Author Picture

রাজীবের অনন্যতা

সৌমিত্র শেখর

রাজীব সরকার ভালো আলোচনা করে এবং বিতর্কে তার কাছাকাছি যাবার প্রতিযোগী প্রায়ই পাওয়া যায় না। যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র সে, হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে তখন আমি সেটি দেখেছি। ডাকসু ও হল সংসদ সে সময় থাকলে ঘরে পুরস্কার রাখার জায়গা পেতো না সে। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে ও হলের আয়োজনে সাহিত্য-প্রতিযোগিতা খুব-একটা হতো না। এমন কি, বহুবার প্রস্তাব দেওয়ার পরও হল থেকে সাহিত্য পত্রিকাও প্রকাশ করাতে পারিনি। তবে, বিভিন্ন সংগঠনের নানা যে প্রতিযোগিতা হতো এবং ডিইউডিএস-এর যে বাৎসরিক আয়োজন হতো, সেখানে রাজীব তার কৃতিত্ব দেখাতো। জাতীয় টেলিভিশন বিতর্ক প্রতিযোগিতাকে অঘোষিতভাবে বিতর্কের ‘জাতীয়’ প্রতিযোগিতা ধরা হয়। সেই প্রতিযোগিতার ১৮তম আসরে জগন্নাথ হল দল চ্যাম্পিয়ন হয় এবং এটিই জগন্নাথ হলের প্রথম শিরোপা জয়। এই দলের দলনেতা ছিল রাজীব সরকার এবং শ্রেষ্ঠ বক্তা হিসেবেও নির্বাচিত হয়েছিল সে। হলের বিতর্ক দলের মডারেটর হিসেবে আমি দেখেছি, সপক্ষের প্রতিযোগীদের যুক্তির ঘাটতি পুষিয়ে নিয়ে প্রতিপক্ষকে রাজীব কৌশলে মারণবাণটি নিক্ষেপ করতো যথামুহূর্তে। এখানেই সে অনন্য। অন্যরা যেখানে শেষ তীরটি রেখে দেয় অন্তিম মুহূর্তের জন্য, রাজীব সেটি প্রয়োগ করে যথামুহূর্তে। তাই তার শেষ তীর বলে কিছু নেই; সবই প্রথম, সবই শেষ।

রাজীবের বলবার একটি অসাধারণ ক্ষমতা আছে। ক্লাসের বই ছাড়াও বাইরের বই আর পত্রপত্রিকা পাঠে তার আগ্রহ ছিল ব্যাপক। এখনও সেটি বজায় আছে নিশ্চয়। সেখান থেকে উঠে আসা যুক্তির শেল যখন সে প্রতিপক্ষের দিকে ছুঁড়ে দিতো, তার সঙ্গে প্রয়োজনে মেশাতো হিউমার আর উইট, তখন সেগুলো বেশ উপভোগ্য হতো। সিরিয়াস আলোচনায় এই হিউমার আর উইটের ব্যবহার খুব কাজের। বিতর্কের গভীর তর্কের মধ্যে যদি একটু হিউমার আর উইটের প্রলেপ দেওয়া হয়, সেটি শ্রোতা ও বিচারক উভয়েরই ভালো লাগে। বাংলায় ‘হাসি’ শব্দের মাত্রাফের নেই, যেটি আছে ইংরেজিতে। রাজীবের বক্ত‌ৃতা শুনে কারো ‘লাফ্’ আসবে না, আসবে ‘স্মাইল’। বাঙালি সাধারণত ‘লাফ্’ ভালোবাসে আর ফরাসি জাতি স্মাইলিস্ট। ‘স্মাইল’-এর সঙ্গে আছে বুদ্ধির যোগ; আর ‘লাফ্’-এর সঙ্গে অসঙ্গতির সংযোগ। সমাজ বা চারপাশে অসঙ্গতি দেখলেই আমরা হা-হা করে উচ্চস্বরে হেসে দিই। এটি ‘লাফ্’। নিজে না-হেসে অন্যকে ‘স্মাইল’-এ হাসানোর এক অসাধারণ ক্ষমতা আছে রাজীবের।

বিতর্কে তার কাছাকাছি যাবার প্রতিযোগী প্রায়ই পাওয়া যায় না। যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্র সে, হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে তখন আমি সেটি দেখেছি

রাজীব ছাত্র হিসেবে মেধাবী এবং প্রথম শ্রেণি প্রাপ্ত। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে চায়, এমন ইচ্ছের কথা একদিন আমার কাছে ব্যক্ত করেছিল। সে কারণে তাকে নিয়ে ‘অভিযান’ও শুরু করেছিলাম। কিন্তু এরই মধ্যে সরকারি চাকরিতে অনেকের কাছেই আকর্ষণীয় একটি ক্যাডারে সে যোগ দেয়। আমি বিশ্বাস করি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে সে যোগদান করলে দেশ একজন সৎ বুদ্ধিজীবী পেতো। ক্ষতি নেই, ক্যাডার সার্ভিসেও ভালো মানুষ প্রয়োজন। রাজীব সে অভাব পূরণ করবে, আমি নিশ্চিত।

ছাত্রজীবন থেকেই রাজীব লেখালেখি করে। বিভিন্ন প্রথম শ্রেণির পত্রপত্রিকায় ওর নানা লেখা আমার দৃষ্টিগোচর হয় এবং আমি পড়িও। পরে সেগুলো বই হয়েছে। আমার হাতে তিনটি বই এসেছে। সেখান থেকে জানতে পারলাম তার সব মিলিয়ে এখনও পর্যন্ত বইয়ের সংখ্যা দশটি। কম নয়! বরং অনেকের জন্য ঈর্ষণীয়। কারণ, লেখালেখি তার পেশার সঙ্গে অবশ্যযুক্ততো নয়! সে লেখে আনন্দে, মনের তাগিদে। ২০১৪ সাল থেকে প্রতি বছর অন্তত একটি করে বই বের হচ্ছে তার। এই ধারা অব্যাহত থাকলে গ্রন্থপ্রকাশ সংখ্যাতেও রেকর্ড সৃষ্টি হতে পারে। আমার হাতে আসা বইগুলোর শিরোনাম: ‘সাহিত্যের সমাজচেতনা ও অন্যান্য ভাবনা’ (২০১৫); ‘বহুমাত্রিক বুদ্ধদেব বসু : বৈচিত্র্যে বৈশিষ্ট্যে’ (২০১৭); ‘সাহিত্য-ভাবনায় সেকাল একাল’ (২০১৯)। সবগুলো মূলত প্রবন্ধের বই। আর এখানে আছে বহু প্রবন্ধ। বইগুলোর নামের মধ্যেই প্রকাশ পেয়েছে রাজীবের সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ ও নির্ভরতা। সে ছাত্রজীবনে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে লেখাপড়া করেছে।

রাজীব সরকারের প্রবন্ধগুলো স্বল্পায়তনের কিন্তু এতে আছে বহুমুখী চিন্তার খোরাক। স্বচ্ছ সমাজ তার কামনা, সুশীল ব্যক্তিমানুষ তার লক্ষ্য। সমগ্র সাহিত্য থেকে এরই প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ খুঁজে ফেরে সে

জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ঘটনাক্রম, পালাবদল, অগ্রসরমানতা নিজ দৃষ্টিভঙ্গির আলোকেই তার কাছে পরিষ্কার। এই গ্রন্থাবলির লেখাগুলোতে তার প্রভাব আছে। ‘সাহিত্যের সমাজচেতনা ও অন্যান্য ভাবনা’ গ্রন্থে আছে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে হাসান আজিজুল হক পর্যন্ত নানা লেখা নিয়ে ষোলোটি প্রবন্ধ। ‘বহুমাত্রিক বুদ্ধদেব বসু : বৈচিত্র্যে বৈশিষ্ট্যে’ গ্রন্থটি যদিও প্রবন্ধের সংকলন, তবু এটি শুধু বুদ্ধদেব বসুকেন্দ্রিক এবং সে দিক থেকে এর বিন্যাসগত ঐক্য রয়েছে। ঢাকার মানুষ বুদ্ধদেব বসু স্বদেশে বড়োই অবহেলিত। তাঁর ওপর যতোটা কাজ করার প্রয়োজন ছিল, তার কিছু পরিমাণও হয়নি। সে দিক থেকে রাজীব সরকারের এই বই অন্ধকারে মাটির পিদিমের মতো উজ্জ্বল হয়ে থাকলো। ‘সাহিত্য-ভাবনায় সেকাল একাল’ গ্রন্থেও বঙ্কিমচন্দ্র থেকে হরিশংকর জলদাস পর্যন্ত বিভিন্ন লেখকের কর্ম বা জীবন নিয়ে বারোটি প্রবন্ধে আলোচনা আছে।

রাজীব সরকারের প্রবন্ধগুলো স্বল্পায়তনের কিন্তু এতে আছে বহুমুখী চিন্তার খোরাক। স্বচ্ছ সমাজ তার কামনা, সুশীল ব্যক্তিমানুষ তার লক্ষ্য। সমগ্র সাহিত্য থেকে এরই প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ খুঁজে ফেরে সে। বাংলা সাহিত্যের পুরোনো কালের লেখক থেকে সাম্প্রতিকতম লেখকের গ্রন্থও তার পাঠের অধিকারে এবং সেগুলোকে নিয়ে নিজের ভাবনা মতো সে লেখেও; এটাই আমার কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়। সিভিল সার্ভিসে যারা আছেন, তাদের সামনে রাজীব সরকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে এই বইগুলো রচনা করে। প্রশাসন, আইন, বিচার, ভূমি, অপরাধ ইত্যাদি নিয়ে থাকলেই সুচিন্তা ও মননশীলতাকে ধ্বংস করে রাষ্ট্রযন্ত্রের কলকব্জায় পরিণত হতে হবে, রাজীব সরকার প্রকারান্তরে সে ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। আধুনিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্র ও সহায়তাকামী সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে রাজীব সরকারের মতো মননশীলতাকে সজীব ও মুক্ত রাখতে হবে।
আমাদের প্রিয় ছাত্র রাজীবের জন্মদিনে তাকে প্রাণঢালা আশীর্বাদ জানাই।

 

আরো পড়তে পারেন

একাত্তরের গণহত্যা প্রতিহত করা কি সম্ভব ছিল?

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই এক রাতেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে….

ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

আগের পর্বে পড়ুন— চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও একটি সার্থক গণআন্দোলন। এই গণআন্দোলনের মূল চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হলো দেশপ্রেম থেকে জাত সেই অনুভূতি, যার একটি রাজনৈতিক প্রকাশ রয়েছে। আর, বাঙালি জাতিসত্তাবোধের প্রথম রাজনৈতিক প্রকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে দুই হাজার মাইল দূরত্বের….

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল)

আগের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ একুশের আবেগ সংহত থাকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দেও। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। আওয়ামি লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ১৮ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটির সদস্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র….

error: Content is protected !!