Author Picture

আপনি কীভাবে আছেন?

রেজাউল করিম রনি

অস্তিত্বের প্রকৃত/সত্য বোধ বা উপলব্ধি ছাড়াও এই যে আমাদের থাকা এই বিষয়টাকে আরও পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারা দরকার। Being/ সত্তা বা অস্তিত্বের প্রশ্নটি চিন্তার জগতে কিভাবে এড্রেস করা হয়েছে সেই দিকটির হদিস করলেই আমরা খুব সহজে এই আলাপে প্রবেশ করতে পারবো। অস্তিত্ববাদী দর্শনের ইতিহাস ধরে আলাপ করলে লম্বা আলাপে প্রবেশ করতে হবে। সংক্ষেপে এই আলাপটি আমরা তুলতে পারি জঁ পল সার্তের সাথে হাইডেগারের বিং বা সত্তার অস্তিত্বের প্রশ্নটি কোথায় আলাদা এই বিষয়টি আমলে নিলেই।

এই যে আমরা মনে করি টিকে থাকাই সফলতা। আমরা নিজের কর্ম বা যে পরিবেশের মধ্যে আটকে বেঁচে থাকতে বাধ্য হই এর মধ্যেই নিজের এসেন্সে বা সত্যকে যে যার মতো নির্মাণ করে নেই -এই ধরণের চিন্তার নিহিত কারণগুলো বিচার করলেই আমাদের অস্তিত্বের সাথে সত্যের বা এসেন্সের সম্পর্কটা সহজেই বুঝতে পারবো। আমাদের বেশির ভাগ আম-পাবলিক যেভাবে চিন্তা করেন তাকে খুব ননসেন্স ভাবনা বা মূর্খতা বলে সহজেই দাগিয়ে দেয়া যায়। আমরা তা করিও। কিন্তু এইসব চিন্তারও ঘরানা আছে। দার্শনিক বা মতাদর্শিক গুরু আছেন। তাদের কাজ ও পরে সেই কাজের ব্যাখ্যাগুলোর ব্যবহারের ইতিহাসের হদিস করলেই দেখা যাবে আমজনতার বা আপাত মনে হওয়া অস্তিত্ববোধহীন একটা মানুষের চিন্তা-ভাবনাও বিচ্ছিন্ন কোন প্রবণতা নয়। এটারও একটা দার্শনিক বা চিন্তার জগতে এই ধরণের ভাবনারও একটা পাটাতন আছে। এটা গোড়াপত্ত আছে।

আমাদের বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন, তিনি নিজের বুদ্ধি বা আক্কেল দিয়ে সত্য,ভালো-মন্দ ঠিক করে তার পরে জীবন যাপন করেই সফলতার শিখরে পৌঁছাতে পারবেন। তার টিকে থাকার এসেন্সে বা সত্যসার কি তাও তিনি চলতি ট্রেন্ড যেমন- শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মনীতি ( যে যেমন বোঝেন বা ব্যাখ্যা করেন) ইত্যাদি থেকে আয়ত্ত করে জীবন চালিয়ে যেতে থাকেন। আধুনিক, সেকুলার চিন্তার মানুষগুলো খুব সহজেই সত্যের ধারণার পারসনিফিকেশন বা ব্যক্তিয়ান করে ফেলেন। একধরণের সাবজেক্টিভ ও অভিজ্ঞতাবাদী জায়গা থেকে জগতকে দেখে থাকেন। এই দেখবার ফলে আমাদের বর্তমান দুনিয়া হয়ে উঠেছে একটা প্রবল প্রতিযোগিতার মঞ্চ। এক ব্যক্তি আরেক ব্যক্তির সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এক কবি আরেক কবির সাথে, এক বুদ্ধিজীবী অপর বুদ্ধিজীবীর সাথে তুমুল প্রতিযোগিতা করে চলেছেন।

আমরা জ্ঞানগত ভাবে অন্যকে জানার বা বোঝার দাবি করি এবং তার জন্য কি ভালো হবে তা ঠিক করে দেই। এই ভাবে প্রভু হয়ে উঠি

এ ধরণের প্রতিযোগিতামূলক ও অহংবাদী তৎপরতা কেবল বেঁচে থাকার তাগিদেই জন্ম নেয় নাই। এর মূল নিহিত আছে আমাদের অস্তিত্বের বোধ সম্পর্কে ধারণার গলদের মধ্যেই। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে এই আলোচনার জন্য জাঁ পল সার্ত খুব ভালো উদাহরণ। আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিজীবিতা ও রাজনৈতিক তৎপরতার একটা ধরণ সার্তের চিন্তার পর্যালোচনা করার মধ্য দিয়েই আমরা পেয়ে যাবো। আমরা কেন প্রত্যেকেই নিজেকে সেরা ও সত্যের একমাত্র এজেন্ট মনে করি? কেন নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য হাস্যকর সব কাজ করি? কেন আমরা অন্ধ গৌরব ও মূর্খতাকেও বিরাট সম্মানের বিষয় হিসেবে চর্চা করি? কেন আমরা সব সময় নিজেকে দেখাতে সোচ্চার? কেন আমরা সব সময় অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই? কেন আমরা যে কোন রকম ক্ষমতা অর্জন করতে চাই এবং এই ক্ষমতার সব রকম ব্যবহার বা প্রয়োগ করে অন্যের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলতে আনন্দ পাই তারও হদিস পাওয়া সম্ভব।

এই সমস্যার গোড়া খুঁজতে গেলে দেখা যাবে,existentialist বা অস্তিত্ববাদী ধারার আলোচনা এতোদিন দশর্নের জ্ঞানতাত্ত্বিক/এপিসটোমলজিক্যাল পদ্ধতির সমস্যা নিয়ে মনযোগী হয়েছেন। মূলত দর্শনের ইতিহাসে বিং/ সত্তার থাকা না থাকার প্রশ্নটি দেখা হয়েছে এপিসটিক বা জ্ঞানতত্ত্বের বিষয় আকারে। এবং নিশ্চিত জ্ঞান, সত্য জ্ঞান কিভাবে সম্ভব- এই প্রশ্নের ফয়সালা করার জন্য গ্রিক দর্শনে শুরু থেকেই দার্শনিকদের মধ্যে প্রচন্ড তাগদা ছিল। এই জন্য জ্ঞানের বিভিন্ন পদ্ধতিও আবিষ্কার হতে আমরা দেখেছি। দেকার্ত, কান্ট, হেগেল, মার্কস মূলত এই জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতির ভেতরই বিপুল চিন্তাগত বিপ্লব সাধন করেছেন। পাশাপাশি কিছু দার্শনিক অনটলজিক্যাল মানে সত্তাতাত্ত্বিক প্রশ্নের নিরিখে নিজেদের কাজ করে গেছেন। এই ধারাবাহিকতায় গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন দেখা যায় হুসার্লের ফেনোমেনলজিক্যাল পদ্ধতির আবিষ্কারে। অস্তিত্ববাদী ঘরানার দার্শনিকদের মধ্যে অন্যতম চিন্তক সার্তেও এই জ্ঞানতাত্ত্বিক পদ্ধতির আলোকে বিং বা সত্তার প্রশ্নটি ধরে কাজ করেছেন।

অনেকে আবার মনে করেন আমরা পশ্চিমা দর্শন কেন চর্চা করবো? এরা জানে না, দর্শনের কোন পূর্ব-পশ্চিম নাই

হাইডেগার দেখান এপিসটিক ধারার মধ্যে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব না। পশ্চিমা দর্শনের ম্যাটাফিজিক্স এর ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে তিনি জ্ঞানতত্ত্বের সমস্যার দিকগুলো চিহ্নিত করতে থাকেন। তিনি অনটলজিক্যাল বা সত্ত্বতাত্ত্বিক পদ্ধতির আলোকে বিং বা সত্তার একজিনটেন্স ও এসেন্সেকে বুঝতে চেষ্টা করেন। তার শিক্ষক হুসার্লের ফোনোমেনলজিক্যাল পদ্ধিতিকে নিয়ে যান অন্য এক উচ্চতায়। এ দিকটির অনেক বিস্তারিত আলোচনা দরকার। সহজ করে বলতে গিয়ে চিন্তার সরলীকরণের ঝুঁকি নিতে হবে। সেটা নিতে আমি রাজিও আছি। কিন্তু বাংলাতে হাইডেগার নিয়ে আলোচনা কিভাবে সম্ভব আমি এখনও জানি না। এটা শুধু পরিভাষার সমস্যা না। বরং পরিভাষা অবস্থাকে আরও জটিল করে তুলেছে। কারণ হাইডেগার ইংরেজি অনুবাদেও পড়া নিরাপদ না। তিনি যখন কোন শব্দ ব্যবহার করেন, তখন এই শব্দের আদি ধারণার দিকে ইঙ্গিত করেন। মানে, শব্দের অর্থের যে বিবর্তন হয়েছে যার ফলে মূল শব্দের ব্যবহারিক অর্থের বাইরে তিনি আদি ধারণার দিকে ফিরে যেতে চান। তিনি শব্দকে বর্ণনামূলক কাজে ব্যবহার করেন না। ব্যবহার করেন ধারণা বা চিন্তাকে আদি অভিবাজ্য অর্থে প্রকাশ করতে। আর অনেক নতুন শব্দ ও টার্ম তিনি আবিষ্কার করেছেন তার অনুবাদ আদৌ সম্ভব কি না সেটাই বড় প্রশ্ন। ফলে চিন্তার অনুসরণ করেই অর্থ উদ্ধার করতে হবে।

বাংলাতে দর্শন চর্চার রেওয়াজ এতোটা কৃত্রিম ও মেকিভাবে গড়ে উঠেছে যে তাতে কাজের কাজ চালানো মুশকিল। অনেকে আবার মনে করেন আমরা পশ্চিমা দর্শন কেন চর্চা করবো? এরা জানে না, দর্শনের কোন পূর্ব-পশ্চিম নাই। দর্শনের যে সব বিষয় নিয়ে কাজ তা সব দেশে, সব কালে, সব জীবনের জন্যই জরুরী। স্থান-কাল ও ব্যাক্তিভেদে পদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে। নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার হতে পারে কিন্তু চিন্তার বিষয়গুলো সকল জীবন এর জন্যই সমান জরুরী। আমরা দর্শনচর্চা করবো, হোক সেটা পুবের, পশ্চিমের বা দক্ষিণের এবং চিন্তার এই বিষয়গুলোর কি ধরণের পদ্ধতিগত চর্চা আমাদের ইতিহাসে ছিল তারও অনুসন্ধান করবো। নিজেরা পশ্চিমা আধুনিকতার নকল করে স্বদেশি দর্শনচর্চার মজমা বসালে কোন কাজের কাজ হবে না। আমাদের দেশে অযথা নাম জপা ও চিন্তাকে না বুঝেই কাউকে মাথায় তুলে নাচানাচির ফলে ভিনদেশি লেখক-দার্শনিকদের ব্যাপারে অবশ্য বিরক্তি তৈরি হওয়া অস্বাভাবিক না। আমাদের চিন্তা চর্চার দৈন্যই এই সমস্যা তৈরি করেছে।

নিজেরা পশ্চিমা আধুনিকতার নকল করে স্বদেশি দর্শনচর্চার মজমা বসালে কোন কাজের কাজ হবে না

আমি চেষ্টা করছি বাংলাতেই দর্শনের জটিল আলোচনাগুলো যতটা পারি আমার মতো করে হাজির করতে। এখানে যেহেতু সব ধরণের পাঠকদের পড়বার সুবিধার কথা মাথায় রাখি এবং চাই ধীরে ধীরে পাঠক নিজেই আগ্রহী হয়ে উঠুক তাই যতটা সম্ভব জটিল তাত্ত্বিক আলোচনা এড়িয়ে আমাদের প্রতিদিনের জীবনের সাথে চিন্তার যে সম্পর্ক সেই দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী থাকি।

কোন কিছু শেখানোর চেষ্টা নাই। কোন তত্ত্বের প্রচারের প্রচেষ্টা নাই। আছে চিন্তা করতে উস্কে দেয়ার নিয়ত। যাইহোক এপিসটোমলজি বা জ্ঞানতত্ত্ব এবং অনটলজি বা সত্তাতত্ত্ব এই দুই চিন্তা পদ্ধতির মধ্যে আমরা বিং বা সত্তার আলোচনার জন্য অনটলজিক্যাল বা সত্তাতাত্ত্বিক পদ্ধতির আলোকে সহজেই আমাদের বিং/সত্তা বা অস্তিত্বময়তার প্রশ্নটি তুলতে পারবো। তাই এখানে আমরা জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনার দিকে যাবো না।

আমরা কিভাবে আসলে থাকি? এই প্রশ্নের বা সংশয়ের জবাব দিয়েছিলেন দেকার্ত। আমি চিন্তা করি বা ভাবি তাই আমি আছি। এই ধারণার ক্রিটিক কান্ট, হেগেল হয়ে অনেকেই করেছেন। এবং দেকার্তের পদ্ধতির মেটাফিজিক্যাল (যার বাংলা আমরা অধিবিদ্যা করবো না। করবো, বিমূর্তায়ন বা উতকল্পনা) চিন্তার ক্রিটিক হয়েছে। এই যে আমি, যে ভাবে সে কি সচেতন? যে খোদ ‘আমি’ আর যে এই আমিকে ভাবে তার মধ্যে সম্পর্ক কি? দেখা যাচ্ছে, দেকার্তের আমি এক অহংবাদী আমি। যে ধরেই নিয়েছে সে নিজের সম্পর্কে সচেতন, বা নিজেকে জানে। নিজেকে সে নিজেই জানে। তার নিশ্চিত জ্ঞান আছে। কিন্তু হুসার্ল বলছেন, সচেতনতা মানে কোন কিছু নিয়ে সচেতনতা। হুসার্ল মানুষের সত্তার ভেতর এক ট্রানসেডেন্টাল বা পরম বিষয়কে আমলে নিয়েছেন। ফলে এই মানুষ নিজেকে নিজেই জানতে পারে না। মানুষ নিজেকে নিজেই বিষয় আকারে নির্ধারণ করে যদি বলে, আমি চিন্তা করতে পারি- তাই আমি আছি। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে চিন্তা করে আর যে আছে দাবি করে দুইয়ের সম্পর্কের মধ্যে সাবজেক্ট-অবজেক্ট সম্পর্ক তৈরি হয়।

আমি চিন্তা করতে পারি- তাই আমি আছি। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে চিন্তা করে আর যে আছে দাবি করে দুইয়ের সম্পর্কের মধ্যে সাবজেক্ট-অবজেক্ট সম্পর্ক তৈরি হয়

বিভাজিত ‘আমি’ কোন ভাবেই দাবি করতে পারেন না সে জানে বা ভাবতে পারে। নিজেকে নিজে জানে এই দেকার্তীয় দাবি হুসার্ল নাকচ করে দিয়েছেন ফেনোমেনলজির আলোচনায়। এই ধারার সাথে মনোবিজ্ঞানকে এক করে ফেলা যাবে না। অনেকে ফোনোমেনলজির অনুবাদ অভিভাস/উদ্ভাস ইত্যাদি দেখে মনে করেন এটা বুঝি মনোবিজ্ঞানের বিষয়। ফেনোমেনলজির বাংলা কি হবে এটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আর জুতসই বাংলা না হলে এই শব্দই ব্যবহার করতে হবে। এটা মনোবিজ্ঞান না। একটা যে কনসাসনেস বা সচেতনা মানুষের নিজেকে ও জগতকে বুঝতে সহায়তা করে সেই অবস্থাকে বিশ্লেষণের এক বিশেষ দার্শনিক পদ্ধতি।

যাহোক, মানুষ বস্তু বা অবজেক্ট নয়। আবার তাকে একমাত্র সাবজেক্ট বা কর্তা ধরে নিয়ে সে সব কিছুর মূলে এটা বলারও সুযোগ নাই। সার্তে হুসার্লের এই চিন্তার ক্রিটিক করে বললেন, মানুষের সত্তার কোন গভীর-গোপন বা ট্রানসিডেনটাল বা পরমার্থিক ব্যাপার নাই। তিনি নাস্তিক্যবাদী অস্তিত্ববাদ নিয়ে এগুলেন। তার কাছে কর্মই মূল। মানুষ যা করে মানুষ তাই। ফলে তাকে এ্যাকশনে থেকেই নিজের অস্তিত্বের জানান দিতে হবে। তিনি সারা জীবন করেছেনও তাই। তিনি বললেন, “existence precedes essence”। তিনি মনে করেন, মানুষের থাকাই তার এসেন্স এবং এটা ব্যক্তি মানুষ নিজে ঠিক করবে। আদতে ‘হিউম্যান ন্যাচার’/মনুষ্য-স্বভাব বা এসন্সে বা সত্য বলে কিছু নাই। সে নিজের কর্ম দিয়ে নিজের এসন্সে বা সত্য নিজে ঠিক করে নেবে। সে স্বাধীন। কর্মই তার এসেন্স ঠিক করে দেবে।

সার্তের মতে থাকাই মানুষের এসেন্স হলে মানুষের আর কোন সত্য থাকে না। মানুষ যা তাই মানুষের এসেন্স বা সত্য। কিন্তু মানুষ যে কারণে মানুষ বা যে সত্যের বা এসেন্স নিয়ে তার সত্তা বিরাজ করে তার প্রশ্নটিকে তিনি প্রাকসিসে পরিণত করে মূল বিং বা সত্তার প্রশ্ন থেকে সরে গেলেন। মানুষের সত্য মানুষে আর রইলো না। রইলো বাইরের প্রাকসিসে, কর্মে বা সে যে শুধু টিকে আছে বা থাকে তার ভেতরই তার এসেন্সকে বুঝতে চাইলেন সার্তে। কিন্তু নিজের সত্যের সাথে পর্যালোচনা বা মোকাবেলার আগেই কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ার বামপন্থি ট্রেডিশন একের পর এক বিপর্যয় তৈরি করে। সার্তের কাছে অস্তিত্ববাদ মানেই মানবতাবাদ। তিনি হাইডেগারের “Being” (কোন কিছু থাকা) -এর ধারণা পাশ কাটিয়ে মার্কসবাদের আলোকে তৈরি করলেন নয়া নাস্তিক্যধারার বস্তুবাদী অস্তিত্ববাদ।

সত্য বলে কিছু নাই। সে নিজের কর্ম দিয়ে নিজের এসন্সে বা সত্য নিজে ঠিক করে নেবে। সে স্বাধীন

আমাদের দেশে এই সাত্রীর্য় ধারার বামপন্থা, এক্টিভিজম ও বুদ্ধিজীবিতাই মূলধারা হিসেবে স্বীকৃত। কয়েক প্রজন্ম ধরে এটাই খুব জনপ্রিয় ধরণ। এখনও বুদ্ধিজীবিতার এই ধরণ বিপুল লোক ফলো করেন। সার্তের চিন্তার দুর্বলতা নিয়ে অনেক ক্রিটিক আছে। অনেক চিন্তক মনে করেন, সার্ত হাইডেগার দ্বারা প্রভাবিত হলেও তিনি হাইডেগারের মূল প্রশ্নটাই (“Being”/কোন কিছু থাকা ) বুঝতে পারেন নাই। হাইডেগার নিজেও তার ব্যাপারে এই মন্তব্য করেছেন।Being and Time (Sein und Zeit)-এর ফোকাসই বুঝতে পারেন নাই। অথচ হাইডেগারের চিন্তা পদ্ধতির অথেনটিসির আকাঙ্ক্ষাজটিলতার গুরুত্বকে আমলে না নিয়ে এ্যাকশনে মনোযোগ দেয়াতে তিনি বিং এন্ড নাথিংনেস খুঁজে পেয়েছেন। সার্ত দেখাতে চাইলেন, মানুষের সত্য প্রকৃতি বা হিউম্যান নেচার এর পরমার্থিক জার্নি বলে কিছু নাই। তিনি বিং বা সত্তার অস্তিত্বকে বুঝলেন নার্থিননেস/শূন্যতা নিয়ে।

মানুষের অস্তিত্ব ডিফাইন বা নির্ধান হয় মূলত একশন বা কর্ম দ্বারা। এবং মানুষ তার পছন্দের ব্যাপারে স্বাধীন। এই স্বাধীনতার বোধও আবার খুব সাবজেক্টিভ আচরণ দ্বারা নির্ধারিত হয়। এটা অনেকটা দেকার্তের সেই কগিটো, ইগো, অহং এরই প্রত্যাবর্তন। এই স্বাধীনতার ধারণা থেকেই সার্তের সঙ্গিনী সিমন দ্য বুভোয়ার নারীবাদী চিন্তার বিস্তার ঘটিয়েছেন। তিনিও সাত্র‍ীয় ধারার অস্তিত্ববাদী দার্শনিক হিসেবে প্রসিদ্ধ। এটার প্রভাব আমাদের নারীবাদের বেহাল অবস্থার দিকে তাকালে সহজেই বুঝতে পারা যাবে। সেটা অন্যদিক আলোচনা করা যাবে।

কাজেই এই ধারার বুদ্ধিজীবিতার কমন বৈশিষ্ট্য হলো, এরা স্বাধীনতার ব্যাপারে এমন অন্ধ ধারণা পোষণ করার ফলে খুব নার্সিসাস হয়ে থাকেন। ব্যাপক অহংকারীও হয়। তারা প্রত্যেকেই নিজেকে জগতের সেরা ও ত্রাণকর্তা মনে করেন। মনে করেন জাতিকে উদ্ধারের বিশাল কাজে তিনি নিয়োজিত, ফলে তিনিই সেরা।
সার্তের যেমন তার অস্তিত্বকে এ্যাকশন দিয়ে বোঝেন এবং এই এ্যাকশনের জাস্টিফিকেশন আকারে বন্দুক রাখলেন মানবতাবাদের ঘাড়ের ওপরে। তিনি লিখলেন বিখ্যাত বই, “Existentialism is a Humanism” বিং এর প্রশ্নটাকে এড়িয়ে গিয়ে মানে, মানুষের এসেন্সে ও সত্যকে এগিয়ে গিয়ে মানবতা রক্ষার এই প্রচেষ্টার পরিণতি আশা করি আর ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। আমাদের বর্তমান জীবন, শাসনপদ্ধতি এই ধারার ওপরই গড়ে উঠেছে। আমরা এই অবস্থাতেই আছি। মানুষের সত্যের ধারণার কোন খবর নাই কিন্তু চারদিকে বিশাল বিশাল মানবতাবাদী। এবং এই মানবতাবাদের যুক্তি জীবন্ত মানুষকে লাশ বানিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়াতে বিপুল মানুষ আবার সম্মতিও দিয়ে দেন।

এই মানবতাবাদের যুক্তি জীবন্ত মানুষকে লাশ বানিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়াতে বিপুল মানুষ আবার সম্মতিও দিয়ে দেন

দেখা যাচ্ছে, নিজের সত্তার শূন্যতাকে এ্যাকশনে নিয়োজিত করতে অস্তিত্বের প্রশ্নের সাথে মানবতাবাদের যোগ ঘটিয়ে নাস্তিক্যবাদী পজিশন থেকে নিজের তৎপরতাকেই এসেনশিয়াল মনে করেন- এই ধারার মানুষগুলো , আমাদের দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদেরও মোটাদাগে একই প্রবণতা। এটাই আমাদের এখানে মূলধারা।

হাউডেগার সার্তের এই ধরণের পজিশনের ক্রিটিক হাজির করেন একটি লেখায়। লেখাটার নাম, লেটার অনহিউম্যানিজম। এই লেখাতে হাইডেগার সার্তের চিন্তার সমস্যার গভীর এক ক্রিটিক হাজির করেন। নানান দিক থেকেই এটা অনেক জরুরী একটি লেখা। এই লেখা ধরেই একটা আলাদা আলোচনা করা দরকার। এখানে সেই সুযোগ নাই। ছোট্ট একটা অংশ আমরা পড়ে দেখতে পারি, “In competition with one another, such occupations publicly offer themselves as “-isms” and try to offer more than others. The dominance of such terms is not accidental. It rests above all in the modern age upon the peculiar dictatorship of the public realm. However, so-called “private Existence” is not really essential, that is to say free, human being. It simply insists on negating the public realm.” ( Martin Heidegger: Basic Writing; Routledge, London. 1978, p-221)

এই ধরণের ব্যক্তিবাদকেন্দ্রিক অস্তিত্বময়তা কোন সত্য ধারণ করতে পারে। এটা বিভিন্ন ইজম বা মতবাদের নামে আসলে জনতার কতৃত্বকেই অবজ্ঞা করে। লিবারাল তথাকথিত গণতন্ত্রনামী মানবতাবাদী আদর্শের অবস্থা আসলে এমনই। তাই সত্তার প্রশ্নটি কেবলমাত্র সার্তের নিখিল নাস্তি ও মানবতাবাদের জায়গা থেকে বুঝলেই হবে না। এটা বরং সমস্যা তৈরি করে। এটা বুঝতে হবে আরও গভীর জায়গা থেকে।

হাইডেগার সারা জীবন এই প্রশ্নটাই গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছেন। তিনি বারবার বলছেন, মানুষের চিন্তার ইতিহাসে এই জরুরী ও কেন্দ্রীয় প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। তিনি বিং এবং দাজাইনকে আলাদা করে আলোচনা করলেন। তিনি হিউম্যান বিং না বলে কেন দাজাইন বললেন? কারণ, মানুষ বললে এই মানুষ যে সব সময় বিং এর সাথে সম্পর্কিত তা পরিষ্কারভাবে বলা যায় না। ফলে হাইডেগারকে নতুন শব্দবন্ধে এটাকে ধরতে হলো। তো খুব সরল করে বা মেকানিক্যাল পদ্ধতিতে বুঝবার বিপদ হলো তাতে চিন্তার হক আদায় না হয়ে দ্রুতই ইজমের দিকে চলে যায়। এবং আমরা এই যে পরমার্থিক সত্তার ডাক তাকে অস্বীকার করে বস্তু জগতের মধ্যে নিজের অস্তিত্ব আটকিয়ে রেখেছি প্রতিনিয়ত তারই খেসারত দিতে হচ্ছে আমাদের।

বিং এর প্রশ্নটা গ্রিক দর্শনে যেভাবে উঠেছে তিনি তার থেকে আলাদা করে প্রশ্নটাকে আরও গুরুত্ব দিয়ে তুলতে চান

সার্তে হাইডেগারের কাজ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে লিখলেন বিং এন্ড নাথিংনেস। তার কাছে বিং বা সত্তার এসেন্সে বলে আলাদা কিছু নেই। তিনি মনে করেন, অস্তিত্বই এসেন্স। তার পরে মরে যাবে মানুষ। ফলে মানুষ ও অন্য বস্তুজগতকে দেখার ধরণের মধ্যে দার্শনিকভাবে কোন পার্থক্য তার চিন্তায় পাওয়া যায় না। কিন্তু তিনি বিং/ সত্তার অস্তিত্বের এর প্রশ্নটা যে সব চেয়ে জরুরী প্রশ্ন তা স্বীকার করেন। কিন্তু স্বীকার করে এর যে ট্যাকনিক্যাল সমাধান দিলেন। বস্তুবাদী বা সব রকম পরমার্থিবতা থেকে চিন্তাকে মুক্ত করতে গিয়ে তৈরি করলেন চরম বিমূর্তায়ন। চরম মেটাফিজিকসের খপ্পরে পড়লেন। সার্তে হাইডেগারের বিং এর প্রশ্নটাই বুঝেন নাই। হাইডেগার যখন বিং ইনদ্যা ওয়ার্ল্ড বুঝান তিনি দাজাইন শব্দটি ব্যবহার করেন।

হাইডেগার এর বিং BEING (SEIN)( BEING AND TIME -বইটি দেখুন) এর আলোচনা জটিল। এবং আর্লি হাইডেগার ও লেট হাইডেগার বিং এর প্রশ্নকে একইভাবে ডিল করেন নাই। BEING বা সত্তার বা কোন কিছু থাকার এই প্রশ্নটি হাইডেগার কোন কিছুর সাপেক্ষে বুঝতে রাজি নন। তিনি বিং কে বিং আকারেই বুঝতে চান। কোন কিছুর সাথে বিং কে বিচ্ছিন্ন করে দেখেন না। BEING AND TIMEএ তিনি বিং কি এই ধরণের সরল উত্তর খুঁজতে যান নাই। তিনি প্রশ্ন তুলতেছেন এবং তালাশ করছেন, মানুষের জীবনের আসল এসেন্সেটা। ফলে বিং বা এই থাকার প্রশ্নটাই যে সব চেয়ে জরুরী প্রশ্ন এবং এটাকে কোন কিছুর সাপেক্ষে বিচার না করে বিং কে বিং এর মতোই বুঝতে চেষ্টাই হাইডেগারের প্রকল্প। আমরা বিং এর এসেন্স না বুঝলে মানুষ কি কারণে মানুষ তাও বুঝতে পারবো না। নাথিং দিয়ে বুঝতে গেলে তৈরি হবে এনার্কি ও ডেসপারেটনেস। যা কালচারাল বামদের নিয়তি। এর কোন চিন্তাগত দিশা যেমন নাই রাজনৈতিকভাবেও এটা ধ্বংসবাদী।

হাইডেগার তাই বিং কে সাইনটিসিজম, খিওলজি, ডিটারমিনিজম ইত্যাদি খপ্পর থেকে বের করে মূল বা আদি অর্থে ফিরে যাওয়ার দিকে মনযোগ ফেরাতে চান। বিং কে কেন্দ্র করেই জগতের সবকিছু। তাই বিং কে বিং এর আলোকে বুঝতে না পারলে মানুষের এসেন্স বা সত্যকে বুঝতে পারা যাবে না। এই প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া বা কোন ইজমের মধ্যে প্রবেশ করে চিন্তার কঠিন পথ থেকে সরে যাওয়ার বিপদ নিয়ে হাইডেগার সারা জীবন লিখেছেন। এখানে এর বেশি বলার সুযোগ নাই। তবে এই বিষয়ে যারা আরও বিস্তারিত বুঝতে আগ্রহী তারা সম্প্রতি প্রকাশিত, the cambridge HEIDEGGER LEXICON; Cambridge University Press 2021-বইটা দেখতে পারেন। এখানে বিং, দাজাইন সহ হাইডেগার এর মূল ধারণাগুলোর বহুমাত্রিক ব্যাখ্যা আছে। সব চেয়ে বড় কথা হলো হাইডেগারকে বুঝতে হবে হাইডেগারের চিন্তা পদ্ধতির আলোকে। নাহলে সার্তের মতো বিপর্যয়কর অবস্থা হতে পারে।

কোন কিছুর না থাকার চেয়ে কোন কিছুর থাকা কি অর্থ বহন করে সেই হদিস তিনি করতে চান

এখানে শুধু এতোটুকুই বলবো, এথিস্ট-বস্তুবাদী ধারার চিন্তকরা বিং বা সত্তার বা অস্তিত্বময়তার প্রশ্নকে দেখেন, বিং এন্ড নাথিংনেস আকারে। হাইডেগার দেখেন, দেয়ার ইজ সামথিংরেদার দেন নাথিং। কোন কিছু থাকার অর্থটা তিনি অনুসন্ধান করেন। বিং বা সত্তার থাকার মধ্যেই মানুষে গুরুত্ব ও সত্য। বিং এর প্রশ্নটা গ্রিক দর্শনে যেভাবে উঠেছে তিনি তার থেকে আলাদা করে প্রশ্নটাকে আরও গুরুত্ব দিয়ে তুলতে চান। কোন কিছুর এই থাকা, টু বি, বিং এর প্রশ্নটা তাই নিহিলিস্টদের পক্ষে বুঝতে পারা সম্ভব না। এই জন্য হাইডেগার বিং কে কোন ক্যাটাগরির মধ্যে নির্দিষ্ট করেন না। বিং-কে মানুষ বা বস্তুর ধারণার মধ্যেও রাখেন না। এই জন্য আলাদা করে তিনি Dasein শব্দটি ব্যবহার করেন। এটা প্রথম কান্ট ব্যবহার করেছিলেন। কান্ট যে কোন এনটিটির একজিসটেন্সকেই দাজাইন হিসেবে দেখেছেন। হাইডেগার এটা মানুষের বেলাই ব্যবহারের জন্য শব্দটিকে বেছে নেন।

তিনি কেন এই শব্দটি আলাদা করে ব্যবহার করলেন? কারণ দাজাইন বললে হিউম্যান বিং যে জগতের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত তা পরিষ্কার হয়। জার্মান শব্দ, Da মানে there, sein মানে to be মানে এটা দিয়ে ‘being’-কেই বোঝানো হয় ব্যাপক অর্থে। দাজাইনের চলতি ইংরেজি অনুবাদ দেখা যায়, ‘বিং ইন দ্যা ওয়াল্ড’ হিসেবে। হাইডেগার এটা মানুষকে বোঝাতে ব্যবহার করেছেন। মূলত বিং/সত্তার বা অস্তিত্বময়তার বোধ বা চিন্তা ছাড়া মানুষের এসেন্স মানে মানুষ যেই কারণে মানুষ তা বুঝতে পারা সম্ভব না আগেও লিখেছি এই কথা। কিন্তু এটাকে বুঝতে হবে এটার এসেন্সসহ। এসেন্স বা সত্যকে বাদ দিয়ে বিং এর কোন অর্থ থাকে না। কিন্তু এই সত্যকে উলব্ধি করা সহজ নয়। তাই চিন্তার নামে ফ্যাশনেবল ইজমের চর্চা দেখা যায়। সবকিছুর রেডিমেট সমাধান দিয়ে দেওয়ার একটা প্রবণতা দেখা যায়। যেখানে মূল প্রশ্নই আমরা বুঝতে পারি নাই সেখানে বাকি সব আয়োজন বাহুল্যমাত্র। তাই হাইডেগার উত্তর দেয়ার চেয়ে প্রশ্ন উত্থাপনকে জরুরী মনে করেন। কিন্তু এপিসটোমলোজি যেভাবে প্রশ্ন করে তাতে সত্য জ্ঞান সম্ভব হয় না। তিনি তাই প্রশ্নটা ঘুরিয়ে করেন। বিং কি এই প্রশ্নের চেয়ে বিং কি ভাবে? এটা আমাদের বেশি কাজে আসে। কোন কিছুর না থাকার চেয়ে কোন কিছুর থাকা কি অর্থ বহন করে সেই হদিস তিনি করতে চান।

ফলে ক্ষমতা পাইলে এই গোটা মানবতাবাদের ব্যবসাটা হয়ে যায় সন্ত্রাসের হাতিয়ার

আমরা আগের আলোচনায় দেখেছি সার্তে কিভাবে বিং ইন ইট সেল্ফ ও বিং ফর ইটসেল্ফে এর ধারণার আতারণা করে এই প্রশ্নকে চরম বিমূর্তায়ন করে তুলেছেন। বিং কে বিভাজনের এই যে মর্ডানিস্ট চিন্তার ছক এটা এড়াতেই হাইডেগার দাজাইন শব্দটি ব্যবহার করেছেন। হাইডেগার দাজাইন বা হিউম্যানকে কখনও বিং এর থেকে সেপারেট বা আলাদা করে দেখেন নাই উপরে সেটা আমরা আলোচনা করেছি। তাই তিনি বিং -এর প্রশ্ন থেকে মানুষ কে আলাদা করে দেখা এবং এর বিভিন্ন শ্রেণিকরণের যে আধুনিকতাবাদী চিন্তার খপ্পর সেটা থেকে নিজেকে ও দর্শনকে রক্ষা করতে পেরেছেন।

তাহলে আমাদের অবস্থাটা কি দাঁড়ালো? আমরা আছি দেকার্তিয়ান অর্থে? একটু সচেতন হলে। বা একটু বুদ্ধিজীবিতা করতে পারলে আমরা আছি সার্তের অর্থে? এর সাথে আমরা আবার মানবতার মুক্তির দূত আকারেও নিজেকে হাজির করি। ফলে ক্ষমতা পাইলে এই গোটা মানবতাবাদের ব্যবসাটা হয়ে যায় সন্ত্রাসের হাতিয়ার। কারণ বিং-এর সত্যকে, এসেন্সকে আমরা বুঝি নাই। এটাকে আমরা সাবজেক্ট-অবজেক্ট আকারে দেখি। আমরা – ওরাতে বিভাজন করে ফেলেছি নিজেকে ও দুনিয়াকে । এই জন্য হাইডেগার নলেজ শব্দটি এড়িয়ে দাজাইনের সাথে জগতের সম্পর্ক বুঝাতে ব্যবহার করেন ‘আন্ডারসটেনডিং’ ও ‘কেয়ার’ শব্দটি। বিং এর কোন আপন পর নাই। বিং ইজ বিং। কিন্তু আমরা জ্ঞানগত ভাবে অন্যকে জানার বা বোঝার দাবি করি এবং তার জন্য কি ভালো হবে তা ঠিক করে দেই। এই ভাবে প্রভু হয়ে উঠি।

চিন্তাকে পাশ কাটিয়ে সহজ পথে আগানোর ফলে এই বিপর্যয় তৈরি হয়। তাই হাইডেগার বারবার চিন্তার ওপর গুরুত্ব দেন। এবং সব চিন্তার মূল প্রশ্ন হলো এই বিং এই সত্তার অস্তিত্বের প্রশ্ন।

এখন আমাদের ঠিক করতে হবে আমরা আন্ডারস্ট্যানডিং/বুঝতে চেষ্টা করা ও কেয়ারিং/যত্নময় সত্তা হবো নাকি অন্যকে জানার কর্তা হয়ে, প্রভু হয়ে নিজের সুবিধামতো নিজেকে ও জগতে শাসন চালাবো। জালেম হয়ে উঠবো? আমাদের অস্তিত্ব কি ইগোকামি হবে? আমরা কি ইগো বা অহং নিয়ে টিকে থাকবো? নাকি অস্তিত্ব/বিং কে বিং এর সত্য ও এসেন্সসহই টিকে থাকার মতোন জীবনের দিকে নিজেদের পরিচালিত করবো? আমরা কি ভাবে আছি এবং থাকবো তার মীমাংসা করা খুব জরুরী। খুব জরুরী দরকার।

লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ: rkrony@live.com

আরো পড়তে পারেন

একাত্তরের গণহত্যা প্রতিহত করা কি সম্ভব ছিল?

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই এক রাতেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে….

ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

আগের পর্বে পড়ুন— চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও একটি সার্থক গণআন্দোলন। এই গণআন্দোলনের মূল চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হলো দেশপ্রেম থেকে জাত সেই অনুভূতি, যার একটি রাজনৈতিক প্রকাশ রয়েছে। আর, বাঙালি জাতিসত্তাবোধের প্রথম রাজনৈতিক প্রকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে দুই হাজার মাইল দূরত্বের….

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল)

আগের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ একুশের আবেগ সংহত থাকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দেও। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। আওয়ামি লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ১৮ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটির সদস্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র….

error: Content is protected !!