আজাদীর বাঁশীওয়ালা কাজী নজরুল
.
পদ্যে গদ্যে কথার যাদুতে
প্রবল বিদ্রোহে হানলে অগ্নিভাষা
নাট্য গীতিতে ছন্দ সুরে বাঁধিতে
পরাধীনতা ঘুঁচাতে জাগালে আশা।
স্বদেশী মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে শুনালে
বিদ্রোহ জাগরণী শেকল ভাঙ্গার গান
ঔপনিবেশিক ত্রাসের শাসন কাঁপিয়ে
জীবনমৃত দেশবাসীরে এনে দিলে প্রাণ।
বেনিয়া শাসনে আষ্ট্রেপৃষ্ঠে বাঁধা ভারতের সূর্য গেল অস্ত
ধর্মের আফিমে দ্বি-জাতি যখন বিবাদে লাঠালাঠিতে ব্যস্ত
পুজিবাঁদী শাসক তখন সমুদ্র পথে সম্পদ প্রাচারে সিদ্ধহস্ত।
বহুকৌশলী কুশিলবরা মেরুকরণে অহিংস স্বরাজে
বিমূর্ত অস্পষ্ট মতবাদ কাঁদা-ছুড়াছুড়িতে লিপ্ত
কবি তুমিই প্রথম বজ্রনাদে স্পর্ধাভরে
ধূমকেতুর আঘাত হেনে দাবী করলে ব্যক্ত
ভারতবর্ষের এক ইঞ্চি জমিতেও বিদেশী শাসন
আমরা আর করবো না বরদাস্ত।
যে সত্য উচ্চারণে মহাজনেরা দ্বিধাগ্রস্থ
কবি তুমি অগ্নিবাণে করলে পাঠ
‘আনন্দময়ীর আগমনে’ যজ্ঞের মন্ত্র।
ভারতস্বর্গে অবৈধ দখলদার বেনিয়া বজ্জাত
ডাকলে তুমি খড়গহাতে দূর্গতিনাশিণীকে
করতে অত্যাচারী চান্ডালের মুন্ডুপাত ।
রাজশক্তির কোপানলে পুড়ে
জেলে গিয়ে কবি হ’ল রাজবন্দী
‘একজন রাজা হাতে রাজদন্ড, আরজন সত্য হাতে ন্যায়দন্ড’
অমর পঙতিমালা দিয়ে সাজানো রাজবন্দির জবানবন্দি।
‘কালা আদমিকে গুলি মারা’ ব্যঙ্গাত্বক চরম প্রতিবাদী
কন্ঠে দিলে হাঁক, ভূমিকম্পে প্রকম্পিত
উত্তরে হিমালয় হতে দক্ষিণে কন্যাকুমারিকা অবধি।
কালো আদমিকে গুলি করতে কুঁচ পরোয়া নেহি
নাই নিয়ম-কানুন আজও তা বহাল তবিয়তে বর্তমান
সাদা পশুর হাতে র্জজ ফয়েডের শ্বাসরোধ
তোমার সাহিত্যের কালউত্তীর্ণতার অনবদ্য প্রমান।
হে কবি প্রলয় মহারুদ্র
ভাঙ্গিতে দাসত্বের বন্ধন
লিখেছ ‘বিষবন্দী’ প্রবন্ধ
‘ফাঁসির রশি আমাদের প্রিয়ার ভূজ বন্ধন’।
কৃষক-শ্রমিক, নারীর ক্ষমতায়নে যোগালে বল
সাম্যবাদী গানে চেতনায় জাগালে অসাম্প্রদায়িকতা
কারাবন্দী হয়ে শেকল পরে করলে কত কী বিকল
লৌহ কবাট ভাঙ্গার প্রত্যয়ে আনলে স্বাধীনতার বারতা।
পুরুষ মানেই বাজী
.
পুরুষ আমি, অতৃপ্ত অগ্নি জ্বলছে বুকে
উত্তপ্ত মরুভূমির তীব্র দাবদাহে
পুড়ছে আমার কাল, মনের ভিতর অগ্নিগিরি
শিকারী যুগ হতে যাযাবর ঘোরাঘোরি।
এক পশলা বৃষ্টির আশায়
চেয়ে আছি তোমার আঁখির দিকে
বুকে তোমার অথৈই জলদি
ডুব সাঁতারে তপ্ত প্রাণে
শীতল পরশ জুড়ায় যদি।
এ কেমন অদৃষ্ট হায়!
জীবনে আর শান্ত হওয়ার
তোমার চুলের গন্ধ নেবার
সম্ভাবনা রইলো না আর
তবুও আমি স্বপ্নে জাগি
আসছে জন্মে অতৃপ্ত হতেও রাজী
তোমাতেই রাখলাম আজ
শেষ জনমের বাজী।
দ্বৈত সত্তা
.
বাহির পানে তাকায় যিনি
ভিতর পানে না চায় তিনি
অন্তরে প্রসব করে চিন্তা যত
বাইরে তার ভিন্ন প্রকাশ তত।
আদিতে অকার্যকর ছিল বাকযন্ত্র
মস্তিষ্ক সযতনে চালায় তন্ত্রমন্ত্র।
মৌলিক পরশমনি তার কল্পনা শক্তি
ঘটে যা কেবল তাই কি সত্যি?
কল্পনায় এঁকেছিলাম ভালবাসার অনুভুতি
তুমি দিলে না সায়
চোখে জ্বালালে তাচ্ছিল্য হায়!
শব্দ পেলো না সুর, তাই মনে বাজেনা গীতি।
শ্রাবন ধারায় আকাশ যতই কাঁদুক
পাথর হৃদয়ে ঝরনা যতই বাজুক
তোমার নয়ন পানে আমার তাকিয়ে থাকা
এমন ছবি আর যাবে না দেখা।
সাদার উজ্জ্বলতা ফুটে ভালো
পাশে থাকলে কালো
দিনের আলোয় যায় না দেখা
অভিমানী তারার ঝিকিমিকি আলো।
শুভ অশুভের অনাদিকালের দ্বন্দযুদ্ধ
প্রাগৈতিহাসিক হতে চলমান,হয়নি এখনও বন্ধ
এ যুগের নিয়ন্ত্রক ইশ্বররুপী পুঁজিবাদ
কার্বনের কালো রাহুগ্রাস এড়াতে
নানা ছলনায় সৃষ্টি করে
শয়তাণী আগ্রাসনবাদ।
কার গল্প বল?
.
মেঘ তুমি অঝোর ধারায়
বৃষ্টি হয়ে ঝরলে
আসলে তুমি কার গল্প বললে।
মেঘ তুমি নানারুপে নানান রঙ ধর
কখনও সিঁদুরে লাল, কখনও ভয়ানক কালো
কখনোবা বিদ্যুৎ চমকে বজ্রাঘাত হানো
সত্যি তুমি কার গল্প বুনো।
কখনও নিকষ অন্ধকারে চারিধার ঢাকো
কখনও আড়ালে গিয়ে সুর্যালোকে হাসো ।
পাহাড়ের আলিঙ্গনে তুমি ঝর্নার সুরে বাজো
সরোবর হতে নেমে এসে
খোরস্রোতা নদীর জলে ভাসো।
বল তুমি কার গল্প শুনে আনন্দে হাসো।
কলকল ধ্বনি তুলে এঁকেবেকে
নদী বয়ে চলে
সে কি তোমার কথা বলে।
তটিনী আনন্দ অভিসারে সমুদ্রসঙ্গমে হারায়
সমুদ্র কি নদীর কানে কানে তোমার কথা শুধায়?
মুখ ঢেকে যায় মুখোশে
.
তুমি আমি সবাই নিজ স্বার্থে অন্ধ
নিজের বুঝটা বুঝে নিয়ে
পরের করি মন্দ।
আমি তুমি সে মিলে আমরা
স্বার্থের ভাগাভাগিতে
নৈতিকতাকে করি ঝাঁঝরা।
আমরা সবাই মুখোশধারী
নানা বর্ণ ধারণ করে
সাদা-কালো সত্য আড়াল করি।
মিথ্যা ফ্যাশান সর্বত্র বড় কেতাদুরস্ত
সত্যবাদী মুখশ্রী আজ বিরল আকালগ্রস্ত।