Author Picture

দ্যা মাস্ক অব আফ্রিকাঃ আফ্রিকান বিশ্বাসের খন্ডাংশ

মাসউদুল হক

প্রথম পর্বঃ কাসুভি’র সৌধ (৪)

 

কাবাকার অভিষেকের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক নজরে পড়েছিল অভিযাত্রী স্পেকের। মিউতসার জন্মের সময় যে নারী তাঁর নাড়ি কেটেছিল রাজ্যসভায় তিনি অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি হিসেবে বিবেচিত হতেন। অনেকটা দৈবজ্ঞর মতো ছিল তার সম্মান। রাজ্যাভিষেকের সময় ঐ নাড়ি-কাটা নারীকে একটা বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হয়। তিনি অভিষেকের প্রাক্কালে প্রথা অনুযায়ী মিউতসার পিতা সুন্নাহ’র কবরে যান এবং পরীক্ষা করে দেখেন সুন্নাহ’র কবরে রোপন করা উদ্ভিদগুলো (সম্ভবত তিনি নিজেই সেগুলো রোপন করেছিলেন একসময়) কিভাবে বড় হয়েছে? ঐ গাছগুলোর বৃদ্ধি দেখে তিনি সিদ্ধান্ত দিতেন, অভিষেকের পর নতুন রাজা পাশ্ববর্তী রাজ্যের সাথে যুদ্ধে নামবেন নাকি নীরবে প্রাসাদে অবস্থান করবেন। মিউতসাকে অভিষেকের পর যুদ্ধে যেতে হয়েছিল। তার মানসিকতার সাথে যুদ্ধ মানানসই হলেও তিনি মূলত পূর্বপুরুষের আত্মার অধীনস্ততা মেনে নিয়েছিলেন। উগান্ডার রাজারা কখনোই পরিপূর্ণভাবে নিজের ইচ্ছার অধীন থাকতে পারতেন না। রোমান ইতিহাসবিদ লেভি মনে করেন, পৃথিবীর ইতিহাসে রোমানদের সাফল্যের পেছনে অন্যতম কারণ ধর্মনিষ্ঠতা। রোমানরা শ্রষ্টার সাথে আলোচনা না-করে কিছুই করতেন না। মিউতসার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
মিউতসার পিতা সুন্নাহ’র সৌধও কাসুবিতে অবস্থিত। কিন্তু কাম্পালা সময়ের সাথে সাথে পুরনো শহরের নকশা অনুসরন করে বিস্তৃত না-হওয়ায় সুন্নাহ’র সৌধ দূরে সরে গেছে। বর্তমানে সুন্নাহ’র সৌধের পথ অনেক প্যাঁচানো। অভিযাত্রী স্পেক একদা মিউতসার প্রাসাদে হাঁটতে হাঁটতে তার পূর্বসূরী সুন্নাহ’র প্রাসাদে এসেছিলেন। কিন্তু সেই প্রাসাদ থেকে সৌধের অবস্থান তার কাছে বেশ দূরে মনে হয়েছিল। তবে প্রচলিত গল্প হলো সুন্নাহ নিজেই সেই সৌধের স্থান নির্ধারন করেছিলেন এবং প্রাসাদের সাথে ভবিষ্যত সৌধের দূরত্ব দেখে বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘ওয়ামলা’ বা ‘যথেষ্ট দূর’। ফলে কাসুবিতে অবস্থিত হলেও সুন্নাহ’র সৌধটির নাম— ওয়ামলা। ইতিহাসের পাতা থেকে সুন্নাহ এতটাই বিস্মৃত হয়েছেন যে, বর্তমানে আপনাকে সুন্নাহ’র সৌধ খুঁজে পেতে হলে আগেই বুঝে নিতে হবে ঠিক কোথায় আপনি যেতে চান। কারণ সুন্নাহ’র সৌধ পর্যটকদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্ব না-পাওয়ায় উগান্ডার ট্যাক্সি ড্রাইভাররা আপনাকে ওয়ালমাতে না নিয়ে কাসুবিতে অবস্থিত মিউতসার সৌধে নিয়ে যেতে পারে।
বর্তমান উগান্ডায় নিজের এই পরিনতি দেখলে সুন্নাহ হয়তো ব্যথিত হতেন। সুন্নাহ ছিলেন কাসুবি’র রূপকার, এক ভয়-জাগানিয়া যোদ্ধা, যিনি বিশ্বাস করতেন তার জন্ম হয়েছে অনন্তকাল বেঁচে থাকার জন্য অথচ মৃত্যুর একশত পঞ্চাশ বছর অতিক্রম না-করতেই তাঁর স্মৃতি প্রায় মুছে গেছে। তার সৌধের এখন নিতান্তই ভগ্নদশা। রাজকীয় বোগান্ডা উপজাতির সদস্য প্রিন্স কাসিম মনে করেন এটা তাঁর উপজাতির জন্য অবমাননাকর আর সাধারন মানুষ মনে করে উগান্ডার ইতিহাস-ঐতিহ্য যেখানে প্রায় পুরোটাই হারিয়ে গেছে সেখানে এই অল্প কিছু স্মৃতি ধরে না-রাখতে পারা উগান্ডার ব্যর্থতা।
সুন্নাহ’র সৌধে যেতে হলে আপনাকে একটা সোজা রাস্তা ধরে ক্রমবর্ধমান কাম্পালা শহরের প্রান্তে চলে যেতে হবে। তারপর যে রাস্তা শুরু হবে তা যথেষ্ট আঁকা-বাঁকা। আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার এক পর্যায়ে আমাদের বলেছিল, পিচ-ঢালা রাস্তা ছেড়ে ধুলোমলিন এবং ভগ্নপ্রায় রাস্তা ধরে হেঁটে গেলে সুন্নাহ’র সৌধে পৌছে যাওয়া সহজতর হবে। কিন্তু সেদিনটি ছিল— বৃষ্টি-বাদলার দিন। ভাঙ্গা রাস্তার ময়লাগুলো বৃষ্টির পানিতে আটকে ছিল আর রাস্তার দুইপাশের লম্বা ঘাসগুলো ছিল পানিতে নিমজ্জিত। মনে হচ্ছিল, এটা একটা জলের দেশ আর বৃষ্টি না-থামলে বন্যা হয়ে রাস্তাটি পানিতে হারিয়ে যাবে। ঐ পরিস্থিতিতে সৌধে পৌঁছানোর জন্য এমন একটি বিপদসংকুল রাস্তা বেছে নিলে তা একটা অর্থহীন এডভেঞ্চারে পরিনত হবার আশঙ্কা ছিল। ফলে আমরা অন্য আরেকটি রাস্তা বেছে নেই। সেই রাস্তাটিও খুব সংকীর্ণ এবং আঁকা-বাকা ছিল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছিল, আমরা একটি বিপদ ডেকে আনছি। কিন্তু আমরা ঐ রাস্তা ধরে এত সহজে সৌধে পৌঁছতে পেরেছিলাম যে, চালকের মূল রাস্তা ছেড়ে অলি-গলি ব্যবহার করে সৌধে পৌঁছানোর ধারনাটিকে খুব কার্যকর মনে হয়েছিল।

ভাঙ্গা রাস্তার ময়লাগুলো বৃষ্টির পানিতে আটকে ছিল আর রাস্তার দুইপাশের লম্বা ঘাসগুলো ছিল পানিতে নিমজ্জিত। মনে হচ্ছিল, এটা একটা জলের দেশ আর বৃষ্টি না-থামলে বন্যা হয়ে রাস্তাটি পানিতে হারিয়ে যাবে। ঐ পরিস্থিতিতে সৌধে পৌঁছানোর জন্য এমন একটি বিপদসংকুল রাস্তা বেছে নিলে তা একটা অর্থহীন এডভেঞ্চারে পরিনত হবার আশঙ্কা ছিল। ফলে আমরা অন্য আরেকটি রাস্তা বেছে নেই। সেই রাস্তাটিও খুব সংকীর্ণ এবং আঁকা-বাকা ছিল

কিন্তু কাসুবির সৌধ আর সুন্নাহ’র সৌধের মধ্যে আমরা বিস্তর ব্যবধান খুঁজে পাই। সুন্নাহ’র সৌধে কোন প্রবেশদ্বার ছিল না, কোন সীমানা প্রাচীর ছিল না, আমাদের সহযোগিতার জন্য কোন গাইডও অপেক্ষারত ছিল না। বৃষ্টিস্নাত লাল মাটিতে দাঁড়িয়ে থাকা সেই সৌধকে এমন একটা ঝোপের মত মনে হয়েছিল যে এর সাথে কোন ঘটনা বা ইতিহাস জড়িয়ে থাকতে পারে— এমনটা ভাবা কঠিন হয়ে পড়েছিল। তারপরও আমরা গাড়ি চালিয়ে সেই সৌধে উঠেছিলাম।
কাসুবি’র সৌধের ছোট একটা প্রতিরূপ মনে হলেও সেই সৌধের ছাদ ছিল ভেঙ্গে পড়া, অনাদরে-অবহেলায় বেশ পরিপুষ্ট হয়ে ওঠা নানারকম পুরনো ঘাস আর গুল্ম ছাদের এদিক-সেদিক থেকে উঁকি দিচ্ছিল। এই সব ঘাস আর লতা-গুল্মের ফাঁক-ফোঁকর গলিয়ে একটি উজ্জল-সবুজ আংগুর গাছের এগিয়ে চলাও নজরে পড়েছিল। এইসব দেখে আমাদের সুন্নাহর সৌধকে ধ্বংসপ্রাপ্ত কোন খামারের শষ্যগুদাম বলে মনে হয়। হারিয়ে যাওয়া যাদু এবং বিস্ময় হয়তো একদিন এখানে ফিরে আসবে কিন্তু আপাতত তা পুরোই অনুপস্থিত। এখানে কাসুবির সৌধের মত কোন কুঁড়ে-ঘর নেই, কোন পরিচারক নেই, কোন প্রবেশদ্বার নেই, নেই কোন সুনির্দিষ্ট উঠান বা প্রবেশগৃহ। শুধু একপাশে একটা ধূসর কাঠের তৈরি শেড দেখা যায়। সৌধের স্থাপত্যের সাথে ঐ কাঠের শেডের একটা সাজুয্য থাকলেও ইদানিংকালে গড়ে তোলা সেই কাঠের শেডের কোন ধর্মীয় উপযোগীতা নেই। হয়তো ঐ শেড নির্মানের পেছনে কোন কার্য-কারণ আছে কিন্তু আমি তা জানার জন্য কাউকে সেখানে উপস্থিত পাইনি। সৌধে ঢোকার আগেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম, মৃত্যু পরবর্তী একশ পঞ্চাশ বছর না-পেরুতেই সৌধের ভেতরে রাজার পুনরুজ্জীবনের আশায় কোন নারী আর অপেক্ষারত নেই। যেসব আচার-বিশ্বাসকে আমরা জাগতিক সবকিছুর উর্ধ্বে স্থান দিই— সেসব আচার-প্রথাও এক সময় হারিয়ে যায় যদি অর্থের সমাগম না— থাকে।
কাসুবিতে অবস্থিত মিউতসার সৌধটি ছিল মাটির উপর দাঁড়ানো, কিন্তু তার পিতার সৌধটি মাটি থেকে দুই ফুট উঁচু একটি প্ল্যাটফর্মের উপর বসানো। সেই সৌধে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে কংক্রিটের সিঁড়ি আর ঝুলে থাকা খড়ে মাথা ছুঁয়ে প্রবেশ করতে হবে। সিঁড়িটা ইদানিংকালের হলেও এটি যে প্রথা অনুযায়ী নরবলির মধ্য দিয়ে স্থাপন করা ভিত্তির উপর দাঁড়ানো— তা প্রায় নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। সৌধের ছাদের দুটি অংশ ভেঙ্গে পড়ায় সেখান দিয়ে বৃষ্টিস্নাত দিনের ধূসর আলো প্রবেশ করছে। কিন্তু তা দিয়ে সৌধের ভেতরের অন্ধকার বা নির্জনতা দূর হয়নি। এ কারণে সৌধের ভেতরটা বুঝে উঠতে খানিকটা সময় ব্যয় করতে হয়েছিল। দুই সারি পিলার দিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে সৌধের ছাদ দাঁড় করানো হয়েছে। সৌধের বাম পাশে যেখানে খড়ের ছাদের একটা অংশ নেই সেখানে ছাদকে ধরে রাখতে একটা ইটের দেয়াল তৈরি করা হয়েছে। কাবাকাদের সৌধে যা কিছু থাকবে তা নিজ ভূমি থেকে সংগৃহিত হতে হবে— এমন একটা প্রথা প্রচলিত থাকলেও— এখানে এসে সেই প্রথা আর টিকে থাকেনি। কারণ সুন্নাহ’র সৌধে ব্যবহার করা ইটকে উগান্ডার মাটি দিয়ে তৈরি বলে ধর্মীয়ভাবে মেনে নিলেও যে সিমেন্ট দিয়ে প্রলেপ দেয়া হয়েছে তা নিশ্চিতভাবেই আমদানি করা। সুতরাং প্রথা এখানে এসে আর বলবৎ থাকেনি। তবে যাই হোক, ১৮৬০ সাল হলে প্রথা ভাঙ্গাটা সিদ্ধ না অসিদ্ধ সেই আলোচনা চলতে পারতো কিন্তু সুন্নাহ যেহেতু আজ আর বেঁচে নেই সেহেতু এই প্রথা ভাঙ্গার বিষয়টি নিয়ে এখন আর আলোচনা করার কোন মানেই হয় না।
কাবাকা সুন্নাহ’র মৃত্যুর হয়েছিল গুটি বসন্ত রোগে। তার মৃত্যুর পর যথারীতি কয়েকজন নারী হয়তো প্রথা অনুযায়ী তিন মাস মৃদু উত্তাপে তার শরীর শুকিয়েছিল। তারপর প্রথা মতে তার নাড়ী, যৌনাঙ্গ, চোয়ালের হাড় এবং অন্ডকোষ মন্ত্র পড়ে কোন এক পশুর চামড়ার থলিতে রাখা হয়েছিল। কিন্তু সেই প্রয়োজনীয় অঙ্গসমূহ কোথায় রাখা হয়েছে? নিয়ম মানলে এবং কাবাকাদের বিশেষ শক্তিকে যেন কেউ অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে না-পারে সে জন্য এই সৌধের কোথাও সেগুলো পুঁতে রাখার কথা। কিন্তু তেমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সৌধে রাজকীয় স্থাপনার অনেক প্রতীক’ই এখনও বর্তমান। নলখাগড়ার শক্ত বাঁধনে তৈরি ছাদের আড়া-আড়ি বীমগুলো এখনও বাগান্ডা রাজ বংশের নানা উপগোষ্ঠির পরিচয় হিসেবে টিকে আছে। কিন্তু সেই কড়িকাঠের বীমের নীচের সব ঐতিহ্যই এখন ক্ষয়মান। কাবাকারা মৃত্যুর পর যে বনে হারিয়ে যায় সেই বনের প্রতীকরূপে ছাদ থেকে মাটি পর্যন্ত ঝোলানো লম্বা বাকলের পর্দা এখানে অনুপস্থিত। ইটের দেয়ালের ডানে, অনেক দূরে, যেখানে ভাঙ্গা ছাদের অংশ দিয়ে ধূসর দিনের আলো উঁকি দেয় সেখানে এক খন্ড বাকলের তৈরি কাপড় ঝুলতে দেখা যায়। সেই ছোট্ট কাপড়ের টুকরোটিকে ময়লা, বৃষ্টির পানিতে স্যাঁতসেঁতে এবং বেশ নোংরা বলে মনে হয়েছে। মেঝে ছিল ভেজা। সুন্নাহ’র ব্যবহার করা বর্শাটি যে র‌্যাকে রাখা তার পাশেই একটি নলখাগড়ায় বোনা লাল মাদুর আর তিনটি ঝুঁড়ি বর্তমান। সেই ঝুঁড়িতে অল্প কিছু মুদ্রার উপস্থিতি বলে দেয়, এই সৌধ এখনও পুরোপুরি পরিত্যক্ত হয়নি, এটা এখনও কারও কারও কাছে মন্দিরের মতই পূজনীয়, কিছু মানুষ এখনও প্রস্তুত কাবাকা সুন্নাহর কাছ থেকে বিশেষ কোন বর লাভের আশায় দীর্ঘপথ পারি দিতে।
অভিযাত্রী স্ট্যানলি’র মতে কাবাকা সুন্নাহ ১৮২০ সালে জন্ম নেন। তিনি সিংহাসনে আরোহন করেন ১৮৩৬ সালে এবং মৃত্যুবরণ করেন ১৮৬০ সালে। তার বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে অভিযাত্রী স্পেক ১৮৬১-৬২ সালে যখন উগান্ডায় আসেন তখন তিনি মৃত। অভিযাত্রী স্পেক যতটা না অভিযাত্রী ছিলেন তারচেয়ে বেশি ছিলেন একজন ভূগোলবিদ। ফলে তার লেখায় কাবাকা সুন্নাহ’র স্মৃতি খুব অল্পই দেখা যায়। তবে কাবাকা সুন্নাহ’কে চেনা যায় তার মৃত্যুর অনেক বছর পর উগান্ডায় আসা পরিব্রাজক স্ট্যানলির বর্ণনায় (১৮৭৫ সালে তিনি উগান্ডায় আসেন)। স্ট্যানলি যখন আফ্রিকা মহাদেশকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে অতিক্রম করছিলেন তখনও কাবাকা সুন্নাহ’কে দেখেছে এমন অনেকে জীবিত ছিল। তিনি সাংবাদিকের মত তথ্যানুসন্ধানীর চোখে তাদের সাথে গল্প করতেন এবং তথ্য সংগ্রহ করতেন।
সুন্নাহ’র একটা পোষা কুকুর ছিল। কুকুরটির প্রিয় খাবার ছিল মিষ্টি আলু। কুকুরটিকে তিনি এতই ভালবাসতেন যে, কুকুরটিকে পছন্দের মিষ্টি আলু খাওয়ানোর জন্য কিছু গ্রামবাসীকে মিষ্টি আলু চাষে বাধ্য করেছিলেন। কুকুরটি মরে গেলে তার দাফনের জন্য সেই গ্রামবাসীদেরই আবার তিনি কুকুরের জন্য বাকলের পোষাক তৈরিতে বাধ্য করেন। এটা প্রায় নিশ্চিন্তে বলা যায়, সুন্নাহ (এবং প্রাথমিক ভাবে মিউতসা) ছিল উগান্ডার মানুষদের হাতে কুকুর, বর্শা এবং নারীকে তুলে দেয়ার অগ্রদূত।

কুকুরটিকে তিনি এতই ভালবাসতেন যে, কুকুরটিকে পছন্দের মিষ্টি আলু খাওয়ানোর জন্য কিছু গ্রামবাসীকে মিষ্টি আলু চাষে বাধ্য করেছিলেন। কুকুরটি মরে গেলে তার দাফনের জন্য সেই গ্রামবাসীদেরই আবার তিনি কুকুরের জন্য বাকলের পোষাক তৈরিতে বাধ্য করেন। এটা প্রায় নিশ্চিন্তে বলা যায়, সুন্নাহ (এবং প্রাথমিক ভাবে মিউতসা) ছিল উগান্ডার মানুষদের হাতে কুকুর, বর্শা এবং নারীকে তুলে দেয়ার অগ্রদূত

সুন্নাহ আকারে ছোট-খাট হলেও তার গড়ন ছিল শক্ত-পোক্ত। তার অভ্যেস ছিল মাটির দিকে চেয়ে কথা বলা। তার সভাসদ বা জনগন সবসময় সুন্নাহর চোখের সীমানার বাইরে অবস্থান করতে চাইত। কারণ তারা বিশ্বাস করত, সুন্নাহ চোখ তুলে তাকানো মানে কারও না কারও মৃত্যু। বলা হয়ে থাকে সুন্নাহ একদিন এক সাথে আটশ মানুষ খুন করেছিল।
তার সম্পর্কে প্রচলিত সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পটি হলো, বুসোগা’র জনগণের ওপর নেয়া প্রতিশোধ বিষয়ক। বুসোগা উপজাতীর লোকেরা নীল নদের পূর্বপাশে অবস্থান করত। তারা এক সময় বুগান্ডা (যে উপজাতীর লোকেরা কাবাকা বা রাজা নির্বচিত হয়) উপজাতীর আনুগত্য অস্বীকার করে বসে। তাদের এই উদ্ধত্য সুন্নাহ মেনে নেয়নি। তিনি তাদের শাস্তি দেবার পরিকল্পনা নেন। ফলে একটি যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। বুসোগার জনগন ভাল যোদ্ধা হওয়ায় প্রায় তিনমাস সুন্নাহ তাদের পরাস্থ করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত তারা একটা দ্বীপে অবরূদ্ধ হয়ে বুগান্ডা উপজাতীর কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। তাদের আত্মসমর্পনে সুন্নাহকে এতটাই সন্তুষ্ট মনে হয়েছিল যে তিনি তাদের এই আত্মসমর্পন এবং আনুগত্য স্বীকারকে একটি উৎসবের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত করতে চেয়েছিলেন। যথারীতি উৎসবের আয়োজন করা হয়। বুসোগা রাজ্যের প্রধানরা এবং যোদ্ধাদের তিনি নানারকম খাদ্য এবং পাণীয় দ্বারা আপ্যায়নও করেন। এই ধরনের আপ্যায়নের পাশাপাশি তার ইতিবাচক মনোভাবকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে তিনি সন্ধ্যায় বুসোগার যোদ্ধাদের (যুদ্ধের সময় তারা যে নৃত্য পরিবেশন করে থাকেন সেই) যুদ্ধ-নৃত্যও পরিবেশন করতে আমন্ত্রন জানান। কিন্তু এই ধরনের যুদ্ধ-নৃত্য পরিবেশন করতে হলে হাতে অস্ত্র থাকতে হয়। সুতরাং বুসোগা’র যোদ্ধারা অস্ত্র ব্যবহারের অনুরোধ জানায়। তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে রাজা সুন্নাহ তাদেরকে জানায়, বুসোগার যোদ্ধারা অস্ত্র ব্যবহার করলে তার সৈন্যরা বিষয়টিকে সহজভাবে নাও নিতে পারে। সুতরাং বুসোগার সৈন্যরা অস্ত্রের বদলে লাঠি হাতে যুদ্ধ-নৃত্য পরিবেশন করতে সম্মত হয়। উৎসব শুরু হলে ঢাক-ঢোলের শব্দ আর তীর ছোঁড়ার খেলায় বুসোগার সৈন্যরা এতই আত্মহারা হয়ে যায় যে, তারা খেয়াল করেনি তাদের ত্রিশ হাজার সৈন্যর দলটি সুন্নাহ’র এক লক্ষ সৈন্য দ্বারা পরিবেষ্টিত। সুন্নাহ তার সৈন্যদের হাতে আগেই ঘৃতকুমারী গাছের বাকল থেকে তৈরি দড়ি সরবরাহ করে রেখেছিল। উৎসবের এক পর্যায়ে সুন্নাহ ইশারা করতেই তার সৈন্যরা বুসোগার সৈন্যদের সেই দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে এবং অস্ত্র হাতে অবস্থান করা অন্য সৈন্যদের সামনে ছুঁড়ে ফেলতে থাকে। ধারালো অস্ত্র হাতে অবস্থান করা অন্য সৈন্যরা বুসোগার যোদ্ধাদের কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে। বুসোগা উপজাতীর লোকেরা আনুগত্য অস্বীকার করে যে অসম্মান প্রদর্শন করেছিল এবং তিন মাস-ব্যাপী যুদ্ধে লিপ্ত থেকে সুন্নাহকে যে যন্ত্রণা দিয়েছিল সেই যন্ত্রণা আর অসম্মানের প্রতিশোধ নিতে সুন্নাহ বুসোগার মানুষদের হাড়-মাংস দিয়ে একটি পিরামিড তৈরির স্বপ্ন দেখে আসছিলেন। সেই নিরস্ত্র মানুষদের খুনের মধ্য দিয়ে তার সেই স্বপ্নপূরন ঘটে।
এই ভয়ংকর শাস্তি প্রদানের ঘটনা অন্য বিদ্রোহীদের মধ্যে আতংক তৈরি করতে সমর্থ্য হয় এবং তারা আনুগত্য থেকে আর কখনও সরে যায়নি। কিন্তু সুন্নাহ’র এই ভাবমূর্তি শেষ পর্যন্ত তার বিপরিতে কাজ করে। সুন্নাহ’র খুব প্রিয় এক সন্তান ছিল। সে শারিরীকভাবে অনেক দীর্ঘকায় এবং শক্তিশালী ছিল। সুন্নাহ তাকে নিজের মত করে প্রশিক্ষিত করে তুলেছিলেন। সুন্নাহ’র ইচ্ছে ছিল তার মৃত্যুর পর কাবাকা পদে তার সেই প্রিয় পুত্র অধিষ্ঠিত হবে। কিন্তু বাগান্ডা গোত্রের প্রধানরা অনুধাবন করেছিল, সুন্নাহর নিষ্ঠুরতা এবং খামখেয়ালিপূর্ণ আচরনের কারণে ইতোমধ্যে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। তারা সুন্নাহ’র প্রিয় পুত্রের মধ্যে এতটাই বন্যতা দেখেছিল যে তাদের মনে হয়েছিল তাকে কাবাকা পদে অধিষ্ঠিত করা মানে নতুন বিপদ টেনে আনা। সুন্নাহ’র মৃত্যুর পরপরই সেই বন্য-পুত্র নিজেকে কাবাকা হিসেবে ঘোষণা দিলেও গোত্র প্রধানরা তাকে অবরুদ্ধ করে এবং দ্রুত আগুনে নিক্ষেপ করে। সুন্নাহর সম্মানে যত দ্রুত এই সৌধ নির্মাণ করা হয় তত দ্রুতই তার সন্তানদের পুড়িয়ে মারা হয় এবং তত দ্রুতই তার গৌরব ধূলিস্যাৎ হতে শুরু হয়।
সুন্নাহ’র পুত্র মিউতসা ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই যেসব গোত্র-প্রধান তাকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল তাদের কতল করেছিল। অভিষেকের পূর্বেই মিউতসা নানারকম নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন শুরু করেছিল। তার এইসব নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনের পেছনে মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজেকে পিতা সুন্নাহ’র উপযুক্ত উত্তরসূরী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
‘আমার সমাধিস্থ পিতার ইচ্ছা’ ছিল মিউতসার জীবনের ব্রত। যদি আমি মিউতসার সৌধ আগে না দেখতাম তবে হয়তো সুন্নাহ’র সৌধকেই আমার দেখা সবচেয়ে নয়নাভিরাম খড়ের স্থাপত্য-কর্ম হিসেবে বিবেচনা করতাম। মিউতসার সময়ে হয়তো এই সৌধটি যথেষ্টই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেই সময় হয়তো লাল মাদুরে নারীরাও অপেক্ষারত থাকত। এখন কোন অপেক্ষারত নারী নেই। প্রাণের কোন স্পন্দনও নেই। মৃত রাজা এখানে এখন সত্যিই বিপত্নীক, নরবলীর মধ্য দিয়ে স্থাপিত সৌধ এখন প্রায় অর্থহীন হয়ে পড়েছে। এই সৌধে এখন বৃষ্টি নামলে ছাদ দিয়ে পানি ভেতরে প্রবেশ করে, সৌধের ছাদে জন্ম নেয়া নানারকম লতা-গুল্মের ঝোপের কারণে সেখানে সাপেরা আবাস তৈরি করেছে এবং যে পবিত্র ঝুলিতে মিউতসার নাড়ি, চোয়াল এবং বিশেষ অঙ্গসমূহ রাখা হয়েছিল সেই ঝুলিও যথাস্থানে নেই। যে বর্শাগুলো সৌধের লোহার র‌্যাকে রাখা ছিল সেগুলো কাল এবং আকারে ছোট। মিউতসার কাসুবি সৌধে আরবদের উপহার দেয়া যে দীর্ঘ এবং রাজকীয় বর্শা দেখা যায় সেই তুলনায় এইগুলো একেবারেই সাধারন। ঐ ছোট আকৃতির বর্শাগুলোর ডানে সুন্নাহ’র বিস্ময়কর ছোট আকৃতির বর্ম এবং তীরের ফলা রাখা আছে। ঐসব বর্ম এবং তীরের মাথা ধুলায়িত এবং নোংরা। অন্ধকারাচ্ছন্ন বলে সেই কথিত পবিত্র স্থানে প্রবেশ না-করলে সেগুলোর অস্তিত্ব জানাও কঠিন ছিল।
আমরা এত ঘুরপথে সুন্নাহ’র সৌধে এসেছিলাম যে আমরা আসলে কাম্পালার কোথায় আছি তা বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু ফেরার পথে পেছনে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিলাম কাম্পালার অনেকগুলো পাহাড়ের একটির চূড়ায় আমরা দাঁড়িয়ে আছি। ধারণা করা হয়েছিল হয়ত সুন্নাহ বা তার আত্মা এই পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে তার শত্রুদের উপর নজরদারি করতে পারবে। কিন্তু এখন আর সেই সুযোগ নেই। উল্টো হতভাগ্য কাম্পালার বস্তিঘর আর আবর্জনা চারপাশ থেকে সুন্নাহ’র সৌধকে চেপে ধরেছে। চারপাশের এই স্বাভাবিক আগ্রাসনকে রুখে দেবার মত কোথাও কোন পদক্ষেপ নজরে পড়েনি।

[অনুবাদকের কথাঃ ভি এস নাইপলের এই পুস্তকটি কোন এক বিমানবন্দরের বুক স্টোর থেকে সংগ্রহ করা। অনেক দিন ধরে খুব ধীরে ধীরে আমি পাঠ করে যাচ্ছি। পাঠ করার সময় মনে হলো এই পাঠ-অভিজ্ঞতা শেয়ার করা মন্দ হবে না। একটা দায়িত্ববোধের মধ্যে নিজেকে আটকে রাখলে বই পড়ার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা সহজ হয়। সেই ভাবনা থেকে অনুবাদ শুরু করি। এই বইয়ে রয়েছে ‘আফ্রিকান বিশ্বাস’কে কেন্দ্র করে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন ভ্রমন-বিষয়ক প্রবন্ধ। প্রতিটি প্রবন্ধ আবার অনেকগুলো অধ্যায়ে বিভক্ত। পাঠকের এবং নিজের সুবিধার্থে লাইন বাই লাইন অনুবাদ না করে, মূল তথ্য অবিকৃত রেখে বইটির বিষয়বস্তুর একটি ভাবানুবাদের চেষ্টা করা হয়েছে। তিনশত পঁচিশ পৃষ্ঠার ‘দ্যা মাস্ক অব আফ্রিকা’র ঠিক কত পর্ব পর্যন্ত চালিয়ে যেতে পারব জানি না। মতামত জানাতে পারেন : onemasud@gmail.com]

আরো পড়তে পারেন

একাত্তরের গণহত্যা প্রতিহত করা কি সম্ভব ছিল?

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই এক রাতেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে….

ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

আগের পর্বে পড়ুন— চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও একটি সার্থক গণআন্দোলন। এই গণআন্দোলনের মূল চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হলো দেশপ্রেম থেকে জাত সেই অনুভূতি, যার একটি রাজনৈতিক প্রকাশ রয়েছে। আর, বাঙালি জাতিসত্তাবোধের প্রথম রাজনৈতিক প্রকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে দুই হাজার মাইল দূরত্বের….

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল)

আগের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ একুশের আবেগ সংহত থাকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দেও। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। আওয়ামি লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ১৮ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটির সদস্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র….

error: Content is protected !!