Author Picture

ভালোবাসার যোগ্য হয়ে ওঠাটা সবার জন্যই উন্মুক্ত : আইন র্যা ন্ড

তৌফিক জোয়ার্দার

রাশিয়ান আমেরিকান ঔপন্যাসিক ও দার্শনিক আইন র্যারন্ড (Ayn Rand) মারা যান ১৯৮২ সালের ৬ই মার্চ। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বই এ্যাটলাস শ্রাগড ও দা ফাউন্টেনহেড প্রকাশিত হয় রঙিন টেলিভিশন বাজারে আসারও আগে- ষাটের দশকে। কিন্তু তাঁর অবজেক্টিভিজমের তত্ত্ব, তথা নিজের স্বার্থপরতার উপর বিশ্বাস, তথা সবাইকে প্রথমে ও সবচেয়ে ভালো করে নিজের যত্ন নিতে হবে— এ ধারণা এখনো চিন্তার জগতে দারুণ আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় তোলে। তাঁর মতে, মানুষের নিজের সুখই তার নৈতিকতার মূল ভিত্তি। এটিই, তাঁর মতে, সবকিছুর মৌলিক ও পরম কারণ। কারো কারো মতে আইন র্যা ন্ডের দর্শন খুবই সাদাসিধে, শীতল, ও অতি-সরল, কিন্তু অন্য অনেকের মতে এটিই চিন্তার সঠিক পথ। মাইক ওয়ালেস নামের একজন বিখ্যাত সাংবাদিক ১৯৫৯ সালে এই বিতর্কিত নারী দার্শনিকের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন দা মাইক ওয়ালেস ইন্টারভিউ নামের টেলিভিশন টক শোর জন্য। সেই সাক্ষাৎকারে ভালোবাসার সংজ্ঞা নিয়ে আইন র্যা ন্ডের মতামত জানতে পারা যায়।

 

তুমি কে, আইন র্যা ন্ড? তোমার কথায় একটা টান আছে, যা.. রাশিয়ান। তোমার জন্ম কি রাশিয়ায়?

-হ্যাঁ।

এদেশে এসেছো কবে?

-সে প্রায় ৩০ বছর হবে।

আর তোমার এ দর্শন, তা কোত্থেকে পেলে?

-আমার নিজের মন থেকেই; তবে এর জন্য এ্যারিস্টোটলের ঋণ স্বীকার করতেই হয়, তিনিই একমাত্র দার্শনিক যিনি আমাকে প্রভাবিত করতে পেরেছেন। তবে দর্শনের বাদবাকি অংশ আমি নিজেই দাঁড় করিয়েছি।

 তুমি বিবাহিতা?

-হ্যাঁ।

তোমার স্বামী, সে কি কোন শিল্পপতি?

-না। সে একজন শিল্পী। তার নাম ফ্র্যাঙ্ক ও’কনোর।

সে কি তার শিল্পের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করে?

-সে মাত্রই পেইন্টিং নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেছে। সে আগে ডিজাইনার ছিল।

তার কাজের জন্য সে কি সরকারের কাছ থেকে কোন সহায়তা বা ভাতা পায়?

-অবশ্যই না।

 তাহলে কি সাময়ীকভাবে সে তোমার সাহায্যের উপর চলছে?

-না, তার নিজের কাজ থেকেই তার ব্যয় নির্বাহ হয়। অতীতে কখনো আমার কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে থাকতে পারে, তবে সেটার খুব একটা প্রয়োজন হয়নি।

আমি বলি নিজের সুখের উপর প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব অধিকার আছে। এবং এই সুখ তার নিজেকেই অর্জন করে নিতে হবে। তার এটা দাবি করা উচিত হবেনা যে, অন্য কেউ নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে তাকে সুখী করবে। এবং সেই সাথে তারও উচিত হবেনা নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়ে অন্যকে সুখী করতে যাওয়া।

 এই যে তুমি তাকে বিভিন্ন সময় সাহায্য সহযোগিতা করেছো, এর মাধ্যমে তুমি কি তোমার দর্শনের সাথে স্ববিরোধীতা করনি?

-না; কারণ দ্যাখো আমি স্বার্থপরভাবে তাকে ভালোবাসি। তার কোন প্রয়োজন হলে তাকে সাহায্য করাটা আমার নিজের স্বার্থেই। আমি একে কোন আত্মত্যাগ বলব না, কারণ এর মাঝে আমি এক ধরণের স্বার্থপর আনন্দ খুঁজে পাই। আমি বলি নিজের সুখের উপর প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব অধিকার আছে। এবং এই সুখ তার নিজেকেই অর্জন করে নিতে হবে। তার এটা দাবি করা উচিত হবেনা যে, অন্য কেউ নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে তাকে সুখী করবে। এবং সেই সাথে তারও উচিত হবেনা নিজের সুখকে বিসর্জন দিয়ে অন্যকে সুখী করতে যাওয়া। আমি বিশ্বাস করি মানুষের আত্মসম্মান থাকা উচিত।

এবং তার আশপাশের অন্য মানুষকে ভালবাসলে তার আত্মসম্মান থাকবে না! হায় যীশু, মানুষের ইতিহাসের প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ নীতিবান নেতা আমাদেরকে শিখিয়েছেন যে আমাদের একে অপরকে ভালোবাসা উচিত। তাহলে, এই ধরণের ভালোবাসা তোমার কাছে কেন নীতিহীন মনে হচ্ছে?

-এটা নীতিহীন, যদি এই ভালোবাসাকে নিজের উপরে স্থান দেওয়া হয়। এটা শুধু নীতিহীনই না, এটা অসম্ভবও। কারণ তখন নির্বিচারে সবাইকে ভালোবাসতে হয়, তার মানে কোন মানদন্ড ছাড়াই। কোন মূল্যবোধ বা গুণাবলী নেই এমন কাউকে ভালোবাসতে বলার মাধ্যমে তুমি মূলতঃ কাউকেই সত্যিকার অর্থে ভালোবাসতে দিচ্ছ না।

কিন্তু তোমার বইতে তুমি ভালোবাসা সম্পর্কে এমনভাবে বলেছো যেন, এটা একধরণের ব্যবসায়ীক লেনদেন। ভালোবাসার সারমর্ম কি এই নয় যে তুমি একজনকে আত্ম-স্বার্থের উপরে উঠে ভালোবাসবে?

-তাহলে, আত্মস্বার্থের উপরে উঠে ভালোবাসা বলতে কী বোঝায়? এটা দিয়ে বোঝায়, যেন, প্রচলিত নৈতিকতার মানদন্ডে নীতিবান একজন স্বামী তার স্ত্রীকে বলছে, আমি তোমাকে বিয়ে করছি শুধুমাত্র তোমারই জন্য; আমার এতে নিজের কোন স্বার্থ নেই। দ্যাখো আমি কতটা অ-স্বার্থপর, তাই শুধু তোমার ভালোর জন্যই তোমাকে বিয়ে করছি।

স্ত্রীর ক্ষেত্রেও কী?

-জানতে চাচ্ছ একজন স্ত্রী এটা পছন্দ করবে কিনা? আমি তোমার কথা স্বীকার করে নিচ্ছি যে বিয়েকে আমি একটা ব্যবসায়ীক লেনদেনের মতো দেখিয়েছি। কিন্তু প্রত্যেক ব্যবসায়ীক লেনদেনেরই নিজস্ব শর্ত থাকে এবং নিজের মতো মুদ্রা থাকে। এবং ভালোবাসার ক্ষেত্রে সেই মুদ্রা হলো গুণ। তুমি একজনকে ভালোবাসো এটা ভেবে নয় যে তুমি তার জন্যে কী করবে, বা সে তোমার জন্যে কী করবে। তুমি তাদেরকে ভালোবাস তাদের মূল্যবোধ ও গুণাবলীর জন্য। তুমি কার্যকারণকে ভালোবাস না। এবং তুমি নির্বিচারেও সবাইকে ভালোবাস না। তুমি কেবল তাদেরকেই ভালোবাস যারা তার যোগ্যতা ধারণ করে। মানুষ মুক্ত ইচ্ছার অধিকারী। যদি একজন মানুষ ভালোবাসা প্রত্যাশা করে, তার উচিত নিজের ত্রুটিগুলোকে সংশোধন করা। এরপর সে ভালোবাসা ডিজার্ভ করতে পারে। কিন্তু সে কখনোই তা দাবি করতে পারেনা যা সে অর্জন করে নেয়নি।

তাহলো তো, তোমার মানদন্ড অনুযায়ী খুব অল্প মানুষই আছে যারা ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য।

-দুঃখজনক হলেও তা-ই; খুব অল্প। কিন্তু ভালোবাসার যোগ্য হয়ে ওঠাটা সবার জন্যই উন্মুক্ত। আর আমার নৈতিকতা এই উপহারটাই সবাইকে নিশ্চিত করে— ভালোবাসার জন্য যোগ্য হয়ে ওঠা; যদিও সেটাই প্রাথমিক উদ্দেশ্য নয়।

এটা কি হতে পারেনা যে আসলে আমরা সবাই খুব নিঃসঙ্গ মানুষ, তাই আমরা প্রত্যেকেই পরস্পরের জন্য দায়বদ্ধ?

-কেউ কখনোই এমন যুক্তি দাঁড় করাতে পারবেনা যে আমরা অপরের জন্য দায়বদ্ধ। এবং তুমি তোমার চারপাশে এমন উদাহরণ অনেক দেখতে পারবে যে, মানুষ অন্যের জন্য দায়বদ্ধ হতে গিয়ে নিজে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে।

তোমার কিছুতেই বিশ্বাস নেই, তাইনা?

-বিশ্বাস না।

 শুধু তোমার মনের উপর।

-সেটা বিশ্বাস না। সেটা দৃঢ়বিশ্বাস। হ্যাঁ, আমার বিশ্বাস বলতে কিছু নেই। আমার কেবল আছে দৃঢ়বিশ্বাস।

 

আইন র্যা ন্ডের সাথে ফ্র্যাঙ্ক ও’কনোরের বিয়ে হয়েছিল ১৯২৯ সালে, যা ১৯৭৯ সালে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত টিকে ছিল।  

আরো পড়তে পারেন

রুশ সংস্কৃতির প্রধান শত্রু রুশ রেজিম: মিখাইল শিশকিন

অন্য দেশে ইমপেরিয়াল অথবা সোভিয়েত রাশিয়া থেকে বর্তমানের রুশ ফেডারেশনের নির্বাসিত লেখকদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। অনেকে যাকে সমকালীন রুশ সাহিত্যে পাস্তারনাক ও সলঝোনেতসিনের উত্তরসূরি হিসেবে মনে করেন, সেই মিখাইল শিশকিন ১৯৯৫ সাল থেকে বসবাস করছেন সুইজারল্যান্ডে। একমাত্র লেখক হিসেবে লাভ করেছেন রাশিয়ার প্রথমসারির প্রায় সব সাহিত্য পুরস্কার, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য— রুশ বুকার (২০০০), বিগ….

বাংলা সাহিত্যের লেখকদের কূপমণ্ডূকতা পাঠকদের কূপমণ্ডূক করেছে : হারুন আল রশিদ

রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন উপন্যাসের লেখক হারুন আল রশিদ বাংলা সাহিত্যে এক ব্যতিক্রম ও সম্পূর্ণ নতুন কণ্ঠ। তার  গদ্যের শক্তি ও গভীরতা পাঠকের কাছে যেমন বিস্ময়ের ব্যাপার তেমনি তার ভাষার সহজবোধ্যতা বাংলা গদ্যের একটি নতুন ধারা তৈরি করেছে। মাত্র দুটি উপন্যাস প্রকাশ করে তিনি পাঠকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। অন্য উপন্যাসটি হল— ‘রেণুর আবির্ভাব’। তাঁর তৃতীয়….

ঘৃণা কাটিয়ে ওঠা একজন ফিলিস্তিনি এবং একজন ইসরায়েলি বাবার মুখোমুখি

তাদের গল্পটা এতটাই অবাস্তব যে মনে হয় এটি কোনো চলচ্চিত্রের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এমনকি, স্টিভেন স্পিলবার্গ  তাদের গল্পকে বড় পর্দায় আনার স্বত্বও কিনেছিলেন। ফিলিস্তিনি বাসাম আরামিন এবং ইসরায়েলি রামি এলহানান বছরের পর বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অক্লান্ত লড়াই করে যাচ্ছেন। যারা মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাতে সন্তান হারিয়েছেন তাদের দল ‘দ্য প্যারেন্টস সার্কেল’ নামে….

error: Content is protected !!