Author Picture

চৌধুরী রওশন ইসলাম-এর একগুচ্ছ কবিতা

চৌধুরী রওশন ইসলাম

ফুল-কুড়ানি
.
বহুকাল আগে দেখা একখানি কিশোরী-মুখ আজকাল প্রায়শ মনে আসে।
ভোর বেলায় বকুল তলায় ঝরা ফুলগুলিকে পরম স্নেহে তুলে নিত।
‘দেখি তো কতগুলি পেয়েছিস ?’ বলতেই
মুখটা নিচু করে ফুলে-ভরা কুলো এগিয়ে ধরতো।
‘কী করিস এত ফুল দিয়ে প্রতিদিন? বরের জন্য মালা গাঁথিস, না ? হা হা হা…’
এমন ক্ষীপ্র নয়নে তাকাল, কেমন যেন হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম।

এম.এ.টা শেষ করে কয়েক দিনের জন্য গ্রামে গিয়েছিলাম।
শুনলাম, পরদিন সেই ফুল-কুড়ানির বিয়ে; ছেলের ব্যবসা আছে আরেক গাঁয়ে।
প্রতিবেশী কন্যার বাপ এসে নিমন্ত্রণ করে গেল, ‘বাবা, আজ এসে খুব ভালো করেছ।
কাল তোমার অনেক কাজ, আমি একা সামলাতে পারব না।’

রাতে শুয়ে শুয়ে সেই কালকের কাজগুলো নিয়ে ভাবছিলাম।
হঠাৎ-ই আমার খোলা জানালা দিয়ে কে যেন কী একটা ছুঁড়ে দিল ঘরের ভেতর।
দ্রুত খাট থেকে নেমে হারিকেনের আলোটা বাড়িয়ে দিতেই বিস্ময়।
একগাদা বকুল ফুলের মালা, সারা ঘরের মেঝেতে ছড়ানো— ফুলগুলি শুকিয়ে বিবর্ণ।
খোলা জানালার দিকে তাকালাম— বাইরে অন্ধকার।

পরদিন বিকেল নাগাদ কন্যার বাপ কন্যা বিদায়ের অশ্রু মোচন করলেন;
আর ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে নীরবে অশ্রু লুকালো আমার এম.এ.পাশ বুদ্ধি।


হীরক
.
নিজের ভিতরে খুঁড়ে খুঁড়ে খুব গভীর হতে
খুঁজে নিয়ে এসেছিলাম কয়েক টুকরো
বিশ্বাসের দ্যূতিময় হীরক।
সে হীরকালোয় অন্ধকার ভেদ করে তুমি
নীরবে চুপিচুপি চলে গেছ
নিজের নিশ্চিন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে।
তারপর সেই হীরক-খণ্ডগুলি আমার
ছুড়ে ফেলে দিলে অবিশ্বাসের গভীর পঙ্কে।

আমি আবারও নিজের ভিতরে আরও গভীরে
খুঁড়ে খুঁড়ে খুঁজে ফিরি বিশ্বাসের হীরক-খণ্ড।
সুলেখা, খুব গোপনে তোমাকে বলে দিই—
মানুষের ভিতরে খুব বেশি হীরক থাকে না।


গোপন সুর (১)
.
একদিন এই নারী আমার হৃদয়েও ফুঁ দিয়ে ঝড় তুলেছিল।
কত কত বার হৃদয়ের গলিপথে মৃদু পায়ে হেঁটে গেছে।
রোজ তার গোলগাল মুখখানি মনের আকাশে ভেসে উঠে
সারারাত জ্যোৎস্নায় ডুবিয়েছে আমার সমস্ত ভুবন।

একদিন এই নারী সুর শিখিয়েছে;
অনুর্বর বিস্তীর্ণ কবিতার মাঠ আমি অক্লান্ত চষে গেছি।
সব ভুলগুলো ফুলের মতো মোহনীয় হয়ে ফুটেছিল।

আজ এই নারী তার কুঁচকানো ত্বক নিয়ে বসে আছে।
হাতে তার জপমালা, বসে বসে ওপারে যাওয়ার দিন গোনে।
এই নারী আজও জানে না, কোনো দিন জানবে না,
হৃদয়ের গভীরে তার শেখানো সুর আজও বাজে গোপনে।


গোপন সুর (২)
.
আজ যে বৃদ্ধ কেশহীন মস্তকে সাদা দাঁড়ি মুখে নিয়ে
লাঠি হাতে ধীর পায়ে হেঁটে চলে গেল,
একদিন জানালার ফাঁক গলে, ডালিমের ডালে বসে, কিম্বা
জামরুলের ঘন সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে, উঠোনের জাঙলা হতে
শসা তুলতে তুলতে, চোরা-চোখে লুকিয়ে দেখেছি তারে কতবার !

মনে হতো প্রবল বিদ্যুৎ শরীরে নিয়ে পাশ দিয়ে হেঁটে যেত;
সে বিদ্যুতের আবেশে কতবার শিহরণে কেঁপে কেঁপে উঠেছি,
কতবার মূর্তির মতো হয়ে গেছি নিশ্চল।

যে বৃদ্ধ আজ ধীর পায়ে হেঁটে চলে গেল লাঠি হাতে,
একদিন তার পায়ে অগ্নি-গোলকের মতো ঝলসে উঠত ফুটবল;
সারা মাঠ চিৎকারে ধ্বনিতে-প্রতিধ্বনিতে জেগে উঠত।
খেলা শেষে সন্ধ্যার রাগ মুছে গেলে দূর হতে ভেসে আসা
করুণ বাঁশির রাগে যে যুবক একদিন
কোনো এক যুবতীর গৃহস্থালি এলোমেলো করে দিত রাতের পর রাত,
আজ সেই যুবক বৃদ্ধের বেশে লাঠি হাতে হেঁটে চলে গেল।

আজ তার হাতে আর বাঁশি নেই, দাঁড়াবার একখানা লাঠি আছে;
জানা নেই তার, জানবেও না সে কোনো দিন, তার সেই বাঁশিটিরে
টিনের বাক্সে লুকিয়ে রেখেছি আজ চার যুগ ধরে।
আর সে করুণ সুর— কেউ জানে না— কতটা যত্নে
এই বুকের গভীরে আজও গোপনে চুপিচুপি রয়ে গেছে।


তবু বলছি
.
শুরুতেই পাশমিনা শালটা চোখে পড়েছিল; ভালো লেগেছিল।
যখন জানতে চাইলে, বললাম, ‘‘তাই তো ! আগে খেয়াল করি নি।”
তোমারও কি মনে হয়, আগে খেয়াল করিনি ?
পাহাড়ি পথ বেয়ে কতগুলো দোকান ঘুরেছি সে তো আমি জানি।
ভালো লাগা কি সব সময় মুখে বলা যায় ?

তবু বলছি, আমার বিরহে তুমি আগের চেয়ে সুন্দর হয়েছ।
যে-রূপের এত সমঝদার চারিদিকে,
সে-রূপ নিয়মিত চর্চায় আরো উজ্জ্বল হয়ে আলো ছড়িয়েছে।
রূপ-চর্চায় বিরহ-থেরাপি নতুন বোধ হয় !

আর একটি কথা না বললেই নয়;
জানি খুব আটপৌরে শোনাবে— তবু বলছি,
তোমার হাতের সাদা শাঁখাটা আমার বুকের খুব গভীরে
তোমার সিঁদুরের চেয়েও গাঢ়-রঙ রক্ত ঝরিয়েছে।

আরো পড়তে পারেন

রিয়াসাত আল ওয়াসিফের একগুচ্ছ কবিতা

রেট্রোসপেক্টিভ বই সাজাতে সাজাতে জনৈক কবির মনে হলো— এত এত বই কবে পড়ব! এই ফোকাস হারানো সময়ে মানুষ যেন গুড়ো গুড়ো কাচ। হঠাৎ তাঁর মনে হলো বই বাদ দিয়ে আজ বরং পাপগুলোকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা যাক। কতদিন দেখেনি দেখতে চায়নি, দেখা হয় না, দেখা যায় না। যাপিত জীবনের কাদায় শুধু মুখ ঢেকে যায়। মুখ….

সাযযাদ আনসারীর একগুচ্ছ কবিতা

ঋতু রমনী অন্তহীন পথের মত ছিলো ঋতু রমনী চেনা পাতা ও পাখি থেকে অচেনা ফুলের পথে চলে গেল সে। কথা ছিলো তার সাথে রাগ-রাগিনীর কথা ছিলো অসংখ্য পত্র-পল্লবীর, কথা ছিলো আমাদের নাম উড়াবার কথা ছিলো কত কথা দেবার নেবার। এই খানে আমাদের মন অন্ধ অধীর এই খানে না বাঁধা ঘাট জীবন নদীর, এই খানে পথে….

আজাদুর রহমানের তিনটি কবিতা

দূরত্ব একটা ধারণা আমাদের মধ্যে কোন দূরত্ব নেই। তুমি যেভাবেই থাকো, শুয়ে-বসে-দাঁড়িয়ে সামনে-পিছনে-ডাইনে-বায়ে তোমার যেভাবে মন চায় এমনকি পরস্পর গভীর আলিঙ্গনেও। তুমি যেখানেই থাকো ঢাকা বগুড়া চট্রগ্রাম আমেরিকা কোস্টারিকা কিংবা পৃথিবীর যে কোণাতেই, আমাদের মধ্যে এতটুকু দূরত্ব নেই। দূরত্ব বলে আসলে কিছুই নেই এই যে ছায়াপথের পর সুদূরে জ্বলছে যে তারা সেখানে কেউ কারও দূরে….

error: Content is protected !!