Author Picture

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে যত কথা

একেএম শামসুদ্দিন

২৮ আগষ্ট জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোয় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়- বাংলাদেশের চিলাহাটি ও ভারতের হলদিবাড়ী পথে আগামী বছরের ২৬ মার্চ রেল যোগাযোগ শুরু হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিকে সামনে রেখে এই রেল যোগাযোগের উদ্বোধনের দিন ধার্য করা হয়েছে বলে নীলফামারীর চিলাহাটিতে রেল লাইনের নির্মানকাজ পরিদর্শন করতে গিয়ে রেলমন্ত্রী মো: নূরুল ইসলাম এ কথা জানান। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে পণ্য পরিবহনে সুবিধা করে দেওয়ার জন্য ভারতের কাছে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুত ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্টের অংশ হিসেবে এ রেল যোগাযোগের নির্মান কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। অবিভক্ত ভারতের পূর্বাঞ্চলে এই রেলপথই ছিল যোগাযোগের প্রধানতম মাধ্যম। কলকাতা থেকে এ পথে তখন ট্রেন চলাচল করত। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের সময় এ রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে কলকাতা থেকে ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে পণ্য পরিবহন করতে হতো। সুতরাং পণ্য পরিবহনে যদি ব্রিটিশ আমলের সেই পুরাতন রেলপথ ব্যবহার করতে পারে তাহলে সময়ের বিচারে এবং অর্থ সাশ্রয়ে ভারত প্রভূত লাভবান হবে সন্দেহ নেই।

চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রেল যোগাযোগের এ খবরটি যখন প্রচার হয়, তার ঠিক দশদিন আগে অর্থাৎ ১৮ আগষ্ট বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি বা একনেক ৮৪৫ কোটি ৫৩ লাখ টাকা ব্যয়ে বারৈয়ারহাট-হোঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে আমদানি-রফতানিসহ দ্বিপাক্ষিক বানিজ্য সম্প্রসারণের সুবিধা বাড়ানো। একনেকের মিটিংএ অনুমোদন শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান জানান, ‘এই প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ ও ভারতের ত্রিপুরার মধ্যে সংযোগ সড়ক তৈরী হবে এবং এতে উভয় দেশের ব্যবসা-বানিজ্য বিশেষ করে ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন হবে।’ ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের সড়ক যোগাযোগ অনেক আগে থেকেই আছে। আখাউড়া স্থল বন্দর দিয়ে দুদেশের পণ্য যাওয়া আসা অনেক পূর্ব থেকেই চালু আছে। এই সুবিধা থাকা সত্বেও বারৈয়ারহাট-হোঁয়াকো-রামগড় সড়ক প্রশস্তকরনের পিছনে যে আরও একটি কারণ আছে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে পরিকল্পনা মন্ত্রী সে বিষয়টি উল্লেখ করেননি। গত জুলাই থেকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে, বন্দর থেকে আখাউরা স্থলবন্দর দিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনের জন্য যে সড়কপথ ব্যবহার শুরু হয়েছে, তাতে ভারত মনে করে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আখাউড়া পর্যন্ত দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে তাদের অতিরিক্ত অর্থ ও সময় উভয়ই ব্যয় হচ্ছে। সুতরাং আখাউরার পথ বাদ দিয়ে বারৈয়ারহাট-হোঁয়াকো-রামগড়ের এই সংক্ষিপ্ত সড়ক ব্যবহার করলে ভারতের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় সংকোচন করা সম্ভব হবে এই কথা চিন্তা করেই এই সড়ক প্রশস্তকরণের উদ্যোগ নিয়েছে। জানা গেছে ভারতের আগ্রহেই এই প্রকল্পের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এক সময় কলকাতা থেকে আগরতলা পণ্য পৌঁছাতে ১৬০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হতো। তাতে প্রচুর সময় ও অর্থ ব্যয় হতো। মূলত পণ্য পরিবহনের সেই ব্যয় কমাতেই ভারত বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের কাছ থেকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের সুবিধাটি আদায় করে নিয়েছে। অপরদিকে ২৫ আগষ্ট ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকায় নৌপথে ভারতের পণ্য পরিবহন সুবিধার কথা বলা হয়েছে। তবে পত্রিকার শিরোনামটি দেখে অবাক হতে হল! শিরোনামটি ছিল এরকম, ‘নৌপথে পণ্য পরিবহন সুবিধা নিতে যাচ্ছে ভারত-বাংলাদেশ।’ পত্রিকাটিতে বলা হয়েছে, ‘প্রথমবারের মতো নৌপথে পণ্য পরিবহন সুবিধা নিতে যাচ্ছে দুই প্রতিবেশী দেশ ভারত ও বাংলাদেশ। ৫ সেপ্টেম্বর পরীক্ষণমূলক যাত্রার মধ্য দিয়ে ভারতের বানিজ্য সুবিধা নেওয়া শুরু হয়ে গেছে। ভারতীয় জাহাজ এমভি প্রিমিয়ার ৫০ টন সিমেন্ট নিয়ে কুমিল্লার দাউদকান্দি থেকে গোমতি নদী দিয়ে ত্রিপুরার সোনাইমুরার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে।’ খবরের শিরোনাম দেখে অবাক হবার কারণ হলো, শিরোনামে উভয় দেশ লাভবান হবে বলা হলেও এই নৌপথের পণ্য পরিবহন করে বাংলাদেশ কী কী বানিজ্যিক সুবিধা পাচ্ছে সে বিষয়ে কোনোকিছুর উল্লেখ নেই।

ওদের অপারেটরদের বার্ষিক ২ থেকে ৩ কোটি টাকা হারে চাঁদা দিতে হবে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমাদের দেশে ভারতের ৮০ থেকে ৯০টা চ্যানেল চালু থাকলেও এজন্য ওদের চ্যানেল মালিকদের কিন্তু আমাদের ক্যাবল অপারেটরদের এক কানাকড়িও চাঁদা দিতে হয় না; বরং ওদের পে-চ্যানেলগুলোর জন্য আমাদের বার্ষিক ২০০০ কোটি টাকা পে করতে হয়

অবস্থাগতিকে মনে হচ্ছে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ যতটুকু না সুবিধা আদায় করে নিতে পারছে তার চেয়ে অনেক বেশী ভারতকে দিতে হচ্ছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য বাংলাদেশ থেকে ভারতের বেশী বেশী আদায় করে নেওয়ার বিষয়টি আরও স্পষ্ট করেছে। তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ ভারতের জন্য কি না করেছে, ভারত হয়তো তা প্রত্যাশাও করেনি। ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের হস্তান্তরসহ বাংলাদেশ কত কী না দিয়েছে সেটাও ভারতকে স্মরণে রাখতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পরও বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে ইদানিং আমাদের নীতি নির্ধারক মহলের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির কোনো কোনো বক্তব্য দেশবাসীকে অবাক করে বৈকি। সেদিন তো সরকারের একজন মাননীয় মন্ত্রী বলেই দিলেন, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের এক আত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সম্পর্ক তাকে অন্যদেশের সম্পর্কের সঙ্গে এক নিক্তিতে মাপা ভুল হবে।’ কারণ তাঁর ভাষায়, ‘ভারতের সঙ্গে আমাদের রয়েছে রক্তের সম্পর্ক!’ ভাবতে অবাক লাগে যখন শুনি তিনি প্রকাশ্যে বলেন, ‘আমাদের বিজয় মানে ভারতের বিজয়, আমাদের উন্নয়ন মানেই ভারতের উন্নয়ন’ তখন কী তিনি একবারও ভেবে দেখেছেন, স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? আমরা লক্ষ্য করেছি ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিষয়ে আমাদের নীতি নির্ধারকদের চিন্তাধারা এবং বাস্তবতা এক সূত্রে গাঁথা নয় এবং দেশের অধিকাংশ মানুষের ধারণার সাথে তাদের এ চিন্তাধারার মিল খুঁজে পাওয়া অনেক সময়ই কষ্টকর হয়ে পড়ে। কারণ বন্ধুত্বের সম্পর্কের মধ্যে যে আন্তরিকতা ও উদারতা থাকার প্রয়োজন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তার শতভাগ থাকলেও ভারত প্রায় সব ক্ষেত্রেই চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়েছে। অথচ আমাদের নীতি নির্ধারকরা বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক নিয়ে যখন বক্তব্যে রাখেন তখন তাঁদের বক্তব্যে বাস্তব অনেক তথ্যই অনুচ্চারিত রয়ে যায়। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়কপরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সম্প্রতি দেওয়া একটি বক্তব্যের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। গত ১১ আগষ্ট ঢাকেশ্বরী মন্দিরে হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্মাষ্টমী পালন উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত দু’দেশের সম্পর্ক ৭১’র রক্তের রাখিবন্ধনে আবদ্ধ। তিনি বলেন, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভালো ‘বোঝাপড়া’ থাকলে অনেক অমীমাংসিত ইস্যু সহজেই সমাধান সম্ভব, যার প্রমাণ বাংলাদেশ ও ভারত। তিনি তাঁর বক্তব্যের স্বপক্ষে প্রমান দিতে গিয়ে বাংলাদেশের সমুদ্রজয়ের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সমুদ্র জয়ের মামলায় ভারত আপিল না করে বন্ধুসুলভ যে আচরণ করেছে তা সম্পর্কের সূত্রকে করেছে আরও সুদৃঢ়। ‘জনাব ওবায়দুল কাদের এখানে বিশেষ করে তিনি ‘বোঝাপড়া’ বলতে কী বুঝিয়েছেন তা স্পষ্ট নয়! এই বোঝাপড়ায় বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থ কতটুকু সংরক্ষিত হচ্ছে তার বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে। বাংলাদেশের সমুদ্র জয়ের মামলার রায়ে ভারত আপিল করেনি বলে ভারত বন্ধুসুলভ আচরণ করেছেন বলে তিনি যে দাবি করেছেন তা কতটুকু যৌক্তিক সে কথাও ভেবে দেখতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, এই সমুদ্র জয়ের পথ কী এতই কন্টকমুক্ত ছিল? ভারত যদি বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে এগিয়েই আসতো এবং বাংলাদেশের দাবি মেনে নিত তাহলে তো বাংলাদেশকে নেদারল্যান্ডের স্থায়ী সালিশি আদালত পর্যন্ত যেতে হতো না! বাংলাদেশের ন্যায্য দাবি ভারত মানেনি বলেই বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের কাছে যেতে হয়েছে এবং সালিশি আদালতের রায় বাংলাদেশের পক্ষে আসার পর ভারত তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। আসলে এই সালিশি আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগই ছিল না ভারতের। আদালতের পাঁচ বিচারকের মধ্যে একমাত্র ভারত বংশদ্ভুত বিচারক প্রেমারাজু শ্রীনিবাসা রাও ছাড়া বাকী চার বিচারপতিই বাংলাদেশের পক্ষে রায় দিয়েছেন। যেহেতু এই মামলা ৪-১ ভোটে রায় হয়েছে, এ কারণে আপিল করে লাভ হবে না ভেবে ভারত হয়তো সে পথে আর পা বাড়ায়নি।

চুক্তির পর প্রয়োজনীয় মুহূর্তে যেন প্রাপ্য পানি থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত না হয়। পাশাপাশি চীনের আর্থিক সাহায্যে তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশ যে প্রকল্প পরিকল্পনা হাতে নিতে যাচ্ছে, তাতেও যেন ভাটা না পড়ে। এ প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যেতেই হবে, তা না হলে অতীতের মতো ভারতের বাংলাদেশের সঙ্গে একই আচরণের আশঙ্কা থেকে যাবে

স্বাধীনতার পর থেকে এ যাবত বাংলাদেশ বরাবরই ভারতকে নানান রকম সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আসলেও ভারতের কাছে থেকে বাংলাদেশের নায্য পাওনাটুকু আদায় করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে গলদঘর্ম পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হয়েছে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বাংলাদেশ ভারতের এরূপ আচরণের সম্মুখিন হয়ে আসছে। এখানে দু’একটি ঘটনা উল্লেখ করলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে বলে মনে হয়। জনাব ওবায়দুল কাদের যে সমুদ্র জয়ের কথা বলেছেন সেই সমুদ্র জয় এত সহজেই অর্জিত হয়নি। তিনি হয়তো ভুলে গেছেন, সমুদ্রসীমা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর আমল থেকেই ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধ চলে আসছিল। বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে সমুদ্রসীমা নিয়ে বাংলাদেশের নায্য দাবি ভারত নাকচ করে দিয়ে এক প্রতিবাদলিপিতে বাংলাদেশ সরকারকে জানিয়েছিল, বাংলাদেশের দাবিকৃত উপকুলীয় সমুদ্র অঞ্চলের মধ্যে ২১ মাইল ভারতীয় এলাকা রয়েছে। অতঃপর এ বিরোধ নিয়ে ১৯৭৫ সালের ২৯ মার্চ পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে দিল্লিতে একটি সমঝোতা বৈঠক বসে। তিন দিনব্যাপী সে বৈঠকে ব্যাপক আলোচনা করেও উভয় পক্ষ মতানৈক্যে পৌঁছুতে ব্যর্থ হয়। অতঃপর মতপার্থক্যের কারণে কোনো সিদ্ধান্ত না হওয়ায় অচলাবস্থা সৃষ্টি হলে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা বৈঠক শেষে দেশে ফেরার জন্য বিমান বন্দর অভিমুখে যাত্রা করলে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীর অনুরোধে তারা আবার ফিরে যান এবং আরও একদিন বর্ধিত বৈঠক করেও কোনো সিদ্ধান্তে উপনিত হতে পারেননি। ভারতের বাঁধার কারণে সমুদ্রসীমা বিরোধ এত দীর্ঘপথ অতিক্রম করে, শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সালিশি আদালতের মাধ্যমে ২০১৪ সালে এসে মিমাংসা হয়।

‘তিনবিঘা করিডোর’ নিয়েও ভারত একই কাজ করেছে। সেই ১৯৭৪ সালের মে মাসে ‘মুজিব-ইন্দিরা’ চুক্তি স্বাক্ষরের পরপর চুক্তি অনুযায়ী আমাদের সংসদের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করে একই বছরের নভেম্বরে দক্ষিণ বেরুবাড়ি হস্তান্তর করা হলেও ভারত সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ করতে থাকে এবং তিনবিঘা এলাকার আশেপাশের স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক কর্মীদের সংগঠিত করে মুজিব-ইন্দিরা সম্পাদিত চুক্তির বিপক্ষে ভারতীয় দুটি উগ্র সংগঠনের জন্ম দেওয়া হয়। সংগঠন দুটি ছিল ‘ভারতীয় কুচলীবাড়ি সংগ্রাম সমিতি’ এবং ‘তিনবিঘা সংগ্রাম সমিতি’। ভারতীয় প্রশাসনের ছত্রছায়ায় এ সংগঠন দুটির নেতাদের দিয়ে চুক্তির বিরুদ্ধে একটি মামলা ঠুকে দিয়ে তিনবিঘা করিডোর বাংলাদেশকে হস্তান্তর থেকে বিরত থাকার জন্য আদালত থেকে স্থগিতাদেশ জারি করা হয় এবং পাশাপাশি স্থানীয়দের দিয়ে ব্যাপক আন্দোলন করানো হয়। তিনবিঘা হস্তান্তরকে আদালত কর্তৃক একটি ‘বিচারিক বিষয়’ বলে ভারত সেসময় চুক্তির এ বিষয়টি সংসদে পাস না করিয়ে ঝুলিয়ে রাখে এবং বাংলাদেশকে দীর্ঘদিন ভোগাতে থাকে। অতঃপর দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে ১৯৯২ সালে আংশিক, পরবর্তী সময়ে ২০১১ সালে তিনবিঘা করিডোর সম্পূর্ণ খুলে দেয়। ছিট মহল বিনিময়ের বিষয়টিও সেভাবেই মিমাংসিত হয়েছে।

সেই ১৯৭৪ সালের মে মাসে ‘মুজিব-ইন্দিরা’ চুক্তি স্বাক্ষরের পরপর চুক্তি অনুযায়ী আমাদের সংসদের প্রয়োজনীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করে একই বছরের নভেম্বরে দক্ষিণ বেরুবাড়ি হস্তান্তর করা হলেও ভারত সরকার চুক্তি বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ করতে থাকে এবং তিনবিঘা এলাকার আশেপাশের স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক কর্মীদের সংগঠিত করে মুজিব-ইন্দিরা সম্পাদিত চুক্তির বিপক্ষে ভারতীয় দুটি উগ্র সংগঠনের জন্ম দেওয়া হয়। সংগঠন দুটি ছিল ‘ভারতীয় কুচলীবাড়ি সংগ্রাম সমিতি’ এবং ‘তিনবিঘা সংগ্রাম সমিতি’

এখন তিস্তা নদীর চুক্তি নিয়েও একই অবস্থা, তবে ভিন্নরূপে। পশ্চিমবঙ্গের দোহাই দিয়ে এ চুক্তি করা থেকে এ যাবত ভারত বিরত থেকেছে। তিস্তা নিয়ে ভারতের এই গড়িমসি বাংলাদেশের হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফারাক্কা চুক্তি নিয়েও একইভাবে ভারত বাংলাদেশকে অনেকদিন ভুগিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর কলকাতা বন্দরের নাব্যতা বৃদ্ধির নাম করে (১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল থেকে ৩১ মে পর্যন্ত) মাত্র ৪১ দিনের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধের সব ফিডার ক্যানেল খুলবে বলে বাংলাদেশের তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর সরকারকে জানিয়েছিল ভারত। পরীক্ষামূলকভাবে ফারাক্কা বাঁধ চালু করা ভারতের এ পদক্ষেপটি ছিল সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যমূলক। কারণ ভারত সেই যে বাঁধ চালু করেছিল তা আজও চলমান। মাঝে ১৯৭৯ সালে গ্যারান্টি ক্লোজসহ ৫ বছর মেয়াদী এবং ১৯৯৬ সালে ৩০ বছরের জন্য অপর একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল মাত্র। ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রাপ্য পানির অংশ পাওয়া তো দূরে থাক, ১৯৯৬ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে ভারত বাংলাদেশকে কখনও তার হিস্যার পানি পায়নি। সেই চুক্তি অনুযায়ী, শুষ্ক মৌসুমে অর্থাৎ পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩১শে মে পর্যন্ত দুই দেশ চুক্তিতে উল্লেখিত ফর্মুলা অনুযায়ী পানি ভাগাভাগি করে নেবে। চুক্তিতে বলা ছিল, নদীতে প্রবাহ যদি ৭৫,০০০ কিউসেকের বেশি হয় তাহলে ভারত পাবে ৪০,০০০ কিউসেক আর বাদবাকী পাবে বাংলাদেশ। প্রবাহ যদি ৭০,০০০ থেকে ৭৫,০০০ এর মধ্যে হয় তাহলে বাংলাদেশ পাবে ৩৫,০০০ কিউসেক আর বাদবাকী পাবে ভারত। প্রবাহ যদি ৭০,০০০ এর কম হয় সেক্ষেত্রে দুই দেশ সমভাবে পানি ভাগ করে নিবে। তবে যেহেতু শুষ্ক মৌসুমে দুই দেশেই পানির প্রয়োজন বেশি তাই প্রবাহ ৭০,০০০ এর চেয়ে কমে গেলেও ১১-২০ মার্চ, ১-১০ এপ্রিল, ও ২১-৩০ এপ্রিল এই তিনটি সময়ে বাংলাদেশ ৩৫,০০০ কিউসেক পানি গ্যারান্টি সহকারে পাবে; পক্ষান্তরে ২১-৩০ মার্চ, ১১-২০ এপ্রিল ও ১-১০ মে এই তিন সময়ে ভারত ৩৫,০০০ কিউসেক পানি গ্যারান্টি সহকারে পাবে। একটি দেশ যখন গ্যারান্টিড পানি পাবে অন্যদেশ তখন মোট প্রবাহ থেকে ৩৫০০০ কিউসেক বাদ দিলে যা থাকে তাই পাবে। তবে কোনো কারণে যদি ফারাক্কা নদীর পানির প্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেকের নীচে নেমে যায় তাহলে দুই দেশে কে কী পরিমাণ পানি পাবে সেটা পারস্পরিক আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু দেখা গেছে শুষ্ক মৌসুমে পানির প্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেকের নীচে নেমে যাওয়ার পরও চুক্তি অনুযায়ী ভারতের সঙ্গে পানি বন্টনের আলোচনা সভা হয়েছে কিনা এবং আলোচনা সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় পানির হিস্যা বাংলাদেশ পেয়েছে কিনা এমন নিশ্চিত কোনো তথ্য এদেশের মানুষের জানা নেই। বস্তুত দেখা গেছে ফারাক্কা চুক্তি ভারতীয় স্বার্থ রক্ষা করলেও বাংলাদেশের জন্য কোনো ভাল ফল বয়ে আনেনি। অথচ বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আন্তরিকতার উদাহরণ টানতে গিয়ে প্রায়ই আমাদের নেতাদের মুখে এই চুক্তির কথা আমরা শুনতে পাই!

ভারত অভিন্ন নদীর পানি বন্টনে দু’মুখো নীতি মেনে চলে। তার সাম্প্রতিক প্রমাণ হলো ব্রহ্মপুত্রের উজানে তিব্বতে চীন যে ‘জাংমু ড্যাম’ নামক বাঁধ নির্মাণ করেছে সে ব্যাপারে ভারতের প্রতিবাদ এবং চীনের বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ় অবস্থান। উজানের দেশ হিসেবে ভাটির দেশ ভারতকে না জানিয়ে, তাদের সম্মতি না নিয়ে অথবা চুক্তি না করে এ প্রকল্প নির্মাণ করে চীন আন্তর্জাতিক প্রথা ও বিধির লঙ্ঘন করেছে বলে ভারত জোর গলায় অভিযোগ করেছে। শুধু তাই নয়, চীনের সঙ্গে ভারতের এ পানিবণ্টনের মামলায় ভারত বাংলাদেশকেও পাশে চেয়েছে। বাংলাদেশ যদি ভারতের পাশে দাঁড়ায় তাহলে পানির এ মামলাটি আন্তর্জাতিক মহলে আরও অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা পাবে এবং চীনের বিরুদ্ধে এ লড়াইয়ে ভারতের হাত আরও শক্ত হবে বলে তারা আশা পোষণ করেছে। অথচ ভারতের সঙ্গে অভিন্ন নদীর পানিবণ্টনে ভাটির দেশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশকে শুধু বঞ্চিতই করেনি, বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে পানিবণ্টন চুক্তি করতে চাইলে ভারত তা অগ্রাহ্য করে চলেছে। তিস্তার পানি নিয়ে চুক্তি করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও এযাবৎ ভারত শুধু টালবাহানা করেই যাচ্ছে।

নাগরিক পঞ্জিকে ঘিরে ভারতের এই কট্টর হিন্দুপন্থি ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি-ধামকি ও ধর্মীয় উসকানিমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে যে আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের মানুষ যে আহত হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ কথা ভারতের প্রগতিশীল দল ও তাদের নেতারাও স্বীকার করে থাকেন

বাংলাদেশকে সবচেয়ে নিকটতম এবং ঘনিষ্ঠতম বন্ধু রাষ্ট্র বললেও বিগত প্রায় একদশক ধরে এ দেশের মানুষের ধর্মানুভূতির প্রতি ভারত যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করতে পারছে না। বিশেষ করে ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সাম্প্রদায়িক আচরণ ও বল্গাহীন বক্তব্য এদেশের মানুষের পীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে দাবিদার ভারতে এমন একটি অন্ধ ধর্ম বিশ্বাসী দল কী করে সে দেশের সাধারণ মানুষের মন জয় করে পরপর দুবার ক্ষমতাসীন হয়েছে তা নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়। নাগরিক পঞ্জিকে ঘিরে ভারতের এই কট্টর হিন্দুপন্থি ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি-ধামকি ও ধর্মীয় উসকানিমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে যে আগ্রাসী মনোভাব প্রকাশ করেছে, তাতে বাংলাদেশের মানুষ যে আহত হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ কথা ভারতের প্রগতিশীল দল ও তাদের নেতারাও স্বীকার করে থাকেন। সে দেশের বুদ্ধিজীবী মহল, সুশীল সমাজ ও সচেতন মানুষও এ ব্যাপারে বেশ সোচ্চার। বন্ধুত্বের আড়ালে তাদের এই আগ্রাসনকে বাংলাদেশের মানুষও ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের এ আগ্রাসন শুধু রাজনৈতিক পরিমন্ডলেই সীমাবদ্ধ নেই। এর বিস্তৃতি ঘটেছে আমাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনেও। আগ্রাসনের ইংরেজি শব্দ ‘Aggression’, যার অর্থ হল বিনা প্ররোচনায় আক্রমণ। কিন্তু আমাদের দেশে ভারতীয় যে আগ্রাসন অব্যাহত আছে তা শুধু আক্রমণেই সীমাবদ্ধ নেই; পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে এর অনুপ্রবেশ ঘটে গেছে। আগ্রাসনের যতগুলো ধরন আছে তার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক আগ্রাসন হল সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন কোনো দেশ বা জাতির কৃষ্টি-ঐতিহ্য, শিল্প-সংস্কৃতি ও সামাজিক মূল্যবোধকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়ে আগ্রাসী সংস্কৃতির আধিপত্য বিস্তার ঘটিয়ে থাকে। ভারত দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে এ কাজটিই করে যাচ্ছে। আকাশ সংস্কৃতির ফাঁদে বাঙালির এতদিনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চা আজ ভূলুণ্ঠিত হওয়ার পথে। এ আগ্রাসন, শুধু রাজধানী শহরে নয়, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত শহর বা উপশহরের সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখুন, হাই ভলিয়মে চটকদার হিন্দি গানের তালে বলিউড স্টাইলে নাচ না হলে আজকাল কোনো অনুষ্ঠানই সম্পন্ন হয় না। শুনেছি পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান জেনারেশনও নাকি অনেক আগে থেকেই একই আগ্রাসনে আক্রান্ত।
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও অর্থনৈতিক আগ্রাসন বস্তুত সমান্তরাল গতিতে চলে। বরং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন অনেকটা অর্থনৈতিক আগ্রাসনের ভিত্তিমূল তৈরি করে দেয়। এ আগ্রাসনের ফলে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায়, রুচিতে, পোশাকে-আশাকে, ফ্যাশনে ও খাদ্যাভ্যাসে চোখে পড়ার মতো পরিবর্তন ঘটে থাকে। বাংলাদেশের এলিট শ্রেণীর মানুষের ভেতর এর প্রভাব আরও ব্যাপক। এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব সমাজের অন্যান্য স্তরেও পড়তে বাধ্য। এভাবেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের সমাজে বিভক্তি তৈরি করে দেয়। আকাশ সংস্কৃতির বদৌলতে বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই ভারতীয় বিলাসী পণ্যের এক বিরাট বাজার তৈরি হয়ে গেছে। এরই জের ধরে প্রতি বছর বিভিন্ন উৎসব উপলক্ষ্যে বিপুল অঙ্কের মুনাফা সীমানা পেরিয়ে ওপারে চলে যাচ্ছে। আমরা জানি আমাদের দেশে ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর অবাধ প্রচারের সুযোগ থাকলেও বাংলাদেশের কোনো চ্যানেল ওপারে প্রচারের সুযোগ নেই। এখানেও ভারত সেই তিনবিঘা করিডোরের মতো কূটচাল প্রয়োগ করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে রেখেছে। ওরা বলে বেড়ায়, ভারতে বাংলাদেশের টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান প্রচারে তাদের সরকারের কোনো আপত্তি নেই। সরকারের আন্তরিক ইচ্ছা থাকলেও ওখানকার ক্যাবল অপারেটরদের অনীহার জন্য তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। বাংলাদেশের চ্যানেল মালিকপক্ষ নাকি ওদের ক্যাবল অপারেটরদের সন্তুষ্ট করতে পারলে বাংলাদেশের টেলিভিশন ভারতে প্রচারের প্রবেশাধিকার পাবে। এর জন্য আমাদের চ্যানেল মালিকদের ওদের অপারেটরদের বার্ষিক ২ থেকে ৩ কোটি টাকা হারে চাঁদা দিতে হবে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমাদের দেশে ভারতের ৮০ থেকে ৯০টা চ্যানেল চালু থাকলেও এজন্য ওদের চ্যানেল মালিকদের কিন্তু আমাদের ক্যাবল অপারেটরদের এক কানাকড়িও চাঁদা দিতে হয় না; বরং ওদের পে-চ্যানেলগুলোর জন্য আমাদের বার্ষিক ২০০০ কোটি টাকা পে করতে হয়।

চীন ও ভারতের সাম্প্রতিক বৈরিতা, নেপালের ভারত বিমুখ, শ্রীলঙ্কার চীনমুখী হয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে ভারত ভাল চোখে দেখছে না। এ নিয়ে ভারতের মিডিয়া বাংলাদেশ সম্পর্কে আপত্তিজনক ভাষায় বিশেষ প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে

সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের আকস্মিক অথচ রাজসিক বাংলাদেশ সফরকে ঘিরে তিস্তা চুক্তির বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। অনেকেরই ধারণা তিস্তা প্রকল্পে বাংলাদেশে চীনের এক বিলিয়ন ডলার অর্থ ঋণের ঘোষণার পর পরই তড়িঘড়ি করে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের এই সফর। এমনিতেই বাংলাদেশে চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ ভারতের অস্বস্তির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে, তার ওপর বাংলাদেশ যদি চীনের কাছ থেকে তিস্তা প্রকল্পের জন্য এক বিলিয়ন ডলার নিয়ে পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয় তখন কী হবে? তাদের আশঙ্কা চীনের এই ঋণ বাংলাদেশ যদি পরিশোধ করতে না পারে তাহলে তিস্তার প্রকল্পের ভাগ্যও যদি শ্রীলঙ্কার হাম্মানটোটা বন্দরের ভাগ্যের মতো হাত বদল হয়ে যায়, তাহলে ভারতের নিরাপত্তার জন্য তা হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন টেলিভিশনে প্রচারিত বিশ্লেষণমূলক অনুষ্ঠানগুলোতে এমন কথাই বলা হচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সফরের সময় উভয় দেশ যদিও তিস্তা প্রকল্পে চীনের অর্থ সাহায্যের বিষয়টি আলোচনা হয়েছে কিনা স্বীকার করেনি, তবুও ভারত এবং বাংলাদেশের পত্র পত্রিকায় এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে।

চীন ও ভারতের সাম্প্রতিক বৈরিতা, নেপালের ভারত বিমুখ, শ্রীলঙ্কার চীনমুখী হয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে ভারত ভাল চোখে দেখছে না। এ নিয়ে ভারতের মিডিয়া বাংলাদেশ সম্পর্কে আপত্তিজনক ভাষায় বিশেষ প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ চীনমুখী হয়ে পড়ে কিনা এ নিয়ে ভারতের ভেতর এক ধরণের অস্থিরতা কাজ করছে বলে বোঝা যায়। তবে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এক বক্তব্যেই ভারত আপাতত তুষ্ট বলে মনে হয়েছে। ‘চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অর্থনৈতিক আর ভারতের সঙ্গে রক্তের সম্পর্ক।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন বক্তব্যে ভারতের সাউথ ব্লক নাকি সন্তুষ্ট, এমন কী ভারতীয় জনতাও এই বক্তব্যকে সাধুবাদ জানিয়েছে। গত ৮ আগষ্ট ভারতের একাধিক সংবাদপত্রে এ খবর প্রকাশিত হয়েছে। তারপরও যে তারা স্বস্তিতে নেই তা ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তবের গত ২৭ আগষ্টের সাপ্তাহিক সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ভারত শীঘ্রই তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। আসন্ন বাংলাদেশ-ভারত পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের যৌথ পরামর্শ কমিটির বৈঠকে তিস্তা নদীর পানি বন্টন নিয়ে আলোচনা হবে। শুধু তাই নয় এই বৈঠকের আগেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে প্রয়োজনীয় আলাপ-আলোচনা তারা শেষ করে রাখবে বলে তিনি জানিয়েছেন। তিস্তা প্রকল্পে চীনের অর্থ বিনিয়োগের প্রেক্ষিতে ভারত যে কিছুটা নড়েচড়ে বসেছে তা উপলব্ধি করা যায়। অনুমান করা যায়, ভারত এখন হয়তো তিস্তা চুক্তি নিয়ে অগ্রসর হতে চাইবে। চীনকে ঠেকাতে ভারত যদি সত্যিই বাংলাদেশের সঙ্গে পানি চুক্তির ব্যাপারে অগ্রসর হতে চায় তাহলে বাংলাদেশকেও একটু সতর্ক পদক্ষেপে এগোতে হবে। ফারাক্কা চুক্তির মতো আরও একটি চুক্তি যেন না হয়; অর্থাৎ চুক্তির পর প্রয়োজনীয় মুহূর্তে যেন প্রাপ্য পানি থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত না হয়। পাশাপাশি চীনের আর্থিক সাহায্যে তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশ যে প্রকল্প পরিকল্পনা হাতে নিতে যাচ্ছে, তাতেও যেন ভাটা না পড়ে। এ প্রকল্প এগিয়ে নিয়ে যেতেই হবে, তা না হলে অতীতের মতো ভারতের বাংলাদেশের সঙ্গে একই আচরণের আশঙ্কা থেকে যাবে।

ভারত বাংলাদেশকে যতই ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে প্রচার করুক না কেন, তাদের বিরূপ আচরণে বাংলাদেশের মানুষের মনে সংশয় জাগে বৈকি! ভারতকে একটা কথা মনে রাখতে হবে, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বন্ধুত্বের পূর্বশর্ত। এই শ্রদ্ধাবোধ প্রদর্শন শুধু লৌলিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে চলবে না, কাজেকর্মেও তা দেখাতে হবে। ভারত বাংলাদেশের প্রতি প্রকাশ্যে যে আন্তরিকতা প্রকাশ করে তা শুধু ওদের স্বার্থ আদায়ের জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই। ভারতের এ স্বার্থপর আচরণ আমাদের পীড়া দেয়। ভারতের এহেন আচরণে বাংলাদেশের জনগনের মনোভাব কী অথবা তাদের সম্পর্কে এদেশের মানুষের কী প্রতিক্রিয়া তা নিয়ে তারা খুব বেশী চিন্তিত কিনা জানি না। তবে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে এতটুকু বলা যায়, ভারত স্বার্থের জন্য বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার চেয়েও তাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ রক্ষা করবে এমন কোনো গোষ্ঠী, দল বা ব্যক্তির প্রতিই সচারাচর দূর্বলতা দেখিয়ে থাকে। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এক তরফা হলে তা টেকসই হয় না। আমরা ভারতের কাছ থেকে অতিরিক্ত কোনো ছাড়ও প্রত্যাশা করিনা। আমরা আপাতত: ভারতের কাছ থেকে তিস্তা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যাটুকু চাই।


লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল

আরো পড়তে পারেন

একাত্তরের গণহত্যা প্রতিহত করা কি সম্ভব ছিল?

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই এক রাতেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে….

ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

আগের পর্বে পড়ুন— চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও একটি সার্থক গণআন্দোলন। এই গণআন্দোলনের মূল চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হলো দেশপ্রেম থেকে জাত সেই অনুভূতি, যার একটি রাজনৈতিক প্রকাশ রয়েছে। আর, বাঙালি জাতিসত্তাবোধের প্রথম রাজনৈতিক প্রকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে দুই হাজার মাইল দূরত্বের….

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল)

আগের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ একুশের আবেগ সংহত থাকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দেও। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। আওয়ামি লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ১৮ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটির সদস্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র….

error: Content is protected !!