Author Picture

ত্রিভুজ প্রেমের মামলা

খন্দকার রেজাউল করিম

অসতী

অলিভ পাহড়ের মাথায় অসতী মেরি ম্যাগডিলানকে খুন করতে যাচ্ছিল হিংসায় উন্মত্ত একদল লোক। পাশের মন্দির থেকে এক দীপ্ত যুবক বেরিয়ে এসে মেয়েটিকে আগলে ধরলো। ‘‘ও একটা বাজারের মেয়ে, বেশ্যা, ওকে পাথর ছুড়ে মারতে হবে, পুরানো বাইবেলের নির্দেশ।’’ যুবকটি বললো: ‘‘He that is without sin among you, let him first cast a stone at her (John 8:7)।’’ পাপ ছাড়া তো মানুষ নেই, সবাই একে একে সরে পড়লো। প্রসন্ন নয়নে মেয়েটির দিকে চেয়ে যুবকটি বললো, ‘‘Neither do I condemn you: go, and sin no more (John 8: 11)।’’ এই যুবকটিকে খ্রীষ্টানরা ডাকে ত্রাণকর্তা যীশু বলে, আর মুসলমানরা ওকে জানে ঈসা নবী হিসেবে।

হামুরাবির আইন-গ্রন্থে অসতীদের জন্য ভয়াবহ শাস্তির বিধান রয়েছে: হাত পা বেঁধে বস্তায় পুরে Tigris নদীতে ফেলে দেয়া। এটা যীশু খ্রীষ্টের জন্মের ১৭৫৪ বছর আগের কথা। টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর ধারে মানুষ তখন ঘর বেঁধে বাস শুরু করেছে। ছোট ছোট শহর। ব্যাবিলন আর মেসোপটেমিয়া সভ্যতার যুগ। রাজা হামুরাবি আকাশ আর নক্ষত্রপুঞ্জের দেবতা ‘‘আনু’’র হলফ করে এই আইনগুলি লিপিবদ্ধ করেন।

কিশোর বয়সে যে অসতী আমাকে অনেক কাঁদিয়েছে তার নাম সোনিয়া। ভালো নাম সোফিয়া সেমিওনোভা মারমেলাডোভা। রুশ সাহিত্যের দিকপাল ডসটোইয়েভস্কির (Dostoyevsky) লেখা ‘‘Crime and Punishment’’ উপন্যাসের নায়িকা সে। নিষ্পাপ, মৃদুভাষী, আত্মত্যাগী, লাজুক এই মেয়েটি। বাবা মাতাল, হতদরিদ্র সংসার। মেয়েটিকে বাধ্য করা হলো পতিতাবৃত্তি করে সংসারের হাল ধরতে। প্রথম দেহ বিক্রির ফসল, কয়েকটি রুপার মুদ্রা, হাতের মুঠোয় নিয়ে মেয়েটি যে দিন বাড়ি ফেরে, তার চোখের উষ্ণ জল ডসটোইয়েভস্কি যেন আমার কিশোর বুকের উপর ঝরিয়েছিলেন।

হামুরাবির আইন-গ্রন্থে অসতীদের জন্য ভয়াবহ শাস্তির বিধান রয়েছে: হাত পা বেঁধে বস্তায় পুরে Tigris নদীতে ফেলে দেয়া। এটা যীশু খ্রীষ্টের জন্মের ১৭৫৪ বছর আগের কথা। টাইগ্রিস আর ইউফ্রেটিস নদীর ধারে মানুষ তখন ঘর বেঁধে বাস শুরু করেছে। ছোট ছোট শহর। ব্যাবিলন আর মেসোপটেমিয়া সভ্যতার যুগ

স্বর্গ থেকে দেবদূতরা পৃথিবীতে ছদ্মবেশে এসেছিলেন সৎ মানুষের খোঁজে। জার্মান নাট্যকার বের্টোল্ট ব্রেখটের ‘‘The Good Person of Szechwan’’ নাটকের গল্প। নায়িকা শেন টে একজন অসতী বারবনিতা। যত দূর মনে পড়ে, ঢাকার ‘‘নাগরিক’’ নাট্যগোষ্ঠী ওর নাম দিয়েছিল ফুলি, ভারতের অনেক নাট্যশালায় ওর নাম রামকলি। সারা সেচোয়ান শহর ঘূরে দেবদূতরা খুঁজে পেলেন শুধুই লোভী, স্বার্থপর, ভন্ড, অসৎ, মিথ্যেবাদী মানুষের দল। শহরের বিত্তবান, পুন্যবান, বিশিষ্ট জনেরা অনেকেই গোপনে অসতী ফুলির খদ্দের, কিন্তু বাইরে সাধু সেজে বসে আছে। কোথায়ও জায়গা জুটল না, শেষে ফুলির ঘরেই দেবদূতরা আশ্রয় পেলেন।

তারাশংকর বন্দোপধ্যায়ের ‘কবি’ উপন্যাসের নায়িকা ‘বসন’ও একজন অসতী পণ্যস্ত্রী। গ্রামে-গঞ্জে ঝুমুর দলের আসরে সে অশ্লীল নাচ দেখায়। এই অভিশপ্ত জীবনের জন্য ঈশ্বরের উপরে তার ভারী অভিমান। তবুও মৃতুর মুহুর্তে সেই ঈশ্বরের কাছেই সে নিজেকে সমর্পণ করে।
ঘেটু দলের একটি বালককে নিয়ে হূমায়ন আহমদ বানিয়েছেন তাঁর সিনেমা, ‘‘ঘেটু পুত্র কমলা’’- বহু যুগের যৌন-নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে এক নিঃশব্দ চিৎকার। বিদ্রোহী কবি নজরুল প্রতিবাদ করেছেন। ‘‘কে তোমায় বলে বারাঙ্গনা মা, কে দেয় থুতু ও গায়ে?’’ অথবা ‘‘শোনো ধর্মের চাঁই, জারজ কামজ সন্তানে দেখি কোনো সে প্রভেদ নাই।’’
কবি ওমর খইয়াম পুন্যবানদের মুখোশ খুলে দিতে চেয়েছেন: সাধুদের গেরুয়ার আড়ালে লুকিয়ে আছে কি কুৎসিত কংকাল?
‘‘A clergyman once told a prostitute, you are drunk!
You sleep with one man and then with another!
She replied, Oh dear Mullah, I am what you say I am,
But are you what you appear to be?’’
ধর্মগ্রন্থগুলিতে অপরাধ, শাস্তি, অনুতাপ, আর ক্ষমার কথা চক্রাকারে লেখা থাকে। যীশুর মতো মহাপুরুষেরা ক্ষমাকেই বড় করে দেখেন। ধর্ম-মোড়লদের কাছে অপরাধ আর শাস্তিটাই প্রধান হয়ে দাঁড়ায়, অনুতাপ আর ক্ষমার কথা মনেও আসে না। অসতীর বাইরের পাপটাই ওদের চোখে পড়ে, অন্তরের পবিত্রটা নয়। যে যেমনি জগৎ দেখে তেমনি।

আরো পড়তে পারেন

প্রতিদান

‘আমাকে আপনার মনে নেই। থাকার কথাও নয়। সে জন্য দোষও দেব না। এত ব্যস্ত মানুষ আপনি, আমার মত কত জনের সঙ্গেই হঠাৎ চেনা-জানা। কেনইবা মনে রাখবেন তাদের সবাইকে?’ বেশ শান্ত গলায় বললেন মিসেস অঙ্কিতা। টেবিল থেকে কি যেন একটা নিলেন তিনি। পিটপিট করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সাফরাব। একটা ইনজেকশন, একটা ছোট টেস্টটিউবের মতো ভায়াল,….

লিলিথ

শাওয়ার বন্ধ করে দিতেই পানির হালকা ঝিরঝিরে শব্দটা বন্ধ হয়ে যায়। প্রযুক্তির কল্যাণে ঝরনার শব্দ আজকাল বাসাতেই শোনা যাচ্ছে। আর এ শব্দটা অদ্ভুত সুন্দর। কেমন যেন মোলায়েম। সাদা তুলতুলে মেঘের মতো। অনেক দূর থেকে ভেসে ভেসে এসে জড়িয়ে ধরে। চোখের পাতাগুলোয় ঠান্ডা আমেজ ছড়িয়ে ঘাড় বেয়ে নামতে থাকে। আরামে চোখ বুজে আসে আমার। রিলাক্স হতে….

বন্ধনবিলাস

এ শতকের ধূলিধূসরিত ঢাকায় দাঁড়িয়ে কল্পনা করাও কঠিন। গত শতকের ঢাকা ছিল রাজহাঁসের পালকের মতো পরিচ্ছন্ন ধবধবে। একতলা-দোতলার ছাদে শীতলপাটি বিছিয়ে রাতের আকাশের দিকে চাইলে দেখা যেত নক্ষত্রদের কনফারেন্স। মেঘহীন রাতগুলোতে খুব কাছের হয়ে যেত দূরছায়া নীহারিকার পথ। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। অগণ্য তারার যে কোনো তারাকে। রাস্তার দু’ধারে জামরুল-জিউল আর বাবলার অন্ধকার ঢাকতে….

error: Content is protected !!