Author Picture

লুসি : সিনেমার সিমানা পেরিয়ে

জাহেদ সরওয়ার

স্কারলেট জোহানেস দুর্দান্ত সব বাণিজ্যিক সিনেমার অভিনেত্রি। হলিউডের এখন সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া শিল্পী। অ্যাকশন থ্রিলার, সায়েন্স ফিকশন ছবিতে তিনি অনবদ্য। লুসি সিনেমার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। সিনেমাটি দুর্দান্ত অ্যাকশন দৃশ্যে ভরপুর। টানটান সাসপেন্স। কিন্তু সে অর্থে এটাকে অ্যাকশন সিনেমা বলা যাবে না। কারণ কাহিনি থাকা সত্ত্বেও এটা যেমন কাহিনির চেয়ে বেশি কিছু তেমনি সিনেমার সব লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও এটা যেন সিনেমার চেয়ে বেশি কিছু।

মানুষের মস্তিস্কের ধারণ ক্ষমতা ও তার বিকাশকে কেন্দ্র করে এগিয়েছে এই সিনেমা। তাইওয়ান ভিত্তিক সাধারণ ক্রিমিনালদের একটা গ্যাংয়ের হাতে এসে পড়ে সিপিএইচফোর নামের একটা ড্রাগ। সেটার ক্রিয়া সম্পর্কেই যাদের ধারণা নাই। এটা নিয়ে ইউরোপে ড্রাগ জগতে নাম করাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। এই গ্যাংটি থাইওয়ান ভিত্তিক চায়না মাফিয়ারা নিয়ন্ত্রণ করে। চারজন লোক সংগ্রহ করে তাদের পেঠ কেটে পাকস্থলির নিচে ড্রাগের প্যাকেটগুলো ঢুকিয়ে তাদের পাঠানো হয় বার্লিন, ফ্রান্স ও রোমে। লুসি নামের মেয়েটি একটা অনাখাংকিত ঘটনার শিকার হয়ে জড়িয়ে পড়ে। তারও পেট কেটে ফেলা হয়। তাকেও আমেরিকায় পাঠানোর জন্য রাখা হয় গ্যাংয়ের কিছু মেম্বারদের জিম্বায়।

লুসি সুন্দরী একা বন্দিনি সুতরাং গ্যাং মেম্বাররা তাকে রেপ করতে চায়। সে বাধা দিলে তারা তাকে বেদম মারে। তার পেটে লাথি লেগে পেটের ভেতর থাকা ড্রাগের একটা প্যাকেট ফেটে পাওডারগুলো তার শরীরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে এবং তার প্রতিক্রিয়া শুরু করে।

লুসি সুন্দরী একা বন্দিনি সুতরাং গ্যাং মেম্বাররা তাকে রেপ করতে চায়। সে বাধা দিলে তারা তাকে বেদম মারে। তার পেটে লাথি লেগে পেটের ভেতর থাকা ড্রাগের একটা প্যাকেট ফেটে পাওডারগুলো তার শরীরের ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে এবং তার প্রতিক্রিয়া শুরু করে

এখানে মর্গান ফ্রিম্যান প্রকৃতি বিজ্ঞানী, লেকচারার। ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচাল জা লুক গদার একবার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি ক্যামেরা দিয়ে প্রবন্ধ লিখেন। এই ছবিটাও আসলে গল্পের চেয়ে প্রবন্ধের কাঠামো বেশি। মর্গান ফ্রিম্যান তার লেকচারে বলছেন প্রথমে একটা নিওরনের বিকাশ হল নিশ্চল জীবন। দুটো নিউরন মিলতেই প্রাণি জগতে অনেক ঘটনা ঘটতে থাকে। অথচ মানুষের মস্তিস্কে রয়েছে একশ মিলিয়ন নিউরন। যার মাত্র পনের পার্সেন্ট সক্রিয়। যা একটা মহাকাশের তারকারাজির চেয়ে অনেক গুণ বেশি। মানুষ জন্মের আগে অন্যান্য প্রাণীরা তাদের মস্তিস্কের মাত্র তিনচার ভাগ ব্যবহার করতে পারত। মানুষই সেই উন্নত প্রাণি যারা কিনা তাদের মস্তিস্কের দশভাগ ব্যবহার করতে পারে। আর এই দশভাগ ব্যবহার করেই আজকের মানুষ। মানুষ যদি তার মস্তিস্কের বিশভাগ ক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পারে তাহলে সে নিজের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। আর চল্লিশভাগ ব্যবহার করতে পারলে সে অন্যকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। এর বেশি ব্যবহার করতে পারলে সে পদার্থকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অর্থাৎ আমাদের চারপাশে সবকিছু তার কথা শুনবে। এরপরের কিছু সম্পর্কে তিনি জানেন না। তবে মানুষ ছাড়া আরেকটা প্রাণি মস্তিস্কেও প্রায় বিশভাগ ব্যবহার করতে পাওে সেটা হচ্ছে ডলফিন।

‘লুসি’ ছবির একটি পোস্টার।

এই ড্রাগ আসলে মানুষের মস্তিস্কের ক্ষমতাকে ব্যবহার করার সক্ষমতা বাড়ায়। লুসির শরীরে এটা ক্রিয়া শুরু করে। স্ট্যাপ বাই স্ট্যাপ লুসির মস্তিস্কের ক্ষমতা বাড়তে থাকে। লুসির বিশ পার্সেন্ট হওয়ার সাথে সাথেই সে নিজের সবকিছু মানে কিভাবে তাকে আত্মরক্ষা করতে হবে। কোন দিক থেকে তাকে আক্রমণ করতে হবে। অটোমেটিকালি নিজের ব্যবহার্য সমস্ত যন্ত্রপাতি অপারেটিংয়ের ক্ষমতা চলে আসে। লুসি বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে হাসপাতালে যায়। সেখানে অন্য রোগির অপারেশন হচ্ছিল তখন কিন্তু মনিটরে অপারেটিং স্থান দেখে সে বুঝতে পারে এই রোগিকে বাচানো যাবে না। সো রোগিকে গুলি করে টেবিল থেকে ফেলে দেয়। আর নিজেই টেবিলে শুয়ে পড়ে। ডাক্তার অ্যানেসথেসিয়া দিতে চাইলে সে নেয় না কারণ সে ব্যাথাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

এরপর লুসি দ্বিতীয় চিন্তা হল ড্রাগগুলোকে গ্যাংটার কাছ থেকে নিয়ে গবেষণার কাজে লাগানো। সে গ্যাং লিডারের কাছে ফিরে যায় এবং তার মাথায় দুই বুড়ো আঙ্গুল দিয়েই সে এখন ড্রাগবহনকারীরা কোথায় আছে সেটা সনাক্ত কওে ফেলে। আর নেটে বসে সে প্রকৃতিবিজ্ঞনী মর্গান ফ্রিম্যানকে খুজে বের করে। এরপর কাহিনি মোড় নিতে থাকে।

মর্গান ফ্রিম্যানের তিনচারটি বক্তৃতার দৃশ্য সন্বিবেশিত করা হয়েছে। যে গুলো সিনেমাটাকে প্রবন্ধের মাত্রা দিয়েছে। লুসি খুব দ্রুত এমন এক শক্তি অর্জন করতে থাকে। সে বাতাস থেকে তার ইচ্ছানুযায়ী নেটওয়ার্ক খুজে যোগাযোগ করতে পারে। সে রেডি টিবি মোবাইল ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যখন যার সাথে ইচ্ছা যোগাযোগ তৈরি করতে পারে। বৃক্ষ কিভাবে তার জীবনরস টেনে নেয় পরিবেশ থেকে তা সে বুঝতে পারে। মোট কথা জগতের অদৃশ্য সব যোগাযোগ গুলো সে বুঝতে পারে। এমনকি মস্তিস্কের গভীরের সে চলে যেতে পারে। তুলে আনতে পারে তার জন্মের প্রথম দিনও।

এই সিনেমায় লুসির মস্তিস্কের একশ পার্সেন্ট বিকাশ দেখা যায়। যেখানে ক্লাইমেক্সে মাফিয়ারা লুসিকে খুঁজতে আসে আর লুসি ধীরে ধীরে ড্রাগ গুলোকে উদ্ধার করে। এদিকে তার মস্তিস্কেও ক্ষমতাও ক্রমাগত বাড়তে থাকে। সে মানবজন্মের শুরু তথা বিগব্যংগ পর্যন্ত বুঝতে পারে

এই সিনেমার ফরাসি চিত্র পরিচালক লাক ব্যাসন সায়েন্স ফিকশন নির্মাতা হিসাবে বেশ সুনাম করেছেন হলিউডে। অ্যাঞ্জেলা, ভেলারিয়ানের মত দুর্দান্ত সব ফিকশন বানিয়েছেন তিনি। তিনি শুধু সায়েন্স ফিকশন বানিয়েছেন তা না আনা দ্য লেডির মত ছবিও বানিয়েছেন।

লুসি সিনেমাটায় তিনি জীববিজ্ঞানের উপাত্ত ব্যবহার করেছেন। যদিও তিনি অসামান্য এক প্রশ্ন তুলেছেন কিন্তু আসলেই এটা বিজ্ঞান সম্মত কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যায়। এই সিনেমায় লুসির মস্তিস্কের একশ পার্সেন্ট বিকাশ দেখা যায়। যেখানে ক্লাইমেক্সে মাফিয়ারা লুসিকে খুঁজতে আসে আর লুসি ধীওে ধীওে ড্রাগ গুলোকে উদ্ধার করে। এদিকে তার মস্তিস্কেও ক্ষমতাও ক্রমাগত বাড়তে থাকে। সে মানবজন্মের শুরু তথা বিগব্যংগ পর্যন্ত বুঝতে পারে। তারপর বিবর্তনের ক্রমাগতির পথ সে বুঝতে চেষ্টা করে। একশ পার্সেন্ট হওয়ার সাথে সাথে সে বায়ুর সাথে মিশে যায়। মানে সে সব দেখতে পারে সবই করতে পারে কিন্তু তাকে কেউ দেখতে পায় না। অর্থাৎ সবকিছুতেই তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। বলতে হয় সে ঈশ^রে পরিণত হয়। শেষের দিকে এটাকে কবিতা মনে হয়। আসলে দুনিয়াতে মানুষতো আগে কল্পনা করেছে তারপরই আবিস্কাওে নেমেছে। এটাও এই পথে একটা কল্পনা হতে পারে। তবে বিজ্ঞানের যে ভাবে বিকাশ হচ্ছে হয়ত অচিরেই আমরা লাক ব্যাসনের এই কল্পনাকে বাস্তবে দেখতে পাবো। মানুষ তার মস্তিস্কেও শতভাগ ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু মানুষ সেটার সাথে সাথে তার সেলফিশ জিনকেও বয়ে বেড়াবে। তার সমস্ত আবিস্কার সে যদি মানুষের বিরুদ্ধেই ব্যবহার কওে তবে গ্রহের ভবিষ্যত নিয়েও ভাবার যথেষ্ট অবকাশ আছে। অসাধারণ সিনেমার ভাষায় নির্মিত লুসি বাণিজ্যিক সিনেমা জগতের মাইলফলক। এই সিনেমার পর জোহানেস স্কারলেট নাকি হলিউডের সবচাইতে বেশি পারিশ্রমিক পাওয়া তারকা। এ যেন সিনেমার সীমানা পেরিয়ে যাওয়া সিনেমা।

আরো পড়তে পারেন

দ্য পিয়ানিস্ট ইয়ানী

পাঁচ তারকা হোটেলের সবচেয়ে ফাইন ডাইন রেস্টুরেন্টে অতিথিকে স্বাগত জানানোর জন্য বসে আছি। বিশ্বের অন্যতম উন্নত, সবুজ শহরের প্রতিনিধি আমাদের আমন্ত্রণে আজ সকালে দেশে এসে পৌঁছেছেন, কাল আমাদের আয়োজিত সেমিনারে বক্তব্য রাখবেন, অনুষ্ঠানের পূর্ববর্তী সৌজন্য ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে যেখানে আমার অফিসের শীর্ষ পদের ব্যক্তিবর্গ এবং একই কমিউনিটির বাংলাদেশের আরও কিছু ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।….

সেকুলার নির্মাতা ইসমত চুগতাই

স্বতন্ত্র স্বর ও নিজস্ব স্টাইলে উর্দূ সাহিত্য ইতিহাসে ইসমত চুগতাই (১৯১৫-১৯৯১) অনন্য উজ্জ্বল এক নাম। ধ্রুবতারা’র মতোই জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল তার শ্রেষ্ঠ সব সৃষ্টিকর্ম। বহুলপ্রজ এ ছোটগল্পকার শিল্প-সাহিত্যে বিশেষ অবদানে অর্জন করেছেন ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী পুরস্কারসহ নানাসব বৃহৎ সম্মাননা। কিন্তু ভারতীয় সিনেমায় তার বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান সম্পর্কে কতটুকু জানি আমরা! কখনো আলোচনা হয় কি….

মেট্রোপলিশ ও আমাদের বস্ত্রকারখানার অস্থিরতা

মেট্রোপলিশ ছবির পরিচালক ফ্রিৎস ল্যাঙকে জার্মান চলচ্চিত্রকার ও তার সব ছবিকে জার্মানির প্রথমার্ধের চলচ্চিত্রের অর্ন্তভুক্ত হিসাবে ধরলেও তিনি জন্ম নিয়েছিলেন অষ্ট্রিয়ায়। অস্থিরতাই বুঝি শিল্পীর নিয়তি ও স্বভাব। কারণ সব সময় একজন শিল্পীকে সৃজনবেদনা তাড়িয়ে বেড়ায়। নতুন কিছু করবার যন্ত্রণায় শিল্পী দগ্ধ হতে থাকে অহরহ। তেমনি অনেক ঘাটের জল খেয়েই তিনি থিতু হয়েছিলেন জার্মানিতে। মেট্রোপলিশ সম্পর্কে….

error: Content is protected !!