Author Picture

কিম কি দুকের ‘বো’ : বাসনার মর্মভেদী সিনেকবিতা

জাহেদ সরওয়ার

“Strength and a beautiful sound like in the tautness of a bow. I want to live like this until the day I die.”

কোরিয়ার সমুদ্র উপকুলের কাছাকাছি ৪০ ফুটি একটা বোটের ওপরের ঘটনা। যেটার পরিচালক এক বৃদ্ধলোক। এখানে পর্যটকরা মাছ ধরতে আসে। তার সাথে আছে ১৬ বছর বয়সী এক অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়ে যাকে বৃদ্ধলোকটি তার যৌবনে কুড়িয়ে পেয়েছিল। যখন মেয়েটির বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর। যার মাবাবা তাকে এখনো খুঁজছে। এতদিনে বৃদ্ধলোকটির সর্বাত্মায় পরিণত হয়েছে মেয়েটি। সে পরিকল্পনা করে রেখেছে যে মেয়েটার বয়স ১৭ বছর হলে তাকে সে বিয়ে করবে। দুজনেরই মুখেই কোনো সংলাপ নাই। বৃদ্ধলোকটি নিয়ম করে মেয়েটাকে দিকে পাশ থেকে গুণে গুণে তিনটি তীর ছুড়ে। এবং নিয়ম করে ভায়ালিন বাজিয়ে শোনায় মেয়েটাকে। নিয়ম করে তিনি গোসলও করিয়ে দেন।

একদিন এক মাছশিকারী ট্রলারে করে খুবই সুদর্শন দেখতে এক ছাত্র আসে। মেয়েটা প্রথম দেখাতেই তার প্রেমে পড়ে যায়। ছেলেটাও তাই। ছেলেটার সাথে মেয়েটার আচরণ বৃদ্ধকে চিন্তিত ও আহত করে তোলে। সে খুব সতর্কতার সাথে ক্যালেন্ডারে তারিখ কাটতে থাকে। আর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে যে কবে সতের বছর শেষ হবে। এক পর্যায়ে ছাত্রটাকে প্রায় জোর করে লোকটি তার ছোট বোটে করে তীরে রেখে আসে। কিন্তু কিছুদিন পর ছাত্রটি আবার ফিরে আসে। যখন সে মেয়েটিকে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য ছোট বোটে চড়ে বসে। তখন বৃদ্ধটি নৌকা বাধার দঁড়িটি তার গলায় পরে আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে। কারণ মেয়েটাকে ছাড়া তার বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নাই।

বোটটি আস্তে আস্তে ফিরে আসে মূল বোটের কাছে যেখানে ছাত্রটি তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। বোটটি মূল বোটের সাথে আসার পর ছেলেটা বোটে মেয়েটিকে ঘুমন্ত দেখতে পায়। এর মাঝেই মেয়েটা শীৎকার করতে থাকে, বৃদ্ধ লোকটির অশরীরী আত্মার সাথে। ছেলেটিকে মেয়েটি জড়িয়ে ধরবে ঠিক সেই সময়েই লোকটার ছুড়ে দেয়া তীরটা এসে বিদ্ধ হয় মেয়েটার স্কার্টের নীচের অংশে।

নৌকা ছেড়ে দেবার পরও যখন নৌকা আটকে থাকে তখন মেয়েটার সন্দেহ হলে সে ফের বোটে উঠে দেখে দঁড়িটি বৃদ্ধলোকটির গলায় বাধা। ১০ বছরের জীবন। মেয়েটারও মায়া হয়। মেয়েটা তাকে সহানুভূতি জানায়। লোকটি ধীরে ধীরে জমানো তার বিয়ের কাপড়চোপড় বের করে। মেয়েটাকে কনের সাজে সাজায়। নিজে বরের পোশাক আশাক পরে নেয়। তারপর ছোটবোটটি ছেড়ে দেয় সমুদ্রে। শুরু হয় বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। একপর্যায়ে আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে লোকটি ভায়োলিন বাজাতে থাকে। ভায়োলিনের সুরে মেয়েটা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলে বৃদ্ধলোকটি উপরের দিকে তীর ছুড়ে দিয়ে নিজে ঝাপিয়ে পড়ে সমুদ্রে তলিয়ে যায়।
বোটটি আস্তে আস্তে ফিরে আসে মূল বোটের কাছে যেখানে ছাত্রটি তার জন্য অপেক্ষা করে আছে। বোটটি মূল বোটের সাথে আসার পর ছেলেটা বোটে মেয়েটিকে ঘুমন্ত দেখতে পায়। এর মাঝেই মেয়েটা শীৎকার করতে থাকে, বৃদ্ধ লোকটির অশরীরী আত্মার সাথে। ছেলেটিকে মেয়েটি জড়িয়ে ধরবে ঠিক সেই সময়েই লোকটার ছুড়ে দেয়া তীরটা এসে বিদ্ধ হয় মেয়েটার স্কার্টের নীচের অংশে।

সিনেমাটার শিরোনাম এখানে বাসনার চিহ্নরূপে বিদ্যমান। কিম কি দুকের সিনেমা নিয়ে এমনিতেই আন্তর্জাতিক সমালোচকরা অনেক আশা ব্যক্ত করেন। যেমন তিনি সিনেমায় বৈশ্বিক সাংস্কৃতিক মুভমেন্টগুলোর থিমগুলোকে ব্যবহার করেন। যেটা তার সিনেমার আঙ্গিক, অভিনয়, সংলাপ, সম্পাদনা ইত্যাদিতে খুব সফলভাবেই প্রয়োগ করেন তিনি। এবং তার সিনেমায় সংলাপ পরিহারের ব্যাপারটা একটা ঘটনা বটে। এমনিতে দীর্ঘদিন ধরে বাঘা বাঘা চলচ্চিত্র নির্মাতারা সিনেমা থেকে তার সাহিত্য নির্ভরতাকে পরিহার করার জন্য তাদের লেখায় সিনেমায় বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে আসছেন। সম্ভবত এর সবচাইতে ভাল ব্যবহার করেছেন ফরাসি নিউ রিয়ালিস্টরা। তাদের মধ্যে ত্রুফো শাব্রেল গদাররা তাদের সিনেমায় সংলাপের পরিমাণ খুবই কমিয়ে এনেছিলেন। সেই সংলাপ পরিমিতির ব্যাপক ব্যবহার করেছেন কিম কি দুক তার সিনেমায়।

কিম কি দুক তার বেশ কয়েকটা সিনেমায় সমুদ্র হ্রদ ও নদীর লোকেশন ব্যবহার করেছেন। বো সিনেমাটায়ও সমুদ্রের মাঝখানে এমন একটি কাঠের ট্রলার যেটা মাছ শিকারি পর্যটকরা ভাড়ার বিনিময়ে বড়শি দিয়ে মাছ ধরতে পারে। আর সেটার হোস্ট এমন এক বয়স্ক মানুষ যিনি গম্ভীর, বলতে গেলে সিনেমায় তার কোনো সংলাপই নাই। কিন্তু তার চোখের চাহনি, ক্রিয়াকলাপ ইত্যাদিই যতেষ্ঠ তার মনোভাব বুঝানোর জন্য। অথবা বৃদ্ধলোকটি আর মেয়েটির যেই বয়েস তাতে কোনো সংলাপ হয় না। সিনেমার যেই নিজস্ব ভাষাভঙ্গির কথা বলা হয় তাও হয়তো তাই। যে এটা একটা আলাদা প্রকাশভঙ্গি সম্মৃদ্ধ মিডিয়া।
কিম কি দুকের সব সিনেমাতেই ছড়িয়ে আছে এর প্রমাণ। সাথে ফ্রয়েডের মনস্তাত্ত্বিক দুনিয়া, চিত্রকলার ইমেজ ও কবিতার সাররিয়ালিস্টিক যেই ব্যবহার তিনি করেছেন তা এক কথায় অসাধারণ।

এ এক ট্রাজিক প্রেমের সিনেমা। যাকে তুলনা করা যেতে পারে গ্রিক ট্রাজেডিগুলার সাথে। দর্শকরা প্রথম দিকে বৃদ্ধ নায়কের প্রতি বিরূপ মানসিকতা থাকলেও শেষে সব সহানুভূতি গিয়ে বর্তায় তার প্রতি। যখন সমস্ত সামাজিকতার শেষে সে নায়িকাকে পাবেনা সেটা মেনে নিয়েই সমুদ্রে ঝাপ দেয়। সংলাপের ব্যবহারে যেই সংযমের পরিচয় দিয়েছেন কিম।

এই সিনেমাটায় সিম্বল হিসাবে যেই তীরের ব্যবহার তিনি করেছেন। যেন পুরা সিনেমাটায় পরস্পর পরস্পরের দিকে তাক করে আছে একেকটি তীর। সর্বপরি নায়ক ও নায়িকার এমন এক বয়সের পার্থক্য যা যে কোনো দর্শক সিনেমাটার মাঝ পর্যন্ত মনে করতে পারেন এটা আসলে দাদা ও নাতনীর কাহিনী। কিন্তু পরে দেখা গেল যে আসলে তারা সম্পর্কে কেউ হোন না। মেয়েটা অপহৃতা আর লোকটা অপহরণকারী। যে কিনা শিশুবেলায় মেয়েটাকে অপহরণ করে এনেছে। আর মেয়েটাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার বাবা মা।

কিন্তু সিনেমার ডিটেল হিসাবে কিম হাজির করেছেন নায়িকাকে ট্রলারের নীচে দোলনায় দোল খাওয়া অবস্থায় নিয়ম করে তীর নিক্ষেপ করা। এবং একটা তীরও নায়িকার দেহ ভেদ না করা। এতে বয়স্ক লোকটির দৃঢ়তা শক্ত হাতে হান্টার ধরা আর চোখের যেই ম্যাজিক তা তৈরি করে এমন এক দুর্বোধ্য মানসিকতার যা একমাত্র কিম কি দুকের দ্বারাই সম্ভব। আর সেই অবস্থায় নায়িকার অসহায় চোখ অথচ আরেক দুর্বোধ্য হাসি দৃশ্যটাকে আরো বেশি রহস্যঘন করে তোলে। আর লোকটার আরেক ভাষা ভঙ্গি হচ্ছে মিউজিক। তিনি যে কোনো মনের অবস্থা জানান দিতে ভায়োলিন বাজান ট্রলারের ডেকের এককোণায়।
তবে সবখানেই লোকটার লক্ষ্যভেদি চোখ আর সবসময় প্রস্তুত তীর মেয়েটাকে অন্য পর্যটকদের হাত থেকে রক্ষা করেছে সবসময়। যদিও তার নিজের তীর লক্ষ্যভেদ করতে পারে নাই এখনো। পুরো সিনেমাটাই এগিয়েছে এই বাসনার তীরকে কেন্দ্র করে। টার্গেট করে তীরবিদ্ধ করতে না পারা। একেতো নায়িকার বয়েস কম দ্বিতীয়ত কোরিয় বিবাহনীতি ১৭ বছরের জন্য অপেক্ষা।

সর্বপরি এ এক ট্রাজিক প্রেমের সিনেমা। যাকে তুলনা করা যেতে পারে গ্রিক ট্রাজেডিগুলার সাথে। দর্শকরা প্রথম দিকে বৃদ্ধ নায়কের প্রতি বিরূপ মানসিকতা থাকলেও শেষে সব সহানুভূতি গিয়ে বর্তায় তার প্রতি। যখন সমস্ত সামাজিকতার শেষে সে নায়িকাকে পাবেনা সেটা মেনে নিয়েই সমুদ্রে ঝাপ দেয়। সংলাপের ব্যবহারে যেই সংযমের পরিচয় দিয়েছেন কিম। মিউজিকের অসামান্য ব্যবহার, লোকেশান আর মনস্তাত্বিক জটিলতা ছবিটাকে করেছে অতুলনীয়। তাই কিম কি দুকের সিনেমা দেখে যে কেউ বলে দিতে পারবে তার ছবি শুধুই কিম কি দুকীয়।

 

আরো পড়তে পারেন

দ্য পিয়ানিস্ট ইয়ানী

পাঁচ তারকা হোটেলের সবচেয়ে ফাইন ডাইন রেস্টুরেন্টে অতিথিকে স্বাগত জানানোর জন্য বসে আছি। বিশ্বের অন্যতম উন্নত, সবুজ শহরের প্রতিনিধি আমাদের আমন্ত্রণে আজ সকালে দেশে এসে পৌঁছেছেন, কাল আমাদের আয়োজিত সেমিনারে বক্তব্য রাখবেন, অনুষ্ঠানের পূর্ববর্তী সৌজন্য ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে যেখানে আমার অফিসের শীর্ষ পদের ব্যক্তিবর্গ এবং একই কমিউনিটির বাংলাদেশের আরও কিছু ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।….

সেকুলার নির্মাতা ইসমত চুগতাই

স্বতন্ত্র স্বর ও নিজস্ব স্টাইলে উর্দূ সাহিত্য ইতিহাসে ইসমত চুগতাই (১৯১৫-১৯৯১) অনন্য উজ্জ্বল এক নাম। ধ্রুবতারা’র মতোই জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল তার শ্রেষ্ঠ সব সৃষ্টিকর্ম। বহুলপ্রজ এ ছোটগল্পকার শিল্প-সাহিত্যে বিশেষ অবদানে অর্জন করেছেন ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী পুরস্কারসহ নানাসব বৃহৎ সম্মাননা। কিন্তু ভারতীয় সিনেমায় তার বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান সম্পর্কে কতটুকু জানি আমরা! কখনো আলোচনা হয় কি….

মেট্রোপলিশ ও আমাদের বস্ত্রকারখানার অস্থিরতা

মেট্রোপলিশ ছবির পরিচালক ফ্রিৎস ল্যাঙকে জার্মান চলচ্চিত্রকার ও তার সব ছবিকে জার্মানির প্রথমার্ধের চলচ্চিত্রের অর্ন্তভুক্ত হিসাবে ধরলেও তিনি জন্ম নিয়েছিলেন অষ্ট্রিয়ায়। অস্থিরতাই বুঝি শিল্পীর নিয়তি ও স্বভাব। কারণ সব সময় একজন শিল্পীকে সৃজনবেদনা তাড়িয়ে বেড়ায়। নতুন কিছু করবার যন্ত্রণায় শিল্পী দগ্ধ হতে থাকে অহরহ। তেমনি অনেক ঘাটের জল খেয়েই তিনি থিতু হয়েছিলেন জার্মানিতে। মেট্রোপলিশ সম্পর্কে….

error: Content is protected !!