ্ধতি আজও কার্যকর বলে বিবেচিত হতে পারে। উন্নয়ণবাদি বা সম্পদের দিকে মানুষের দৃষ্টিকে আবদ্ধ করে রাখার নীতি কোনো কাজের কাজ হতে পারে না। সক্রেটিস এই ধরণের নীতির বিরুদ্ধে বলতেন, ‘সম্পদ থেকে সদগুণ জন্মায় না বরং সদগুণ থেকেই আসে অর্থ এবং মানুষের জন্য ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবনের অন্যান্য উত্তম জিনিস।’— এটাই তিনি প্রচার করেছেন অ্যাথেন্সের পথে পথে।

ফলে সদগুণ অর্জনের প্রচেষ্টাকে বাদ দিয়ে সম্পত্তি দিয়ে উন্নতি অর্জনের প্রচেষ্টার নীতি একজন শাসকের জন্য কোন ফল বয়ে আনে না। তাতে প্রকৃত অগ্রগতি কায়েম হয় না। কাজেই আজকের এই ভোগের চরম প্রতিযোগিতার কালে উন্নতি ও সম্পত্তিমূখিন নীতির কারণে মাষের মধ্যে বৈষম্য যেমন বেড়েছে অন্যদিকে সারা দুনিয়া এক অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। কাজেই সক্রেটিসীয় নীতির আলোকে একজন নেতার জন্য সঠিক কৌশল প্রণয়ন করার গুরুত্বও আজও এতোটুকু কমে না।

ফলে সদগুণ অর্জনের প্রচেষ্টাকে বাদ দিয়ে সম্পত্তি দিয়ে উন্নতি অর্জনের প্রচেষ্টার নীতি একজন শাসকের জন্য কোন ফল বয়ে আনে না

অন্যদিকে জনগোষ্ঠীর এই ধরণের উৎকর্ষসাধণের জন্য রাষ্ট্রক্ষতা দখল করে কাজ করার সুযোগ পাওয়া প্রায় অসম্ভব তাও সক্রেটিস বুঝেছিলেন। তাই তিনি প্রথাগত রাজনৈতিক দলে নিজেকে যুক্ত করেন নাই। জবানবন্দিতে তিনি এইসব বিষয় নিয়ে পরিস্কার করে বলেওছেন। সত্য জ্ঞান ও সদগুণ অর্জন ছাড়া রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চা করলে অন্যায় করা থেকে নিজেকে বিরত রাখা যাবে না। আর কোন অবস্থাতেই অন্যায় করা যাবে না। জীবন গেলেও না। এমনই কড়া সক্রেটিসের নৈতিক নীতি। কারণ অন্যায় করলে আত্মা ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে সেক্রেটিসকে মনে করা যায়, তিনি সদগুণসমৃদ্ধ প্রকৃত বা সত্য জ্ঞান ভিত্তিক রাষ্ট্রনায়কের শাসন পদ্ধতির পক্ষে ছিলেন। পরর্বতী সময়ে প্লেটো যেরকম দার্শনিকের শাসন বা দার্শনিক রাষ্ট্রনায়কের কথা বলেছেন তার মূলে আছে সক্রেটিসরে শিক্ষা। কারণ, তিনি দেখেছিলেন, তথাকথিত গণতন্ত্রের নামে বেশি সংখ্যক অন্যায়কারী লোক কীভাবে একজোট হয়ে সক্রেটিসকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। এই ঘটনা সারাজীবন সক্রেটিসের অন্যান্য শিষ্যদের সাথে প্লেটোকে ব্যাথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। তাই তিনি প্রায় ২৬ টির অধিক সংলাপ রচনা করে সক্রেটিসের চিন্তা ও দর্শনের ভীত পরর্বতী প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার কাজে নিয়োজিত হন।

আজকের দিনেও একজন নেতাকে এইসব দিক নিয়ে ভাবতে হয়। গণতন্ত্রের ত্রুটি চিহ্নিত করতে সক্রেটিসীয় শিক্ষার প্রভাব আজও দুনিয়াতে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তবুও তিনি যেই পদ্ধতিতে এই সমস্যার সামাধানের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চেয়েছেন সেই— প্রকৃত সত্য এবং প্রজ্ঞাময় সত্যের শাসন কায়েমের সাধনার দিকে আমাদের মনযোগ দিতে দেখা যায় না।

গ.
অপরীক্ষিত জীবন যাপনযোগ্য নয়
—সেক্রেটিস

সক্রেটিসের জবানবন্দির এই বাক্যাটি আজ বহুল পরিচি। অনেক জায়গায় কোটেশন আকারে ব্যাবহার করা হয়। কিন্তু একজন নেতার সবচেয়ে বেশি এই পরীক্ষার বা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয় বলে মনে হয়। প্রতিটি মানুষকেই জীবনের বিভিন্ন ধাপে বিভিন্ন রকম পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। নেতার জন্য পরীক্ষা যদিও একটা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু সক্রেটিস এই পরীক্ষিত জীবনকেই আদর্শ জীবন মনে করেন। এবং অপরীক্ষিত জীবন যাপন কারা যাবে, সেটা যাপনযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেন। তার মানে নীতিগতভাবে আমাদের পরীক্ষিত জীবন বেছে নিতে হবে। চ্যালেঞ্জহীন, মসৃন জীবনের জন্য বিভিন্ন কৌশল শিখানো জন্য চারদিকে মটিভেশনাল গুরুদের যে নসিহত শুনি সক্রেটিস তার বিপরীতে অবস্থান নেন। মটিভেশনাল গুরুদের মূল কাজ হলো, কৌশল শিখানো যা কোন না কোনভাবে কোন না কোন সত্যের নকল। আর সক্রেটিসের নীতি হলো, সত্য নীতির শিক্ষা। আর এই শিক্ষার পথ কঠিন। যে সত্য কথা বলেন, তার চেয়ে অপ্রিয় আর কে? প্লেটোর এই বাক্যও বহুল পরিচিত।

এখন আমরা দেখি নেতারা সবচেয়ে বেশি সময় ব্যায় করেন কৌশলের পিছনে। কারণ কৌশল প্রয়োগ করে কঠিন পরীক্ষা এড়িয়ে যাওয়ার পদ্ধতিই যেন রাজনীতির শিল্প হয়ে উঠেছে। কিন্তু সক্রেটিসের শিক্ষা ঠিক উল্টা। কৌশল নয়, নীতির আলোকে চলতে হবে। আর এতে স্বাভাবিক ভাবেই কঠিন পরীক্ষার মধ্যে পড়তে হবে। এই পরীক্ষার মধ্যে পড়াই হবে জীবনের চাওয়া, সাধনা। পরীক্ষা থেকে বেঁচে যাওয়ার নীতি নয় বরং পরীক্ষিত জীবনের নীতিই অবলম্বন করতে বলেন তিনি। কেন না অপরীক্ষিত জীবন যাপনযোগ্য নয়। ফলে চ্যালেঞ্জ বা পরীক্ষা এড়িয়ে বাঁচার যে প্রতিযোগিতা এটা আসলে যে জীবন যাপনযোগ্য নয়—সেই জীবন পাওয়া জন্যই প্রতিযোগিতা। আর এটাই এখন জনপ্রিয় হুজুগ বা প্রবণতা।

সক্রেটিস যখন তার কালের সফিস্টদের মানে ছদ্দ-জ্ঞানীদের দ্বারা, কবি ও রাজনীতিবিদদের দ্বারা প্রচলিত জীবনাদর্শনকে খন্ডন করার বা পরীক্ষা করার নীতি গ্রহণ করেন তখন তিনি ভালো করেই জানতেন, এই পরীক্ষার জীবন তাকে কতটা কষ্টের মধ্যে ফেলতে পারে কিন্তু এই প্রচলিত প্রবণতার পরীক্ষন ছাড়া প্রকৃত সত্য ও জ্ঞানের মর্মতে পৌঁছানো সম্ভব না। আর সত্য ছাড়া, প্রকৃত জ্ঞান ছাড়া জীবনের কোন অর্থও হয় না। ফলে পরীক্ষনের এই কঠিন নীতি পরিহার করে সহজ ও কৌশলী চাতুরির নীতি গ্রহণ আত্মক্ষয়ের শামিল। এবং সক্রেটিস এটা করতে পারেন না। একজন নেতার জন্য যখন সফলতাই মূখ্য হয়, তখন অনেক সময় এই পরীক্ষিত পথ ত্যাগ করে কৌশলের মাধ্যমে সহজ জয়ের পথকেই সেরা বা কার্যকর মনে করতে পারেন তিনি। কিন্তু সেটার কোন এসেন্স বা মর্ম নাই। যেহেতু সত্যের চেয়ে কোন কিছুই আর বেশি মূল্যবান নয় তাই সত্যকে অর্জনের জন্য এই পরীক্ষিত নীতির পথই সক্রেটিসের বিবেচনায় উত্তম পথ।

একজন নেতার জন্য যখন সফলতাই মূখ্য হয়, তখন অনেক সময় এই পরীক্ষিত পথ ত্যাগ করে কৌশলের মাধ্যমে সহজ জয়ের পথকেই সেরা বা কার্যকর মনে করতে পারেন তিনি

এই নীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এতে রাজনীতি শুধুমাত্র একটা ক্ষমতার প্রশ্ন না হয়ে, একই সাথে হয়ে ওঠে সত্য সাধনার একটা ধারা। অর্থ, খ্যাতি, ক্ষমতা সবকিছু শেষ হয়ে যেতে পারে, কিন্তু সত্য অক্ষয়। ফলে এই সত্যকে অর্জনের জন্য পরীক্ষিত জীবনের বিকল্প নাই। তাই অপরীক্ষিত জীবন কোনভাবেই যাপনযোগ্য হতে পারে না। কারণ তাতে সত্যের দিকে ধাবিত হওয়ার কোন প্রচেষ্টা নাই। প্রতিটি মানুষ তো বটেই, এই কথা যদি আমরা একজন নেতার জন্য পালনীয় সত্য হিসেবে বিবেচনায় রাখি তখন গোটা রাজনীতির চলতি চিত্রকে ভিন্নভাবে অনুভব করা সম্ভব হয়। নেতার প্রতিযোগিরা এবং চারপাশের ধান্ধাবাজ ছদ্দ নেতারা যদি খুবই চৌকশ কৌশলের আশ্রয় নেয়, কঠিন ও কঠোর পরীক্ষার পথকে বাইপাস করে অপরীক্ষিত পথে বিজয় অর্জন করতে চায় তখন অন্তিমে যা জুটে তা খুবই লজ্জাকর। তাতে গৌরবের কিছু থাকে ন। যেমন ধরা যাক, একজন নেতা জনগনের রায়কে পাশ কটিয়ে বা জনগের পরীক্ষার মুখোমুখি না হয়ে কৌশলে, প্রতিষ্ঠান দখল করে, টাকার বিনিময়ে বা অস্ত্রের মুখে জনতার রায়কে নিজের করে নিলো এবং সব ক্ষমতার কেন্দ্রে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলো তাতে আদতে যা অর্জন হলো তা আত্মার ক্ষতি ও মানুষ্য জন্মের লজ্জা। এবং এই ক্ষতি এই অন্যায় যখন নীতি হিসেবে জনগনের উপর চাপিয়ে দেয়া হবে তখন সমগ্র জনগোষ্ঠির মধ্যে একনীতিহীন অরাজকতার নীতির প্রতিষ্ঠা হবে, তাতে যে কোন ধরণের উন্নয়ণ ও অগ্রগতির দাবী সরস কৌতুকে পরিণত হবে।

অন্যদিকে যখন একজন নেতা এই অপরীক্ষিত জীবনের পথ পরিহার করবেন। পরীক্ষিত জীবনের দিকে ফিরবেন তখন তাকে প্রথমে নিজেকে প্রকৃত সত্যের দিকে ফিরাতে হবে। এবং পরীক্ষিত জীবনের ভেতর সত্যর দিকে আপোষহীন হয়ে তিনি যদি অটল থাকেন তবে তার পরাজয়েও কোন অগৌরব নাই। কিন্তু নেতাদের মধ্যে যখন মিথ্যার সাথে মিথ্যার লড়াই শুরু হয়। মিথ্যাকেই সত্য হিসেবে আখ্যায়িত করার আয়োজন শুরু হয়, তখন আসলেই এক হতাশার অবস্থা তৈরি হয়। কাজেই প্রতিটি মানুষ তো বটেই একজন নেতাকে সবচেয়ে বেশি স্মরণ রাখতে হবে যে, অপিরিক্ষীত জীবন যাপনযোগ্য নয়। স্কেপ বা সত্য থেকে পালানো মৃত্যুর চেয়ে জঘন্য। আর ছদ্দ নেতা, দার্শনিক বা চিন্তক বা সফিস্টদের এইজন্য স্কেপিস্টও/টলায়নবাদি বলা হয়ে থাকে।

ঘ.
অন্যায়কারী এবং অন্যায়ের শিকার হওয়া মানুষ পরষ্পরের বন্ধু হতে পারে না।
— সক্রেটিস

‘লাইসিস’ নামক প্লেটোর রচিত সংলাপটিতে সক্রেটিস এই উক্তি করেন। এখানে বন্ধুত্ব নিয়ে মূলত কথা-বার্তা শুরু হয়। এবং সক্রেটিস এখানে বন্ধুত্ব বলতে কি বুঝায় সেটার কোন চূড়ান্ত মিমাংসায় পৌঁছাননি কিন্তু প্রতিটি মানুষের জীবনে বন্ধুত্বের প্রয়োজন। এবং ক্ষমতাধর, রাষ্ট্রপরিচালকদের আরও বেশি প্রয়োজন—এমন মতামত দিয়েছেন তিনি। সক্রেটিসের বন্ধুত্বের ধারণার মূল কথা হলো, সদগুণের সাথে সদগুণের বন্ধুত্ব। কোন অবস্থাতেই অন্যায়ের সাথে অন্যায়ের বন্ধুত্ব হতে পারে না। কারণ, অন্যায়কারী ও অন্যায়ের শিকার পরষ্পরের বন্ধু হতে পারে না। তাদের মধ্যে প্রয়োজনের জন্য, কোন কিছু হাসিল করার জন্য সাময়িক সখ্যতা বা ঐক্য হতে পারে কিন্তু বন্ধুত্ব হতে পারে না। কারণ সক্রেটিসের বিবেচনায় বন্ধুত্ব এমন একটি সদগুণ যা অর্জন করতে হয়।

সক্রেটিস ব্যাবহারিক নীতি-দার্শনিক হিসেবে আরও একটি বিষয়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তা হলো, প্রতিশোধ গ্রহণের নীতি। একজন নেতার জন্য বা রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে এই প্রতিশোধ গ্রহণের প্রশ্নটি বারবারই ফিরে ফিরে আসে। এই বিষয়ে নেতাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কারণ— যেকোন নেতাকেই শত্রু-মিত্রের নীতির মিমাংসার মধ্যদিয়ে যেতে হয়। ফলে এই বিষয়ে সক্রেটিসের শিক্ষার গুরুত্ব বলাই বাহুল্য। সক্রেটিস যদিও স্পার্তার বিরুদ্ধে পরিচালিত তিনটি যুদ্ধে নিজের নগরীর পক্ষে অংশ গ্রহণ করেছেন (পতিদিয়া খ্রি. পূর্ব ৪৩২ সালে, দেলিয়াম খ্রি. পূর্ব ৪২৪ সালে এবং অ্যামফিপলিস খ্রি. পূর্ব ৪২২ সালে) । তার পরেও প্রতিশোধ গ্রহণের বেলায় সক্রেটিসীয় নীতি তার অন্যতম শিষ্য ক্রিতোর সাথে আলাপের সময় ব্যাক্ত করেন। তিনি বলেন,
‘বেঁচে থাকা গরুত্বপূর্ন নয়, সত্যিকারে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ভালোভাবে বাঁচা। অন্যায় কাজ কোন অবস্থাতেই ভালো বা সম্মানজনক হতে পারে না। অন্যায় কাজ সব সময়ই মন্দ ও অসম্মানজনক। কোন মানুষের ওপর অন্যায় করা হলে, তাকে আঘাত করা হলে, শত প্ররোচনা সত্যেও এর পাল্টাটি করা যাবে না।’

এই নীতি সেই সময়ের গ্রীসের প্রচলতি নিয়মের বিরোধী। কিন্তু এই নীতি গ্রহণের মূলে সক্রেটিসের এই ধারণা কাজ করছে যে, কোন মানুষই মূলগত বা মৌলিক ভাবে অন্যায়কারী না। অজ্ঞানতাই এইসব অন্যায়ের দিকে মানুষকে নিয়ে যায়। তাই সত্য জ্ঞানের উম্মেষ ঘটাতে পারলেই মানুষ অন্যায়ের ধারা থেকে ফিরে আসবে। এবং তিনি সেই কাজেই সারা জীবন ব্যায় করেছেন। এবং অ্যাথেন্সের ৫০০ জন জুরুীর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের বিচারের রায়ে তিনি মৃত্যুদন্ডের বিধান মেনে নিয়ে হেমলক পান করে মৃত্যু বরণ করেন।

নেলসন ম্যান্ডেলাসহ, প্রতিশোধ গ্রহণ না করার এই নীতি অনেক নেতাকে অনুপ্রাণিত করেছে। অনেকেই প্রতিশোধ গ্রহণের নীতিকে প্রকৃত পথ মনে করেন নাই। মহাত্মা গান্ধীর বিখ্যাত বাক্যা- ‘চোখের বদলে চোখ নেয়ার নীতি পুরো দুনিয়াকে অন্ধ করে ফেলে’— এখানে সেক্রটিসীয় দর্শনের বলিষ্ঠ প্রয়োগ দেখতে পাওয়া যায়।

প্রতিশোধের বেলায় এই ধরণের নীতিগ্রহণই সক্রেটিসীয় দর্শনের সাথে যায়। কেন না সক্রেটিসের কাছে দেহ গুরুত্বপূর্ণ নয়। কারণ, দেহ মরণশীল। আত্মার উন্নতিই আসল কথা। আর প্রকৃত জ্ঞান ছাড়া দুনিয়ার আর কোন কিছু অর্জন করাই যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ নয়, ফলে প্রতিশোধের কোন প্রয়োজন নাই। প্রতিশোধ গ্রহণের মধ্য দিয়ে ন্যায় কায়েম করা সম্ভব হয় না। ফলে একজন নেতা যখন নিজেকে এইসব দুনিয়াবী প্রয়োজনের বাইরে দেখবেন, তখনই কেবল এই ধরণের নীতি গ্রহণের কথা ভাবতে পারবেন।

ঙ.
সদগুনই হলো জ্ঞান
—সক্রেটিস

এটা সহজেই বুঝতে পারা যাচ্ছে সক্রেটিস দুনিয়ার যে কোন সমস্যাকে জ্ঞানের সমস্যা মনে করতেন। ফলে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনই সমস্যা সামাধানের কার্যকর পথ বলে মানতেন। এবার প্রশ্ন দেখা দেয় তাইলে, জ্ঞান কী?
সক্রেটিস দুই ধরণের জ্ঞানের কথা বলেছেন -দেখা যায়। এক. মানবীয় জ্ঞান, দুই. ঐশ্বরিক জ্ঞান। জ্ঞানের চূড়ান্ত হিসেবে তিনি যে ঐশ্বরিক জ্ঞানকে দেখেছেন তা তিনি বিভিন্ন সংলাপে বলেছেন। এবং এটাও বলেছেন মানুষের পক্ষে সেই জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়। তবে মানবীয় বা মানুষের পক্ষে অর্জনযোগ্য যে জ্ঞান তাকে তিনি সদগুণ বলেই চিহ্নিত করেছেন বিভিন্ন আলাপে।

তাহলে যখন প্রশ্ন দেখা দেয় মানুষ যখন অন্যায় করে তখনও অনেকে মনে করে তারা সঠিক কাজটিই করছেন। এটার সমাধান কি? সক্রেটিস মনে করেন, দুটি মন্দের মধ্যে একটি বেছে নিতে পারলে কেউ বড়টিকে বেছে নিবে না বলে মত দেন সক্রেটিস। ছোট্ট সংলাপ মেনোতে তিনি এই বিষয়ে বলেন, ‘যারা মন্দকে মন্দ বলে চিহ্নিত করে না তারাও মন্দকে কামনা করে না। বরং যা ভালো বলে মনে করে তাই কামনা করেন— যদিও আদতে তা মন্দ; যারা অজ্ঞতার কারণে খারাপ জিনিসকে ভালো বলে ধরে নেয় তারা অবশ্যই অন্তর থেকে ভালো জিনিসই কামনা করেন।’

সক্রেটিস মনে করেন যেহেতু মানুষ ভালো হতে চায়, উত্তম হতে চায় ফলে উত্তম হওয়ার প্রতিবন্ধকতা দূর করাই হলো শিক্ষা ও দর্শনের উদ্দেশ্য। এবং এই একই উদ্দেশ্য রাজনীতিরও। নেতা এই নীতিকে গ্রহণ করে উত্তম হওয়ার বাধাসমূহ দূর করার জন্য কাজ করতে পারেন। সেক্ষেত্রে একটা বড় সমস্যা এইসময়ে দেখা যায়, তা হলো, মন্দ জিনিসকে ভালো বলে প্রচার ও প্রতিষ্ঠার ফলে মানুষ মন্দ জিনিসকে সত্যি সত্যিই ভালো বলে ধরে নিয়ে সেটাই কামনা করে। এর ফলে গোটা সমাজের নীতির ভীতই দাঁড়িয়ে যায় দুর্নীতির ওপরে। এই সময়ের রাজনীতির জন্য একজন প্রকৃত নেতার জন্য এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সত্যকে মিথ্যার সাথে মিশিয়ে, মন্দকে ভালোর মোড়কে জড়িয়ে উপস্থাপনের এই প্রতিযোগীতার মধ্যে একজন নেতাকে এই ধরণের সক্রেটিসীয় অবস্থান নেয়ার জন্য কঠোর মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকতে হবে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, সব সমস্যার মূল্যে আছে প্রকৃত জ্ঞান না থাকার সমস্যা। আর সদগুণই যেহেতু জ্ঞান; তাহলে, সদগুণ অর্জন জ্ঞানার্জনের পরিপুরক। একজন মানুষের জন্য তো বটেই, একজন নেতার জন্যও জ্ঞান অর্জনের কোন বিকল্প নাই। এবং এটার নীতি হলো সদগুণ অর্জন করা। সক্রেটিসীয় সংলাপগুলোতে দেখা যায়, তিনি যে কোন সদগুণকে জ্ঞানের বিষয় যেমন করে তুলছেন, একই ভাবে আলাপের মাধমে কোন জ্ঞানের বিষয়কে সদগুণের একটি উপাদান হিসেবে দেখছেন। এবং একটি সদগুণ অপরটির সাথে সম্পর্কিত এমন ধারণাও তিনি ব্যাক্ত করছেন। সদগুণসমূহের মধ্যে একটা যৌথতার সম্পর্ক আছে—এমনটিই দেখা যায় সক্রেটিসীয় চিন্তায়। যাহোক, সদগুণ অর্জন একজন নেতার জন্য কতটা জরুরী তা আর ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। আমরা দেখবো এই সদগুণ অর্জনের সক্রেটিস পদ্ধতি আসলে কীভাবে কাজ করে। সক্রেটিসের পদ্ধতি হলো, প্রশ্ন করা। প্রশ্ন করার মাধ্যমে আমাদের মধ্যে থাকা চিন্তাগুলোকে বের করে নিয়ে আসা এবং সেগুলোকে প্রশ্ন করতে করতে সত্য ও প্রকৃত জ্ঞানে উপনীত হওয়ার চেষ্টা করা। এই হলো এলেংকাস বা খন্ডননীতি।
এভাবে প্রশ্ন করার মধ্যদিয়ে সক্রেটিস যেভাবে তার শিষ্য, ছাত্রদের চিন্তা করতে বাধ্য করতেন। চিন্তাকে উন্নত করতে প্ররোচিত করতেন— এই কৌশল একজন নেতাকে যোগ্য অনুসারী তৈরির কাজেও সমান ভাবে সহযোগিতা করতে পারে।

নীতি গ্রহণের মূলে সক্রেটিসের এই ধারণা কাজ করছে যে, কোন মানুষই মৌলিক ভাবে অন্যায়কারী না। অজ্ঞানতাই এইসব অন্যায়ের দিকে মানুষকে নিয়ে যায়

সক্রেটিস স্থির-নির্দিষ্ট কোন কিছুর সংজ্ঞা দিতে চাইতেন না। বরং যে সংজ্ঞাগুলো আছে সেগুলোকে খন্ডন করতেন। খন্ডন করতে গিয়ে দেখা যেত এই ধরণের সংজ্ঞায়নে বিষয়টার প্রকৃত মর্ম বা সত্য ধরা যায়নি। কিন্তু তারপরেও সেটাকেই সেই বিষয়ের সংজ্ঞা বা প্রমাণ্যতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। এই পদ্ধতির সাথে সাম্প্রতিক দর্শনের ডিকনসট্রাকশন বা অবিরাম নির্মানের দেরিদীয় পদ্ধতির মিল রয়েছে। সক্রেটিসের জন্মের প্রায় তিন হাজার বছর পরেও একজন দার্শনিক এই পদ্ধতির আলোকে বা এই পদ্ধতির কার্যকরী উন্নত দিক আবিষ্কার করে পশ্চিমা জ্ঞানের জগতে এক বিপ্লবের সূচনা করে দিয়েছিলেন। যাহোক সেই আলোচনা আজকের বিষয় না। আজকে আমরা দেখবো একজন নেতা তাহলে সক্রেটিসের এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে কীভাবে নিজের উন্নতি করবেন। এই জন্য আমরা সক্রেটিসের একটি সংলাপের দিকে নজর দিবো। এই সংলাপ মনযোগ দিয়ে খেয়াল করলে আমরা সক্রেটিসের পদ্ধতির দিকটি স্পষ্টভাবে বুঝতে পারবো। এবং সাম্প্রতিক কালে সক্রেটিসের পদ্ধতী কীভাবে একজন নেতাকে সহায্য করতে পারে সেই দিকটি আলোচনা করেই এই লেখার ইতি টানবো।
‘লেকিজ’ সংলাপটি প্লেটো রচনা করেন ‘সাহস’ বিষয়টি নিয়ে। এখানেও অন্যান্য সংলাপের মতোই সক্রেটিস অন্যতম চরিত্র। লেকিজ ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা। প্রথমে তিনি সাহসের সংজ্ঞা দিয়ে আলোচনা শুরু করেন।

লেকিজ: সেই মানুষই সাহসী যে শত্রুর মুখোমুখি হতে ভয় পায় না, আক্রমনের মুখে পালিয়ে আসে না। যুদ্ধক্ষেত্র দখল করে থাকে। নিশ্চিতই বলা যায় সে-ই সাহসী।

সক্রেটিস এই সংজ্ঞার সূত্রধরে এর সিমাবন্ধতার দিকে দৃষ্টি ফেরাতে চান।

সক্রেটিস: শুধু ভারী অস্ত্রশস্ত্রসজ্জিত পদাতিক সৈন্যদের সাহস বলতে কী বুঝায় তাই জানতে চাচ্ছিলাম না আমি, বরং অশ্বারোহী সৈন্য, অন্য সকল ধরনের সৈন্যরাও সাহস বলতে কী বুঝায় তাও জানতে চাচ্ছিলাম; কেবল যুদ্ধের সময়ে কে সাহসী তা-ই নয়, সমুদ্রে বিপদ কালে কে সাহসী, তাও জানতে চাচ্ছিলাম; আমি বের করতে চাচ্ছিলাম অসুস্থতার মুখে, দারিদ্রকবলিত অবস্থায়, রাষ্ট্রকর্ম সম্পাদনে সাহস কী। অধিকন্তু, কেবল ব্যাথাবেদনা বা ভীতি কাটানোর ক্ষেত্রেই সাহস নয়, লোভ-লালসা এবং সংযমহীনতা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তা কী, তা ও জানতে চাচ্ছিলাম। কারণ— আমি ধরে নিচ্ছি এমন মানুষ আছে যারা এ সমস্ত পরিস্থিতির সবগুলো ক্ষেত্রেই সাহসী। কেউ কেউ আনন্দে সহসী, কেউ কেউ বেদনায় সাহসী, কেউ কেউ কামনা-বাসনায়, কেউ বা অসংযমে বা ভীতিতে সাহসী। আমি কল্পনা করছি হয়তো একই অবস্থায় অন্যরা ভীতু। যাকে আমরা সহস বলি তার সাধারণ গুন কী; কোন সক্ষমতাকে সাহস বলা হয়— যাকে অনন্দ বেদনা এবং যে সমস্ত পরিস্থিতি আমরা এই মাত্র বললাম তার সবগুলোতে পাওয়া যায়। এবার লেকিজ নতুন ভাবে তাঁর উত্তর প্রণয়ণ করতে উদ্যোগী হন।

লেকিজ: যে সর্বজনীন প্রকৃতি উল্লিখিত সকল পরিস্থিতির মধ্যে বিদ্যমান থাকে তা হলো আত্মার একধরণের সহিষ্ণুতা।

সাহসকে মহতী গুণ হিসেবে স্বীকার করা হয় কিন্তু সার্বজনীন সংজ্ঞা ঠিক করা যায় না। কারণ, নির্বোধ এবং মন্দ ও ক্ষতিকর সহিষ্ণুতা নয়, কেবল বিচক্ষণ সহিষ্ণুতাই সাহস বলে দাবি করতে পারে বলে ভাবা হয়। আলোচনায় এ কথাও বেরি আসে, যে ব্যক্তি বিচক্ষণ তার চাইতে বরং নির্বোধ, গোঁয়ার লোকই অধিক সাহস প্রদর্শন করতে সক্ষম। অজ্ঞতা সর্বদাই মন্দ এবং সাহস ও প্রজ্ঞা উত্তম— এমন মৌলিক এক প্রত্যায়ের আলোকে এটি একটি গভীর সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়। সমস্যাটি অধিক গভীর হয়ে দেখা দেয় যখন সক্রেটিস বলেন, ‘শেষ বিচারে সম্ভবত সহিষ্ণুতা আদতেই সাহস।’ লেকিজ এমন অবস্থায় হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন। এই অচলাবস্থা নিরসনে সক্রেটিস নিসিয়াসকে এগিয়ে আসার প্রস্তাব করেন। তিনি সক্রেটিসের আগে বলা একটি কথার সূত্র ধরে বলেন, ‘প্রতিটি মানুষ সেই ব্যাপারে উত্তম যাতে সে জ্ঞানী। আর যাতে সে অজ্ঞ তাতে সে মন্দ। এই কথার সূত্রে বলা যায়, সাহসী মানুষ যদি ভালো হয় তবে সে তো জ্ঞানীও বটে।’ সক্রেটিস নিসিয়াসের বক্তব্যকে পরিস্কারভাবে প্রকাশ করতে এবার বলেন— ‘সাহস এক ধরণের প্রজ্ঞা’। নিসিয়াসের বুদ্ধিবাদী অবস্থান লেকিজসহ অন্য বন্ধুদের পছন্দ হয় না। বিতর্ক জমে ওঠে। সক্রেটিস এবার স্পষ্ট করেন। তিনি বলেন, ‘যা ভীতিকর আর যা আশাব্যঞ্জক তার জ্ঞানই হলো সাহস।’ (সূত্র: সক্রেটিস: জীবন মৃত্যু দর্শন- আমিনুল ইসলাম ভুইয়া, পাঠক সমাবেশ- ফেব্রুয়ারী, ২০২২ ।)

এই সংলাপ মনযোগ দিয়ে দেখলে আমরা সক্রেটিসের পদ্ধতি সহজেই বুঝতে পারি। সাহস নিয়ে কথা বলার জন্য এই বিষয়ে যিনি জানেন বলে আমরা ধরে নেই তেমন সামরিক ব্যক্তিকে ডাকা হয়। এবার তার বক্তব্য পরীক্ষা ও খন্ডন করে ক্রমে ক্রমে এই বিষয়ে সত্য জ্ঞানের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। তার পরে বেরিয়ে আসে এই বিষয়ে সবচেয়ে যৌক্তিক ও কার্যকর জ্ঞানবাক্য ‘যা ভীতিকর আর যা আশাব্যঞ্জক তার জ্ঞানই হলো সাহস’—ভাবেই সক্রেটিস সদগুণ ও প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের জন্য খন্ডননীতিতে রাষ্ট্রের নাগরিকদের উন্নতি সাধনের জন্য সারা জীবন কাজ করেছেন। এখন একজন নেতা বা রাষ্ট্রপরিচালকের জন্যও এইভাবে ক্রমে উত্তমে পেঁছনোর সুযোগ আছে। তার জন্য আগে তাকে জ্ঞানের ভূমিকা বুঝতে হবে, মানতে হবে।

পরর্বতী সময়ে প্লেটো যে পর্যালোচনা জগতে প্রবেশ করেন দর্শনকে নতুন দিশার দিকে নিয়ে যান তা মূলত সক্রেটিসীয় জ্ঞানান্দোলনেরই সম্প্রসারণ। সক্রেটিসের চিন্তার অনেক কিছু তিনি নিয়েছিলেন, অনেক কিছু বাদও দিয়েছিলেন। জনি থাক্কার তার বই—‘প্লেটো এজ এ ক্রিটিক্যাল থিংকার’—এ এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক অংশটি আমলে নিলে দেখা যায় জনি বলছেন, ‘সক্রেটিস মনে করেন শাসকের উইজডম বা প্রজ্ঞার চর্চা করতে হবে। এবং এই প্রজ্ঞার চর্চা তাকে খন্ডিতভাবে করলে হবে না। করতে হবে সার্বিক বা সর্বান্তকরণে।’
সার্বিক বিষয়ে প্রজ্ঞাকে প্রধান্য দিতে হবে। এবং প্লোটের দার্শনিক রাষ্ট্র নায়কের আদর্শ চিন্তা সক্রেটিসের এই ভাবনারই সম্প্রসারণ বই তো নয়। ফলে শাসন পদ্ধতি যাই হোক শাসকের জন্য অবশ্য কর্তব্য হলো উইজডম বা প্রজ্ঞার চর্চা করা। আর প্রজ্ঞা বা জ্ঞান যেখানে সদগুণের সমার্থক তখন আজকের দিনে একজন নেতার জন্য এর চেয়ে আদর্শ পরামর্শ আর কি হতে পারে?

আরো পড়তে পারেন

একাত্তরের গণহত্যা প্রতিহত করা কি সম্ভব ছিল?

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই এক রাতেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে….

ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

আগের পর্বে পড়ুন— চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও একটি সার্থক গণআন্দোলন। এই গণআন্দোলনের মূল চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হলো দেশপ্রেম থেকে জাত সেই অনুভূতি, যার একটি রাজনৈতিক প্রকাশ রয়েছে। আর, বাঙালি জাতিসত্তাবোধের প্রথম রাজনৈতিক প্রকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে দুই হাজার মাইল দূরত্বের….

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল)

আগের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ একুশের আবেগ সংহত থাকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দেও। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। আওয়ামি লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ১৮ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটির সদস্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র….

error: Content is protected !!