‘এ মণিহার আমায় নাহি সাজে…
তাই তো বসে আছি,
এ হার তোমায় পরাই যদি তবেই আমি বাঁচি।’

জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে এক শিক্ষকের বাসায় শান্তিনিকেতন ফেরত এক নবীন গায়ক ‘এ মনিহার আমায় নাহি সাজে’ গানটি গাইছিলেন। সবাই চোখ বুঁজে গান শুনছে, শুধু একজন শ্রোতা ক্রমাগত তার পিঠ চুলকাচ্ছে। আমি তখন নবীন যুবক, এমন কাঁচা বয়েসে এ গান কার না ভালো লাগে! বিশেষ করে যদি মনিহার কেনার মতো পয়সা পকেটে না থাকে।
একেবারেই ঘরোয়া অনুষ্ঠান। মাত্র ছয়জন শ্রোতা, প্রায় সবাই গুণী মানুষ। নাট্যকার সেলিম আল দীন, কবি রফিক ভাই, একজন অভিনেতা, আরো দুজন সাহিত্যিক। নিমন্ত্রকর্তার বউ বাপের বাড়ি বেড়াতে গেছে, সেই সুযোগে তার বাসায় এই গান আর আড্ডার আয়োজন। গানের পালা শেষ হবার পরে ‘শেষ গানের রেশ নিয়ে’ সেলিম আল দীন আর আমি ঘরে ফিরছিলাম।

রাত বারোটা বাজে। আমাদের দুজনার আবাস ক্যাম্পাসের একই দিকে।
‘মনে হচ্ছিলো দিই ব্যাটার গালে কসে এক থাপ্পড়’, সেলিম আল দীন জানালো।
‘তুই কার কথা বলছিস?’
‘ওই যে, বসে বসে পিঠ চুলকাচ্ছিল।’
‘কেন? রবীন্দ্রনাথের গানের সময় পিঠ চুলকানো নিষেধ নাকি?’
‘রবীন্দ্রনাথের গান আরাধনার মতো, এ সময়ে পিঠচুলকানো, নাকঝাড়া ইত্যাদি ক্রিয়াকলাপ বন্ধ রাখতে হবে।’ সেলিম আল দীন আবার জানালো।
‘এ মনিহার আমায় নাহি সাজে’, একটা ফালতু গান, আমি বললাম। বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, গবেষক, এবং নাট্যকার সেলিম আল দীনের রবীন্দ্রভক্তি ফুটবল খেলায় আর্জেন্টিনার সর্মথকদের চেয়েও ভয়ানক। ওকে ইচ্ছে করেই চেতিয়ে দিলাম।

বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক, গবেষক, এবং নাট্যকার সেলিম আল দীনের রবীন্দ্রভক্তি ফুটবল খেলায় আর্জেন্টিনার সর্মথকদের চেয়েও ভয়ানক

‘কস কি! বিটলামি করণের আর জায়গা পাস না। আমার শকুন্তলা নাটক দেইখ্যা তুই আউলফাউল কথা কইছস, দিলের মধ্যে চাক্কু মারছস। কিছু মনে করি নাইক্যা। তয় ‘এই মনিহারের’ বদনাম করলে কুন্নাইয়া রসাতল করাইলামু, খুনখারাপি ভি হইবার পারে।’
খেপে যেয়ে সেলিম আল দীন ‘ঢাকাইয়া বাঙাল’ ভাষায় কথা বলা শুরু করলো। ১৯৭৭ সালের কথা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার হিসেবে চাকুরীজীবন শুরু করেছি। সেলিম আল দীন আগে থেকেই ওখানে বাংলার অধ্যাপক। ওর সাথে খুব দ্রুত বন্ধুত্ব অথবা শত্রুতা হতে পারে। কপালগুনে আমার সাথে বন্ধুত্ব হয়েছিল। ওর সাথে মাঝে মাঝে ঢাকাইয়া এবং আর সব বাঙাল ভাষায় কথা বলার প্রতিযোগিতায় নামতাম।
‘মহাকবি কালিদাস শকুন্তলা নাটক লিখলেন। সেই শকুন্তলা হইলো গিয়া স্বর্গ আর মর্তের মহব্বত, আর তোর শকুন্তলা স্বর্গ এবং মর্তের কাজিয়া। কার্ল মার্ক্সের শ্রেণী-সংগ্রাম নিয়ে তোর শকুন্তলা খামোখা ফাল পাড়ে।’ আমি সংক্ষেপে শকুন্তলা নাটকটির মূল্যায়ন করলাম। নাট্যমঞ্চে এই নাটকটি দেখার জন্য তখন বেজায় ঠেলাঠেলি।
‘তোর কথা শুনলে ঘোড়ায় হাসবো। তুই ব্যাটা নাটক আর কবিতার বোঝস টা কি?’ সেলিম আল দীন সংক্ষেপে আমার মূল্যায়ন করলো।
একেবারে সত্যি কথা। কখন কোন লেখা যে কবিতা হয়ে যায় তা বোঝার সাধ্য আমার নেই। পদ্য এবং কবিতা যে এক নয় সেটা অনুমানে বুঝি। কিন্তু গদ্য, পদ্য, কবিতা, এবং গদ্যকবিতার মধ্যে ফারাক করার মতো কোনো লিটমাস টেস্ট সাহিত্যে নেই! সাহিত্যে ‘গুরু’ আছেন, বিজ্ঞানে কোনো গুরু নেই, পন্ডিত নেই, কতৃপক্ষ নেই। আইনস্টাইনকে শ্রদ্ধা করি, ভালোবাসি, কিন্তু তাঁর যুক্তিতে সামান্যতম ছিদ্রের সন্ধান পেলে ফাল হয়ে সেখানে ঢুকে পড়বো। পুরানো পন্ডিতদের তত্ত্বে যত তাড়াতাড়ি ভুল বের করা যায়, বিজ্ঞান তত তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে চলে। সাহিত্যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ আছেন, ভক্তি আছে, দলাদলি আছে। বিজ্ঞানের ভক্তিহীন সংস্কৃতি নিয়ে সাহিত্যের আসরে কথা বলতে গেলেই গোলমাল বাধে।

রবিঠাকুরের কোনো কবিতার নিন্দে করলে কেউ বা কানে আঙ্গুল দেয়, কেউ বা তেড়ে মারতে আসে। বিজ্ঞান যুক্তি-নির্ভর, তাই দলাদলি বেশিদিন টেকে না

রবিঠাকুরের কোনো কবিতার নিন্দে করলে কেউ বা কানে আঙ্গুল দেয়, কেউ বা তেড়ে মারতে আসে। বিজ্ঞান যুক্তি-নির্ভর, তাই দলাদলি বেশিদিন টেকে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলার আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব যে ভুল তা প্রমান করার জন্যে ১০০ জন জার্মান বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি দল গঠন করেছিলেন। আইনস্টাইন হেসে বলেছিলেন, ‘আমার তত্ত্ব ভুল হলে একজন বিজ্ঞানীর যুক্তিই যথেষ্ট ছিল।’
‘এ মনিহার আমায় নাহি সাজে’, পূজা পর্যায়ের গান। তবে গানটি পূজার না প্রেমের তা নিয়ে কোন্দল করা শুধুই বিড়ম্বনা। এই গানটি শুনে কোনো কিশোরী যদি ছেলেদের কথা না ভেবে ঈশ্বরের কথা ভাবে, তবে তার মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন আছে।
মনিমালার বোঝা নিয়ে এই পৃথিবীর কোন নর বা নারী লজ্জা পায়? রবিঠাকুরের কবিতা-গানের পাত্র-পাত্রীরা যেন স্বপ্নের জগতের বাসিন্দা, রক্ত-মাংসে গড়া মানব-মানবী নয়। রাবীন্দ্রিক মন্ত্র, ‘দেবতাকে প্রিয় করি, প্রিয়রে দেবতা’, দেবলোকেই সম্ভব। দেবতাকে প্রিয় করতে অসুবিধা নেই, উল্টোটাতেই বিপদ। শিবের মাথায় জল, ফুল, আর বেলপাতা ছিটালেই তিনি নাকি খুশি হয়ে যান। পকেটে মনিহার লুকিয়ে রেখে প্রেমিকার মাথায় এসব ছিটালে কি হবে সেটা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।

হিটলার আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব যে ভুল তা প্রমান করার জন্যে ১০০ জন জার্মান বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি দল গঠন করেছিলেন। আইনস্টাইন হেসে বলেছিলেন, ‘আমার তত্ত্ব ভুল হলে একজন বিজ্ঞানীর যুক্তিই যথেষ্ট ছিল।’

সেলিম আল দীনের সাথে আমার শেষ যোগাযোগ হয়েছিল সম্ভবত ২০০২ সালের দিকে। ঢাকা থেকে ফোন করেছিল আমেরিকার লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস থেকে একটি দুষ্প্রাপ্য প্রাচীন বাংলা বইয়ের খোঁজে। অনেক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কারের সাথে ও ২০০৭ সালে একুশের পদক লাভ করেছিল। সেলিম আল দীন নাকি বাংলাদেশের একমাত্র নাট্যকার যার নাটক বাংলাদেশের বাইরে মঞ্চায়ন করা হয়েছে। দশ বছর আগে, ২০০৮ সালে মাত্র ৫৮ বছর বয়েসে ও মারা যায়।
ওর অনেক স্মৃতির মধ্যে দু’একটি খুব মনে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে সাভার বাজারে খুব ভালো গরুর মাংস পাওয়া যেত। রাত্রে ভূরিভোজন করে মাঝে মধ্যে ও আমার ঘরে রেকর্ড প্লেয়ারে গান শুনতে আসতো। ওর বউয়ের হাতের রান্না করা সাভারের গরুর ভুনা-মাংস খেয়ে এসেছে, অনেক ধোয়াধুয়ির পরেও হাতে রান্নার গন্ধ লেগে আছে। হাতের মুঠিটা আমার নাকের ডগার সামনে বাগিয়ে ধরে বলতো, ‘তোর কপালে তো এখনো বউ জোটে নি, বাবুর্চির রান্না খেয়েই জীবন গেছে, দ্যাখ ব্যাটা গন্ধ শুঁকে, বউয়ের রান্না কাকে বলে!’

আরো পড়তে পারেন

প্রতিদান

‘আমাকে আপনার মনে নেই। থাকার কথাও নয়। সে জন্য দোষও দেব না। এত ব্যস্ত মানুষ আপনি, আমার মত কত জনের সঙ্গেই হঠাৎ চেনা-জানা। কেনইবা মনে রাখবেন তাদের সবাইকে?’ বেশ শান্ত গলায় বললেন মিসেস অঙ্কিতা। টেবিল থেকে কি যেন একটা নিলেন তিনি। পিটপিট করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সাফরাব। একটা ইনজেকশন, একটা ছোট টেস্টটিউবের মতো ভায়াল,….

লিলিথ

শাওয়ার বন্ধ করে দিতেই পানির হালকা ঝিরঝিরে শব্দটা বন্ধ হয়ে যায়। প্রযুক্তির কল্যাণে ঝরনার শব্দ আজকাল বাসাতেই শোনা যাচ্ছে। আর এ শব্দটা অদ্ভুত সুন্দর। কেমন যেন মোলায়েম। সাদা তুলতুলে মেঘের মতো। অনেক দূর থেকে ভেসে ভেসে এসে জড়িয়ে ধরে। চোখের পাতাগুলোয় ঠান্ডা আমেজ ছড়িয়ে ঘাড় বেয়ে নামতে থাকে। আরামে চোখ বুজে আসে আমার। রিলাক্স হতে….

বন্ধনবিলাস

এ শতকের ধূলিধূসরিত ঢাকায় দাঁড়িয়ে কল্পনা করাও কঠিন। গত শতকের ঢাকা ছিল রাজহাঁসের পালকের মতো পরিচ্ছন্ন ধবধবে। একতলা-দোতলার ছাদে শীতলপাটি বিছিয়ে রাতের আকাশের দিকে চাইলে দেখা যেত নক্ষত্রদের কনফারেন্স। মেঘহীন রাতগুলোতে খুব কাছের হয়ে যেত দূরছায়া নীহারিকার পথ। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। অগণ্য তারার যে কোনো তারাকে। রাস্তার দু’ধারে জামরুল-জিউল আর বাবলার অন্ধকার ঢাকতে….

error: Content is protected !!