Author Picture

ত্বহা হুসাইন এর দিনগুলি

কাউসার মাহমুদ

চার

আসলে অজানা জিনিস জানার ক্ষেত্রে সে ছিল প্রবল অনুসন্ধিৎসু; যা তাকে কষ্ট দিত ও অস্বস্তিতে রাখত খুব। তবে একদিন বিশেষ এক ঘটনা তার এই কৌতূহল দমন করে তার হৃদয়কে লজ্জায় পরিপূর্ণ করে দেয়,যা এখনও অব্যাহত আছে। একদিন বাবা ও ভাইদের সাথে রাতের খাবারের জন্য বসে ছিল সে। মা রোজকার মতোই খাবার পরিবেশনে তদারকি করছিলেন। পরিচারক ও কন্যাদের নির্দেশ দিচ্ছিলেন। মেয়েরা খাবারের প্রয়োজনীয় ডিশগুলো আনতে চাপরাশিকে সাহায্য করছিল। সে তখন অন্যদের মতো খাচ্ছিল; কিন্ত হঠাৎ এক অদ্ভুত চিন্তা তার মাথায় এসে হাজির হয়! সে ভাবে, কী হবে যদি খাবারের কোনো একটি লোকমা এক হাতের পরিবর্তে দু’হাতে নিয়ে মুখে পোরে? আর কী-ই বা তাকে একবার তা পরখ করে দেখতে বাধা দিচ্ছে? অবশ্যই কিছু না! সুতরাং সে দুহাতে একটি লোকমা নেয়। তা মুখে পুরে ধীরে মুখ উঠিয়ে দেখে, তার ভাইয়েরা হাসিতে ফেটে পড়ছে। মার দুচোখ জুড়ে অশ্রু টলমল। বাবা তখন ভারাক্রান্ত কোমল কন্ঠে বলেন, ‘এভাবে খেতে নেই সোনা!’ এই ঘটনাটুকুর পর সেদিন সে অতিক্রম করেছে অস্থির, যন্ত্রণাগ্রস্ত এক রাত।

সেই দিন থেকে তার সমস্ত চলাচল, বিচলন, সীমাহীন এক লজ্জা, ভয় ও সতর্কতার ভেতর শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। সেসময় থেকে সে বুঝতে পারে তার একটি দৃঢ় ইচ্ছেশক্তি আছে। এমনকি তারপর পঁচিশ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকার খাবারের স্বাদ-আস্বাদন থেকেও নিজেকে বিরত রেখেছিল সে। যেমন, তখন ভাত ও সুপ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। এমনকি চামুচ দিয়ে খেতে হয় ওসব খাবারও। কেননা সে বুঝেছিল, চামচ দিয়ে অমন কায়দা করে খাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং কোনোভাবেই সে চাইতো না, এ কারণে ভাইয়েরা তার দিকে তাকিয়ে অমন বিদ্রুপের হাসি হাসুক। মা কাঁদুক আর বাবা ভারাক্রান্ত হয়ে মৃদু ভৎসনা করুক।

সেই দিন থেকে তার সমস্ত চলাচল, বিচলন, সীমাহীন এক লজ্জা, ভয় ও সতর্কতার ভেতর শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে পড়ে। সেসময় থেকে সে বুঝতে পারে তার একটি দৃঢ় ইচ্ছেশক্তি আছে। এমনকি তারপর পঁচিশ বছর পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকার খাবারের স্বাদ-আস্বাদন থেকেও নিজেকে বিরত রেখেছিল সে। যেমন, তখন ভাত ও সুপ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল। এমনকি চামুচ দিয়ে খেতে হয় ওসব খাবারও। কেননা সে বুঝেছিল, চামচ দিয়ে অমন কায়দা করে খাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং কোনোভাবেই সে চাইতো না, এ কারণে ভাইয়েরা তার দিকে তাকিয়ে অমন বিদ্রুপের হাসি হাসুক। মা কাঁদুক আর বাবা ভারাক্রান্ত হয়ে মৃদু ভৎসনা করুক

অবশ্য এ ঘটনাটি তাকে আবুল আ-লা সম্পর্কে প্রচলিত একটি গল্প সঠিকভাবে বুঝতে সাহায্য করেছিল। যেমনটা তারা বলে যে, একদিন তিনি খেজুর বা মধুর গুড় জাতীয় কিছু খাচ্ছিলেন। তখন অলক্ষেই রসের কিছু অংশ তার বুকের ওপর জামায় গড়িয়ে পড়ে। এরপর যখন তিনি দরসে (ক্লাসে) উপস্থিত হন, তখন ছাত্রদের একজন বলে, ‘গুরুজি! আপনি গুড় খেয়েছেন?’ এই শুনে তড়িৎ আবুল আ-লা তার বুকের ওপর হাত রাখেন এবং বলেন, ‘হ্যাঁ। আল্লাহ আমাদের অতিভোজন থেকে রক্ষা করুন।’ এ ঘটনার পর সারাজীবনে কখনও তিনি আর গুড় খাননি। তদুপরি এই ঘটনাটি তাকে আবুল আ-লার অন্যান্য বিষয়াবলি সম্বন্ধেও ধাপেধাপে ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে। যেমন সে বুঝেছিল, কেন আবুল আ-লা কখনো কারো সামনে খাবার খেতেন না! এমনকি তার ভৃত্যের সামনেও না। মূলত মাটির নীচে এক নির্জন প্রকোষ্ঠেই তিনি তার আহারাদি সারতেন। তাই খাবারের সময় হলে ভৃত্যকে ওখানে খাবার রেখে চলে আসার নির্দেশ দিতেন। এরপর একাকী ওই খাবার থেকে যতটুকু ইচ্ছে, যা ইচ্ছে খেতেন।

এছাড়া তারা এ-ও বলে যে, একদিন তার ছাত্ররা আলেপ্পোর সুমিষ্ট তরমুজ সম্পর্কে আলোচনা করছিল। এটা শুনে আবুল আ-লা তাদের জন্য কাউকে ওই তরমুজ আনতে পাঠান। তরমুজ এলে ছাত্ররা তা পেট ভরে খায়। তখন ভৃত্য তা থেকে সামান্য অংশ আবুল আ-লার জন্য তার ওই নির্জন কামরায় রেখে আসে। কিন্তু যেখানে সে রোজ খাবার রাখে, সেখানে না রেখে অন্য স্থানে রাখে।ফলে আবুল আ-লা আর ওই তরমুজের কথা জিজ্ঞেস করতে পছন্দ করেননি। সুতরাং যা হওয়ার তাই হলো। অর্থাৎ ওই তরমুজ নষ্ট হওয়া পর্যন্ত ওখানেই ছিল।কিন্তু তা থেকে সামান্যও চেখে দেখননি তিনি।

আমাদের বন্ধুটি আবুল আ-লার এসব বৈশিষ্ট্যগুলো খুব ভালোভাবেই উপলব্ধি করেছিল। কেননা এসবের মাঝে সে নিজেকেই দেখতে পেত যেন। তাছাড়া শৈশবে কতবার সে এমন নির্জনে খেতে চেয়েছে! কিন্তু কখনোই এ ইচ্ছের কথা পরিবারের কাউকে বলার সাহস পায়নি। তা সত্ত্বেও রমজানের সময় ও বছরের বিশেষ কোনো উৎসবে প্রায়ই সে তার খাবারের অংশটুকু নির্জনে একাকী খেতে পারত। যখন তার পরিবার বিভিন্ন পদের মিষ্টি জাতীয় খাবার খেত; যেসবের বেশির ভাগই আবার চামচ দিয়ে খেতে হতো। তখন সে তাদের সঙ্গে দস্তরখানে খেতে অস্বীকৃত জানাত। এতে মা তার এই পরিহারপ্রিয়তা পছন্দ করতেন না ঠিক। তবু তার জন্য বিশেষ একটি থালা আলাদা করে বিশেষ এক কামরায় রেখে দিতেন। যার ভেতর সে নিজেকে আবদ্ধ রাখতে পারবে এবং খাওয়ার সময় অন্য কেউ তাকে দেখতেও পারবে না।

এরপর যখন সে কিছুটা বোধবুদ্ধির বয়সে পৌঁছে, তখন থেকে এটাকে তার সাধারণ অভ্যেস হিসেবে গ্রহণ করেছিল। এমনকি যখন সে প্রথম ইউরোপ ভ্রমণ করে, তখনও এই নির্জনতার পথই অনুসরণ করেছিল সে। তাই অবসাদের কথা বলে জাহাজের ডাইনিং রুমে যায়নি বলে খাবার তার রুমে এনে দিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপর যখন সে ফ্রান্সে যায় তখন তার নিয়ম ছিল, হোটেল বা কোনো পরিবারের সাথে যেখানেই উঠুক না কেন, কমন ডাইনিং রুমে যাওয়া ব্যতিরেকে কোনোরূপ বিরক্ত করা ছাড়াই খাবার তার রুমে দিয়ে যেতে হবে। এমনকি বিয়ে করা পর্যন্ত সে তার এ অভ্যেস পরিত্যাগ করতে পারে নি। অবশ্য বিয়ের পর স্ত্রী তার এমন বহু অভ্যেসই ভাঙিয়েছেন; যেসবের ঘনিষ্ঠতায় বেড়ে উঠেছিল সে। যদিও পরবর্তীকালে আবার এ ঘটনা তার জীবনে বেশ কিছু সমস্যা ও কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণ তা তাকে পারিবারিক জীবন থেকে সামাজিক জীবনে অতিক্রান্ত হওয়ার পথে পরিবার ও পরিচিতদের মাঝে আলাদা হিসেবে তৈরি করেছিল।

সে ছিল স্বল্পভোজী। তবে তা এ কারণে নয় যে তার ক্ষুধা পেত না। বরং এই ভয় ছিল, হয়তো তাকে পেটুক বলা হবে এবং তার ভাইয়েরা পরস্পর তাকে নিয়ে চোখাচোখি করবে। প্রথম দিকে বিষয়টি তাকে ভীষণ যন্ত্রণা দিলেও খুব দ্রুতই সে এতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। ফলে অন্যরা যেভাবে খায়, সেভাবে খাওয়া তার জন্য কষ্টকরই ছিল।
সাধারণত খাবারের খুব ছোট লোকমা নিত সে। এতে তার এক চাচা তার সাথে যারপরনাই বিরক্ত ছিল। সুতরাং যখনই সে তাকে অমন ছোট লোকমায় খেতে দেখত, তার সাথে রাগারাগি করত। তীর্যক মন্তব্য করত ও বড় লোকমা নেওয়ার জন্য বাদানুবাদে লিপ্ত হত। তখন তার ভাইয়েরাও তাকে নিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তো। এ কারণেই সে তার ওই চাচাকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করত।

এমনকি দস্তরখানে সবার সঙ্গে কিছু পান করতেও লজ্জা পেত সে। কেননা তার ভয় হত; হয়তো পানপাত্রটি তার হাত থেকে পড়ে যাবে, অথবা যখন তার কাছে তা দেয়া হবে,অপটু হাতে সে তা ঠিকঠাক গ্রহণ করতে পারবে না। অতএব দস্তরখানে সবসময়ই সে তার খাবার শুকনো খেত; এমনকি যখন সে উঠে কলে হাত ধুতে যেত তখন অবধি তার খাবার শুকনোই থাকত। তারপর কল থেকে প্রাণভরে জল পান করত সে। আর এ জল অবশ্যই সবসময় পরিশুদ্ধ ছিল না। আর তৃষ্ণা নিবারণের এ পদ্ধতি তার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী ছিল না। সুতরাং তার কঠিন পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হওয়া অবধি সবকিছু এভাবেই চলতে থাকে এবং কেউ এর কোনো কারণ বুঝতে পারেনি।

তদুপরি নিজেকে সে সবরকম খেলাধূলা ও আমোদ থেকে সরিয়ে রেখেছিল। তবে ওসব ব্যতিত; তার প্রতি কোনো উপহাস বা সহানুভূতি দেখানো হতো না। যদিও একটা খেলা তার বেশ প্রিয় ছিল। তা হলো : ছোটো ছোটো লোহার টুকরো কুড়িয়ে ঘরের নির্জন এককোণে জমা করা। তারপর চুপচাপ বসে বসে ওগুলো আলাদা করে একটা অপরটার সাথে টুংটাং আঘাত করা। এভাবে ক্লান্ত হওয়া অবধি ঘন্টার পর ঘন্টা সে সবার থেকে দূরে, আলাদা হয়ে বসে থাকত। এরপর পুনরায় উঠে গিয়ে ভাই ও বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধূলায় যোগ দিত। যেখানে সে তার মন দিয়ে যোগ দিত ঠিক কিন্ত হাত দিয়ে নয়। আর এভাবেই সে কোনোরূপ অংশগ্রহণ ছাড়াই এমন অসংখ্য খেলা জানত। তাছাড়া এ ধরণের খেলাধুলা থেকে নিবৃত হওয়ার ফলে সে ভিন্ন এক বিনোদন ও আমোদে অনুরাগী হয়ে ওঠে। তা ছিল গল্প ও পৌরাণিক কাহিনি শ্রবণ। তবে তার পরম আনন্দ ছিল কোনো কবির কবিতা শোনা।অথবা লোকদের সাথে তার বাবার গল্পগুজব ও অন্যান্য নারীদের সাথে মায়ের কথোপকথন শ্রবণ। সুতরাং এখান থেকেই শ্রবণের শৈল্পিকতা অর্জন করেছিল সে। মূলত তার পিতা ও উনার কিছু বন্ধু এসব কেচ্ছা ও গল্পগুজব ভালোবাসত খুব। ফলে প্রায় রোজই তারা আসরের নামাজের পর একসঙ্গে কোনো একজনের চারপাশে গোল হয়ে বসে যেতেন। যিনি তাদেরকে বিভিন্ন যুদ্ধ ও বিজয়ের গল্পগাথা শোনাতেন। আনতারা ও জহির বাইবার্স এর দুঃসাহসিক সব অভিযানের ঘটনা এবং বিভিন্ন নবী ও সাধু-সন্তদের জীবনী সম্বন্ধেও বেশ কায়দা করে বলতেন। এমনকি তিনি তাদের ধর্মোপদেশ সংবলিত বক্তৃতা ও ধর্মীয় আইন সংক্রান্ত পুস্তকাদি থেকও পড়ে শোনাতেন।

আমাদের বন্ধুটি তখন তাদের থেকে সম্মানজনক দূরত্বে নিশ্চুপ বসে থাকত। যদিও তারা তার উপস্থিতি সম্বন্ধে পুরোপুরি উদাস। কিন্তু সে যা শুনছে তা থেকে কোনোরূপ অমনোযোগী ছিল না। এমনকি এসব গল্পগুলো শ্রোতাদের অন্তরে কীরূপ প্রভাব ফেলে,তা সম্বন্ধেও তার ছিল সজাগ উপলব্ধিবোধ। এরপর যখন সূর্য অস্ত যেত, তারা তাদের রাতের খাবারের জন্য উঠত। কিন্তু এর কিছু পরেই এশার নামাজ শেষে আবার তারা খোশগল্পের জন্য একত্র হত। আর তা অবিশ্রান্তভাবে রাতের দীর্ঘ সময় পর্যন্ত চলত। তখন কবি সবার সম্মুখে এগিয়ে আসে এবং বনু হিলাল ও জানাতি গোত্রদ্বয়ের ক্রিয়াকাণ্ড সম্পর্কে বলতে শুরু করে। আর আমাদের বন্ধুটিও তখন রাতের প্রথম ভাগে শুনতে বসে, যেমন সে দিনের শেষভাগে শুনেছিল।

এদিকে মিশরের গ্রাম্য নারীরা কখনও চুপচাপ থাকতে পছন্দ করে না। সুতরাং যখন তাদের কেউ একাকী থাকে এবং গল্পগুজব করার জন্য কাউকে না পায়; তখন সে নিজেই নিজের সঙ্গে বিভন্ন রকম কথাবার্তা শুরু করে। তাই তখন যদি তার মন ভালো থাকে, তাহলে গান গায়। আর যদি ভালো না থাকে, তাহলে বিলাপ শুরু করে। কারণ মিশরের প্রত্যেক নারীই যখন ইচ্ছে শোক করতে পারে। এ ক্ষেত্রে গ্রামের নারীরা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে যখন তারা একত্র হয়ে নিজেদের দুরবস্থার কথা মনে করে এবং যারা মারা গেছে তাদের বৈশিষ্ট্যাবলির কথা স্মরণ করে তাদের স্তুতি গাইতে থাকে। যেখানে প্রায়শই এ স্মৃতিচারণ ও স্তুতি তাদের সত্যিই কাঁদিয়ে তোলে।

আমাদের বন্ধুটিও সবসময় তার বোনের শোকগাঁথা ও মায়ের বিলাপ শুনে খুশি হত। যদিও বোনের ওই শোকগীতি সাধারণত তাকে বিরক্ত করে তুলত এবং তার ওপর কোনো প্রভাবই ফেলত না। কেননা কোনোরূপ ধ্বনিসংযোগ বা হেতু ছাড়াই রচিত এগুলো তার কাছে কেবলই অন্তঃসারশূন্য, অর্থহীন মনে হত। অথচ যেখানে তার মায়ের বিলাপের স্বরগুলো তুমুলভাবে তাকে নাড়া দিত এবং সে কাঁদতও খুব। ফলে এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের বন্ধুটি অসংখ্য শোকসংগীত, বিলাপগাঁথা আর গুরুতর ও মজার ঘটনাবলি আত্মস্থ করে নিয়েছিল। অধিকন্ত সে এমন কিছুও শিখেছিল; যেসবের সঙ্গে উপরিউক্ত বিষয়াবলির কোনো সম্পর্কই নেই। মূলত তা ছিল কোরানের উল্লেখযোগ্য কিছু আয়াত; তার অন্ধ দাদা যা সকাল সন্ধ্যা তেলাওয়াত করতেন।
দাদা ছিলেন তার কাছে খুবই অপ্রিয় আর অদ্ভুত। যিনি প্রতিটি শীতকাল জুত করে ঘরে বসে কাটাতেন এবং শেষ জীবনে বেশ ধার্মিক ও তপস্বী হয়ে উঠেছিলেন। প্রত্যহ তিনি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতেন এবং তার জিহ্বা কখনোই আল্লাহর স্মরণ থেকে নিবৃত হত না। দৈনন্দিন ভোরের আমল পালনে সাধারণত শেষ রাতেই নিদ্রা ত্যাগ করতেন। আর রাতে ঘুমুতে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যহ এশারের পর দোয়া-দরুদ ও জিকির আযকার সম্পন্ন করতে বেশ বিলম্বই হত তার। এদিক আমাদের বন্ধুটি যেহেতু তার কামরার পাশের কামরাতেই ঘুমাত; তাই সে তার সমস্ত তেলাওয়াত শুনতে পেত। এবং ধীরে ধীরে সে তার শ্রবণকৃত বহু কুরআনের আয়াত ও দোয়াসমূহ মুখস্থ করে ফেলেছিল।
তাছাড়া গ্রামবাসীও সূফী-সাধকদের যারপরনাই ভালোবাসত ও নিয়মিত তাদের প্রার্থনা ও জিকিরে অংশগ্রহণ করত। আমাদের বন্ধুটিও তাদের এ ঝোঁক ও প্রবণতাকে ভালোবাসত খুব। কেননা সে জিকির এবং এর মাঝে যা কিছু পাঠ করা হয়,এর সবকিছুই মনেপ্রাণে উপভোগ করত। সুতরাং নয় বছরে পৌঁছার আগেই বিভিন্ন সংগীত, শোকগীতি, গল্প, হিলালি ও জিনাতিদের সম্বন্ধে রচিত অসংখ্য কবিতা, বিভিন্ন দোয়া-দরুদ ও সূফি দরবেশদের থেকে শ্রুত অগুনতি নীতিবাক্যের বিশাল এক ভাণ্ডার হৃদয়ঙ্গম করে নিয়েছিল সে। আর এসবের বাইরেও সে যা শিখেছিল; তা ছিল মহাগ্রন্থ আল-কোরান।

* আবুল আ-লা আল-মাআরী : বিখ্যাত আরব কবি, লেখক ও দার্শনিক। উত্তর সিরিয়ার অধিবাসী এ মহান মনীষীর জন্ম ৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে, মৃত্যু ১০৫৭ খ্রিষ্টাব্দে । এ গ্রন্থের লেখকের মতো তিনিও শৈশবে তার দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন।
* আনতারাহ ও জহির বাইবার্স : আনতারাহ ছিল ইসলামপূর্ব যুগের বিখ্যাত প্রেমের কবি। তার পুরো নাম,‘আনতারাহ বিন শাদ্দাদ আল-আবসি’৫২৫-৬০৮ খ্রিষ্টাব্দ। সংক্ষেপে আনতার নামে পরিচিত এ কবি একইসাথে তার কবিতা ও দুঃসাহসিক জীবনের জন্য বিখ্যাত। তার উল্লেখযোগ্য কবিতা দিয়ে ‘মু’আল্লাকাত’ এর একটি অংশ রচনা করা হয়েছে। যেগুলো প্রাচীনকালে কাবার দেয়ালে বিখ্যাত ‘সাবঅে মুয়াল্লাকাত’ এর সংকলনে স্থান পেয়েছিল।

সুলতান জহির বাইবার্স : পুরো নাম,‘আল মালিক আল জহির রুকন আল দিন বাইবার্স আল বানদুকদারি আবু আল ফুতুহ।’ তুর্কি কিপচাক বংশোদ্ভূত এই মিশরীয় মামলুক সুলতান এর জন্ম, ১২২৩/১২২৮ সাল। মৃতু ১ জুলাই ১২৭৭ । এক চোখা দাস থেকে মধ্যযুগে মিশরীয় ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ফ্রান্সের নবম লুইয়ের সপ্তম ক্রুসেড যুদ্ধে মিশরীয় বাহিনীর একজন সেনাধ্যক্ষ ছিলেন তিনি। ১২৬০ সালে আইনে-জালুতের যুদ্ধে মিশরীয় সৈন্যবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। সে যুদ্ধে মোঙ্গলদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। যা ছিল মোঙ্গলদের প্রথম পরাজয় এবং ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা।
* বনু হিলাল, বনু জানাতি ও হিলাল : এরা ছিল আরব উপদ্বীপের হেজাজ ও নাজদ অঞ্চল থেকে আরব উপজাতিদের একটি মৈত্রী গোষ্ঠী। ১১ শতকের দিকে তারা উত্তর আফ্রিকায় চলে যায়। নজদের বিস্তৃত মালভূমির অধিকারী এই গোত্রটি যেন নিজেদের কুখ্যাতিকে উপভোগ করতো কিছুটা। আর এর কারণ সম্ভবত আরব গোত্রের মাঝে তুলনামূলকভাবে দেরিতে ইসলাম ধর্ম প্রবেশ এবং ইরাক ও সিরিয়ার সীমান্তে তাদের সামরিক অভিযানসমূহ। এছাড়াও ৯৩০ সালে পবিত্র মক্কা লুণ্ঠনেও অংশ নিয়েছিল তারা। জানাতি : উত্তর আফ্রিকার বর্বর এক গোত্র ছিল জানাতি। প্রাচীনকালে তারা মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া এবং লিবিয়া অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। ভ্রমণের ওপর ভিত্তি করেই প্রধানত তাদের জীবনযাত্রা গঠিত ছিল এবং সপ্তম শতাব্দীর শুরুর দিকে তারা ইসলাম গ্রহণ করে। ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন বলেন, জানাতিরা মূলত প্রধান এই তিনটি গোত্রে বিভক্ত ছিল : জিরাওয়া, মাগরাওয়া এবং বনু য়াফরান ।

 

আরো পড়তে পারেন

একাত্তরের গণহত্যা প্রতিহত করা কি সম্ভব ছিল?

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই এক রাতেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে….

ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

আগের পর্বে পড়ুন— চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও একটি সার্থক গণআন্দোলন। এই গণআন্দোলনের মূল চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হলো দেশপ্রেম থেকে জাত সেই অনুভূতি, যার একটি রাজনৈতিক প্রকাশ রয়েছে। আর, বাঙালি জাতিসত্তাবোধের প্রথম রাজনৈতিক প্রকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে দুই হাজার মাইল দূরত্বের….

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল)

আগের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ একুশের আবেগ সংহত থাকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দেও। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। আওয়ামি লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ১৮ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটির সদস্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র….

error: Content is protected !!