১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। নয় মাসের রক্তয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ পেলো কাঙ্ক্ষিত বিজয়। সেসময়ের একটি ছবি চোখে ভাসে, বিজয়ের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন দুই মুক্তিযোদ্ধা। একজন আরেক জনকে জড়িয়ে ধরেছেন বিপুল আবেগে। একজনের হাতে একটি স্টেনগান। যার হাতে স্টেনগান সে দৃঢ়, তার শরীরী ভাষা অভিভাবক সুলভ। অন্যজনের বাঁধভাঙা আনন্দ, সেই প্রবল আনন্দ কান্না হয়ে ঝরছে। তাঁর জন্যই বড় ভাইয়ের মতো দৃঢ় বুক পেতে দিয়েছেন অন্যজন। বাংলাদেশের জন্মলগ্নের এমন ছবি বিরল। ছবিটি আমাকে বারবার আবেগতাড়িত করে। ঢাকার একটি সড়ক থেকে ছবিটি ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন আব্বাস। বিশ্বআলোকচিত্র জগৎ ও ইতিহাসে তিনি আব্বাস নামেই পরিচিত। পুরো নাম আব্বাস আত্তার। গত ২৫ এপ্রিল প্যারিসে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আলোকচিত্রকলা ও ফটোসাংবাদিকতার একটি উজ্জ্বল অধ্যায়ের ইতি ঘটলো। তবে মহান শিল্পীদের মৃত্যু নেই, তারা বেঁচে থাকেন তাদের সৃষ্টিকর্মে। পৃথিবীর ইতিহাসে আব্বাসও বেঁচে থাকবেন তার সাদাকালো আলোকচিত্রকর্মের মাধ্যমে।
পৃথিবী যেখানেই যুদ্ধ, বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব সেখানেই ক্যামেরা নিয়ে ছুটে গেছেন এই আলোচিত্র-বীর। বায়াফ্রা, বাংলাদেশ, উত্তর আয়ারল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মধ্যপ্রাচ্য, চিলি, কিউবা ও দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে বেড়িয়েছেন ইতিহাসকে ফিল্মে চিত্রিত করার লক্ষ্যে। দেশে দেশে রাজনৈতিক সংকটকে স্থিরচিত্রে ধরে রাখার ক্ষেত্রে তার জুড়ি মেলা কঠিন। তার জীবনের অন্যতম প্রধান এসাইনমেন্ট ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি প্রধানত বাংলাদেশের উত্তর ও দঞ্চিণাঞ্চলে ঘুরে বেরিয়েছেন।
এই ইরানি ফটোসাংবাদিকের জন্ম ১৯৪৪ সালে। তিনি আলোকচিত্রী ও আলোকচিত্রকলাকে দিয়েছেন জীবনের ষাটটি বছর। পৃথিবী যেখানেই যুদ্ধ, বিপ্লব-প্রতিবিপ্লব সেখানেই ক্যামেরা নিয়ে ছুটে গেছেন এই আলোচিত্র-বীর। বায়াফ্রা, বাংলাদেশ, উত্তর আয়ারল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মধ্যপ্রাচ্য, চিলি, কিউবা ও দক্ষিণ আফ্রিকা ঘুরে বেড়িয়েছেন ইতিহাসকে ফিল্মে চিত্রিত করার লক্ষ্যে। দেশে দেশে রাজনৈতিক সংকটকে স্থিরচিত্রে ধরে রাখার ক্ষেত্রে তার জুড়ি মেলা কঠিন। তার জীবনের অন্যতম প্রধান এসাইনমেন্ট ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তিনি প্রধানত বাংলাদেশের উত্তর ও দঞ্চিণাঞ্চলে ঘুরে বেরিয়েছেন। তার ছবি দেখে অনুমান করা যায়, তিনি বেশিরভাগ সময় পাকিস্তানি সেনা সদস্য ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে থেকে ছবি তুলেছেন। অর্থাৎ তিনি তখন ‘এমবেডেড জার্নালিজম’ তথা ‘বশংবদ সাংবাদিকতা’ই করেছেন বা করতে বাধ্য হয়েছেন। তাতে তার ছবি পক্ষপাতদুষ্ট হয়নি বরং আমরা আরো কাছ থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা দেখতে পেয়েছি। পাকিস্তানি বেষ্টণী থেকে বেরিয়ে বারবার তিনি স্বাধীনতাকামী মানুষের ভিড়ে মিশেছেন। তার ছোট লাইকা ক্যামেরা মানবতার সঙ্গে প্রতারণা করেনি।
আব্বাসের মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। ১. যুদ্ধ চলাকালীন সময়, ২. বাঙালির বিজয় এবং ৩. যুদ্ধের ত। প্রথম ভাগে আমরা দেখি যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের তৎপরতা। আমার ধারণা যুদ্ধের শেষের দিকে আব্বাস বাংলাদেশে এসেছিলেন। তার ক্যামেরা আমাদেরকে দেখাচ্ছে কীভাবে পাকসেনা সদস্যরা ভারতীয় সেনা-সদস্যদের মরদেহ টেনেহঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। গরুর পালের সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে বাঙালিরা, যুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষ আর গরুর পালে যেন তফাত থাকে না। কিছু ছবিতে পাকিস্তানি জেনারেল নিয়াজিকে দেখা যায়, তিনি সেনা ঘাঁটি পরিদর্শন করছেন, সেনা সদস্যদের সঙ্গে কথা বলছেন। তিনি হেলিকপ্টার থেকে নামছেন তখন তাঁর মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া, কথা বলছেন তখনও তিনি চিন্তিত। তিনি হয়তো বুঝতে পারছিলেন যে পরাজয় নিশ্চিত। একটি ছবিতে তাঁকে হাসতে দেখা যায়, ঝিনাইদহে। তাঁকে ঘিরে আছে পাক-বাহিনীর দোসরেরা। তারা হাত মেলাতে চাইছে নিয়াজির সঙ্গে। আরো দেখি, ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদেরকে চোখ বেঁধে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পাকবাহিনী। ভারতের বিমান হামলা এবং ভারতীয় হামলা থেকে বাঁচতে পাক সেনা সদস্যদের নানা কৌশলের চিত্রও ফুটে উঠেছে ছবিগুলোতে।
তিনি আরো চিত্রিত করেছেন পাক-বাহিনীর দোসরদের তৎপরতা। একটি ছবিতে জিন্নাহ কোট ও টুপি পরা এক স্থানীয় (সৈয়দপুর) রাজাকার নেতাকে বক্তৃতা দিতে দেখা যায়। ছবির টাইমিং অনবদ্য, মুক্তিকামী বাঙালির প্রতি তার ঘৃণা যেন উগলে দিচ্ছে সে। অনেক ছবি হয়তো সহজেই পেয়েছেন আব্বাস, কিন্তু কিছু ছবি নিশ্চিতভাবেই পাকবাহিনীর চোখের আড়ালে থেকে তোলা। এই ক্ষেত্রে শব্দহীন লাইকা কাজে দিয়েছে। আব্বাসের এই এসাইনমেন্ট বা প্রজেক্টের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা, রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর ছবিতে অনুপস্থিত। মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, তাদের অভিযান ও জীবনযাপন ক্যামেরাবন্দি করতে পারেননি এই আলোকচিত্রী, আমরা অন্তত দেখিনি। এই আফসোস নিশ্চয়ই আব্বাসেরও ছিল। সেই ঘাটতি পূরণ করতেই হয়তো তিনি আমাদের বিজয়োৎসবটাকে আবেগ দিয়ে ফ্রেমবন্দি করেছেন। দ্বিতীয় ধাপের ছবিগুলো তারই প্রমাণ। আমার বিবেচনায়, তার তোলা মুক্তিযুদ্ধের ছবিগুলোর মধ্যে এই ছবিগুলোই বেশি জ্বলজ্বলে ও প্রাণবন্ত।
পাকিস্তান আত্মসমর্পন করছে, মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ উল্লাস প্রকাশ করছে, মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার-আলবদর-আলশামসদেরকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি নানা দৃশ্য ফুটে উঠেছে ছবিগুলোতে। আব্বাস গাড়িতে বসে ঢাকার এক উচ্ছ্বসিত কিশোরের ছবি তুলেছেন, পাখির ডানার মতো মেলে ধরা দুহাত- কি দীপ্তি! কি আনন্দ তার মুখে! এমন ডিসেসিভ মোমেন্ট ধারণ করতে আব্বাসের মতো ত্বরিতকর্মারাই পারেন। আরেকটি ছবিতে দেখি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ফেলে যাওয়া বিমান-বিধ্বংসী অস্ত্র নিয়ে একদল শিশু-কিশোর খেলছে। মুক্তিযুদ্ধের এমন ছবি আমি আর দেখেছি বলে মনে পড়ে না। যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতির এমন ভিন্ন চিত্র কম আলোকচিত্রীই আমাদেরকে দেখিয়েছেন। এমন আরেকটি ছবির কথা উল্লেখ করতেই হয়, ঢাকার সড়কের পাশে বসে দর্জিরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা সেলাই করছেন, তাদের ঘিরে উৎসুক জনতার ভিড়। স্বাধীনতার পর আব্বাস মূলত ঢাকার সড়কে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর ‘স্ট্রিট ফটোগ্রাফি’ করেছেন।
ওই চলতে চলতেই তিনি যুদ্ধের ক্ষতগুলোকে ফিল্মে এক্সপোজ করেছেন। কিছু লোক ঢাকার মাটি খুঁড়ে বের করে আনছে একটি মরদেহ, যাকে হত্যা করে পুঁতে রেখেছিল ‘বিহারী’রা। দেখি বিরান মাঠে পড়ে আছে এক বাঙালির কঙ্কাল, সম্ভবত ঢাকার রায়ের বাজারের ছবি। বাংলাদেশে যে পাকিস্তান জান্তা গণ্যহত্যা চালিয়েছিল তা বিশ্ববাসীকে জানাতে ভূমিকা রেখেছিল আব্বাসের ছবি। তার তোলা রায়ের বাজার বধ্যভূমির ছবি ছাপা হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন ‘নিউজউইক’-এর ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি সংখ্যায়।
দুটি ছবির কথা বিশেষ করে উল্লেখ করতে চাই। যুদ্ধের শেষের দিকে। পাকিস্তানের জেনারেল নিয়াজি হেলিকপ্টার থেকে নামছেন অথবা হেলিকপ্টারের আসনে বসছেন ঠিক সেই মুহূর্তের একটি ছবি। তাঁকে সাহায্য করছেন আরেকজন সেনা কর্মকর্তা- তাঁর চোখ বন্ধ, তাঁর শরীর বাজেভাবে আরেকজন যাত্রীকে আড়াল (ওভারল্যাপ) করেছে, তারপরও কেন আব্বাস ছবিটি রাখলেন? রাখার কারণ, ছবিটিতে নিয়াজির একটি অস্বস্তিকর (অড) পজিশন আছে, দাঁড়ানো ও বসার মাঝামাঝি অবস্থা। এই ছবি কি নিয়াজির নিশ্চিত পরাজয়ের ব্যঙ্গাত্মক প্রতীক?
আরেকটি ছবিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবকে হাত নাড়িয়ে উচ্ছ্বসিত জনতাকে অভিবাদন জানাতে দেখা যায়। ছবিটি দুর্লভ। সবার মুখে হাসি, বঙ্গমাতার মুখ মলিন। দেশ স্বাধীন হলেও বঙ্গবন্ধু যে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি।
গোটা বিশ্বকে প্রভাবিত করতে পারেন- এমন সৌভাগ্য সবার হয় না। আব্বাস আত্তার তাঁর কাজের মাধ্যমে এই সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরেছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ সকল গণমাধ্যম তাঁকে স্মরণ করেছে। মানুষের ইতিহাসে তাঁর নাম ও তাঁর ছবি গুরুত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাকবে। তিনি নিজেও হয়তো তা জানতেন, তাই হয়তো নিজেকে তিনি ‘বর্তমানের ইতিহাস রচয়িতা’ হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করতেন। তাঁর সাদাকালো ছবিগুলো তাঁর আত্মবিশ্বাসেরই প্রতিবিম্ব।