‘‘এবার ফিরাও মোরে, লয়ে যাও সংসারের তীরে,
হে কল্পনে, রঙ্গময়ী! দুলায়োনা সমীরে সমীরে
তরঙ্গে তরঙ্গে আর, ভুলায়োনা মোহনী মায়ায়।’’

বেগুন, মরিচ, এবং টোম্যাটো গাছ লাগিয়েছিলাম। হৃদয়ের উত্তাপ দিয়ে ওদের বড় করেছি। আগাছা পরিষ্কার করে প্রতিদিন পানি ঢেলেছি ওদের মাথায়। আর অপেক্ষা করেছি। ফসলের অপেক্ষা।
সূর্যের আলো, বাতাসের কার্বন ডাই অক্সাইড, আর আমার ঢালা পানি দুই মাস পরে আজ বেগুন, টোম্যাটো, এবং মরিচ হয়ে গাছের ডালে ডালে দোল খাচ্ছে। অলৌকিক বলে মনে হয়। কত অসংখ্য অসম্ভব কাকতালীয় ঘটনা একসাথে হাত মেলালে Big Bang থেকে বেগুন জন্মাতে পারে তা অনেকবার ভেবেছি। সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ কি আছেন?
গতকাল ইউ টিউবে সম্ভবত তৃতীয়বারের মতো আকিরা কুরোসোয়ার The Seven Samurai ছবিটি দেখলাম। ভূমিদস্যু লুটেরা ডাকাতের দল কৃষকদের জমির ফসল লুট করতে আসছে। কৃষকদের ভীত, জরাগ্রস্থ মুখগুলো এখনো আমার চোখের সামনে ভাসছে। তার সাথে মিষ্টি সেই মেয়েটির মুখ। পুরুষের হাত থেকে ওকে বাঁচাবার জন্যে ওর বাবা ওর গায়ে পুরুষের পোশাক চাপিয়েছে, জোর করে ওর মাথার লম্বা কালো চুল ছেঁটে দিয়েছে। মানুষের হাত থেকে মানুষ এবং নারীকে বাঁচাতে হবে! মানব জন্মের অভিশাপ। যুগ যুগ ধরে চলছে।
আমার ক্ষেতের বেগুন, মরিচ, এবং টম্যাটো মহাজন আর ডাকাতের দল কেড়ে নিতে এলে আমি কি পরাজয় জেনেও জীবন বাজি ধরে লড়াই করতাম! নারী এবং ফসলের উপরে ভালোবাসা কি কৃষককে ভীরু করে তোলে? যেটুকু আছে সেটুকুও হারাবার ভয়ে ওরা যুদ্ধ করতে ভয় পায়?
ধন্যবাদ কুরোসোয়াকে। চাষীদের দল এবং মেয়েটিকে জিতিয়ে দিলেন। চাষীদের কপালে বাটিভর্তি সাদা ভাত জুটলো, মেয়েটির খোঁপায় বনফুল। কুরোসোয়ার আরো দুটি ছবি, “রাশোমন” এবং “হিডেন ফোরট্রেস” আমার খুব প্রিয়। হিডেন ফোরট্রেসকে অনুকরণ করে “ষ্টার ওয়ার্স” বানিয়ে জর্জ লুকাস সিনেমা রাজ্যে কেউকেটা বনে গেলেন! অতি তুচ্ছ জীবনের মাঝেও কুরোসোয়া গরিমা খুঁজে পান। মানব-জীবন অভিশপ্ত জেনেও আবার ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।
‘‘এবার ফিরাও মোরে’’ বলে একবার হৈচৈ করে রবীন্দ্রনাথ চাষীদের কাছে আর ফিরলেন না। নিজের ব্যর্থতার জন্যে শুধুই আক্ষেপ করলেন,
কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন,
কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,
যে আছে মাটির কাছাকাছি,
সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি।

অনেক পরে আল মাহমুদ চাষীদের জীবনের শরিক হয়ে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে পেশ করলেন তাঁর সোনালী কাবিন,
বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই
দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর,
লাঙ্গল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই
হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোনো কবি করে না কসুর।…

বধূবরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকুল
গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল।

আমার নামের প্রথম অংশ খন্দকার। এই বিদঘুটে শব্দের অর্থ জানা ছিল না এতদিন। আজ এক বাংলা অভিধানে দেখলাম যে খন্দকার মানে কৃষক, কৃষিজীবী, চাষী, চাষা, ইত্যাদি। গর্বে বুকের ছাতি ফুলে গেছে অনেকখানি। চাষা রেজাউল করিম, তুই ফেলে এসেছিস কারে!

আরো পড়তে পারেন

প্রতিদান

‘আমাকে আপনার মনে নেই। থাকার কথাও নয়। সে জন্য দোষও দেব না। এত ব্যস্ত মানুষ আপনি, আমার মত কত জনের সঙ্গেই হঠাৎ চেনা-জানা। কেনইবা মনে রাখবেন তাদের সবাইকে?’ বেশ শান্ত গলায় বললেন মিসেস অঙ্কিতা। টেবিল থেকে কি যেন একটা নিলেন তিনি। পিটপিট করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সাফরাব। একটা ইনজেকশন, একটা ছোট টেস্টটিউবের মতো ভায়াল,….

লিলিথ

শাওয়ার বন্ধ করে দিতেই পানির হালকা ঝিরঝিরে শব্দটা বন্ধ হয়ে যায়। প্রযুক্তির কল্যাণে ঝরনার শব্দ আজকাল বাসাতেই শোনা যাচ্ছে। আর এ শব্দটা অদ্ভুত সুন্দর। কেমন যেন মোলায়েম। সাদা তুলতুলে মেঘের মতো। অনেক দূর থেকে ভেসে ভেসে এসে জড়িয়ে ধরে। চোখের পাতাগুলোয় ঠান্ডা আমেজ ছড়িয়ে ঘাড় বেয়ে নামতে থাকে। আরামে চোখ বুজে আসে আমার। রিলাক্স হতে….

বন্ধনবিলাস

এ শতকের ধূলিধূসরিত ঢাকায় দাঁড়িয়ে কল্পনা করাও কঠিন। গত শতকের ঢাকা ছিল রাজহাঁসের পালকের মতো পরিচ্ছন্ন ধবধবে। একতলা-দোতলার ছাদে শীতলপাটি বিছিয়ে রাতের আকাশের দিকে চাইলে দেখা যেত নক্ষত্রদের কনফারেন্স। মেঘহীন রাতগুলোতে খুব কাছের হয়ে যেত দূরছায়া নীহারিকার পথ। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। অগণ্য তারার যে কোনো তারাকে। রাস্তার দু’ধারে জামরুল-জিউল আর বাবলার অন্ধকার ঢাকতে….

error: Content is protected !!