Author Picture

গণতন্ত্রটা বড় বেশি গণতান্ত্রিক

মাহবুব কামাল

পৃথিবীতে প্রতিদিন কোন্ শব্দটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়, একটি জরিপে পাওয়া গিয়েছিল- ‘হ্যালো’। বাংলাদেশেও নিশ্চয়ই এটি সর্বাধিক উচ্চারিত শব্দ। এর বাইরে যেসব শব্দ বেশি উচ্চারিত হয়, সেগুলোর মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এবং ‘গণতন্ত্র’ও রয়েছে। এই তিনের মধ্যে ‘গণতন্ত্র’ আবার আদর্শের বৈচিত্র্য সত্ত্বেও সব রাজনৈতিক দল তো বটেই, সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে গণমাধ্যম, সাধারণ মানুষ- সব মহলেই খুব আদরণীয় একটি শব্দ। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে শব্দটি একটি ফ্যাশনও বটে। তো আমরা এ লেখায় এই মহামূল্যবান শব্দটি নিয়ে কথা বলব।

গণতন্ত্র হল ‘জনগণের দ্বারা গঠিত, জনগণের জন্য এবং জনগণের সরকার’ (government by the people, for the people, of the people)- আব্রাহাম লিংকনের এই লাইনটি যদি হয় গণতন্ত্রের সর্বজনীন এবং সর্বাধিক সমর্থিত ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা, তাহলে সংজ্ঞাটি নিশ্চয়ই আমাদের সবার কাছ থেকে একটা প্রশ্নের উত্তর চাইতে পারে যে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ টিকিয়ে রেখে অথবা গরিব শোষণের সব ধরনের নিয়ম-রীতিকে আঘাত না করে এবং এমন আরও অনেক বিষয়ের মীমাংসার উদ্যোগ না নিয়ে একটি সমাজ বা রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা কি সম্ভব? কারণ আমরা দেখেছি, পৃথিবীর অনেক দেশেই লিংকন-কথিত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও সেসব সরকার এমন কিছু বিষয়ের নিষ্পত্তি করতে উদ্যোগ নেয়নি, যেগুলো গণতন্ত্র নামক বৃক্ষের সৌন্দর্যবর্ধক ডালপালার মতো হওয়ার কথা ছিল। লিংকনের সংজ্ঞাটিতে কেবল সরকারের রূপ (form) ও চরিত্রকেই (characteristics) গণতন্ত্রের শর্ত হিসেবে দেখা হয়েছে, অর্থাৎ বলা হচ্ছে সরকারটি যদি জনগণের ভোটে গঠিত হয় ও সেই সরকার যদি ঘোষণা করে সেটি জনগণের জন্যই গঠিত হয়েছে এবং আরও, জনগণ যদি সরকারটিকে নিজের মনে করে বগল দাবায়, তাহলেই গণতন্ত্রের ষোলোকলা পূর্ণ হবে! বাহ্, চমৎকার! এমন সংজ্ঞা আর হয় না, আর তাই গত দেড় শতাধিক বছরেও সংজ্ঞাটিকে কেউ চ্যালেঞ্জ করেননি। লিংকন বলে কথা!

অবশ্য কেউ যুক্তি দেখাতেই পারেন যে, সরকারটি যদি সত্যি সত্যি লিংকনের সংজ্ঞা মোতাবেক জনগণের জন্য হয়, তাহলে তো সেটি পুরুষশাসিত সমাজ বা শোষণমূলক অর্থনীতি এবং এরূপ আরও অনেক বিষয় মেনে নেবে না এবং তাই অসঙ্গতিগুলো দূর করার উদ্যোগ নেবে, কারণ নারী ও গরিব শ্রেণী তো জনগণেরই অংশ। তিনি হয়তো আরও যোগ করবেন- সংজ্ঞা তো আর বিস্তারিত বর্ণনা নয়, সংজ্ঞা সবসময় ছোটই হয়, লিংকনের সংজ্ঞাটির তফসির (গূঢ়ার্থ) করলে সেটা আরও বড় হবে এবং তাহলেই পাওয়া যাবে এসব প্রশ্নের উত্তর।

তা বটে। তবে গূঢ়ার্থটি ঠিকমতো বোঝা চাই। যেমন, এ উপমহাদেশেই এমন অসংখ্য নারী রয়েছেন, পুরুষশাসিত সমাজই যাদের পছন্দ। ধর্মীয় কুসংস্কার তাদের শিখিয়েছে স্বামীই দেবতা। প্রাচীন ভারতের একটি গল্প এমন : এক নারী জনৈক সাধুর শরণাপন্ন হয়ে তাকে বললেন, তার স্বামী তাকে ভালোবাসে না; এরপর তিনি পরামর্শ চাইলেন কীভাবে স্বামীর ভালোবাসা আদায় করা যায়। সাধু জানতে চাইলেন তিনি কীভাবে বুঝলেন যে স্বামী তাকে ভালোবাসে না। ওই নারী একবাক্যে ব্যাখ্যা করলেন- তার স্বামী তাকে পেটায় না! মুসলমান সমাজেরও অনেক নারী তাদের স্বামীকে আল্লাহর পরেই স্থান দিয়ে থাকেন। ইসলামের কোথাও বলা নেই স্বামীর পায়ের তলায় বেহেশত, অথচ কেমন করে যেন আমাদের গ্রামীণ নারীসমাজের একটা অংশের মনে গেঁথে রয়েছে এই ধর্মতত্ত্ব।

পৃথিবীতে প্রতিদিন কোন্ শব্দটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়, একটি জরিপে পাওয়া গিয়েছিল- ‘হ্যালো’। বাংলাদেশেও নিশ্চয়ই এটি সর্বাধিক উচ্চারিত শব্দ। এর বাইরে যেসব শব্দ বেশি উচ্চারিত হয়, সেগুলোর মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু’, ‘মুক্তিযুদ্ধ’ এবং ‘গণতন্ত্র’ও রয়েছে। এই তিনের মধ্যে ‘গণতন্ত্র’ আবার আদর্শের বৈচিত্র্য সত্ত্বেও সব রাজনৈতিক দল তো বটেই, সুশীল সমাজ থেকে শুরু করে গণমাধ্যম, সাধারণ মানুষ- সব মহলেই খুব আদরণীয় একটি শব্দ। রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে শব্দটি একটি ফ্যাশনও বটে।

তো প্রশ্নটা এখানেই যে, অজ্ঞতা কিংবা চিন্তার অনগ্রসরতার কারণে শাসিত বা বঞ্চিত হওয়াটাই যারা মনে করেন জীবনাদর্শ, জনগণের সরকার জনগণের সেই নারী অংশের নিগ্রহ দূর করবে কীভাবে? তবে কি জনগণের এই অংশটির লেজুড়বৃত্তি করতে হবে? আধুনিক মননশীলতা তাতে সায় দেয় না। অতঃপর আমরা লিংকনের সংজ্ঞাটির সঙ্গে আরও দু’-একটি শব্দ যুক্ত করতে পারি, তাহলেই সংজ্ঞাটি সম্পূর্ণ হবে। আসলে গণতন্ত্র মানে জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য, জনগণের এবং জনগণকে জাগিয়ে তোলার সরকার।

হ্যাঁ, এই সরকারকে অর্থনৈতিক শোষণের নিয়ম-কানুনের বিরুদ্ধেও জাগিয়ে তুলতে হবে জনগণকে। কারণ শোষিত শ্রেণীর একটি বড় অংশ মনে করে, শোষিত হওয়াটাই তার নিয়তি অথবা তারা যে শোষিত হচ্ছে এই বোধটাও নেই অনেকের। অথচ ভোটের অধিকারের মতো উন্নত জীবনের অধিকারও গণতন্ত্রের আওতাভুক্ত না হয়ে পারে না। ফলে জনগণের এই অংশটিকে তাদের অধিকারবোধে জাগিয়ে তোলার প্রশ্নটি গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক। লিংকনের সংজ্ঞা অনুযায়ী যে সরকার গঠিত হয়, সেটা তা না-ও করতে পারে, কারণ শ্রমিক একাই শুধু জনগণ নয়, মালিকও জনগণ। এ জায়গাটাতে কথিত গণতান্ত্রিক সরকারের বুঝতে ভুল হয়ে যায় যে, মালিকপক্ষ জনগণের অংশ হলেও শ্রমিকের ন্যায্য পাওনা না দেয়াটা অন্যায় এবং তাই মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষে জনগণের সব অংশকেই এ ধরনের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঔচিত্যবোধে জাগিয়ে তোলাটাও সরকারটির কর্তব্য। সমাজতন্ত্রীরা অবশ্য ঔচিত্যবোধের উপদেশে বিশ্বাস করেন না, তাই তারা মালিকের বিরুদ্ধে শ্রেণীসংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে চান শ্রমিককে। গণতন্ত্র এই যুদ্ধটা অনুমোদন করে না, গণতন্ত্রীদের কাছে অহিংসা ও সহিষ্ণুতাই বড় অস্ত্র। ম্যান্ডেলা, গান্ধী প্রমুখ এই শক্তিতেই উদ্দেশ্য সাধনে জয়ী হয়েছেন। তারা দেখিয়েছেন, অহিংসার শক্তি অনেক কিছুই পারে, সাম্রাজ্যবাদ উৎখাত করতেও। সুভাষ বোস যা পারেননি, গান্ধী তা পেরেছেন। যাকগে।

দ্বিতীয় কথা, মিস্টার লিংকন কেন যে গণতন্ত্রকে শুধুই ‘সরকার’-এর ব্র্যাকেটে আটকে রাখলেন, সেটাও বোঝার উপায় নেই, যদিও গণতন্ত্রের প্রশ্নে সরকারই সবচেয়ে বড় স্টেকহোল্ডার। এ পর্যায়ে কনফিউশন এড়ানোর জন্য গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরকারের ভূমিকাই যে মুখ্য, সে সম্পর্কে কিছু কথা বলতে হবে, তবে এটা মাথায় রেখেই যে, গণতন্ত্র সরকারসর্বস্ব নয়। হ্যাঁ, সরকার ও রাজনৈতিক দলই একটি দেশের চালিকাশক্তি (driving force)। সরকারের ধরনই আলটিমেটলি রাষ্ট্রের চরিত্র এবং মানুষের জীবনব্যবস্থা গঠন করে এবং সেভাবেই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরের যে কোনো দুর্ভোগের (প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাদে) ব্যাপারে সরকারের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ দায় থাকে। সীমিত সম্পদের দেশে অগ্রাধিকার নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকার যখন দক্ষতা কিংবা সদিচ্ছা দেখাতে ব্যর্থ হয়, তখনই তৈরি হয় এই দুর্ভোগ। খুব ছোট করেই উদাহরণ দেয়া যায়, আমরা যখন মশার কামড় খাই, তখন চূড়ান্ত অর্থে সেটা সরকারেরই কামড়। একটি সমাজে গণতন্ত্র কতটা থাকবে অথবা আদৌ থাকবে কিনা, সেটাও নির্ভর করে মূলত সরকারের কর্মপদ্ধতির ওপর। সরকারের হাত এত লম্বা যে, তা এমনকি বিজ্ঞান-শিল্প-সাহিত্য-সঙ্গীতের মতো রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ বিষয়গুলোকেও স্পর্শ করতে পারে। রাশিয়ায় যে শাখারভ কিংবা সোলঝেনেৎসিনের মতো মানুষেরা অকার্যকর (dysfunctional) হয়ে পড়েছিলেন অথবা চীনে যে বহুকাল পাশ্চাত্য সাহিত্য পড়তে দেয়া হয়নি কিংবা বাংলাদেশে যে একবার মান্না দে’কে আসতে দেয়া হচ্ছিল না, সে তো সরকারগুলোর অগণতান্ত্রিক চরিত্রের কারণেই। মান্না দে’র ঢাকায় আগমনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল মিসেস জিয়ার প্রথম টার্মে, তখন লিখেছিলাম- গায়ক কি কুকুর যে, স্বরাষ্ট্র কিংবা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় মুগুর হাতে তার ঘেউ ঘেউ থামাতে চায়? সরকার এমনকি তথ্যও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। রাশিয়ায় একসময় রাষ্ট্রীয় পত্রিকা ‘প্রাভদা’ জনগণকে যা জানাত, সেটাই ছিল তথ্য, বাদবাকি গোপন ঘটনা। অগণতান্ত্রিক দেশে কবির কাব্যমানসকেও নিয়ন্ত্রণ করার নজির রয়েছে। রুমানিয়ার কমিউনিস্ট স্বৈরশাসক চসেস্কু একটি কমিউনিজমবিরোধী কবিতা, তা-ও সেটা স্যাটায়ারধর্মী, লেখার অপরাধে সেই কবিকে উধাও করে দিয়েছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার কবি বেঞ্জামিন মলোয়সকে ঝুলতে হয়েছিল ফাঁসির রজ্জুতে।

তখনও লিখেছিলাম- আনিকা মৌলবাদবিরোধী অথবা গণতন্ত্রের পক্ষে দৃশ্যত কোনো আন্দোলন করেনি; কিন্তু এ দেশে এই দুই আন্দোলনের সে এক বড় প্রতীকী সংগ্রামী। আনিকার প্রতি যারা রি রি ছুড়েছিল, তাদের অগণতান্ত্রিক মানসকে কে পুনর্নির্মাণ করবে? লিংকনের গণতন্ত্র? আরও কি বলা যায় না, এ দেশে ক’টি দাম্পত্য অথবা পরিবার গণতন্ত্রসম্মতভাবে জীবন চালায়? অথবা এভাবেও তো বলা যায়, ড্রাইভার কেন গাড়িতে আগে তেল ভরেনি আর তাই গণতন্ত্রের ব্যানার টাঙানো সভামঞ্চে যেতে দেরি হল বলে তাকে চড়-থাপ্পড় মারাটি কি গণতন্ত্র?

এবার আসি। উপরের প্যারাটি পড়ার পর কেউ বলতেই পারেন, সরকারই যদি এত ক্ষমতাবান, তাহলে লিংকনের সংজ্ঞা ঠিক রেখে সরকার গঠিত হলে এবং সেই সরকার ‘জনগণের জন্য’ কথাটির প্রতি বিশ্বস্ত থাকলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়, আর কোনো সমস্যা থাকে না। কিন্তু না, তারপরও সমস্যা থাকে এবং তা কম বড় নয়। by, for, of- এই তিন দিয়ে একটি কথিত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে সেসব সমস্যা কাভার করা যাবে না। বোঝা দরকার, গণতন্ত্র একটি টোটাল প্রসেস বা সামগ্রিক প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়ায় দৃশ্য-অদৃশ্য অসংখ্য বিষয় যুক্ত রয়েছে, যা এককভাবে কোনো সরকারের পক্ষেই সামাল দেয়া সম্ভব নয়। আর এখানেই এসে যায় জনগণকে জাগিয়ে তুলে তাদের চিন্তায় অগ্রসর করে তোলার প্রশ্ন।

প্রথম কথা, আমরা এমন কিছু বিষয় অনুশীলন করে চলেছি, যেগুলোকে অভ্যাসের বশে মনেই হয় না যে সেগুলো অগণতান্ত্রিক কর্ম বা আচার; আর মনে হয় না যেহেতু, সেহেতু গণতান্ত্রিক সরকার সেগুলোকে স্পর্শ করতে তাগিদ অনুভব করে না। ফলে সরকার গণতন্ত্রী হলেই পুরো সমাজ গণতন্ত্রসম্মত হয়ে যায় না। উদাহরণের কি শেষ আছে? সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে কর্মরত অবস্থায় আমরা একবার গণতন্ত্রের দ্বি-সহস্র বছর পূর্তি উপলক্ষে একটি রচনা প্রতিযোগিতা আহ্বান করেছিলাম। কথা ছিল, প্রথম পুরস্কার বিজয়ীকে গণতন্ত্রের উৎসভূমি গ্রিসের (গণতন্ত্রের সূতিকাগার ইংল্যান্ড কথাটা ঠিক নয়) রাজধানী এথেন্সে অনুষ্ঠেয় গণতন্ত্র-উৎসবে পাঠানো হবে আয়োজকদের খরচেই। প্রতিযোগিতায় আম্মিতা আফসার নামের একটি মেয়ে প্রথম হয়েছিল; কিন্তু সে গণতন্ত্র-উৎসবে যায়নি। কারণটা ছিল, সে ছিল নবপরিণীতা। তার স্বামী তাকে যেতে দেয়নি অথবা সে নিজেই বিয়ের পরপর স্বামীছাড়া হতে চায়নি। পাঠক খেয়াল করুন, গণতন্ত্রবিষয়ক রচনায় প্রথম স্থান অধিকারিণী কতটা অগণতান্ত্রিক চেতনার শিকার! এই মেয়েকে কি জাগিয়ে তোলার প্রেরণা রয়েছে লিংকনের সংজ্ঞায়? আবার দেখুন, আনিকা তাহের নামের একটি মেয়ে বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে নির্বাচিত হয়েছিল। এ সমাজেরই অনেকের মুখে তখন রি রি শোনা গিয়েছিল। তখনও লিখেছিলাম- আনিকা মৌলবাদবিরোধী অথবা গণতন্ত্রের পক্ষে দৃশ্যত কোনো আন্দোলন করেনি; কিন্তু এ দেশে এই দুই আন্দোলনের সে এক বড় প্রতীকী সংগ্রামী। আনিকার প্রতি যারা রি রি ছুড়েছিল, তাদের অগণতান্ত্রিক মানসকে কে পুনর্নির্মাণ করবে? লিংকনের গণতন্ত্র? আরও কি বলা যায় না, এ দেশে ক’টি দাম্পত্য অথবা পরিবার গণতন্ত্রসম্মতভাবে জীবন চালায়? অথবা এভাবেও তো বলা যায়, ড্রাইভার কেন গাড়িতে আগে তেল ভরেনি আর তাই গণতন্ত্রের ব্যানার টাঙানো সভামঞ্চে যেতে দেরি হল বলে তাকে চড়-থাপ্পড় মারাটি কি গণতন্ত্র? অথবা চায়ে চিনি বেশি পড়েছে বলে গৃহপরিচারিকার চুল ছিঁড়ে নারীর গণতন্ত্রায়নের মিছিলে যোগ দিলেন যে নারীনেত্রী, তিনিই বা কতটা গণতন্ত্রী? এই প্যারার শেষের বাক্যটা এমনও হতে পারে- আমাকেই ভোট দিতে হবে এবং আমাকেই ভালোবাসতে হবে- গণতন্ত্রহীনতার প্রশ্নে এ দু’য়ের মধ্যে আছে কি কোনো পার্থক্য?

আবার শুনুন, আমি একবার একটি গল্প লিখতে চেয়েও পারিনি। গল্পের প্লটটি এমন : মূল চরিত্র তার দলের ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এলাকায় রাজনীতি করে বেড়ায়। গণতন্ত্রের জন্য তার জান কোরবান। তার কাছে ধর্মের চেয়ে মানবতা বড় ইত্যাদি ইত্যাদি। এলাকায় তিনি জনপ্রিয়ও বটে। তো চরিত্রটি যখন তার সব মাধুর্যসহ ফুলে-ফেঁপে উঠবে, তখন তার এক কর্মী এসে জানাবে তার (এই নায়কের) ছোট বোন একটি হিন্দু ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে। আর ঠিক তখনই পাঠক চরম অ্যান্টি-ক্লাইমেক্সে ভিরমি খাবে- নায়ক তা মেনে নিচ্ছে না তো বটেই, উল্টো তার কর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছেন- ওই শালার মালাউনের বাচ্চা রে র্ধ! বিশুদ্ধ গণতন্ত্রের জন্য শ্লীল-অশ্লীলের পার্থক্যটা বুঝতে পারাটাও জরুরি। নিজস্ব ধর্মীয় চেতনার কারণে কেউ শ্লীলকে অশ্লীল ভাবলে শুরু হয়ে যেতে পারে অন্যের সঙ্গে তার সংঘাত-সংঘর্ষ। তো জনগণের রুচি কে তৈরি করবে? গণতান্ত্রিক সরকার?

কে যেন একদিন বলছিলেন, এ দেশে পুলিশই সবচেয়ে ভালো লোক। তিনি প্রাপ্ত ক্ষমতার কম প্রয়োগ করেন, অন্যরা করেন বেশি। সেই দেয়াল লিখনটিও মনে পড়ে- পিস্তল ঠেকানো আর ফাইল ঠেকানো একই কথা।

এই সমাজের পরতে পরতে বাসা বেঁধে আছে সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতি ও ধর্মীয় কুসংস্কার। ভোট দেয়াটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি আর ধমকাধমকি অথবা দুর্বলকে তুচ্ছ জ্ঞান করাটা সামন্ততান্ত্রিক। বলা বাহুল্য, সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে গণতন্ত্রের রয়েছে ঘোর বিরোধ। যে সমাজ ছেয়ে আছে সামন্ত সংস্কৃতিতে, গণতান্ত্রিক সরকার তাকে পারে কতটা উদ্ধার করতে? এই সরকার কি পারে প্রেম করার দায়ে প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের কলেজে যাওয়া বন্ধ করেছেন যে অভিভাবক, তাকে গণতন্ত্রের শিক্ষা দিতে? সমস্যা আরও আছে। গণতন্ত্রের অপর নাম প্লুরালিটি। বহুত্ব। বহুর ভেতর একক সত্তা যখন বিলীন হয়ে যায়, তখনই সেটা গণতন্ত্র। ঘটনাটা বলে নিই আগে। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তখন কলকাতা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি। ব্রিটিশ আমলে এই শহরের রেড রোড নামের রাস্তাটিতে নেটিভদের চলাচল নিষিদ্ধ ছিল, শুধু ইংরেজরাই যেতে পারত এই রোড ধরে। তো আশুতোষ একদিন তার ফিটন গাড়িতে চড়ে ওই রোডে ঢুকতেই ব্রিটিশ পুলিশ তাকে বাধা দিয়ে ফেরত পাঠায়। তিনি কী আর করেন তখন! গাড়ি ঘুরিয়ে চলে এলেন কলকাতাস্থ ব্রিটিশরাজের বড় কর্তার কাছে। জানতে চাইলেন এই নিষেধাজ্ঞার কারণ। সব শুনে কর্তা বললেন- ইউ আর পারমিটেড টু গো থ্র“ রেড রোড। আশুতোষ সঙ্গে সঙ্গেই জিজ্ঞেস করেছিলেন- ইজ ইয়োর ‘ইউ’ সিঙ্গুলার অর প্লুরাল? বলা বাহুল্য, ইংরেজির ‘ইউ’ এক ও বহুবচন উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। ব্রিটিশরাজ হেসে উত্তর করেছিলেন- ইয়েস, ইট ইজ প্লুরাল। এরপর থেকে স্থানীয়রাও যেতে পারত রেড রোড দিয়ে।

আশুতোষের এই মননই প্রকৃত গণতন্ত্র। বিপরীতে সামন্ত সংস্কৃতির বড় লক্ষণই হল তা আমিত্বের অহংয়ে ভোগে। এ দেশের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের প্রায় সবাই পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্র- প্রতিটি স্তরেই আমিত্বের চিররোগী যেন। আশুতোষের জায়গায় তাদের কেউ হলে তিনি ‘ইউ’কে সিঙ্গুলার ধরে নিয়ে বুক ফুলিয়ে সবাইকে বলে বেড়াতেন- দ্যাখো আমিই কেবল এই রাস্তায় যেতে পারি। কে যেন একদিন বলছিলেন, এ দেশে পুলিশই সবচেয়ে ভালো লোক। তিনি প্রাপ্ত ক্ষমতার কম প্রয়োগ করেন, অন্যরা করেন বেশি। সেই দেয়াল লিখনটিও মনে পড়ে- পিস্তল ঠেকানো আর ফাইল ঠেকানো একই কথা। ঠিক এমন একটি অবস্থায় শুধু দুই নেত্রীকে দুষে অথবা উল্টোভাবে বললে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের সুষ্ঠু নির্বাচনে একটি গণতান্ত্রিক সরকার পেলেও গণতন্ত্রের মর্মকে স্পর্শ করা যাবে না। এ বড় কঠিন মতবাদ, এর বিস্তারের সীমা-পরিসীমা নেই। গণতন্ত্রটা আসলে বড় বেশি গণতান্ত্রিক। জনগণকে জাগিয়ে তোলার নিরন্তর চেষ্টাই কেবল পারে এই জাতিকে গণতন্ত্রের মঞ্জিলে মকসুদে পৌঁছে দিতে।

পুনশ্চ: আব্রাহাম লিংকনের সংজ্ঞার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে কোনো সরকার যদি গণতন্ত্র চর্চা করতে পারে, সেটাও কিন্তু কম পাওয়া নয়। ভিক্ষার চালের কাঁড়াই কী আর আকাঁড়াই কী! এই চালের মান বিচার নিরর্থক। ছাঁটা অথবা আছাঁটা- চাল হলেই হল। এ দেশে তো সেটাও পাওয়া যায় না। লিংকনের নু, ভড়ৎ, ড়ভ আমাদের পরিহাস করে শুধু। সংজ্ঞাটি পড়তে গিয়ে দৃষ্টিভ্রম (optical illusion) ঘটে, ফলে দেখতে পাই- এই তিনের বানানগুলো সামান্য পরিবর্তিত হয়ে গেছে। পড়তে হয় buy the people, far the people, off the people- জনগণকে ক্রয় করো, জনগণ থেকে দূরে থাকো এবং জনগণকে সবকিছুর বাইরে রাখো।

মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
mahbubkamal08@yahoo.com

আরো পড়তে পারেন

একাত্তরের গণহত্যা প্রতিহত করা কি সম্ভব ছিল?

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই এক রাতেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে….

ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

আগের পর্বে পড়ুন— চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও একটি সার্থক গণআন্দোলন। এই গণআন্দোলনের মূল চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হলো দেশপ্রেম থেকে জাত সেই অনুভূতি, যার একটি রাজনৈতিক প্রকাশ রয়েছে। আর, বাঙালি জাতিসত্তাবোধের প্রথম রাজনৈতিক প্রকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে দুই হাজার মাইল দূরত্বের….

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল)

আগের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ একুশের আবেগ সংহত থাকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দেও। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। আওয়ামি লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ১৮ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটির সদস্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র….

error: Content is protected !!