Author Picture

হাসির দিকপাল ঢাকার ভানু

মযহারুল ইসলাম বাবলা

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় খাঁটি বাঙাল এবং অনিবার্যরূপে আমাদেরই লোক। পূর্ববঙ্গের তো বটেই। খাস ঢাকারও। ঢাকার স্থানীয় কুট্টি ভাষাকে পশ্চিমবাংলা জুড়ে ছড়িয়ে ঢাকার ভানু খ্যাতিমান হয়েছিলেন। তাঁর কৌতুক নক্শা সমূহে এবং বাংলা চলচ্চিত্রে নিজের সংলাপগুলো নির্ভেজাল ঢাকার কুট্টি ভাষায় প্রয়োগ ও প্রচার করে নিজেকে ঢাকার ভানু রূপে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।
এমনিতে পূর্ববঙ্গীয় বাংলা ভাষা নিয়ে পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের নাক সিঁটকানো, ব্যঙ্গোক্তি, বিদ্রুপ, হাসি-তামাশার কমতি ছিল না। পূর্ববাংলার প্রচলিত বাংলা ভাষাকে তাঁরা রীতিমত উপহাস করতেন। এর ওপর ঢাকার স্থানীয় কুট্টি ভাষা তাঁদের পক্ষে সহ্য-হজম করা কঠিন থেকে কঠিনতর ছিল। ভানুর ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষা নিশ্চিত তাঁদের কান গরম করে দিত। তাচ্ছিল্যের ঢাকাইয়া ভাষাকে পশ্চিমবাংলার বাঙালিদের উপর চাপিয়ে উল্টো তাঁদেরই নাজেহাল করে ছেড়েছেন। ভানুর অসাধারণ কৌতুকের ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষা তাঁরা নিরুপায়ে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ভানুর কৌতুকে মানুষ হেসেছে— নির্মল আনন্দ উপভোগ করেছে। ভানুর কৌতুক কেবল হাসি সর্বস্ব ছিল না। তির্যক ছিল বহুলাংশে। অসঙ্গতি-অনাচারের শৈল্পিক উপহাস করেছেন কৌতুকের মাধ্যমে। সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি সকল ক্ষেত্রের অসঙ্গতি নিয়ে কৌতুকে তির্যক করেছেন— খোঁচা দিয়েছেন। ভানুর কৌতুকের উল্লেখযোগ্য দিকটি অসঙ্গতিকে উপহাস করা। সেটা সার্থকভাবে তিনি করেছেন। দম ফাটানো হাসিতে লুটোপুটি খেলেও ভানুর তির্যকপূর্ণ কৌতুক শ্রোতাদের বুঝতে বেগ পেতে হত না। সহজ-সাবলীল এবং সর্বজন বোধগম্যে ভানুর কৌতুকের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি।

ঢাকার স্থানীয় কুট্টি ভাষাকে পশ্চিমবাংলা জুড়ে ছড়িয়ে ঢাকার ভানু খ্যাতিমান হয়েছিলেন। তাঁর কৌতুক নক্শা সমূহে এবং বাংলা চলচ্চিত্রে নিজের সংলাপগুলো নির্ভেজাল ঢাকার কুট্টি ভাষায় প্রয়োগ ও প্রচার করে নিজেকে ঢাকার ভানু রূপে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন

ঢাকার ভানু কেবল পশ্চিমবাংলায় সীমাবদ্ধ ছিলেন না। মাতৃভূমি পূর্ববঙ্গেও জনপ্রিয় ছিলেন। ভারতীয় চলচ্চিত্র পূর্ব পাকিস্তানে প্রদর্শনে বিধি নিষেধ ছিল না। ১৯৪৭-এর মধ্য আগস্টের দেশভাগের পরও ভারতীয় হিন্দি-বাংলা ছবির বিশাল বাজার ছিল পূর্ববাংলায়। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় জেনারেল আইয়ুব খান তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে ভারতীয় চলচ্চিত্রের প্রদর্শনী নিষিদ্ধ করে দেন। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পূর্ববর্তী বছরগুলোতে পূর্ববাংলায় কলকাতায় নির্মিত বাংলা এবং মুম্বাইর হিন্দি ছবি অবাধে প্রদর্শিত হত। সে কারণে পূর্ববঙ্গের দর্শকদের কাছে ভানু অপরিচিত-অজ্ঞাত কেউ ছিলেন না। বরযাত্রী (১৯৫১), পাশের বাড়ি (১৯৫২), সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩), ওরা থাকে ওধারে (১৯৫৪), ভানু পেল লটারী (১৯৫৮), যমালয়ে জীবন্ত মানুষ (১৯৫৮), পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (১৯৫৯), ভানু অভিনীত অনেক ছবি এখানে নিয়মিত প্রদর্শিত হবার কারণে ভানু দুই বাংলায়ই সমান জনপ্রিয় ছিলেন। আমার বাবা-মায়ের কাছে শোনা নির্মল হাসি-আনন্দের উপভোগ্য সে সমস্ত ছবির ঘটনা শুনে-শুনে বড় হয়েছি। সে কারণে সে সকল ছবির প্রতি এক প্রকার আকর্ষণ কিশোর বয়স থেকেই অনুভব করতাম। নিষিদ্ধের কারণে ভানুর কৌতুক শোনা এবং তাঁর চলচ্চিত্র দেখার তখন উপায় ছিল না। স্বাধীনতার পরই অডিও ক্যাসেটে ভানুর কৌতুক নক্শা শোনার সুযোগ পেয়েছিলাম। এর-ওর থেকে ক্যাসেট সংগ্রহ করে হরহামেশা শুনতাম অসাধারণ সব কৌতুক নক্শা। ভানুর ন্যায় বাংলা ভাষায় অন্য কেউ তাঁর স্থানে আজ অবধি দাঁড়াতে পারে নি এবং তাঁকে অতিক্রমও করতে পারে নি। ভানু তাই আজও একমাত্র এবং অদ্বিতীয়। চলচ্চিত্র সংসদ কর্তৃক আয়োজিত ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের অডিটোরিয়ামে ভানুর অভিনীত ছবি দেখার সুযোগ হয়। এর বহু পরে ভিসিআর-এর আগমনে ভিডিও ক্যাসেটে ভানুর অভিনীত ছবি দেখেছি। স্যাটেলাইট টিভির বদৌলতে এখন তো আমাদের জন্য কিছুই নিষিদ্ধ-আরাধ্য নেই। কলকাতার বাংলা চ্যানেলে কলকাতার স্বর্ণযুগের বাংলা ছবিও মাঝে-মধ্যে সম্প্রচারিত হয়। এছাড়া ভিডিও সিডি এখন বেশ সহজলভ্য। ভানুর অভিনীত প্রচুর ছবি এখন সিডিতে পাওয়া যায়।

শুটিং এর ফাকে (বাঁ থেকে) উত্তম কুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

ভানুর অভিনয় শৈলী, অভিব্যক্তি, বাচনভঙ্গি, কণ্ঠস্বর সমস্ত মিলিয়েই হাস্যকৌতুকের দিকপাল ভানু। দর্শক-শ্রোতাদের কখনো সুড়সুড়ি দিয়ে হাসানোর বৃথা চেষ্টা তিনি করেন নি। শ্রোতা-দর্শকদের হাসানোর অসাধারণ ক্ষমতার অধিকারী ভানু। সচরাচর কৌতুক শিল্পীদের মাঝে তিনি কেবল অসামান্য নন-বিরলও। এই অসামান্য প্রতিভার মানুষটিকে যোগ্য সম্মান আমরা দিতে পারি নি। আমাদের একজন চলচ্চিত্রকার কিংবা সাংস্কৃতিক আয়োজনে তাঁকে এখানে কেউ ডাকে নি। এই লজ্জা আমাদের বহন করতেই হবে। ক্ষণজন্মা ভানু মাত্র ৬২ বছর বয়সে প্রয়াত হয়েছেন। একাত্তরের বিজয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশে পশ্চিমবাংলার অনেক গুণী-শিল্পীদের আগমন ঘটেছিল। সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগে তাঁরা ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু ভানুকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ঢাকায় কেউ আনে নি। অগত্যা ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। বিটিভি তাঁকে নিয়ে অনুষ্ঠানও সম্প্রচার করেছিল। সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, কৌতুক পরিবেশন করেছিলেন ওই অনুষ্ঠানে। জানিনা বিটিভি’র আর্কাইভে সেই অনুষ্ঠানটি সংরক্ষিত আছে কিনা? বিটিভি’র সাক্ষাৎকারে ভানু আক্ষেপে-শ্লেষে বলেছিলেন— ‘আমাকে আপনারা কেউ ডাকলেন না। আপনাদের ডাকের অপেক্ষায় বহুদিন ছিলাম। কিন্তু আপনারা কেউ আমাকে ডাকেন নি।’ আমরা নিশ্চয় ভানুর প্রতি সুবিচার করিনি। ঢাকার ভানুকে ঢাকা যোগ্য সম্মান দিতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এই লজ্জা আর মোচন হবে না। নিজেকে কেবল পূর্ববঙ্গীয় নয়, খাস ঢাকার বলেই গর্ব করে বলতেন— আমি বাঙাল। এতে তাঁর হীনমন্যতা ছিল না। ছিল প্রচন্ড অহংকার বোধ।
ক’বছর পূর্বে কলকাতা ভ্রমণে নন্দনে ছবি দেখতে গিয়েছিলাম। ছবি দেখে বের হচ্ছি হঠাৎ কলকাতার স্থানীয় আমার সঙ্গীটি ইশারায় এক ভদ্রমহিলাকে দেখিয়ে নীচুস্বরে বলেন, ঐ মহিলা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বড় মেয়ে। শুনেই আমি ছুটে যাই ভদ্রমহিলার নিকট। দ্বিধা-সংকোচের পরোয়া না করে জিজ্ঞেস করি তিনি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে কিনা? অপরিচিত আমার প্রশ্নে তিনি কিছুটা ইতস্তত। তার মুখে হ্যাঁ শোনার পর তাকে বলি— আমি ঢাকা থেকে এসেছি। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় আমার ছিল না। কিন্তু তাঁর সৃজনশীলতার সঙ্গে আমার পরিচয় বহু পূর্বের। আমার কথায় তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁর পিতার প্রসঙ্গে অনেক প্রশ্ন করি এবং তিনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন নির্মল আন্তরিকতায়, সামান্যতম বিরক্ত না হয়ে। ভানুর সদৃশ তাঁর মেয়ে বাসবী, একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। ভানু পারিবারিক পরিমন্ডলে আজীবন খাস ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলতেন। কলকাতার স্থানীয় বাঙালিদের ঘটি বলতে ছাড়তেন না।

চলচ্চিত্র সংসদ কর্তৃক আয়োজিত ঢাকাস্থ ভারতীয় দূতাবাসের অডিটোরিয়ামে ভানুর অভিনীত ছবি দেখার সুযোগ হয়। এর বহু পরে ভিসিআর-এর আগমনে ভিডিও ক্যাসেটে ভানুর অভিনীত ছবি দেখেছি। স্যাটেলাইট টিভির বদৌলতে এখন তো আমাদের জন্য কিছুই নিষিদ্ধ-আরাধ্য নেই

১৯৪৬ সালে চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত হন এবং ঐ বছরই বিয়ে করেন। ১৯৪৭-এর রক্তাক্ত দেশভাগে মাতৃভূমিতে ফিরে আসার আশা ত্যাগ করে কলকাতায় স্থায়ী হয়ে যান। সাম্প্রদায়িকতার দেশভাগে বাঙালি আর বাঙালি ছিল না। হিন্দু-মুসলমানে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে থাকলেও মাতৃভূমিতে ফিরে আসা সম্ভব ছিল না। জয় বাংলার আমন্ত্রণের প্রতীক্ষায় থাকলেও, জীবদ্দশায় তাঁকে কেউ ঢাকায় আমন্ত্রণ জানায় নি। এই নিয়ে আক্ষেপ করতেন। শেষে নিজ উদ্যোগে ঢাকায় গিয়েছিলেন। বাসবী’র কাছে জেনেছিলাম ভিন্ন এক ভানুর কথাও। যে কথা কেউ-কেউ জানলেও, অনেকেই জানেন না। আমিও জানতাম না। মাত্র গত ডিসেম্বরে জি-বাংলা চ্যানেলের ‘মীরাক্কেল’ অনুষ্ঠানে বাসবী বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছিলেন। রজতাভ দত্ত সে প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলেন এবং বাসবী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেনও আমাকে বলা সেই একই কথা, তাঁর বাবা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় সশস্ত্র স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। সক্রিয় সদস্য ছিলেন সশস্ত্র স্বদেশী সংগঠন অনুশীলন দলে। কলকাতার রাইটার্স অপারেশনে অংশ নিয়েছিল তিন দেশপ্রেমিক স্বদেশী বীর। বিনয়, বাদল এবং দীনেশ। অপারেশনে তিনজন পৃথকভাবে রাইটার্সে ঢুকেছিলেন সেদিন। দীনেশকে রাইটার্স বিল্ডিং-এ অপারেশন সংঘটনে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব পড়েছিল ভানুর ওপর। সাইকেলের সামনে বসিয়ে দীনেশকে রাইটার্সের গেইটে পৌঁছে দিয়েছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়। দলীয় সিদ্ধান্ত অনুসারে দীনেশকে নামিয়ে গেইটের বাইরে সাইকেল নিয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ভানু রাইটার্স এলাকা ত্যাগ করেছিলেন। রাইটার্স অপারেশনের পরিণতি আমরা জানি। ইউরোপীয় পোশাকে সজ্জিত তিন বিপ্লবী রাইটার্সে আচমকা আক্রমণ করে হত্যা করেন কুখ্যাত কর্নেল সিম্পসনকে। নিরাপত্তা রক্ষীদের সঙ্গে সংঘর্ষে তিন ইংরেজ পুলিশ কর্মকর্তা টোয়াইনাম, প্রেন্টিস এবং নেলসন গুরুতর আহত হয়। ধরা পড়ে যাবার মুহূর্তে বাদল বসু পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে ঘটনাস্থলে আত্মহত্যা করেন। বিনয় বসু ও দীনেশ গুপ্ত নিজেদের পিস্তলের গুলিতে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন মেডিকেল ছাত্র বিনয় বসু সকলের অলক্ষ্যে বুলেটের ক্ষতস্থানে নিজের আঙুল ঢুকিয়ে আত্মহত্যা নিশ্চিত করেন। গুলিবিদ্ধ দীনেশ সুস্থ হলে বিচারে তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে উপনিবেশিক ইংরেজ শাসক।

একাত্তরের বিজয়ের পর স্বাধীন বাংলাদেশে পশ্চিমবাংলার অনেক গুণী-শিল্পীদের আগমন ঘটেছিল। সরকারি ও বেসরকারি নানা উদ্যোগে তাঁরা ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু ভানুকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ঢাকায় কেউ আনে নি। অগত্যা ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন। বিটিভি তাঁকে নিয়ে অনুষ্ঠানও সম্প্রচার করেছিল। সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন, কৌতুক পরিবেশন করেছিলেন ওই অনুষ্ঠানে। জানিনা বিটিভি’র আর্কাইভে সেই অনুষ্ঠানটি সংরক্ষিত আছে কিনা?

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবনের রাজনৈতিক-দেশপ্রেমের এই অধ্যায় জানা সম্ভব হত না, যদি সেদিন আগ বাড়িয়ে বাসবী বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ না করতাম। ভানুর টানেই সেদিন তাঁর মেয়েকে পেয়ে ছুটে গিয়ে আলাপ করে ভানু সম্পর্কে জেনেছিলাম অনেক অজানা কথা।

সিনেমায় নারী রুপে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

ভানুর প্রকৃত নাম সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্ম ২৭ আগস্ট ১৯২০ ঢাকার বিক্রমপুরে। পিতা জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। মা সুনীতি বন্দ্যোপাধ্যায়। শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনের শুরুটা কেটেছে ঢাকায়। সদরঘাটের সেন্ট গ্রেগরি’স হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে ভর্তি হন জগন্নাথ কলেজে। জগন্নাথ কলেজের শিক্ষা শেষে ১৯৪১ সালে জীবিকার জন্য চলে যান কলকাতায়। শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, সাধারণ পেশা, সম্মানজনক জীবিকার সুযোগের কারণে কলকাতার গুরুত্ব তখন ছিল সর্বাধিক। পূর্ববাংলার প্রচুর মানুষ শিক্ষা, পেশার কারণে কলকাতায় দ্বিতীয় আবাস গড়ে তুলেছিলেন। কলকাতার বালীগঞ্জের অশ্বিনী দত্ত রোডে বোনের আশ্রয়ে থেকে চাকরিতে যোগ দেন আয়রন এন্ড স্টীল কোম্পানি নামক সরকারি দফতরে। দুইবছর বোনের কাছে থাকার পর টালিগঞ্জের চারু এভিনিউতে নিজের পৃথক আবাসে ওঠেন। ১৯৪৬ সালে নিলীমা মুখোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন। তাঁদের তিন সন্তান। গৌতম, বাসবী এবং পিনাকী। চলচ্চিত্রে প্রথম অভিনয় করেন জাগরণ ছবিতে। সেটি মুক্তি পায় ১৯৪৭ সালে। একই বছরে দ্বিতীয় ছবি অভিযোগ মুক্তি পাবার পর তাঁকে আর পেছনে তাকাতে হয় নি। ক্রমেই হয়ে পড়েন চলচ্চিত্রের ব্যস্ত শিল্পী। তাঁর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র মনমুগ্ধ (১৯৪৯), বরযাত্রী (১৯৫১), পাশের বাড়ি (১৯৫২), বসু পরিবার (১৯৫২), সাড়ে চুয়াত্তর (১৯৫৩), সাড়ে চুয়াত্তর সুচিত্রা সেন অভিনীত প্রথম ছবি। নির্মল হাস্যরসের অসামান্য ছবি সাড়ে চুয়াত্তরের কাহিনীকার বিজন ভট্টাচার্য (সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীর স্বামী) পরিচালক তপন সিংহ। ওরা থাকে ওধারে (১৯৫৪), ভানু পেল লটারী (১৯৫৮), যমালয়ে জীবন্ত মানুষ (১৯৫৮), পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (১৯৫৯), গল্প হলেও সত্যি (১৯৬৬), ৮০তে আসিও না (১৯৬৭), মিস প্রিয়ংবদা (১৯৬৭), ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্ট্যান্ট (১৯৭১), সর্বশেষ ছবি শোরগোল তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৮৪ সালে মুক্তি পেয়েছিল। বান্দিশ (১৯৫৫) এবং এক গাঁও কি কাহানী (১৯৫৫) এই দুইটি হিন্দি ছবিসহ ভানু অভিনীত সর্বমোট চলচ্চিত্রের সংখ্যা ২৩১টি। ২২৯টি বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছেন অসামান্য প্রতিভাধর সপ্রতিভ অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কৌতুক নক্শাসমূহ ভানু এল কলকাতায়, লর্ড ভানু, টেলিফোন বিভ্রাট, ভানু সদানন্দ, নব রামায়ন, ঘাতক সংবাদ, কর্তা বনাম গিন্নি, কর্তা বাবুর দেশ ভ্রমণ, হনুমানের নগর দর্শন, কলকাতা ও ভদ্রতা, চাটুজ্যে-বাড়–জ্যে ইত্যাদি।

৪মার্চ ১৯৮৩ মাত্র ৬২ বছর বয়সে মানুষ হাসানোর অসামান্য এই মানুষটি অকালে মৃত্যুবরণ করেন। এই মহান শিল্পীর জন্মশত বর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

আরো পড়তে পারেন

একাত্তরের গণহত্যা প্রতিহত করা কি সম্ভব ছিল?

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই এক রাতেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে….

ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

আগের পর্বে পড়ুন— চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও একটি সার্থক গণআন্দোলন। এই গণআন্দোলনের মূল চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হলো দেশপ্রেম থেকে জাত সেই অনুভূতি, যার একটি রাজনৈতিক প্রকাশ রয়েছে। আর, বাঙালি জাতিসত্তাবোধের প্রথম রাজনৈতিক প্রকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে দুই হাজার মাইল দূরত্বের….

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল)

আগের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ একুশের আবেগ সংহত থাকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দেও। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। আওয়ামি লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ১৮ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটির সদস্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র….

error: Content is protected !!