Author Picture

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত কী বন্ধুরাষ্ট্র হারাচ্ছে ?

একেএম শামসুদ্দিন

গত ২৫ জুন অনলাইনে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশিত সংবাদ পড়তে গিয়ে একটি ইংরেজি নিবন্ধের শিরোনাম দেখে চোখ আটকে গেল। শিরোনামটি ছিল এরকম,‘India is Paying the Price for Neglecting it’s Neighbors’। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি বেইজ এফপি নিউজ ম্যাগিজিনে নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘এফপি’ বা ‘ফরেন পলিসি’ নিউজ ম্যাগাজিন মূলত বিশ্বপরিস্থিতি এবং বিভিন্ন দেশের আভ্যন্তরীণ নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক কুটনীতি নিয়ে লেখা নিবন্ধ প্রকাশ করে থাকে। ২৩ জুন প্রকাশিত উল্লিখিত নিবন্ধটির লেখক মি. সুমিত গাঙ্গুলি। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক। সুমিত গাঙ্গুলি সাধারণত বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে ভারতের রাজনীতি ও বিদেশ নীতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোতে লিখে থাকেন। তিনি ভারতীয় নাগরিক এবং জাতিতে একজন বাঙালি। ভারত এবং চীনের বর্তমান সম্পর্ক নিয়ে লেখা তার নিবন্ধের চুম্বক অংশটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়েছে। তিনি লিখেছেন, ‘নরেন্দ্র মোদি প্রথমবার ক্ষমতায় আসার পর দেশবাসীর উদ্দেশে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নে ভারতের নিকটতম রাষ্ট্র যেমন নেপাল, শ্রীলংকা এবং বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রগুলো অগ্রাধিকার পাবে কিন্তু ক্ষমতার প্রথম অধ্যায় তো নয়ই, ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পরও মোদি তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেননি। ফলে চীন সেই সুযোগ গ্রহণ করে একসময়ের ঘনিষ্ঠ এই বন্ধুরাষ্ট্রগুলোকে ভারতের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছে।’

নিকটতম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভারতের যে আগের মতো ভাল সম্পর্ক নেই তা খোদ ভারত সরকারও হয়তো মেনে নিয়েছে মনে হয়। এর পিছনে অবশ্য যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণও আছে। এসব কারণ উল্লেখ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে এই অবনতিশীল সম্পর্ক নিয়ে ভারতে অভ্যন্তরেও যে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমগুলোর দিকে চোখ রাখলে সহজেই বোঝা যায়। অতি সম্প্রতি ভারত বিষয়ে নেপাল ও ভূটানে নেওয়া কিছু কিছু পদক্ষেপ তার প্রমাণ করে। যদিও পরবর্তীতে ভুটান তাদের অবস্থান স্পষ্ট করে দিয়েছে। তবে লিপুলেখ, কালাপানি ও লিম্পিয়াধুরা উত্তরাখন্ড রাজ্যের পিথোরাগড় জেলার অংশ হিসেবে ভারত দাবি করলেও, সম্প্রতি নেপাল উল্লিখিত ভূখন্ডগুলো নিজ দেশের অবিচ্ছিন্ন অংশ দেখিয়ে একটি নতুন ম্যাপ তৈরী করে এবং ওই নতুন ম্যাপটি পার্লামেন্টে সর্বদলীয় ভোটে পাশ করিয়ে নেয়। নেপালের পার্লামেন্টে বিলটি পাশ করার এই ঘটনা ভারতের জন্য একটি বিরাট ধাক্কা বলেই বিবেচিত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, সকল দলের সম্মতিতে এ বিল পাশ হওয়ায় নেপালের সকল শ্রেণীর জনগণের ভারতবিরোধী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মত প্রকাশ করেছেন।

জওহরলাল নেহেরু ও তাঁর দি ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া

দক্ষিণ এশিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালাচনা করে বোঝা যায়, মোদির নেতৃত্বাধীন হিন্দুধর্ম-আশ্রিত বিজেপি দু’দুবার ক্ষমতায় আসীন হয়েও নিকটতম বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। বরং সাম্প্রতিক সময়ে তাদের নেওয়া একাধিক বিতর্কিত পদক্ষেপ এসব রাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের মনের ভেতর বৈরী মনোভাব তৈরীতে সহায়তা করেছে। এ বিষয়ে নতুন করে এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। তবে দু’একটি ঘটনা উদাহরণ হিসেবে আলোচনা করা যেতে পারে। পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভারতের অভ্যন্তরেও যে এক প্রকার আশঙ্কা বিরাজ করছে তার কিছু কিছু নমুনা তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমে দৃশ্যমান হয়েছে। সে দেশের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমে এর প্রতিফলনও দেখা গেছে। লাদাখে চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত সংঘর্ষ ও নেপালের পার্লামেন্টে নতুন ম্যাপের বিল পাশের পর ২৪ জুন থেকে ভারতের জি নিউজসহ বেশ কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে অভিযোগ করা হয়, ভুটান আসামের বাকসা ও উদলগিরি জেলার ভারতীয় কৃষকদের পানি সরবরাহ লাইন বন্ধ করে দিয়েছে।

নেহেরুর রচিত ‘দি ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ নামক বইয়ের নাম উল্লেখ করা যায়। এই বইয়ের একটি অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন, পৃথিবীতে ছোট রাষ্ট্রগুলোর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাদের এক সময় বড় রাষ্ট্রগুলোর সাথে মিশে যেতে হবে। হায়দরাবাদ ও সিকিমকে ভারতভুক্ত করা, মালদ্বীপ, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে নিজেদের কব্জা করে রাখার প্রচেষ্টা, ইন্ডিয়ান ডকট্রিন ও নেহেরুর দি ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া বইয়ে উল্লেখকৃত পরিকল্পনার অংশ কিনা ভেবে দেখতে হবে

উল্লেখ্য ভুটানের সীমান্তবর্তী সামদ্রুপ জংকার জেলার বিভিন্ন উৎস থেকে ভারতের ওই জেলাগুলোতে কয়েক দশক ধরেই পানি সরবরাহ করে আসছিল। সংবাদ মাধ্যমে এই সংবাদটি প্রকাশ হওয়ার পর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয় এবং তা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। তবে গত ২৬ জুন ভুটানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খবরটি সঠিক নয় বলে এক বিবৃতি প্রদান করে। প্রকৃত ঘটনা হল, প্রাকৃতিক কারণেই ভুটানের ওই উৎসগুলোতে পানি না থাকার কারণে আসামের কৃষকেরা এবার কৃষি জমিতে ভুটান থেকে পানি সরবরাহ পাচ্ছে না। বিষয়টি স্পষ্ট না করেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অন্যান্য মাধ্যমে যে হৈচৈ পড়ে যায় তাতে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের অস্থিরতারই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এফপি ম্যাগাজিনে সুমিত গাঙ্গুলির ‘India is Paying the Price for Neglecting it’s Neighbors’ নিবন্ধে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।

ভারত চীনকে কেন্দ্র করে তার পার্শ্ববর্তী ছোট দেশগুলোর ভূমি ব্যবহার করে যে বৃহত্তর রণকৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তা ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হওয়ায়, চীনও তার অর্থনৈতিক শক্তি ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে ভারত পরিবেষ্টিত দেশেগুলোকে কাছে টানার চেষ্টা করছে। সামরিক গুরুত্ব বিবেচনা করে ভারত চীনের সীমান্তবর্তী এলাকা বরাবর দীর্ঘ রাস্তা নির্মাণের যে উদ্যোগ নিয়েছে চীন তা ভাল চোখে দেখেনি। এরই ধারাবাহিকতায় লাদাখে সড়ক এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণকে কেন্দ্র করেই চীনের সঙ্গে ভারতের সংঘর্ষের অন্যতম কারণ। সম্প্রতি নেপালের সঙ্গে ভারতের সীমান্তে রাস্তা নির্মাণ নিয়ে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। নেপাল এই রাস্তা নির্মাণের সময় প্রতিবাদ জানালেও ভারত তা শোনেনি। হিমালয়ের এই অংশের একটা গিরিপথের নাম লিপুলেখ এবং এর দক্ষিণে অবস্থিত কালাপানি এলাকা। চীনকে মোকাবেলা করার জন্য এই এলাকাটির সামরিক গুরুত্ব রয়েছে। ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধের সময় নেপাল ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে এই এলাকায় ভারতকে অস্থায়ীভাবে সৈন্য সমাবেশের অনুমোদন দিয়েছিল। নেপালের দাবি অনুসারে, সেই থেকে ভারতীয়রা কালাপানি থেকে আর সরে যায়নি। ভারত লিপুলেখ থেকে কালাপানি পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি রাস্তা নির্মাণ করেছে যেন সহজে তিব্বতের কৈলাস মানস সরোবরে যেতে পারে। পূর্বে সিকিম হয়ে কৈলাস মানস সরোবরে পৌঁছুতে পাঁচদিন লাগতো। যেমন পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসাম ঘুরে আগরতলা পৌঁছুতে বেশ কয়েকদিন লেগে যেত। এখন বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে সরবরাহ রুটের সুবিধা পাওয়ার ফলে একদিনেই পৌছানো যায়।

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সুমিত গাঙ্গুলি

ভারত কালাপানি থেকে লিপুলেখ পর্যন্ত শুধু রাস্তাই নির্মাণ করেনি, গত নভেম্বরে কালাপানি এলাকাকে তাদের নতুন ম্যাপে অন্তর্ভুক্তও করে নিয়েছে। এরপরই নেপালে ভারতের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ শুরু হয়। অথচ নেপালের ডিপার্টমেন্ট অব সার্ভে এর এক প্রতিবেদনও বলা আছে, ১৮৫০ ও ১৮৫৬ সালে সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রস্তুত করা মানচিত্রে ভারত ও নেপালের সীমান্তরেখা হিসেবে চিহ্নিত মহাকালি নদীর উৎপত্তিস্থল দেখানো হয়েছে কালাপানি থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে। এর ফলে প্রমাণিত হয় যে কালাপানি নেপালের অংশ। কিন্তু ভারত প্রমাণ হিসেবে এখন আর এসব মানচিত্র গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়। বরং এলাকাটি যে কয়েক যুগ ধরে তাদের নিজেদের দখলে রেখেছে সেটা নেপালকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। তারপরও কালাপানির মতো একই যুক্তিতে নেপাল, লিপুলেখ ও লিম্পিয়াধুরাও এলাকা নিজেদের ভূমি দাবি করে নতুন ম্যাপে তা অন্তর্ভুক্ত করেছে। নেপালের এই এক তরফা পদক্ষেপ ভারত সহজভাবে গ্রহণ করেনি। নেপালের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের এমন সাহস দেখে এই অঞ্চলের শক্তিধর দেশের নাগরিক হিসেবে দাবি করা ভারতীয়রা যে আহত হয়েছে তার প্রতিফলন আমরা ইতোমধ্যেই সেদেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় দেখেছি। শুধু তাই নয় অতি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সীমানায় নেপালের পুলিশের গুলিতে একজন ভারতীয় নাগরিকের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখেছি তা চোখে লাগার মতো; অথচ বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশীদের নিয়মিত হত্যাকান্ডে প্রতিক্রিয়া হিসেবে যদি নূন্যতম পক্ষে আফসোস করেও দেখাত তাহলে এসব ভারতীয়দের মানবিক মনে হতো।

১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধে সামরিক গুরুত্ব বিবেচনা করে নেপালের ভূখন্ড ‘কালাপানি’ অঞ্চলে বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে ভারত অস্থায়ী সামরিক ঘাঁটি গড়ার সুবিধা পেয়ে স্থায়ীভাবে গেড়ে বসেছিল। ভারতকে সেই সুবিধা দিয়ে নেপাল আজও দুর্ভোগ সহ্য করে চলেছে। তাই ভয় হয়, আকাশে কালো মেঘ দেখলে যেমন ঝড়ের আশঙ্কা হয়; ভবিষ্যতে বাংলাদেশের আকাশে কালো মেঘ জমে যদি তেমন ঝড় ওঠে, তাহলে বাংলাদেশ কী পারবে সেই ঝড় ঠেকাতে?

ইদানিং নানাবিধ কারণে ভারত পরিবেষ্টিত রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের যে টান পড়েছে তা সহজে অনুমান করা যায়। চির বৈরী পাকিস্তানের সম্পর্কে কথা নাই বা বললাম। তামিল সমস্যা নিয়ে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের চির ধরেছে। মালদ্বীপের সাথে ভারতের সম্পর্ক কিছুটা অম্লমধুর। সে দেশের সরকারের পালাবদলের ওপর এই সম্পর্ক অনেকটা নির্ভর করে। সম্প্রতি আসামসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে নাগরিকত্ব তালিকা তৈরী নিয়ে সে দেশের ক্ষমতাসীন নেতাদের বাংলাদেশ নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বক্তব্য এদেশের সাধারণ মানুষের মনে ভারতের প্রতি নতুন করে বিরূপ ধারণার জন্ম দিয়েছে। মোট কথা ভারতের এরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ক্ষতিসাধন করছে। ভারতের এই দৃষ্টিভঙ্গি দেশটির প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে অপরিবর্তিত রয়েছে। এর অন্যতম কারণ হতে পারে ভারতের প্রতিষ্ঠাকালীন ডকট্রিন। ভারতের এই ডকট্রিনে বলা হয়েছে, ভারত এই অঞ্চলে অবশ্যই তার গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করবে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলবে ভারত। এ বিষয়ে ভারতের স্বাধীনপূর্ব নেহেরুর রচিত ‘দি ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া’ নামক বইয়ের নাম উল্লেখ করা যায়। এই বইয়ের একটি অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন, পৃথিবীতে ছোট রাষ্ট্রগুলোর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। তাদের এক সময় বড় রাষ্ট্রগুলোর সাথে মিশে যেতে হবে। হায়দরাবাদ ও সিকিমকে ভারতভুক্ত করা, মালদ্বীপ, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে নিজেদের কব্জা করে রাখার প্রচেষ্টা, ইন্ডিয়ান ডকট্রিন ও নেহেরুর দি ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া বইয়ে উল্লেখকৃত পরিকল্পনার অংশ কিনা ভেবে দেখতে হবে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে ভারত প্রতিবেশীদের সাথে যে আচরণ করে চলেছে, তারই ফলশ্রুতিতে এ সমস্ত দেশ স্বাভাবিক নিয়মেই তাদের রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য অন্য এমন রাষ্ট্রের সাথে জোট বাঁধতে চেয়েছে যেন সেই রাষ্ট্র সামরিক ও অর্থনৈতিক শক্তিতে ভারতের সমকক্ষ বা তারও অধিক হয়। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। প্রতিবেশীদের সাথে ভারতের সম্পর্কের এই টানাপড়েনের সুযোগ গ্রহণ করে চীন এসব দেশের প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, যা ভারত সহজভাবে নিতে পারছে না। যুক্তরাষ্ট্রের এফপি ম্যাগাজিনে সুমিত গাঙ্গুলির ‘India is Paying the Price for Neglecting it’s Neighbors’ নিবন্ধে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে চীন ও ভারতের মধ্যে এই বৈরী পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ভূমিকা কী হবে? বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য সম্পর্ক রক্ষা করে উভয় দেশ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে নিতে পারে! মনে রাখতে হবে স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে ঠিকই, তবে স্বাধীনতার পর এ যাবত তারা বাংলাদেশ থেকে যে সুবিধা আদায় করে নিয়েছে এবং এখনও নিয়ে যাচ্ছে, বিনিময়ে বাংলাদেশ পেয়েছে খুব সামান্যই। অপরদিকে বাংলাদেশের বর্তমান উন্নয়নে চীন যে বিলিয়ন ডলার অর্থ বিনিয়োগ করে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তা যেন বন্ধ না হয়ে যায়। বর্তমানে চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। বাংলাদেশে চীন থেকে মোট আমদানী হয় ৩৪ শতাংশ; যার মূল্য ১৪ বিলিয়ন। সম্প্রতি চীন বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যের ওপর ট্যাক্স ফ্রি করে দিয়েছে। ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এর বাংলাদেশ সফরের সময় ২৪ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়। এটা বাস্তবায়ন হলে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৮ বিলিয়ন ডলারে। বাংলাদেশে কোনো বিদেশি কোনো দেশের বিনিয়োগের এটাই সবচেয়ে বেশী অর্থলগ্নী। চীনের এই উদ্যোগে উদ্বিগ্ন হয়ে ভারতও বাংলাদেশকে ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের ঘোষণা দেয়, তবে কঠিন শর্ত জুড়ে দিয়ে। কিন্তু দেখা গেছে, এই শর্ত অনুযায়ী অর্থ খরচ করলে বাংলাদেশের চেয়ে ভারতই উপকৃত হবে বেশী। তাদের দেয়া শর্ত অনুসারে এই অর্থের অধিকাংশ খরচ করতে হবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সাথে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে, যেন সহজেই বাংলাদেশের ওপর দিয়ে অল্প খরচ ও সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে সেখানে পণ্য পৌঁছানো যায়। আগে যেখানে তিন থেকে চারদিন লাগত এখন একদিনেই সেখানে পণ্য পৌঁছে যাবে। তবে আশঙ্কা হয় বর্তমানে এই যোগাযোগ ব্যবস্থা বাণিজ্য পণ্য পরিবহনে সীমাবদ্ধ থাকলেও ভবিষ্যতে বন্ধুত্বের দোহাই দিয়ে (উত্তর-পূর্ব অঞ্চল সীমান্তে চীনের সঙ্গে যদি কোনো সামরিক সংঘর্ষে হয় অথবা ওই অঞ্চলে তাদের আভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে) সামরিক সরঞ্জামাদি পরিবহণের জন্য ভারত যে অনুরোধ করবে না সে গ্যারান্টি কোথায়? ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধে সামরিক গুরুত্ব বিবেচনা করে নেপালের ভূখন্ড ‘কালাপানি’ অঞ্চলে বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে ভারত অস্থায়ী সামরিক ঘাঁটি গড়ার সুবিধা পেয়ে স্থায়ীভাবে গেড়ে বসেছিল। ভারতকে সেই সুবিধা দিয়ে নেপাল আজও দুর্ভোগ সহ্য করে চলেছে। তাই ভয় হয়, আকাশে কালো মেঘ দেখলে যেমন ঝড়ের আশঙ্কা হয়; ভবিষ্যতে বাংলাদেশের আকাশে কালো মেঘ জমে যদি তেমন ঝড় ওঠে, তাহলে বাংলাদেশ কী পারবে সেই ঝড় ঠেকাতে?


লেখক: অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল

আরো পড়তে পারেন

একাত্তরের গণহত্যা প্রতিহত করা কি সম্ভব ছিল?

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই এক রাতেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে….

ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

আগের পর্বে পড়ুন— চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও একটি সার্থক গণআন্দোলন। এই গণআন্দোলনের মূল চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হলো দেশপ্রেম থেকে জাত সেই অনুভূতি, যার একটি রাজনৈতিক প্রকাশ রয়েছে। আর, বাঙালি জাতিসত্তাবোধের প্রথম রাজনৈতিক প্রকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে দুই হাজার মাইল দূরত্বের….

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল)

আগের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ একুশের আবেগ সংহত থাকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দেও। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। আওয়ামি লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ১৮ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটির সদস্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র….

error: Content is protected !!