‘মনের জালে দুঃখের বৃষ্টি ঝুমঝুমাইয়া পড়ে,
একলা ঘরে ভালোবাসা কেঁদে কেঁদে মরে।
ইন্দুবালা গো, তুমি কোন আকাশে থাকো!
ডুবিয়া মরিলাম, মরিয়া ডুবিলাম, তোমারি প্রেমে পড়িলাম।’

স্কুল এবং কলেজ জীবনে কেভিন ছিল সেরা খেলোয়াড়দের একজন। সেই এতটুকু বয়েস থেকেই আমেরিকার জাতীয় বাস্কেটবল দলের খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন দেখতো। সব স্বপ্ন মাঠে মারা গেছে। কলেজ থেকে শারীরিক ব্যায়াম বিষয়ে ডিগ্রি নিয়ে প্রথমে ওয়ালমার্টের সেলসম্যান হিসেবে অল্পবেতনের চাকরি, তারপরে আরো দু’চার ঘাটের পানি খেয়ে অবশেষে গ্রামের এক স্কুলে ক্রীড়াশিক্ষক হিসাবে যোগ দিয়েছে সে। গ্রামের স্কুল হলেও আধুনিক সুবিধাগুলো আছে; লাইব্রেরি, ক্যাফেরারিয়া, সুইমিং পুল, পার্ক, ফুটবল স্টেডিয়াম, বাস্কেটবল কোর্ট, জিমনেসিয়াম। আসেপাশের আরো দশ গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা স্কুলটিতে পড়তে আসে। দিগন্তজোড়া ভুট্টা, গম, এবং সয়াবিনের ক্ষেত। কৃষকদের বাড়ির সামনে বিরাট উঁচু ফসলের গোলা। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ির দূরত্ব অনেক, বাড়ির সামনের পাকা সরু রাস্তাগুলো মিউনিসিপ্যালিটির রাস্তার সাথে যেয়ে মিশেছে। রাস্তাগুলো টানা সরল রেখার মতো। বাড়ি, রাস্তা, পুকুর, দীঘি, সব যেন ছক বেঁধে, হিসেবে করে বানানো হয়েছে। গ্রামের দশ কিলোমিটার দূর দিয়ে গেছে আন্তঃ অঙ্গরাজ্যের বিশাল এক রাজপথ, এই পথে চব্বিশ ঘন্টা ছুটছে মালবাহী ট্রাক এবং যাত্রীবহনকারী গাড়ি। এই রাজপথগুলো এতই চওড়া এবং মজবুত যে একটি বড়োসড়ো উড়োজাহাজ অনায়েসে উঠানামা করতে পারে।

আবার যদি শৈশবে ফেরা যেত! জীবনটা নদীর মতো একদিকেই বয়ে যায়, ফিরে যাওয়ার উপায় নেই

সুজান এ গ্রামের-ই মেয়ে। এখানেই জন্ম, এই স্কুলেরই প্রাপ্তন ছাত্রী। এখন স্কুলের বাস ড্রাইভার হিসেবে কাজ করছে। স্কুলের গোটা দশেক বাস আছে, বিভিন্ন গাঁয়ে ঘুরে ঘুরে বাসগুলি ছাত্র-ছাত্রী সংগ্রহ করে সকালে স্কুলে নিয়ে আসে, বিকেলে আবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়। আমেরিকার হাইস্কুলগুলোতে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে। ওদেরকে যথাক্রমে, ফ্রেশম্যান, সোফোমোর, জুনিয়র, এবং সিনিয়র বলে ডাকা হয়। স্কুলের মাইনে, বইপত্রের দাম, স্কুল চালনার খরচ সবই আসে এলাকার লোকদের ভূমি-কর এবং গৃহ-কর থেকে। জুনিয়র এবং সিনিয়র শিক্ষার্থীদের বয়েস সতেরো থেকে ঊনিশের মধ্যে। এই বয়সটায় ছেলেমেয়েরা কতগুলি সরকার-অনুমোদিত অধিকার অর্জন করে; গাড়ি চালনার লাইসেন্স, নির্বাচনের ভোট দেয়ার অধিকার, ইচ্ছে করলে মদ এবং সিগারেট কেনা এবং খাওয়ার সুযোগ, অভিভাবকদের মতের বিরুদ্ধে প্রেম এবং বিয়ে করার স্বাধীনতা। হাইস্কুল পাশ করে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যায়। তবে উনিভার্সিটিতে পড়ার সৌভাগ্য গ্রামের স্কুলের বেশির ভাগ ছেলেমেয়ের হয় না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সব খরচের দায় শিক্ষার্থী এবং তাদের পিতামাতার। পড়াশুনায় খুব মেধাবী ছাত্রী হয়েও পয়সার অভাবে সুজানের উনিভার্সিটিতে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা ব্যয়বহুল, প্রায় তিন কোটি টাকার ব্যাপার। শিক্ষামন্ত্রণালয় থেকে সহজেই টাকাটা ধার হিসেবে পাওয়া যায়, কিন্তু এতো টাকা ধার করতে সুজান সাহস পায় নি। ডাক্তার হওয়ার বড় সাধ ছিল সুজানের, হতে হলো বাস ড্রাইভার। ছেলেবেলার বন্ধুরা অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বড় চাকরি করছে। টাকা ধার নিয়ে উনিভার্সিটিতে পড়াশুনা না করার মস্ত ভুলটা পুরানো সহপাঠীদের দামি গাড়ি-বাড়ি দেখলেই বোঝা যায়। আবার যদি শৈশবে ফেরা যেত! জীবনটা নদীর মতো একদিকেই বয়ে যায়, ফিরে যাওয়ার উপায় নেই। সুজান হীনমন্যতায় ভোগে। মাঝে মাঝে নিজের জীবনটাকে নিয়ে ভীষণ ক্ষোভ হয়।

সুজানকে এক নজর দেখার আশায় অকারণে সে পথে কেভিন অনেকবার হেঁটেছে। কখনো চোখাচোখি হয়নি। সামনের সিটে বসে মেয়েটি সবসময় বই পড়ছে। একজন ড্রাইভার সারাবেলা কি এমন বই পড়ে?

তিনজন ছাত্রী এবং একজন ছাত্র এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের সামনের রাস্তায় প্রতিদিন ভোরবেলা দাঁড়িয়ে থাকে। একটু পরেই স্কুলের বাস এসে ওদের তুলে নিয়ে যাবে। কেভিন ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে। দোতালার ব্যালকনি থেকে স্কুলের বাসটা স্পষ্ট দেখা যায়। বাসের ড্রাইভারের সিটে সুজান বসে আছে, ঘাড় ঘুরিয়ে নতুন যাত্রীদের দেখছে। বাসের ইমার্জেন্সি বাতিগুলো জ্বলছে আর নিবছে, বাসের সামনে এবং পিছনে কয়েকটি গাড়ি ইতিমধ্যেই জড়ো হয়েছে। নিরাপত্তার জন্যে ছাত্র-ছাত্রীদের ওঠা-নামার সময় আর কোনো গাড়ির বাস পেরিয়ে যাওয়ার নিয়ম নাই, সবাই গাড়ির ভিতরে শান্তভাবে অপেক্ষা করছে। বাসের জানালার বাইরে এবং সামনের আয়নার দিকে একবার তাকিয়ে সুজান বাসটি নিয়ে স্কুলের দিকে রওনা দিলেই কেভিন লিভিং রুমে ফিরে আসবে, চোখ বন্ধ করে সোফায় বসে কিছুক্ষন সুজানের কথা ভাববে। তারপরে স্কুলের দিকে রওনা হবে। এটা প্রতিদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

স্কুল থেকে দশ কিলোমিটার দূরে আন্তঃঅঙ্গরাজ্যের মহাসড়কটির আশেপাশে একটি ছোট্ট শহর গড়ে উঠেছে। কেভিন সেখানেই এপার্টমেন্টটি ভাড়া নিয়েছে। সুজানের চিন্তা সারাক্ষন কেভিনকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ওকে স্কুলের প্রাঙ্গনে কয়েকবার দেখেছে, আলাপ করার সুযোগ হয়নি। মেয়েটির প্রতি এক দুর্বার আকর্ষণ অনুভব করছে সে। কারণটা ওর জানা নেই। হয়তো অপরিচিত এই গ্রামে ও একা আছে বলে। উনিভার্সিটিতে ওর বান্ধবীর অভাব ছিল না। কিন্তু এই অজপাড়াগাঁয়ের মেয়েটির মতো এমন টানে কেউ তাকে কখনো টানে নি। স্কুলের শেষ ঘন্টা পড়ার আগেই বাসগুলো রাস্তার উপরে সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকে। সুজানকে এক নজর দেখার আশায় অকারণে সে পথে কেভিন অনেকবার হেঁটেছে। কখনো চোখাচোখি হয়নি। সামনের সিটে বসে মেয়েটি সবসময় বই পড়ছে। একজন ড্রাইভার সারাবেলা কি এমন বই পড়ে?

কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, কিছুই ভাবতে পারছে না। সূর্যটাকে কে যেন ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিয়েছে, সুজানের হাসিহাসি মুখ, খেলার মাঠ, সামনের সবকিছু আঁধারে মিশে গেছে

শনিবারের এক সকালে কেভিন স্কুলের মাঠে এসেছে। ছোট্ট ছেলে-মেয়েদের বেসবল খেলার ক্যাম্প বসেছে ওখানে। কেভিনের দায়িত্ব এই খুদে খেলোয়াড়দের বেসবল খেলার হাতেখড়ি দেয়া। স্কুলের সমাজসেবামূলক উদ্যোগ। কচি খেলোয়াড়দের নবীন চোখে অনেক স্বপ্নের ভিড়। হোম-রানের বন্যা বইয়ে দিয়ে এরা সবাই বেব রুথ হতে চায়। কেভিনও চেয়েছিলো বাস্কেট-বল কোর্টে করিম আব্দুল জব্বারের মতো স্কাই-হুক ছুড়তে, মাইকেল জর্দানের মতো শূন্যে উড়তে। কিছুই তো হলো না। এই বিফল জীবনের বোঝা আমৃত্যু বয়ে বেড়াতে হবে।

জনা বিশেক ছেলেমেয়ে মাথায় বেসবল ক্যাপ, হাতে বেসবল ব্যাট নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। মা-বাবা, নানা-দাদি, ভাই-বোনের হাত ধরে আরো অনেক শিশু এখনো গাড়ি থেকে নামছে। একটা গাড়ির কাছে কেভিনের চোখ থমকে গেলো। একটি ছোট্ট ছেলের হাত ধরে গাড়ি থেকে সুজান নামছে। চেয়ারে বসে কেভিন একটি খাতায় সব নবীন খেলোয়াড়দের নাম-ঠিকানা লিখছিলো। সুজান সামনে এসে হাত বাড়িয়ে নিজেকে পরিচয় করিয়ে দিলো, ‘‘হাই, আমি সুজান। আমার ছেলেটিকে আপনার বেসবল-ক্যাম্পে ভর্তি করে নিলে কত যে খুশি হতাম। ও বেব রুথ হতে চায়।’’
কাঁপাকাঁপা হাতে কেভিন নাম-ঠিকানা লেখা শুরু করলো। বুকের ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে, মাথায় অনেক চিন্তার ভিড়। মেয়েটি কি বিবাহিত? স্বামী সন্তান নিয়ে সুখী পরিবার? স্বামীর দেখা নেই কেন? কেভিন স্বাভাবিক হতে পারছে না, ছোট্ট ছেলেটির মাথায় হাত রেখে বেব রুথ কে নিয়ে একটা রসিকতা করার চেষ্টা করলো, কিন্তু কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, কিছুই ভাবতে পারছে না। সূর্যটাকে কে যেন ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিয়েছে, সুজানের হাসিহাসি মুখ, খেলার মাঠ, সামনের সবকিছু আঁধারে মিশে গেছে। শিশুদের হৈচৈ-হট্টগোল, সুজানের কথা, কিছুই আর কানে ঢুকছে না। সুজান অবাক হয়ে টেবিলের উপরে দুই হাত রেখে ঝুঁকে দাঁড়ালো, চোখে চোখ রেখে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে এক গাদা প্রশ্ন করলো, ‘স্যার, কি হয়েছে? কিছু ভুল হয়েছে কি? এমন করছেন কেন? কিছু কি খোয়া গেছে? আপনি ভালো আছেন তো?’

আরো পড়তে পারেন

প্রতিদান

‘আমাকে আপনার মনে নেই। থাকার কথাও নয়। সে জন্য দোষও দেব না। এত ব্যস্ত মানুষ আপনি, আমার মত কত জনের সঙ্গেই হঠাৎ চেনা-জানা। কেনইবা মনে রাখবেন তাদের সবাইকে?’ বেশ শান্ত গলায় বললেন মিসেস অঙ্কিতা। টেবিল থেকে কি যেন একটা নিলেন তিনি। পিটপিট করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সাফরাব। একটা ইনজেকশন, একটা ছোট টেস্টটিউবের মতো ভায়াল,….

লিলিথ

শাওয়ার বন্ধ করে দিতেই পানির হালকা ঝিরঝিরে শব্দটা বন্ধ হয়ে যায়। প্রযুক্তির কল্যাণে ঝরনার শব্দ আজকাল বাসাতেই শোনা যাচ্ছে। আর এ শব্দটা অদ্ভুত সুন্দর। কেমন যেন মোলায়েম। সাদা তুলতুলে মেঘের মতো। অনেক দূর থেকে ভেসে ভেসে এসে জড়িয়ে ধরে। চোখের পাতাগুলোয় ঠান্ডা আমেজ ছড়িয়ে ঘাড় বেয়ে নামতে থাকে। আরামে চোখ বুজে আসে আমার। রিলাক্স হতে….

বন্ধনবিলাস

এ শতকের ধূলিধূসরিত ঢাকায় দাঁড়িয়ে কল্পনা করাও কঠিন। গত শতকের ঢাকা ছিল রাজহাঁসের পালকের মতো পরিচ্ছন্ন ধবধবে। একতলা-দোতলার ছাদে শীতলপাটি বিছিয়ে রাতের আকাশের দিকে চাইলে দেখা যেত নক্ষত্রদের কনফারেন্স। মেঘহীন রাতগুলোতে খুব কাছের হয়ে যেত দূরছায়া নীহারিকার পথ। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। অগণ্য তারার যে কোনো তারাকে। রাস্তার দু’ধারে জামরুল-জিউল আর বাবলার অন্ধকার ঢাকতে….

error: Content is protected !!