‘আমার মনে আছে, আমরা তখন হংকংয়ে থাকি; আমার বয়স পাঁচ। ছুটির দিনে আমরা সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে যেতাম। সমুদ্রের পাড়ে বাবা মাঝে মাঝে ছবি আঁকতেন। সেদিন তিনি বেশ অস্থির ছিলেন। বললেন, “আমার দেশ পুড়ছে আর আমি বসে ছবি আঁকছি।” বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছবি তুলতে কিংবদন্তি ফটোসাংবাদিক কিশোর পারেখের আকুতি দেখতে পাই তাঁর ছেলে স্বপন পারেখের এই স্মৃতিচারণে। ২০১৫ সালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্বপন এসব কথা বলেন। স্বপন নিজেও ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটো পুরস্কার প্রাপ্ত আলোকচিত্রী।
তারপর কিশোর পারেখ কোনো অ্যাসাইনমেন্ট ছাড়া, নিজের খরচে- শুধুমাত্র বিবেকের তাড়নায় ডিসেম্বরের শুরুর দিকে মুম্বাই পৌঁছান। সেখান থেকে কলকাতা হয়ে যান ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে। কিন্তু বেসামরিক লোকজনের সীমান্ত পার হওয়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ছিল। তখন তিনি একটি সামরিক হেলিকপ্টার দেখতে পেলেন। হেলিকপ্টারটি ঢাকা যাচ্ছিল। এক মেজরকে কিশোর অনুরোধ করলেন, যাতে তাকেও সঙ্গে নেয়া হয়। মেজর রাজি হলেন না। ২০০৮ সালে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর এন্টার ম্যাগাজিনের একটি লেখায় কিশোর পারেখের সহধর্মিনী সরোজ পারেখ জানিয়েছেন, তখন কিশোর পারেখ মেজরকে বলেছিলেন, ‘আমাকে এখানে মেরে রেখে যাও অথবা সঙ্গে করে নিয়ে চলো।’ মেজর কিশোরকে সঙ্গে না নিয়ে পারেননি। তারপরের মাত্র পাঁচ থেকে সাত দিন মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের জন্মের মুহূর্তগুলো পরম মমতায় ক্যামেরাবন্দি করলেন কিশোর।
ভারত সরকারের সহযোগিতায় পরের বছর জানুয়ারিতে সেই ছবিগুলো বই আকারে প্রকাশিত হয়। শিরোনাম- বাংলাদেশ: এ ব্রুটাল বার্থ। পেপারব্যাক বইটি প্রকাশ করে হংকং-এর ইমেজ ফটোগ্রাফিক সার্ভিসেস। ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় মোট ২০ হাজার কপি বই প্রকাশ করা হয়েছিল। মোট ৫৮টি মর্মস্পর্শী সাদাকালো আলোককচিত্রকর্ম। কিশোর পারেখ বইটি উৎসর্গ করেছেন, ‘তাদের উদ্দেশ্যে যারা ভুক্তভোগী।’ বইটির ভূমিকা লিখেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক এস মুলগাওকার। প্রতিটি ছবির কাব্যিক ক্যাপশন লিখেছেন কিশোর পারেখ নিজেই। বইয়ের শেষের দিকে সহকর্মীদের ধন্যবাদ জানানো ছাড়া কিশোরের আর কোনো কক্তব্য নেই। ছবিতেই বলেছেন যা বলার।
ষাটের দশকের ফটোসাংবাদিকতায় এক অবিস্মরণীয় নাম কিশোর পারেখ। ভারতবর্ষীয় ফটোসাংবাদিকতায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাকে ভারতের প্রথম ফটোসাংবাদিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। ভারতে ছবির সঙ্গে আলোকচিত্রীর নাম ছাপানোর রেওয়াজও তিনি শুরু করেন। তাঁর হাত ধরেই ভারতীয় সংবাদপত্রে বড় বড় ছবি ও ছবি দিয়ে গল্প ছাপানোর দ্বার উন্মোচিত হয়। এই কর্মবীর ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধ, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, বিহারের দুর্ভিক্ষ (১৯৬৬-৬৭) এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছেন। আর রঘু রাই ও পাবলো বার্থোলোমিউয়ের মতো অনুজ আলোকচিত্রীদের অনুপ্রাণিত তো করেছেনই। তবে তাঁর সব ছবিকে ছাপিয়ে গেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সিরিজ। বিশ্বখ্যাত ফটোসাংবাদিক পাবলো বার্থোলোমিউয়ের মতে, ‘বাংলাদেশ’ কিশোরের সর্বোচ্চ কাজ। কিশোর পারেখের ছেলেরও একই মত।
বাঙালির দুর্দশা ছবিগুলোতে প্রাধান্য পেয়েছে। ছবিগুলো দেখা শেষে বাংলাদেশ নামের নবজাতকের জন্মের প্রসব যন্ত্রণা আঁচ করেন দর্শক। বাংলাদেশের উদ্বাস্তু মানুষগুলোর বিবর্ণ মুখের ছবিগুলোর সামনে থমকে যেতে হয়। হতভাগা মানুষগুলোর সঙ্গে দর্শকের যোগাযোগ তৈরি হয়।
তৎকালীন পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্রের বর্বরতাকে বিশ্ববাসীর কাছে নগ্ন করেছে কিশোরের ছবি। কিছু ছবি তো নিদর্শন হিসেবে রয়ে গেছে। এক বাঙালির লুঙ্গি খুলে শিশ্ন পরীক্ষা করছে এক পাক সেনা সদস্য, রাস্তায় পড়ে থাকা রক্তাক্ত অর্ধনগ্ন শিশু, রাস্তার বেওয়ারিশ লাশের দিকে বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে আছে এক পথশিশু, রায়ের বাজার বদ্ধভূমিতে পড়ে থাকা লাশের পর লাশ, কুকুর ও কাকের শব খুবলে খাওয়ার দৃশ্য…।
বীরত্বের গল্পও শুনিয়েছেন আলোকচিত্রী। ওই যে- পুরোনো ঢাকার সুনসান গলি ধরে নিঃশব্দে দুই গেরিলা যোদ্ধা এগিয়ে যাচ্ছে, তাঁদের পেছনে পড়ে আছে পালিয়ে যাওয়া অথবা নিহত হওয়া এক পাকসেনার বুট। ছবিটি মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের প্রতীক হয়ে আছে। রাইফেলের মাথায় বাংলাদেশের পতাকার ছবিটিও মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক হিসেবে আমরা এখনো ব্যবহার করি। কিশোর যুদ্ধ শেষের দৃশ্যাবলিও বিস্তারিতভাবে ফিল্মবন্দি করেছেন।
বইটি শেষ হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের একটি অপূর্ব দৃশ্য দিয়ে। বিকেলের আলোয় ঝলমল করছে সরিষার ক্ষেত, সেই ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে একটি গরুর বাছুরের পেছনে দৌড়াচ্ছে দুটি শিশু। সিল্যুয়েট (কালো অবয়ব) ছবিটিতে নতুন দেশের প্রতিচ্ছবি জ্বলজ্বল করছে। অবিস্মরণীয় যাত্রার শুরুটা ছিল বেদনাদায়ক, তা শেষ হলো চোখ ভিজে আসা আনন্দ দিয়ে। এমন সুপরিকল্পনা কিশোর পারেখদের মতো প্রজ্ঞাবান আলোকচিত্রীদের পক্ষেই সম্ভব।
কিশোর পারেখের জন্ম ১৯৩০ সালে, ভারতের গুজরাটে। ১৯৬০ সালে তিনি লস এঞ্জেলেসের ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া থেকে চলচ্চিত্র এবং ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফিতে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে ১৯৬১ সালে প্রধান আলোকচিত্রী হিসেবে হিন্দুস্তান টাইমস-এ যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে যোগ দেন হংকং-এর এশিয়া ম্যাগাজিন-এ। পরে প্যাসিফিক ম্যাগাজিনস লিমিটেড-এর আলোকচিত্র সম্পাদক হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন এবং সেখানেই ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ছিলেন। তারপর ভারতে ফিরে বিজ্ঞাপনী ফটোগ্রাফি শুরু করেন। ১৯৮২ সালে হিমালয় অঞ্চলে ছবি তুলতে গিয়ে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বাংলাদেশ: এ ব্রুটাল বার্থ বইটি এখন দুষ্প্রাপ্য। যে সাক্ষাৎকারের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তাতে স্বপন পারেখ জানিয়েছিলেন, তাদের কাছে মাত্র দুটি কপি অবশিষ্ট আছে। গুগল করলে বইটির পিডিএফ সংস্করণ পাওয়া যায়, কিন্তু তা অস্পষ্ট। এই বইয়ের ছবিগুলো অনেকেরই অদেখা রয়ে গেছে। খোদ ভারতেই এই বইয়ের ছবিগুলো নিয়ে প্রথম প্রদর্শনী হয় কিশোর পারেখের মৃত্যুর ৩৩ বছর পর!
বাংলাদেশে কিশোরের ‘বাংলাদেশ’-এর প্রদর্শনী হয়েছে কিনা জানা নেই। বইটিও যেন উধাও। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার কিশোর পারেখকে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ (মরণোত্তর) প্রদান করে। তবে কিশোরের স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্রকৃত অর্থে সম্মান জানানো যাবে তখন, যখন তাঁর আলোকচিত্রিক বাংলাদেশকে আমরা নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে পারবো। সেই ‘বাংলাদেশ’ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে এখনই।