Author Picture

শহীদ সাবেরের ‘আরেক দুনিয়া’ (পর্ব-২)

মযহারুল ইসলাম বাবলা

কয়েদি আছে প্রায় শ’তিনেক। খুনি আসামি, রেপ কেস, ডাকাতি সব ধরনের সাজাওয়ালা। পকেটমার, দাঙ্গাবাজ থেকে শুরু করে সরকারবিরোধী প্রচারপত্র বিলির আসামি সবাই আছে। কারও ছ-মাস, এক বছর, পাঁচ বছর, দশ বছর, এমনকি পঁচিশ বছরের সাজাওয়ালাও কয়েকজন আছে। সশ্রম কারাদণ্ডভোগীরা কাজ করে। দড়ি পাকানো থেকে জল তোলা, মাটি কোপানো সব ধরনের কাজ।

তরিকারির বাগান আছে। জেলের মধ্যে সরকার বাহাদুরের আয় হয় প্রচুর।

যেদিন থেকে শাস্তি হবে, সেদিন থেকে হাজতির পোশাকের বদলে আসবে ডোরাকাটা কয়েদির পোশাক। একটি লম্বা পায়জামা, একটি হাফ প্যান্ট; আর একটি বস্তা সদৃশ্য গায়ের জামা। মশারি নেই। কাউকে কাউকে দেখা যাবে, সারা গায়ে যেন বসন্ত হয়েছে। আসলে ওটা মশার কামড়। এমন ধারা ভুল প্রায়ই হবে। বাইরে থেকে আত্মীয়স্বজন জামা দিলেও, কয়েদিরা তা পরতে পারবে না। মশারি টাঙ্গিয়ে শুতে হলে ৫০ জনের ওয়ার্ডে ৫০ জন রাখা যাবে না।

খাদ্যের পরিমাণ কয়েদদের জন্য হাজতিদের চেয়ে বেশি। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। হাত বদল হয়ে দাঁড়ায় সেই একই।

জেলের মধ্যে অপরাধের জন্য শাস্তি আছে প্রচুর। সব চেয়ে ছোট শাস্তি হল মার্কা কাটা। এক দিক দিয়ে একটা আবার সব চেয়ে বড় শাস্তি। ভালো কাজের জন্য কিছু দিন ‘রেমিশন’ মিলবে। যতদিন রেমিশন মিলবে, ততদিন আগে খালাস পাওয়া যাবে। আবার জেলের মধ্যে অপরাধের জন্য মার্কা কাটা যাবে। হাসপাতালে ভালো চিকিৎসার বন্দোবস্তু কোনো দিন ছিল না, আজও নেই। রোগীদের অবস্থা খুবই খারাপ। সন্ধ্যা বেলায় হাসপাতালের এক নম্বর ওয়ার্ডে দেখা যাবে, দাগি আসামি, ‘মেট’ পাহারা-এরা সবাই বসে গেছে-গল্প গুজব শুরু করেছে। গল্প চলে অতীত দিনে কে কটা ডাকাতি করেছে, নারী ধর্ষণ করেছে ইত্যাদি। সব চেয়ে জঘন্যতম বিষয়গুলো এমন অবলীলায়ক্রমে বর্ণনা করে যায়- ভাবতে অবাক লাগে।

বিড়ি হচ্ছে জেলের মধ্যে এক অতি ভয়ংকর জিনিস। জেলে বিড়ি পাওয়ার নিয়ম নেই কয়েদিদের। বিড়ি দিয়ে না করানো যায় এমন কাজ নেই।… ছোট অল্প বয়সের ছেলেরা, যারা হঠাৎ কোনো অপরাধ করে (বা না করে) জেলে এসেছে, তারা এক শ্রেণীর বিকৃত যৌনচেতনা সম্পন্ন ‘স্বভাব অপরাধীদের’ কাছে দেহ বিক্রি করতে শেখে, বিড়ির লোভে। জেল কোডে না থাকলে কি হবে। জেলে বিড়ি আসে হাজারে হাজারে। কর্তৃপক্ষও জানেন তা জমাদারের সঙ্গে জোট থাকে স্বল্পসংখ্যক দাগি আসামি। ব্যবসা চালায় তারা। শুধু বিড়ি কেন, গাঁজা আফিম সবই পাওয়া যাবে। দাগি আসামিরা নিয়মিত টাকা পাঠায় বাড়িতে- এসব ব্যবসা অর্জিত টাকা। নিয়মিত গোপন ডাক ব্যবস্থার মারফত সেগুলো বাড়িতে যায়।

জেল থেকে আবার অনেকে ডাকাতি দলের লোক সংগ্রহ করে- কলাকৌশল উদ্ভাবন করে।

জমাদার, তার ডাণ্ডা, মার্কা কাটা ইত্যাদি গুরুগম্ভীর আবহাওয়াতে মিলে এখানে ভীষণ ভীষণ ত্রাসের জাল বোনা আছে চারধারে। এ ভেঙে প্রতিবাদ করা সোজা নয়। কিন্তু ভয় দেখিয়ে পেটের খিদে নিবারণ করা যায় না। তার জন্য খাদ্যই দিতে হবে। প্রথমে লোক পেটের দায়ে চুরি করে। তখনও সে চোর হয় না। চুরি তাদের স্বভাবে পরিণত হয় অনেক পরে।

অপরাধীর শোধন এখানে হয় না- আরও বেশি করে অপরাধে প্রবৃত্তি জন্মে। আলি আহমদ বলে, সে বাইরে গিয়েই পকেট কাটবে। নইলে সে খাবে কি? কাজ তো পাওয়া যাবে না কোনো।

সন্ধ্যা বেলায় হাসপাতালের এক নম্বর ওয়ার্ডে দেখা যাবে, দাগি আসামি, ‘মেট’ পাহারা-এরা সবাই বসে গেছে-গল্প গুজব শুরু করেছে। গল্প চলে অতীত দিনে কে কটা ডাকাতি করেছে, নারী ধর্ষণ করেছে ইত্যাদি। সব চেয়ে জঘন্যতম বিষয়গুলো এমন অবলীলায়ক্রমে বর্ণনা করে যায়- ভাবতে অবাক লাগে।

অব্যবস্থা, ঔদাসীন্য, মারধর, জুলুম ইত্যাদি মিলে, কয়েদিরা নিজেদের কথা ভাবতে শুরু করেছে। আলি আহমদ বলেছে- ‘গিঁট শক্ত করতে গিয়ে, দেখো একদিন ফস করে ছিঁড়ে যাবে।’ এক নম্বর, দু নম্বর… পাঁচ নম্বরের পরেই জানানা ফাটক। জানানা ফাটকের পর গুদাম ঘর। গুদাম ঘরের পাশ দিয়ে ঘেরাও করে দেয়াল উঠে গেছে। এ যেন জেলের ভেতর আর এক জেল-আমের ভেতর টাম। পরিসরে দেয়াল ঘেরা এই অংশটি সব দিক দিয়েই জেলের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন। বাইরে থেকে কেবল ওয়ার্ড মধ্যস্থ বিশাল মেহগনি গাছ দেখা যাবে। এটা হচ্ছে অপরাধের প্রায়-শুধু আছে। তবে কমিউনিস্ট ওয়ার্ড হবে এখানে, যদি আইনের চোখে দোষী সাব্যস্ত হয় তারা।

বিশাল মেহগনি গাছের গুঁড়িটার আশপাশে কারা থাকে, সেটা জেনে ভেতরে থেকেও দেখার উপায় নেই। কারণ বলছি; এটা হচ্ছে কারার ভেতর আর এক কারা দুয়ারে পাহারা দাঁড়িয়ে আছে; সর্বক্ষণ দুয়ারটি বন্ধ।

জিজ্ঞেস করে জবাব পাওয়া যাবে এটি কমিউনিস্ট ওয়ার্ড বা রাজবন্দি ওয়ার্ড। আগে এর নাম ছিল ডিভিশন। এখন জেলের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই জানে, এখানে যারা থাকে তারা কমিউনিস্ট। সেপাই সান্ত্রী থেকে জেল কর্তৃপক্ষ পর্যন্ত সবাই বলে কমিউনিস্ট ওয়ার্ড।

সম্প্রতি এখানে কমিউনিস্টরাই শুধু আছে। তবে কমিউনিস্ট বলা ঠিক নয়, কারণ কমিউনিস্ট ছাড়া আরও অন্য সরকারবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে। তারা সবাই থাকবে এখানে। অতএব রাজবন্দি ওয়ার্ড বলাটাই অধিক যুক্তিসঙ্গত। হলে কি হবে, ‘রাজবন্দি’ কথাটি সাধারণ কয়েদি-হাজতিদের মুখে আসে। ইদানিং ‘কমিউনিস্ট’ কথাটা বহু প্রচলিত। তাই সহজ হয়ে গেছে এর প্রচলন।

কমিউনিস্ট ওয়ার্ডের দরজা খুলে গেল। ধরুন আপনি ঢুকে পড়লেন ভেতরে। কমিউনিস্টরা অসূর্যস্পশ্যা। এখানে কেউ আসতে পারে না। পায়খানা পরিষ্কার করার লোক থেকে ঝাড়–দার পর্যন্ত সবাই কমিউনিস্ট হয়ে গেছে। তাদেরও ওয়ার্ডের বাইরে যাওয়ার নিয়ম নেই। সবাই থাকবে ভেতরে। জেলকোর্ডে নিয়ম আছে, কিছু দিন পর পর বেসরকারি পরিদর্শক আসবেন ভেতরে। দু’জন পরিদর্শক ঠিক করাই আছে। এরা দু’জন ঘুরে ফিরে জেল দেখতে আসেন। কিন্তু ওয়ার্ডে আসেন না, আসা নিষেধ। অর্থাৎ বিনানুমতিতে সবারই প্রবেশ নিষিদ্ধ। তবু ভাগ্য গতিকে যদি ঢুকতে পারেন তবে প্রথমেই যা চোখে পড়বে তা হচ্ছে বিশাল মেহগনি গাছের গুঁড়িটার চারপাশে ইট দিয়ে গোলাকার বেদি তোলা। শীতকালে যখন রোদ পড়ে তখন বেদির ওপর বসে দাবা খেলতে বেশ আরাম লাগে। অথবা গল্প করা চলে এখানে বসে বসে। মেহগনি গাছেই স্নানের ‘নাহার’। তারপাশেই পাকের ঘর। পেছনের দিকে পায়খানা। এখান থেকে সংলগ্ন গোয়েন্দা বিভাগের আপিসটা পরিষ্কার দেখা যায়। ডাক দিলে শোনা যায়, এত কাছে।

তারপরে লম্বা হল ঘরটার মাঝখানে পার্টিশন করা। তার ফলে দুটো ওয়ার্ডের সৃষ্টি হয়েছে; বস্তত একটিই ওয়ার্ড। এই হল বাইরের দিক থেকে দেখার জিনিস।

সবশুদ্ধ, এটি আর একটি জেল যেন; যদিও আকারে অনেক ছোট। সারা জেলের অন্যান্য অংশের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের পর কেউ যদি এখানে আসে তবে অবাক হয়ে যাবে সে, নতুন জায়গায় নতুনত্বেও বটে আর ব্যবস্থাপনার উৎকর্ষেও।

এ পৃথিবীর লোকসংখ্যা বেশি না। মোট জনা বাইশের মতো হবে- কয়েকজন হাজতি-কয়েদিও আছে অন্তর্কারায়।

মেহগনি গাছের গুঁড়ির কাছে এক বুড়ো বসে আছে; অদূরে ঝাড়–খানা পড়ে। বুড়োর কাজ ওয়ার্ডটিকে পরিষ্কার রাখা। ডাকাতি কেসের আসামি। নাম ফজলুর রহমান- ও কিন্তু বলে ২লোকে ওকে মিথ্যা মিথ্যা ধরিয়ে দিয়েছে। বুড়োর পাঁচ বছরের সাজা। বেরুবার আশা কম, হয়তো এখানেই মরতে হবে তাকে। কেমন যেন এক ধরনের নিস্ক্রিয় দৃষ্টি দিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে বুড়ো সর্বক্ষণ। কাউকে বিড়ি খেতে দেখলে আশপাশে ঘোরে। চাইতে ভরসা পায় না। ধূমপানকারীর যদি খেয়াল হয়, তবে বুড়োটাকে দেয় বিড়িটা গোড়ার দিকে। নইলে পানবিশিষ্ট বিড়ির টুকরোটা মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে বুড়ো আঙ্গুল আর কড়ে আঙ্গুলের মাঝে চেপে ধরে টানতে টানতে অন্যদিকে চলে যায়। আগুনের আঁচ লেগে হয়তো হাতে সেঁকও লাগে একটু। কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই তাতে।

তারপর আনজু। ওর পদ হচ্ছে ‘ফালতু’। ফালতু কথাটা কাদের দেয়া জানা নেই। তবু শুনতে বেশ লাগে কিন্তু। ফালতুর কাজ হল-পরিচর্যার, তদারকের কাজ। আনজু লোকটি জাহাজি টাইপের মানুষ, শহরের বস্তিবাসী; চার মাস সাজা। চলে যাবে শিগগির।

বিড়ি হচ্ছে জেলের মধ্যে এক অতি ভয়ংকর জিনিস। জেলে বিড়ি পাওয়ার নিয়ম নেই কয়েদিদের। বিড়ি দিয়ে না করানো যায় এমন কাজ নেই।… ছোট অল্প বয়সের ছেলেরা, যারা হঠাৎ কোনো অপরাধ করে (বা না করে) জেলে এসেছে, তারা এক শ্রেণীর বিকৃত যৌনচেতনা সম্পন্ন ‘স্বভাব অপরাধীদের’ কাছে দেহ বিক্রি করতে শেখে, বিড়ির লোভে। জেল কোডে না থাকলে কি হবে। জেলে বিড়ি আসে হাজারে হাজারে।

তারপর আসে ফকির। সবাই ডাকে চাচা বলে। লোকটা একটু পাগলাটে। ওর বৌকে কে যেন জোর করে ধরে নিয়ে গেছে। বিচার হয়নি তার। রাগ হল তার ভীষণ। বৌ কেড়ে নিল জোর করে, গ্রামের ইতর ভদ্র লোক কেউ তার বিচার করল না। ফকির তাই ভাবলে গ্রামশুদ্ধ লোক সবাই যখন অপরাধী, তখন সবাইকে দিতে হবে শাস্তি। তাই গ্রামের স্কুল ঘরটি জ্বালিয়ে দিতে এসেছে সে জেলে। মাথা খারাপ লোক কখন কি বলে তার ঠিক নেই। নিজেকে সে জাহির করে মারফতের সাধক হিসেবে। যেই শোনে সেই হাসে। স্থানীয় এক বিখ্যাত গ্রাম্য কবির আধ্যাত্মিক গানগুলো ওর কণ্ঠস্থ।

‘…’ এর নাম করা ডাকাত সুলতানের পদ হল বাবুর্চির। তবে রান্না তাকে করতে হয় না, জোগান দেয় সে। রান্নার কাজটুকু রাজবন্দিরা নিজেরাই করে। সুলতানের চোখমুখ দেখেই বোঝা যায় ভয়ংকর প্রকৃতির লোক। দুটো বিয়ে। তাছাড়া ইতিপূর্বে আরও করেছে। ‘বুঝলি ফজল, সেবার খয়েরপুরে এক ডাকাইতি কইরলাম। ডাকাইতির বাদে আমরা তো গেছি ছুটে বাইশ মাইল দূরে। তিন দিন পর দেখি ঠিক হাজির। তারপর দিল ছ বছর ঠুকে। এখন আর একটা খবর পেয়েছি। গিয়েই আর এক ধাক্কা চালাব।’ কথাগুলো বেশ নির্লিপ্তভাবে বলে যায় সুলতান।

হাসেম হচ্ছে দ্বিতীয় নম্বরের পাহারা। লম্বা চওড়া। কালো, ঘন কালো রং ‘….’- এর লোক। লকলকে চেহারা। যখন চলতে শুরু করে তখন মনে হয় যেন ঘড়ির পেণ্ডুলাম।

যুদ্ধের সময়ে জাপানিরা এবং যুদ্ধের পরে মিত্র শক্তি বর্মার প্রচুর অস্ত্র-শস্ত্র ফেলে এসেছিল। সেগুলো ওখানকার অধিবাসীরা পুঁতে রেখেছিল- এখন ব্যবহার করা হচ্ছে বিদ্রোহের কাজে। হাসেম বিদ্রোহী নয়। তবু তার ঘরেও কিছু অস্ত্র, যেমন একটি ভাঙা রাইফেল, একটি ব্রেনগান ইত্যাদি ছিল-সেই সূত্রেই গ্রেফতার হয়েছে ও। সাজা হয়েছে দু-বছরের। অসাধারণ সরল প্রকৃতির লোক, ঠাট্টা করে সবাই ডাকে হাসবি। হাসেম কিছু মনে করে না। শুধু হাসে-আর কালো হাঁড়ির তলার মতো জমকালো মুখখানা ভেদ করে দুখানি ভুট্টার দানা বিকশিত হয়।

তারপরে আসে রাজনৈতিক বন্দিদের প্রসঙ্গ। সরকারি বন্দিদের ভাগ করেছেন দু’ভাগে। বিচারাধীন সাধারণ হাজতিদের সঙ্গে থাকত আগে। তাদের পৃথক কোনো রাজনৈতিক সত্তা স্বীকার করা হতো না। সেই আধপেটা খাওয়া, অনাচার পীড়ন, সব কিছুই চলত তাদের ওপর।

কিন্তু জেলখানায় বোবা মানুষের ভাষা প্রকাশের একটি অদ্ভুত হাতিয়ার আছে। সেটি হল ভাত না খাওয়া। কেউ হয়তো স্কুলের ছেলে ছিল, কেউ কলেজের। বাচ্চা ছেলেরা বুঝেছিল সেটা। একটার পর একটা অনশনের পর তারা রাজনৈতিক বন্দি ওয়ার্ডে এসেছেন।

এখন রাজনৈতিক হাজতি-কয়েদি বিশেষ নেই। আগে ছিল প্রচুর। তাদের দু’জন শেষ পর্যন্ত রয়েছেন। একজন এখন সবে কৈশোরের গণ্ডি পেরিয়েছে- হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। চোখে-মুখে অভিযাত্রিক ভাব পরিস্ফুট। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সম্প্রতি পাওয়া পূর্ণ বয়সের ব্যঞ্জনা।

তারপর আসে কবি। কবিকে আপনারা চিনে থাকবেন। ‘মাশরেকী’ পত্রিকায় চাকরি করতেন। কবিতা লেখেন। সব রকমের কবিতা। কবিতায় হাত না পাকলেও সমাজ-সচেতন রচনা সৃষ্টির দিকে একটা সুস্পষ্ট প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তিগত জীবনে কবি এখনও অস্থির আর রোমান্টিক। মুখে আড় নেই কোথাও। জীবনে লুকানোর মতো তার কিছুই নেই। সব কিছুই তিনি পরিষ্কার বলেন। সবাই ডাকে তাকে কবি সাহেব, কয়েদি-হাজতিরা ‘কবি’ বোঝে না। বলে কবির। কবির থেকে কবিরদা; শেষে কবির আহমদ পরিণত হয়েছেন তিনি।

রাজনৈতিক কর্মীদের সংস্পর্শে এসে তার চিন্তা জগতে প্রচুর পরিবর্তন হয়েছে। মার্কসবাদী জীবন দর্শন সম্বন্ধে সঠিক ধারণা না থাকলেও কবি একটা সুস্পষ্ট বামপন্থা বেছে নিয়েছেন। পশ্চিমী গণতন্ত্রের সঙ্গে যে শব্দাবলী অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত তার একটি হচ্ছে ‘নিরাপত্তা’ আটক বন্দিদের আটকানামায় লেখা আছে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা।

মার্কসবাদীদের কাছে শোনা যায়, রাষ্ট্রশক্তি হচ্ছে শাসকশ্রেণীর একটি যন্ত্র, যা কেবল শাসকশ্রেণীর স্বার্থই রক্ষা করে। অতএব এক্ষেত্রে নিরাপত্তা বলতে তারা বোঝেন স্বার্থের নিরাপত্তা। এই নিরাপত্তার ব্যাঘাতকারী হিসেবে যারা বন্দি হয়েছেন তাদের পদবি ‘নিরাপত্তা বন্দি’।

রাজবন্দি ওয়ার্ডে নিরাপত্তা বন্দি আছেন দশজন। তাদের প্রায় সবারই বাইরে রাজনৈতিক জীবন ছিল। কারও কারও হয়তো তা ছিল না। তাদের মধ্যে আছেন বুদ্ধিজীবী, ভূতপূর্ব সন্ত্রাসীবাদী, কৃষক, ছাত্র, সমাজকর্মী, শ্রমিক, পুস্তক বিক্রেতা প্রভৃতি।

চলবে… 

আরো পড়তে পারেন

ভাষা আন্দোলন ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতি (সব পর্ব)

ভাষা আন্দোলন ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতি ভাষা আন্দোলনের পর্যায় বিশ্লেষণ সূচনা ও বিকাশ পর্ব (১৯৪৭-১৯৪৮) বায়ান্নর প্রস্তুতি পর্ব (১৯৪৯-১৯৫১) বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

হারুন আল রশিদের সৃষ্টির ভুবনে ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’

হারুন আল রশিদ দুই দশকের বেশি সময় ধরে গদ্য সাহিত্য রচনার আধুনিক কলা-কৌশল রপ্ত করেছেন। বিশ্ব সাহিত্যে স্থায়ী অবদান রাখা শতাধিক লেখকের উপন্যাস তিনি নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করেছেন। ইংরেজিতে লেখা তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহৎ উপন্যাস, The Memoirs of An Unrequited Love ও The River Flows Upstream, নতুন আঙ্গিকে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। ইংরেজি ভাষায় এ যাবৎ….

রাজীব সরকারের সৃষ্টির ভুবন

রাজীব সরকার এই সময়ের শক্তিমান লেখক। প্রাবন্ধিক হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও, সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তার কাজগুলোও সমান গুরুত্বের দাবি রাখে। বিতর্ক বিষয়ে রাজীব সরকারের একাধিক বই মেধাবী তরুণদের প্রয়োজন মিটিয়েছে। খুব অল্পসময়ের মধ্যেই তার রম্যরচনার আলাদা পাঠকশ্রেণি গড়ে উঠেছে। গল্প ভ্রমণকাহিনি ও লিখেছেন। চলমান বিষয়ে দৈনিক পত্রিকায় মতামতধর্মী কলামও লিখে থাকেন বিভিন্ন সময়ে। জন্ম কিশোরগঞ্জ….

error: Content is protected !!